#প্রণয়ের_পরিণতি
#পর্ব_১৪
#writer_sadia_afrin_nishi
বিশাল বড় রেস্টুরেন্টের ছাদটা পুরোই ফাঁকা। অপুর্ব সুন্দরভাবে ডেকোরেশন করা ছাদটা। চারপাশে রেলিং বেয়ে নেমে এসেছে রজনীগন্ধা আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তৈরি মালা।ছাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন বাহারি ফুলের গাছ।ছাদের ঠিক মাঝ বরাবর একটি পরিমার্জিত টেবিলেকে সুসজ্জিত করছে ছেলেটি। সাথে করে এনেছে ফুলের বুকে আর একটা সুন্দর কেক তার প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে। আজ এই ছাদের প্রত্যেকটি কোণা ছেলেটি নিজের হাতে সুসজ্জিত করেছে।কাউকে একটি বার কিছু ছুতেও দেয়নি।সে চায় তার প্রেয়সী তার রঙে রঙিন হোক।অন্য কারো স্থান সেখানে নেই। গুনগুন সুর তুলতে তুলতে সুনিপুণ ভাবে ডেকোরেশন শেষ করল ছেলেটি।নিজেকে নিজেই বললো, রিশি ইউ আর সো গ্রেট।নিজের হাতে জীবনের প্রথম ডেকোরেট যে এতো সুন্দরভাবে করা যায় তা এতদিন জানা ছিল না রিশির।হয়তো তার তোতাপাখির জন্যই সবটা সম্ভব হয়েছে। তোতাপাখির জন্য যে সে সবকিছু করতে প্রস্তুত।
সকাল সকাল কলেজে চলে গেল তৃপ্তি। কিন্তু তার ফ্রেন্ডদের বা রিশি কাউকেই কোথাও দেখা গেল না। সে কিছুক্ষণ ওয়েট করে তারপর ইতু কে ফোন লাগাল।ইতু বলেছে ওরা কিছু সময় পর চলে আসবে তৃপ্তি যেন ওদের জন্য ওয়েট করে। তৃপ্তিও চুপচাপ একা একা ক্যাম্পাসে বসে বাদাম খেতে লাগল।
_________
তনয়া অফিসে চলে গেছে।কিন্তু তনিমা কোমড়ে ব্যথার জন্য অফিসে যেতে পারেনি।এতে ও কাব্য ফোন করে তনিমাকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছে।
কাব্যের ব্যবহারে তনিমার মুডটাই খারাপ হয়ে গেছে। সে এখন সোফায় বসে বসে মুভি দেখছে যাতে মনটা একটু ভালো হয়। তনিমার মা একটু পর পর এসে মেয়ের খবর নিচ্ছে কীছু লাগবে কী না তাই। মেয়েদের কিছু হলে উনি পাগল হয়ে যান।তিন মেয়েই ওনার কলিজা।
তনয়া অফিসে গিয়ে দেখে রিশান
আগেই পৌঁছে গেছে। তনয়ার আজকে আসতে একটু লেট হয়েছে। তনিমাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। তার ওপর আবার বোনের এটাওটা বায়না শুনতে শুনতে দেড়ি হয়ে গেছে।
অফিসে ঢুকেই ইমার সাথে তার প্রথম দেখা হলো।ইমা তাকে নানারকম অপমান জনক কথা শুনিয়ে দিল।এই যেমন,রিশানকে হাত করে পিএ হয়েছে, তার পদ কেড়ে নিয়েছে, রিশানের সাথে কাজের নাম করে সময় কাটাতে চিটাগং গিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকম খারাপ কথা ইমা তনয়াকে বলেছে।রাগে তনয়ার মাথা ফেটে যাচ্ছিল।তবুও সে সকাল সকাল এই মেয়ের সাথে কথা বলতে চায় না বলে চুপচাপ চলে যেতে চাইল।কিন্তু ইমা তার হাত ধরে তাকে আঁটকে দিল।ইমা এমনভাবে হাত ধরেছে যে তনয়া খুব ব্যথা পাচ্ছে।
ইমা:কোথায় পালাচ্ছ?আমার পুরো কথা শুনেতো যাও।
তনয়া:আমার হাত ছাড়ো।আর তোমার কথা শোনার কোনো ইন্টারেস্ট আমার নেই (রাগি স্বরে)
ইমা:তা বললে তো হবে না। তোমাকে তো আমার কথা শুনতেই হবে(বাঁকা হাসি দিয়ে)
তনয়া:আমার হাতটা ছাড়ো
(কিছুটা চিৎকার করে)
ইমা:ছাড়ব না কি করবে তুমি?
