প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৮

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৮
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মেঘ বর্ষণের পূর্ব মুহূর্তে বাতাসের ছোয়ায় আকাশে ধূসর বর্ণ মেঘের চঞ্চলতায় প্রাণ ফিরে পেলো যেন। গুমোট চারিপাশ হাওয়ার দমকে নৃত্য করে উঠতেই সায়াহ্ন আকাশের পানে মুখ উঁচু করে তাকালো। তার মনে চঞ্চলতা নেই আছে স্থবিরতা। যেন বহুকাল বৃষ্টির ছোয়া লাগে নি,প্রাণ ফিরে পায় নি মন। সায়াহ্ন মোবাইলের অপ্রত্যাশিত আওয়াজে কেঁপে উঠা নয়নে তাকিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার থেকে আবারো ফোন।
সায়াহ্ন ভ্রু কুঁচকে ফোন ধরতেই ওপাশের ব্যক্তি দ্রুত বলল,

‘মিস.আপনি কি আবারো ছাদ থেকে লাফানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন?’

‘আপনি আবার!’ সায়াহ্ন মুখ কুচকে বলল। গলার আওয়াজ চিনতে মোটেও ভুল হয় নি তার। সায়াহ্ন অবাক আর বিরক্তির সহিত বলল,

‘আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়।’

‘পৃথিবীতে সেকেন্ডে সেকেন্ডে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে ধরুন এইটা সেই আশ্চর্যজনক ঘটনার একটি।’

রাওনাফ হেয়ালি করেই বলল। সায়াহ্ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের রেলিঙে হেলে দাঁড়িয়ে বলল,

‘গত দু’দিন আগে আপনাকে আমি কি বলেছিলাম?’

‘কী বলেছিলেন?’ রাওনাফ সুর টেনে বলল।

‘আশ্চর্য লোক তো।আমাকে এতো জ্বালাতন করছেন কেন?’ সায়াহ্ন রাগান্বিত স্বরেই বলল।

রাওনাফ কিছু দূরের একটা ফাঁকা স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলো। যে স্থান থেকে সে সায়াহ্ন কে পুরোপুরিভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। সায়াহ্নের বিরক্তিতে ফুঁটে উঠা মুখের দিকে তাকিয়ে রাওনাফ মৃদু হাসলো। তার ইদানীংকাল অভ্যাস সায়াহ্ন ।
কাজের ফাঁকেফাঁকে রাওনাফকে বিরক্ত করা নিত্যদিনের আরেকটা কাজ তার । সায়াহ্ন হলের ছাদ থেকে দু’তিন বার উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিরাশ হয়ে বলল,

‘কি চাচ্ছেন আপনি?’

‘আপনাকে পড়তে।’ রাওনাফ মৃদু স্বরে বলল। আলোর ঝলকানির মতো বিদ্যুৎ দাপিয়ে বেড়ালো সায়াহ্নের ভেতরে এই একটি কথার রেশে। রাওনাফের কথার পৃষ্ঠে জবাব হাতড়ে বেরিয়ে চুপ করে রইলো সে।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শব্দ ছন্দ তুলতেই নোভা নীচে থেকে বাজার হাতে তাকে ডেকে উঠলো। তাড়া দিয়ে বলল,দ্রুত নীচে নেমে যেতে।
সায়াহ্নের ঘোর কাটতেই সে নোভার দিকে তাকালো। বাজার হাতে খোলা চুলে মেয়েটার চোখেমুখে দায়িত্বশীল বোনের ছাপ স্পষ্ট । ওইদিকে রাওনাফকে বেমালুম ভুলেই গেলো সেকেন্ড দশকের জন্য।

‘মেয়েরা বোন,মা সব হয়। ছেলেরাও কিন্তু বাবা,ভাই,স্বামী হয়। হাতে হাত রেখে ভরসা দেয়।’

