#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১)
লোহার তৈরী বাক্স আকৃতির খাঁচায় চোখ পড়তে ভ্রমরের মুখমন্ডলে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। উত্তেজিত কণ্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“আম্মু,আজকে বাজান আসবে?”
ভ্রমরের মা শরীফা খন্দকার ঘাড় বাকিয়ে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টি ভ্রমরের লালচে ঠোঁটে। ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত মিষ্টি হাসি ঝুলছে। নিচের ঠোঁটটি কি মৃদু কাঁপছে? তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। গভীর পর্যবেক্ষণ চলে ভ্রমরের ওধরের নিম্নভাগে। তন্মধ্যেই ভারী পুরুষ কণ্ঠ,
“কয় জোড়া নিবেন, আপা?”
শরীফা খন্দকারের মনোঃ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। খানিকটা অপ্রসন্ন দেখা গেল চোখের কোটরে,কপালের ভাজে,নাকের আগায়। মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালেন। তামাটে বর্ণের লোকটি দুই হাত উঁচিয়ে পুনরায় বললেন,
“এই দুই জোড়াই আছে। ২৫০ কইরা রাখমু। দিয়া দেই?”
শরীফা খন্দকার লোকটির হাতের দিকে ভালো করে তাকালেন। বাচ্চা কবুতরের শরীরে ছাই রঙের পশম জেগেছে। খুব একটা ঘন হয়নি। মাঝে মাঝে ভেতরের নরম চামড়া দেখা যাচ্ছে। দোকানদারের মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় চারটা বাচ্চাকেই নেড়ে নেড়ে দেখলেন শরীফা খন্দকার। অতঃপর স্বাভাবিক স্বরেই বললেন,
“না। আমার এক জোড়া লাগবে।”
তার মধ্যেই ভ্রমর মায়ের কালো বোরকা খাঁমচে ধরল। নিজের দিকে টেনে বলল,
“বলো না আম্মু,আজকে বাজান আসবে? তুমি বাজানের জন্যই কবুতরের বাচ্চা নিচ্ছো তাই না?”
ভ্রমরের টানাটানিতে শরীফা খন্দকারের কাঁধের ব্যাগ খসে পড়ে কনুইতে ঠেকল। শক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। নীরব রাগে ভ্রমরের হাত ছাড়িয়ে নিলেন। ভ্রমরের একপাশের কাঁধ চেপে ধরে এক হাত দূরে দাঁড় করিয়ে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। যার মানে এই-‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’
অন্য সময় হলে ভ্রমরের চোখদুটো নোনা জলে ভরে উঠত। গোমরা মুখে গাল ফোলাতো। কিন্তু আজ তার একটুও মন খারাপ হচ্ছে না। উপরন্তু চোখের তারায় খুশিরা খেলা করছে। সে ঠোঁটের এক পাশ দাঁত দিয়ে কামড়ে দ্রুত চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। তারা এখন শাহবাগের হাতিরপুল কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ি বলছে,সময় এখন দশটা বেজে কুড়ি। সাধারণত, এই সময়ে ভ্রমর স্কুলে থাকে। আজকেও ছিল। রুটিনমাফিক দ্বিতীয় ঘন্টায় বাংলা ক্লাস চলছিল। ক্লাস চলাকালিন স্কুল কেরানি রমিজ চাচা হাজির হোন। জানায়,তার মা এসেছেন। এখনই বই,খাতা গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে হবে। তার আম্মু ছুটি নিয়েছেন। প্রথম দফায় ভ্রমর ভারি অবাক হয়। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত তার মা স্কুলে আসেন না। আজ কেন এসেছেন? তাহলে কি আজও বিশেষ কোনো প্রয়োজন? ভ্রমরের মনে প্রশ্ন জেগে উঠলেও পরমুহূর্তেই তা গায়েব হয়ে যায়। তৃতীয় ঘন্টায় গণিত ক্লাস। বাড়ির কাজ করেনি সে। করেনি বললে ভুল,করেছিল। পুরো দুই ঘন্টা পার করেও সে অংকের সমাধান মেলাতে পারেনি। গণিত স্যারটা যে কড়া! নির্ঘাত সটাং সটাং বাড়ি লাগাবে তার হাতে। ভ্রমর এত দিনে ঠিক বুঝে নিয়েছে,এই স্যারটা তার উপর প্রচন্ড বিরক্ত। মাঝে মাঝে বিরক্তের উর্ধ্বে চলে গেলে জিজ্ঞেস করে বসেন,
“তোমার জে.এস.সির ম্যাথ খাতাটা কে দেখেছিল বলো তো! তার সামান্যতম ভুলের জন্য আজ তুমি নবম শ্রেণিতে। তার ভুলের শাস্তিটা তোমার সাথে সাথে আমিও পাচ্ছি। তুমি তো আমার এত বছরের রেকর্ড ভেঙে দিবে। এস.এস.সিতে পাক্কা ফেল করবে। বড় বড় দুটো রসগোল্লার হাড়ি পাবে। আমার ছয় বছরের শিক্ষকতায় আমার কোনো ছাত্রী ফেল করেনি। এবার করবে। আর সেটা তুমি! আমার কী করা উচিত তুমি বলো। তোমার মাথায় তো অংক ঢোকাতে পারছি না। তাহলে কি ডিমোশন নেব?”