তনয়া হাতটা জোরে ঝাড়া মেরে সরিয়ে এনে ইমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
তনয়া:কিছু বলছি না বলে ভেবো না আমি কিছু বলতে জানি না। ছোটো থেকে অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছি তোমাদের মতো ননীর পুতুল আমি নই। তাই তোমার থেকে হাতটা আমার একটু বেশিই শক্ত। তোমাদের মতো মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে তাই কিছু বলি না। কিন্তু এটা মনে রাখবে সবসময় সাপের লেজে পা পড়লে সাপ কিন্তু ফোঁস করবেই(এটা বলে তনয়া রেগে হনহন করে চলে গেল)
ইমা:ও মা এই মেয়ে তো দেখি কথাও বলতে জানে।একে যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটা বোকা ও না। এর সাথে বোঝাপড়াটা তো
পরে করে নেব।
রিশান এতক্ষণ সবকিছুই আড়াল থেকে দেখছিল।সে একটু বাহিরে যাবে বলে বেড়নোর সময় ইমা আর তনয়াকে কথা বলতে শুনে আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।ইমা যখন তনয়াকে ওই সব বাজে কথা বলছিল আর তনয়ার হাত চেপে ধরে ছিল তখনই সে সামনে এসে ইমাকে জব্দ করতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগে তনয়ার এই অগ্নিমূর্তি দেখে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেছে। তনয়ার যে এতো গুন তা তার জানা ছিল না। সে ভেবেছিল তনয়া হয়তো ভয় পেয়ে ইমাকে কিছু বলে না। পরক্ষনে নিজেই অবাক হয়ে গেল তনয়ার চাপা প্রতিবাদ দেখে।মেয়েটা আসলেই অনেক গুণবতী। কীভাবে ঠান্ডা মাথায় সবটা সামলাতে জানে।সে তনয়াকে যত দেখছে তার প্রতিটা কাজেই শুধু মুগ্ধ হচ্ছে। এমন ধর্য্যশক্তি রিশানের নেই। সে তনয়ার জায়গায় থাকলেও এতক্ষহণে ইমার খবর করে দিতো।এসব ভাবতে ভাবতে রিশান নিজের কেবিনে চলে যায়।
তনয়া নিজের কেবিনে এসে একটা জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিজের কাজে মন দিল।
________
কাব্য অফিসে বসে বসে ফাইলে সাইন করছে। তনিমা না আসায় তার একটু অসুবিধা হচ্ছে। পিএ এর কাজ করার মতো বাড়তি কেউ তো নেই।তাই সে ম্যানেজারকে ডেকে নিয়েছে কিন্তু ম্যানেজারও তেমন কিছু বুঝতে পারছে না। কাব্য মনে মনে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। তনিমা একটু অশান্ত হলেও কাজে বেশ দক্ষ।