হুট করে রাওনাফের এহেন কথার দমকে সায়াহ্ন দৃষ্টি ঘুরালো নোভার থেকে। তার মন মস্তিষ্ক থেকে এই ব্যক্তি খানিক সময়ের জন্য বিদায় হয়েছিলো ভেবে স্বস্তি যেন মিললো না ব্যক্তিটির কথার জন্য। সায়াহ্ন এখন অহেতুক তর্ক কর‍তে চাইছে না। তাই সে রেলিঙ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বৃষ্টির ফোঁটা তাকে আপন মনে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
ঠান্ডা শিরশিরে বাতাসের দাপটে ঠান্ডা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার শরীরে। মোবাইল টা নেহাৎ ওয়াটারপ্রুফের ত’ক’মা লাগানো। নয়তো তার মতোউ হতো কেঁপে উঠতো বৃষ্টির ছোঁয়ায়।
সায়াহ্ন ফোন কেটে রুমে পা বাড়ানোর জন্য অগ্রসর হতেই রাওনাফ মিনতি করে বলল,

‘আমার সাথে একটিবার দেখা করবেন মিস.?’

‘দেখা করার কোনো কারণ খুজে পাচ্ছি না আমি।তবে দেখা কেন করবো?’ সায়াহ্নের ঘুরানো প্যাঁচানো উত্তর। রাওনাফ কে বিব্রত করা এতোই সহজ?
উক্ত কথা ভেবে মুখে দুষ্টুমির হাসি উদয় হলো তার। সায়াহ্নের মতো সে-ও ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলল,

‘আমার দরকারি একটা জিনিস আপনি হয়তো নিয়ে গিয়েছেন।’

সায়াহ্ন ভা’রী অবাক হলো। বি’স্ময়ে তার মতিভ্রম অবস্থা হলো। অবাক সুরেই বলল,

‘কি জিনিস!’

‘এইটা আমিও বুঝতে পারছি না।’

‘ফাজ’লামো করেন আমার সাথে? আপনার নাম্বার এখনি ব্ল’ক করে দিবো আমি।’

‘এমন একটা জিনিস নিয়েছেন ওই জিনিসের জন্যই তো আমি সব ভুলে যাচ্ছি।’

‘দেখুন মিস্টার.আপনাকে আমি চিনি না। নিছক কাকতালীয় ভাবে দেখা এরপর এতোশত বাহানা। কি চান আপনি! ওইদিন ও বলেছি আমাকে জ্বালাতন করবেন না। তবুও…। ‘

‘শেষবার জ্বালাবো মিস.। আমাকে এই সুযোগ টা দিন। কথা দিচ্ছি আর জ্বা’লাতন করবো না।’

সায়াহ্নের কথার মধ্যখানে রাওনাফ অনুনয়ের সুরে বলল। রাওনাফের বলার মাঝে অদ্ভু’ত টান লক্ষ্য করলো সায়াহ্ন । যে টানের সুতোয় তার মন চট করেই রাজি হয়ে উঠলো দেখা করার জন্য।
তবে সে নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে গলার স্বরে কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে বলল,

‘কাল দুপুর নাগাদ ওই পার্কের সামনে থাকবেন। আর হ্যাঁ,এইটাই শেষবার।’

বলেই সায়াহ্ন কল কেটে দিলো। তার মন হ্ঠাৎ করেই ঝমঝম শব্দে দুলে বেড়ালো। নিজের এহেন পরিবর্তনে বেশ অ’বাক হয়েই সে নীচে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
রাওনফা সায়াহ্নের চলে যাওয়া পথের দিকে পথিকের ন্যায় তাকিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

‘রোগী তোর পেছনে ঘুরে তুই পাত্তা দিস না। তোর কি কপাল দেখ রাওনাফ,আজ তুই রোগীর পেছনে ঘুরছিস রোগী’ই তোকে পা’ত্তা দিচ্ছে না।’

___________

‘ওই লোকের সাথে দেখা করার ব্যাপার নিয়ে তোর এতো আগ্রহ কেন!’ সায়াহ্ন সন্দিহান দৃষ্টিতে নোভার দিকে তাকিয়ে বলল।
নোভা থ’ত’মত খেয়ে নিজের উৎফুল্লতা লুকিয়ে চোখেমুখে ভাবুকতা এনে বলল,

‘কোথায়! আমি তো এমনিই জিগ্যেস করেছি।’

‘কাল বলার পর থেকে তুই আগ্রহ দেখাচ্ছিস। কোনোভাবে লোকটা কি তোকেও জ্বা’লাতন করে?’