ভ্রমরের ভীষণ মায়া হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,’আজ বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অংক কষবে। এক রাতেই সিলেবাস শেষ করে ফেলবে। কিন্তু সিলেবাস তো দূর একটা চ্যাপ্টারও শেষ করতে পারে না। বার বার সূত্র বসিয়েও সে উত্তর মেলাতে পারে না৷ তার কষ্ট হয়। রাগে,দুঃখে চোখ গলে পানি বেরিয়ে আসে। বই ছুঁড়ে মারে,খাতা ছিঁড়ে ফেলে,কলমের গাঢ় আঁচড় বসায় টেবিলে। তারপর বিধাতার পানে অভিযোগ তুলে,’আমার মাথার ঘিলু কার মাথায় দিয়েছো? ফেরত দাও।’
অন্তত একটা দিনের জন্য হলেও স্যার বিরক্ত থেকে রেহাই পাবেন। ভাবতেই ভ্রমরের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। চটজলদি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসে। মায়ের সাথে দেখা হওয়ার পর কথা বলার সুযোগ পায়নি ভ্রমর। তাকে নিয়ে সোজা চলে আসেন কাঁচাবাজারে। মাঝপথে দু/একবার প্রশ্ন করেছিল ভ্রমর। কিন্তু উত্তর পায়নি। সে ভেবে নিয়েছিল,রিকশা থেকে নেমে উত্তর দিবে। কিন্তু তার ভাবনায় পানি ঢেলে দিয়ে চুপচাপ মেয়েকে নিয়ে বাজারে ঢুকে যান শরীফা খন্দকার। তখন থেকেই সামান্য সন্দেহ বাসা বাঁধে ভ্রমরের মনে। সন্দেহটা পুর্ণরূপে প্রকাশ ঘটে মুরগির দোকানে দাঁড়ানোর পর। খাঁচায় বন্দী কবুতরে চোখ যেতেই আন্দাজ করে ফেলে সব। অনুমানটা ঠিক না বেঠিক তা জানতে চেয়েই মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল ভ্রমর। উত্তর না দেওয়াই নিশ্চিতের সিংহভাগে পোঁছায়। সিংহভাগকে পূর্ণ করতে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে। এরপরও যখন মায়ের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয়নি,তখনি ভ্রমর বুঝে নেয় তার সন্দেহই সঠিক। আজ তার সাথে একি ধারে সুখ-দুঃখের দেখা হবে। এক দিকে বাবা আসবে বলে অত্যন্ত খুশি উপলব্ধি করবে,অন্য দিকে আজ মা সারাদিন তার সাথে কথা বলবে না বলে দুঃখ উপলব্ধি করবে। আচ্ছা,কোনটার পরিমান বেশি? ভ্রমর মনের কোণে প্রশ্ন ফেলে মায়ের দিকে তাকাল। তিনি কবুতরের বিল মেটাচ্ছিলেন। সেদিকে চোখ রেখে চেঁচিয়ে উঠল,
“আম্মু,ঐ দোকানের আলুগুলো খুব ভালো দেখাচ্ছে। আমরা ওখান থেকে কিনি?”
ভ্রমর আরজি পেশ করেই সেদিকে ছুটে চলে গেল। সে এতদিনে জেনে গিয়েছে,তার আম্মু কবুতর কেনার পরপরই ছোট আলু কিনে। বাবার জন্য সব থেকে ভালো আলু কিনতে হবে। তবেই না তিনি তৃপ্তিভরে খেতে পারবেন!