কাব্য বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে সাইন করতে করতে পেছন থেকে কেউ এসে ওর চোখ চেপে ধরল।ওর আর বুঝতে বাকি রইল না যে কে ওর চোখ ধরেছে। ও আস্তে আস্তে চোখ ধরা ব্যক্তিটিকে সামনে এনে এক পায়ের ওপর বসিয়ে দিল।ওর চোখ এতক্ষণ ধরে ছিল কণা।
ওর একমাত্র প্রাণপ্রিয় আদরের বোন।
কণা:সারপ্রাইজটা কেমন ছিল(হেসে হেসে)
কাব্য:খুব খারাপ (গম্ভীর হয়ে)
কণা:তাহলে চলে যাই(মন খারাপ করে)
কাব্য:আরে আরে আমি তো মজা করছিলাম।
কাব্য হেসে বোনকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর কিছুসময় দু ভাই বোনের খুনসুটি চলে।কণা বায়না ধরে আইসক্রিম খেতে যাবে।কাব্যও আর না করে না। না বললে বোন তো একেবারে রেগে আগুন হয়ে যাবে। তাই সে কণাকে নিয়ে চলে যায় আইসক্রিম খেতে।
কাব্য কণাকে নিয়ে একটা ক্যাফিটেরিয়ায় যায় আসলে এখানে কফির পাশাপাশি উন্নত মানের আইসক্রিমও পাওয়া যায়। তাই বোনকে নিয়ে সোজা কফি শপে ঢুকে যায়। কাব্য আর কণা একটা টেবিলে বসে গেল।কাব্য আইসক্রিম খাবে না তার এসব পছন্দ না তাই সে কফি নিয়েছে। আর কণা আইসক্রিম খাচ্ছে।
কফি খেতে খেতে তার চোখ তাদের পাশের টেবিলে রিশান আর তনয়ার দিকে।কাব্য তো অবাক ওদের দেখে।
আসলে তনয়ার সকাল থেকেই মনটা খারাপ। একে তো তনিমার চিন্তা, তারপর তৃপ্তির বিদেশে যাওয়া নিয়ে চিন্তা, তার ওপর আবার ইমার সাথে হওয়া কাহিনী। সব মিলিয়ে তনয়ার মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। সে মন মরা হয়ে কাজ করছিল।তার এই মন মরা ভাব একজনের চোখ এড়ায়নি। সেই একজন যেমন তার খুশির মুহুর্তগুলো মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করে তেমনি তার কষ্টের মুহূর্তগুলোও ব্যথিতভাবে অনুভব করে।রিশান তাই তনয়ার মন ভালো করার জন্য কাজের কথা বলে তনয়াকে এখানে নিয়ে আসে। এখানে আসার পর তনয়া অনেক জিজ্ঞেস করেছে যে তাদের কাজটা কী। রিশানের তখন সাবলীল উত্তর কফি খাওয়া তাদের কাজ।তনয়া আর কিছু না বলে রিশানের সাথে টুকিটাকি কথা আর কফি খেতে লাগল।
কাব্য রিশানদের টেবিলের কাছে এসে বললো,
কাব্য:কী রে তোরা এখানে?
রিশান:তুই এখানে?