সায়াহ্ন চিন্তিত স্বরে বলল । নোভা নিজের আগ্রহের মাত্রাকে কিছুক্ষণ নিজ মনে শাসালো। তার ভুলভাল প্রশ্নের জন্য সায়াহ্ন যদি মিস্টার.রাওনাফ আহরারে সাথে দেখা করতে না যায় তবে সব শে’ষ।
আঙ্কেলের আশাভরসা সব। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য দাঁত বলল,

‘আমি ভেবেছি এইটাও তোর কোনো পত্রিকার পাত্র।’

সায়াহ্ন নোভার দিকে দৃষ্টি উঠিয়ে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। নোভার এমন আগ্রহের প্রবণতা তাকে ভাবাচ্ছে না আপাতত। সে ভাবছে ওই আ’জ’ব লোকটা তাকে কেন দেখা করতে বলেছে!
আর সে কাল থেকে সব রুম খুজেও কোনো পুরুষের জিনিস পায় নি। লোকটা তবে কেন বলল,সে নাকি তার কোনো জিনিস এনেছে।
অ-দ্ভু-ত!

মধ্যাহ্নের তপ্ত রোদে অস্বস্তিকর পরিবেশে সায়াহ্ন আরো অস্বস্তিতে পরে ছুটে চলা ব্যস্ত শহরের ভীড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ তার রুহ্ ছটফট করছে৷ অন্তর আত্মা নিগড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে শরীর ছেড়ে৷ সায়াহ্নের ভাবান্তর মুখশ্রী দেখে নিরলস দৃষ্টিতে রাওনাফ তাকিয়ে রইলো৷ তার নিকট মনে হচ্ছে,সে মস্ত বড় অ’প’রা’ধ করে ফেলেছে সায়াহ্ন কে রিক্সায় তার পাশে বসতে বলে৷
সায়াহ্ন দরদর করে ঘামছে৷ রাওনাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টিস্যু বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনাকে আমি এক মিনিট পূর্বেও সাহসিনী পদে ভূষিত করার জন্য সরকারের নিকট তুলে ধরার কথা ভেবেছিলাম৷ তবে আফসোস আপনার মতো ভী’তু দু’টি নেই৷’

সায়াহ্ন টিস্যু নিজের ব্যাগ থেকে বের করে দ্রুত হাতে ঘাম মুছছে৷ রাওনাফের কথায় ক্রু’দ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ভী’তু!’

‘অবশ্যই ভী’তু৷ রিক্সায় সিট শেয়ার করতে বলেছি৷ আপনার জীবন নি’বো বলি নি৷’

সায়াহ্ন ঘর্মাক্ত মুখশ্রী টিস্যু দিয়ে মুছে রাস্তার ধারেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো । কম্পিত কন্ঠস্বরে বলল,

‘হেটে যাবো আমি।’

সায়াহ্নের মুখমণ্ডল দেখে রাওনাফ রিক্সা থেকে বিনাবাক্যে নেমে দাঁড়ালো। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া এমনি মিটিয়ে সায়াহ্নের সামনে এসে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,

‘চলুন।’

সায়াহ্ন রাওনাফের শান্ত ভঙ্গিমা দেখে অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। তারা ফুঁটপাত ধরে পাশাপাশি দূ’র’ত্ব রেখে হেটে চলেছে।
সায়াহ্নের মন পিঞ্জরে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিলেও সে কোনো কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারছে না সেই প্রথন দিনের ন্যায়।
সায়াহ্নের দিকে না তাকিয়েই রাওনাফ বলল,

‘আপনাকে অনেক কিছু বলার এবং জানার আছে।’

‘বলে ফেলুন।’ সায়াহ্ন খুব কষ্টে দু’টো শব্দ উচ্চারিত করে আবারো চুপসে গেলো। রাওনাফ হুট করেই চলার গতি থামিয়ে দিলো।
রাওনাফকে দাঁড়াতে দেখে সায়াহ্ন ও দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রশ্নসূচক চোখে তাকাতেই রাওনাফ আজ সরাসরি সায়াহ্নের চোখের দিকে চোখ রেখে বলল,

‘সব জানা এবং শোনার পূর্বে আমি বলতে চাই,মিস.আপনাকে আমি বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে আবদ্ধ করতে চাই।’

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here