শরীফা খন্দকার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের পেছন ছুটলেন না। ক্ষণকাল নীরব চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ধবধবে সাদা রঙের ইউনিফর্মে তার মেয়েটাকে কি মিষ্টি দেখাচ্ছে! সাদার মধ্যে কি গায়ের কৃষ্ণ রঙটা বেশি চোখে লাগছে? নিজের প্রশ্নে নিজেই আহত হন। সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে হেঁটে যান।
আলু নেওয়া শেষে শরীফা খন্দকার বের হতে নিলে তাঁর হাত চেপে ধরে ভ্রমর। মেয়ের দিকে চোখ রাখতে ভ্রমর বলল,
“লেবু নিবে না? বাজান তো লেবুও পছন্দ করে।”
কথাটা শেষ করেই পাশের দোকানের লেবুতে হাত রাখে ভ্রমর। বেছে বেছে দুটো লেবু তুলে নেয়। মায়ের দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আম্মু,কোনটাতে বেশি রস হবে?”
শরীফা খন্দকার দুটো লেবুই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন।
____________________________
বাজার শেষে সিঁড়ি কেটে তিনতলায় উঠে আসে ভ্রমররা। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়েই মায়ের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায়। সদর দরজায় আধুনিক তালা থাকা সত্ত্বেও বাইরে আলাদা তালা ঝুলছে। কারণ কী? তবে কি আজও পপি আপা ভেতরে? নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে নিতে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল ভ্রমর। এগারটা বেজে পঁয়ত্রিশ। পপি তাদের বাসায় কাজ করে। থাকা,খাওয়া এখানে হলেও বারোটা থেকে দুটো অবধি পাশের ফ্ল্যাটে কাজ করতে যায়। তার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি,আট বছরের একটি পুত্র সন্তান আছে।
ভ্রমর ঘড়ি দেখতে দেখতে পরপর দুই চাবি ব্যবহার করে দরজা খুললেন শরীফা খন্দকার। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে পপি দৌড়ে এলো। ভ্রমরের কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিজের কাঁধে নিয়ে বলল,
“ছুডো ম্যাডাম,লেবুর সরবত বানাইয়া দিমু?”
ভ্রমরের কঁপাল কুঁচকে এলো। সুক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ল পপির ঠোঁটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দাঁতে। কী লেগে আছে? পরিচিত গন্ধও পাচ্ছে। তাহলে কি আজও পপি আপা তার চকলেট চুরি করে খেয়েছে? ভ্রমরের মন বিষন্নে ছেয়ে আসে। বরাবরের মতো এবারও চুপ করে নিজের রুমে চলে যায়। তার পপি আপাকে খুব পছন্দ। কত কাজ করে দেয়! ভ্রমরের জুতো পরিষ্কার থেকে কাপড় ইস্ত্রী সবটাই তো সে করে। যে তার হয়ে এতো এতো কাজ করে তাকে কি দোষী প্রমাণ করা যায়? মায়ের অনুপস্থিতিতে সেই যে এই বাড়ি ও ছোট্ট মেয়ে ভ্রমরের ভালো মন্দের খোঁজ রাখে। মা জানলে যে খুব বকবে। ভ্রমর চায় না পপি বকা খাক।
ভ্রমর স্কুলের জামা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। একবার গোসল করা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বার সাবান মেখে গোসল করল। বাবার নাকে যদি ঘামের গন্ধ করে? মুখ সরিয়ে নেন? নাক সিটকান? তার তো ভীষণ কষ্ট হবে! গোসল সেরেই আলমারি থেকে সব থেকে ভালো ও সুন্দর জামাটা খুঁজতে শুরু করে ভ্রমর। সবগুলোই সুন্দর! সুন্দর হবে না কেন? সবগুলোই যে তার মায়ের হাতের বানানো। মায়ের হাতের তৈরি কি খারাপ,অসুন্দর হতে পারে? কখনই না। সে ভারি বিভ্রান্তে পড়ে গেল! কোনটা পড়বে? কোন রঙের জামাটা পড়বে? কোন জামাটা পড়লে তাকে রূপকথার রাজকন্যাদের মতো লাগবে? ভ্রমর পছন্দ করতে পারে না। সে দু হাতে তিন,চারটা জামা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাকে জিজ্ঞেস করে পড়বে। মায়ের চোখদুটো যেমন সুন্দর,পছন্দ তার চেয়েও সুন্দর।
ভ্রমর চঞ্চল ও উৎকণ্ঠিত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে আসে। শরীফা বেগম পপিকে নিয়ে জবাই করা কবুতরের পশম ফেলছেন। প্রায় শেষের দিকে। কবুতর নিজের হাতে নিয়ে পপির উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাকিটা আমি করছি। তুই আলুর খোসা ছাড়া।”
ব্যস্ত গলায় হুকুম করে বসার রুমে উঁকি দিলেন সময় দেখার জন্য। কিন্তু চোখ জোড়া ঘড়িতে না গিয়ে ছুটে আসা ভ্রমরের দিকেই আটকে গেল। ভেজা চুল গালের দুপাশে এসে লেগে আছে। পানি মুছেনি নাকি মেয়েটা? চুলের অগ্রভাগে পানির বিন্দু জমে আছে। কী স্নিগ্ধ লাগছে তার চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েকে। যেন সদ্য ফোটা কোনো পবিত্র ফুল! একটু ছুঁতে পারলেই সকল পাপ ধুয়ে যাবে। সে কি একটু ছুঁবে?