কাব্য:হুমম শুধু আমি না কণাও এসেছে।
কণা আর কাব্য রিশানদের টেবিলে চলে এলো।তারপর কনা আর তনয়াকে ওরা পরিচয় করয়ে দিল।তারপর সবাই একসাথে খুব আড্ডা দিল।রিশান খেয়াল করলো তনয়ার মনটা আগের থেকে ভালো হয়েছে।এটা দেখে রিশানের ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
________
তুমি আমার মনের ময়ূরী। কবে কোথায় কীভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। শুধু জানি তোমাকে ঘিরে আমার মনের সকল অনুভূতি সাজানো। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিন থেকেই একটা টান অনুভব করতাম তোমার প্রতি কিন্তু বুঝতে পারতাম না কেন এমন হয়। তারপর তোমার বৃষ্টি ভেজা সিগ্ধরুপ দেখে তো পুরোই হারিয়ে গিয়েছিলাম তোমার মাঝে।খুব করে এই মন সেদিন তোমাকে চাইছিল।তুমি যখন আমার শার্ট আর ট্রাউজার পরলে তখন আমার তোমাকে দেখে কী যে হাসি পাচ্ছিল বলে বোঝাতে পারব না তখন তোমাকে পুরোই বাচ্চা মনে হচ্ছিল। কলেজে প্রথম যেদিন তুমি আমার সাথে কথা বললে খুব রেগে রেগে তখনও আমার তোমার ওই রাগি ফেসটা দেখতে খুব ভালো লাগছিল।আবার যখন তুমি আমার দেওয়া অপমান কষ্ট সইতে না পেরে কেঁদেছিলে সেদিনও আমার তোমার জন্য খারাপ লাগা কাজ করেছিল। তারপর যখন তোমার সাথে টানা বারোদিন দেখা হলো না তখন তো আমি পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম।আর ঠিক সেইদিনই আমি ঠিক করে নেই যে তোমাকে আমার চাই।আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো তোতাপাখি। আমি তোমার চোখ পরতে পারি।দেখো আমাদের ভালোবাসাটা কেমন রাগ,হাসি,কান্না, দুঃখ, অভিমান সবকিছুতে পরিপূর্ণ।তুমি দেখে নিও আমরা হবো পৃথিবীর কাপল।মেড ফর ইচ আদার।তুমি আমাকে ভালোবাসবে তো তোতাপাখি?পাশে থাকবে তো সারা জীবন আমার?বিয়ে করবে তো আমাকে?আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে সারাজীবন অনেক সুখে রাখব আই প্রমিজ।কোনো কষ্ট তোমায় ছুতে পারবে না। আই লাভ ইউ তোতাপাখি। উইল ইউ মেরি মি।
এই কথাগুলো বলে রিশি সামনের মানুষটিকে একগুচ্ছ গোলাপের বুকে এগিয়ে দিল। সামনের মানুষটিও পরম যত্নে বুকেটি নিয়ে নিলো রিশির কাছ থেকে। কিন্তু কোনো আওয়াজ করল না। রিশি এবার আস্তে আস্তে উঠে দাড়িয়ে চোখ খুললো।এতক্ষণ রিশির চোখ বাঁধা ছিল। এই আইডিয়াটা ছিল নীলের। নীল বলেছিল এভাবে তৃপ্তিকে প্রপোজ করতে।তাই রিশি চোখ বেঁধে প্রপোজ করে।আর নীল রিশির চোখ বেঁধে দিয়ে বলেছিল সে যখন বলবে বলতে তখনই যেন রিশি বলে।রিশি সরল মনে নীলের সব কথা শুনে।এখন চোখ খুলে রিশি যা দেখল তাতে তো রিশি পুরোই শকড। রিশির সামনে ফুল হাতে হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছে নিশা। রিশি তো কী বলবে কীছুই বুঝতে পারছে না। নীলও এখানে কোথাও নেই। রিশি হতভম্ব হয়ে পেছনে তাকাতেই আঁতকে উঠল।টলমল চোখ নিয়ে তাদের থেকে অনেকটা দুরে ছাদের দরজা ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে মেয়েটি।চোখ মুখের অস্বাভাবিক অবস্থা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি হয় তো পরে যাবে।রিশি কাঁপা-কাঁপা পায়ে সামনে এগোতে লাগলে মেয়েটি আর এক মুহুর্ত সেখানে দাড়ায় না দৌড়ে দৌড়ে এলোমেলো ভাবে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে যায়। অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে রিশির হৃদয়।কাঁপাকাঁপা পাঁয়ে সে হাটুতে ভর দিয়ে বসে পরে নিচে।দুই হাতের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে মাথার চুল।
এই দৃশ্য দেখে বিজয়ী হাসি হাসে আরও দুটি ছেলে-মেয়ে।তাদের চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। তারা ভেঙে দিতে পেরেছে একটু একটু করে গড়ে ওঠা ভালোবাসার ঘর। সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার বদলে যন্ত্রণার প্রাচীর।
চলবে,