“আম্মু,আমি কোন জামাটা পরব? তাড়াতাড়ি বলো। বাবা কি এখনই চলে আসবে?”
মেয়ের দ্রুত প্রশ্নে শরীফা খন্দকারের মোহ ভাঙে। মন চাইলেও কিছু বললেন না। হাতের কবুতর রেখে,বটির সন্ধানে চলে গেলেন। মায়ের এমন ব্যবহারে আশাহত হয় ভ্রমর। তবে কয়েক সেকেন্ড পার হতেই ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,’ইশ! আমি বার বার কেন ভুলে যাই, আম্মু? তোমার নিশ্চুপতায় যে আমার বাবার আগমনের সুবার্তা পাই।
মুখে পরম আহ্লাদ নিয়ে ভ্রমর পপির কাছে এগিয়ে আসে। আপ্লুত গলায় বলল,
“পপি আপা,বলো তো কোনটা পরব?”
পপি হাতের আলুটা রেখে হাত ধুয়ে নিল। বেশ আগ্রহ নিয়ে ভ্রমরের সবগুলো জামা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। মিনিট পাচেক পার করল পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। অতঃপর বলল,
“সবগুলাই সুন্দর। কোনডা পরতে কমু বুঝতে পারতাছি না।”
ভ্রমর ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসল। কী ভেবে আবারও পপির কাছে ছুটে যায়। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পপি আপা,তুমি কি আমার বাজান রে দেখছো? খুব সুন্দর দেখতে তাই না?”
পপি প্রতিত্তোরে কিছু বলতে গেলে থামিয়ে দেয় ভ্রমর। মিষ্টি হেসে বলল,
“বলবে না। একদম বলবে না। আমি আমার বাজান রে নিজ চক্ষে দেখতে চাই। নিজ চক্ষে তাঁর সৌন্দর্যের উপমা সাজাতে চাই। কিছু বলবে না,পপি আপা। কিছু না। আমি জিজ্ঞেস করলেও বলবে না।”
শেষ কথাটা বার কয়েক উচ্চারণ করতে করতে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ভ্রমর। পপি অনেক্ষণ ভ্রমরের চলে যাওয়া পানে চেয়ে থাকে। অজান্তেই তার চোখ সজল হয়ে ওঠে। ঠিক তখনি কানে কারো ফুঁপানির শব্দে আসে। সে ধীরগতিতে পেছনে ঘুরে। যা ভেবেছিল তাই। শরীফা খন্দকার আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় আর্দ্র স্বরে বললেন,
“মেয়েটার মুখে বাজান ডাকটা শুনলে আমার হৃদয়টা পুড়ে যায়! এইটুকু মেয়ে অন্তরের সবটা ভালোবাসা যেন বাজান শব্দটাতেই ঢেলে দেয়। কতবার বলছি,বাজান ডাকবি না। বাবা বলে ডাকবি। শুনেই না! আজকালকার দিনে কি কেউ বাজান বলে ডাকে? কোথা থেকে শিখল কে জানে?”
কথাগুলো ঠিক কার উদ্দেশ্যে বললেন নিজেই ঠাহর করতে পারলেন না শরীফা খন্দকার। এক পলক পপির দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ হলেন।
________________________________
ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখটি লাল কালিতে বন্দী করতে গিয়ে ভ্রমরের মনে পড়ল উনিশ সালের ক্যালেন্ডারটি এখনও আনা হয়নি। মাকে বলতে হবে। এখন না,পড়ে বলবে। এখন সে আঠারো সালের ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাচ্ছে। মার্চ মাসের পাতাটিতে এসে থমকে গেল। মার্চের তেইশ তারিখটি পূর্ব থেকেই লাল বৃত্তে বন্দী থাকা সত্ত্বেও সে দ্বিতীয়বার বন্দী করল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
“বাজান,তোমার দেখা পাওয়ার বিশেষ তিনটি দিবসের আজ একটি। আমি কী করে ভুলে গেলাম? তুমি কি আগে থেকেই বুঝে যাও আমি ভুলে গেছি? সেই রাগ নিয়েই আমার সাথে দেখা করো না? এবারও করবে না? আমি তো এবারও ভুলে গেলাম! একটি বার মাফ করা যায় না,তোমার পঁচা মেয়েটাকে?”
ভ্রমরের চোখ দুটো ছলছল হয়ে আসতেই তার মাথায় কিছু একটা নাড়া দিল। হঠাৎই মনে পড়ল,তার আরো একটি প্রিয় মানুষ আছে। তাকে তো বলাই হয়নি,বিশেষ দিনের বিশেষ মুহূর্তটির কথা! ভ্রমর ছুটে বারান্দায় যায়। চোখের দৃষ্টি সরাসরি পড়ে সামনের এক হাত দূরত্বের বারান্দাটিতে। কেউ নেই। শূন্য বারান্দাটা যেন ভ্রমরের ভেতরটাকেও শূন্যে পরিণত করল। মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়ল তার সর্বাঙ্গ! তার খুশির খবরটা এই মুহূর্তেই বিপরীত পাশের বারান্দার মানুষটিকে দিতে হবে। কী করবে? ভ্রমর গলা উঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল। তার বারান্দার পাশেই রাখা ছোট মাটির পাত্র থেকে দুটো পাথর তুলে নিল। ছুঁড়ে মারল অপর পাশের বারান্দায়। কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো। কিন্তু কারো দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য হলো না। এখন কী হবে? মনের অশান্তি কী করে থামাবে? একটু পরেই তো বাবা চলে আসবে,যদি এ মুখো হতে না পারে? এতগুলো মাস পর আসবেন। তার তো দেখাই ফুরাবে না! অস্থিরতায় ক্রিমমাথা মুখটিতে ঘাম জমতে শুরু করল। বার কয়েক বারান্দার এ মাথা থেকে সে মাথায় ছুটল। অপেক্ষা শেষ হওয়ার পূর্বেই পপির গলা ভেসে আসে। এদিকেই আসছে কি? ভ্রমর আৎকে ওঠে। অদ্ভুত ভয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। চাপা উত্তেজনায় থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। শক্ত করে চেপে ধরে বারান্দার প্রাচির। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,’বাজান এসে পড়েছে?’
প্রশ্নটা শেষ হতে সামনের বারান্দার দিকে তাকাল। না এখনও কারো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়ার কথাও না। তবুও কোন আশায় খুঁজছে কে জানে? চাপা উত্তেজনা আর অস্থিরতার মধ্যেই ভ্রমরের মাথায় বুদ্ধীর দেখা মিলল। সে দৌড়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। খাতা থেকে কাগজ ছিঁড়ে কলম দিয়ে দ্রুত কিছু লিখল। তারপর আবারও ছুটে যায় নিজ বারান্দায়। হাতের কাগজটার পাথরের মধ্যে প্যাঁচিয়ে সামনের বারান্দায় ছুঁড়ে মারে। ভ্রমর উৎসুক নয়নে কাগজটি কোথায় গিয়ে পড়ল সেদিকে চেয়েছিল। কিন্তু গড়িয়ে চোখের আড়াল হতে তার মন খারাপ হলো। যাকে পাঠাল সে পাবে তো? যদি না পায়? ভ্রমর আবারও চিন্তায় পড়ে গেল। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ক্যালেন্ডারের একটি পাতা ছিঁড়ে আনে। সাথে সাদা ট্যাপ ও কেঁচি নিয়ে এসেছে। সে যত দ্রুত পারল দেয়ালের মধ্যে ক্যালেন্ডারের সাদা অংশ সামনে রেখে আটকে দিল। তারপর লাল কালি দিয়ে গাঢ় করে বড় বড় অক্ষরে লিখল,
“আমার বাজান আসছে। দেখা করতে যাচ্ছি। তোমার মতো তিনিও কি আমার হাসির প্রশংসা করবেন? তুমি আজও বললে না,আমার কোন হাসিটা বেশি সুন্দর। মুঁচকি হাসি নাকি দন্ত হাসি? এখন আমি কোন হাসিটা হাসব?
হৃদ্য ভাইয়া, তুমি তো খুব খারাপ। তোমার এই অর্ধেক কথা ঠোঁটে,অর্ধেক কথা পেটে এই অভ্যাসটা কবে পাল্টাবে বলো তো?”
চলবে