প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৭

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৭
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
‘দেখুন মিস.শাড়িওয়ালি আপনার সাথে আমি একটু সময় কাটাচ্ছি। খুব ব্যস্ত মানুষ আমি তবুও আপনার সাথে বসে আছি।’ রাওনাফ সায়াহ্নের সন্দিহান দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল। সায়াহ্ন রাওনাফের বলা কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কথা ভাবছে। সায়াহ্ন কানের পিঠে চুল গুলো সাবধানী হাতে গুজে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বলল,

‘কে বলুন তো আপনি!’

‘মানুষ।’ রাওনাফের হেয়ালি মোটেও পছন্দ হলো না সায়াহ্নের। গত কয়েক দিন যাবৎ এই লোক হুট হাট তাকে জ্বালিয়ে মারছে। সায়াহ্নের রক্তিম মুখ মন্ডল দেখে রাওনাফ খানেক হাসলো। সায়াহ্নের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আছে। লোকটার মতলব কি!
এই প্রশ্ন করতে গিয়েও বিরক্ত হলো। সে উক্ত প্রসঙ্গ এড়িয়ে মুখ স্বাভাবিক করে নম্র গলায় বলল,

‘আপনার পেশা কি?’

‘জেনে কি করবেন?’

‘এতোদিন ধরে আমার পিছুপিছু ঘুরছেন ভদ্রতার খাতিরে জানতেই তো পারি।’

‘বিয়ের প্রস্তাব ট্রস্তাব পাঠাবেন না-কি!’ রাওনাফের এহেন জবাব শুনে সায়াহ্নের বিরক্তির মাত্রা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ালো। তার ইচ্ছা হচ্ছে লোকটাকে খু/ন করে জেলে যেতে কিংবা সুউচ্চ দালান থেকে ধাক্কা মে/রে ফেলে নিজেও ঝাঁপি/য়ে পড়তে।
আজ/ব লোক ! সায়াহ্নের ক্রুর দৃষ্টি দেখে রাওনাফ আবারো হেয়ালি করে বলল,

‘রাগলে আপনাকে লাল টমেটো লাগে মিস.লাল শাড়িওয়ালি।’

‘আপনার মতোই আপনার বলা নাম গুলা আজব।’ সায়াহ্ন দাঁতে দাঁত চেপে বলল। রাওনাফ শিষ তুলে বলল,

‘একটু নজর ফেলে দেখুন লোকটা হ্যান্ডসাম ও।’

রাওনাফের নির্ল/জ্জের মতো বলা প্রতিটি কথায় চরম বিস্মিত হচ্ছে সায়াহ্ন। একটা লোক এতোটা নির্ল/জ্জ আর বে/হায়া কি ভাবে হতে পারে তার ধারণা নেই। সায়াহ্ন দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাওনাফের সামনা-সামনি দাঁড়ালো।
রেশমি হাওয়ার তালে দুলছে বুনো ঘাসের পসরা। দূর দূরান্ত থেকে ব্যস্ত নগরীর টুকটাক আওয়াজ। মিষ্টি সুবাসে বিমোহিত চারিপাশ। সুন্দর পরিবেশের সাথে সায়াহ্ন উপলব্ধি করলো তার সামনের সু-পুরুষের দৃষ্টি জোড়া তার পায়ের নিকটে নিমজ্জিত। অদ্ভুত সুন্দর দৃষ্টি জোড়ার অভিসরণ। সায়াহ্নের কড়া কথা রেশ নিমিষের ধূলিসাৎ হলো।
সায়াহ্ন নিমজ্জিত সেই নয়ন যুগলের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করেও হাল ছেড়ে নিস্তব্ধ ভাবে পাশের দোলনায় বসে পড়লো। রাওনাফ বেশ নিম্ন স্বরে ফিসফিস করে বলল,

‘জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিভে যাবার কারণ কি মিস.।’

‘কারণবিহীন।’ সায়াহ্নের নিমজ্জিত কন্ঠস্বর যেন মুহূর্তেই রাওনাফের মুখমণ্ডলের ভাব পরিবর্তন করলো। সে একরাশ মন খারাপের মেঘ জমিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের পানে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,

‘জানেন মিস.সবাইকে একই দাঁড়িপাল্লায় মাপা জীবনের সবথেকে বড় দূর্বলতা।’

সায়াহৃ ঔদ্ধত্য দৃষ্টি। কথার মানে টা সে ঠিক বুঝে উঠার জন্য সময় নিচ্ছে। রাওনাফের যেন আজ বড্ড তাড়া। সে সায়াহ্ন কে ভাবার মোটেও সময় না দিয়ে দোলনার দুইপাশে হাত রেখে পেছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনার জীবনের তিক্ত স্মৃতি যেমন তিক্ত মানুষ দ্বারা হয়। একই ভাবে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মুহূর্ত কিছু সুন্দর মনের মানুষ দ্বারাই পরিপূর্ণ হয়।’

‘আপনি কতোভাগ নিশ্চিত পৃথিবীতে সুন্দর মনের মানুষ রয়েছে?’ সায়াহ্নের সহজ প্রশ্ন। রাওনাফ মাথা উঠিয়ে সটান হয়ে বসলো। অবিকল সুন্দর সুপুরুষের কাঠামো তার দেহভঙ্গি।
সাঁঝবাতির টিমটিমে তারার মতো জ্বলছে রাওনাফের বা হাতের ঘড়িটি।পরে থাকা ধূসর রাঙা শার্টটা খুব সযত্নে গুছিয়ে রাখা প্যান্টের মাঝে। কুনুই পর্যন্ত হাতাটা গুটিয়ে সূক্ষ্ম হাতে ভাজ করে রাখা যেন। ক্লিন সেভ গালের একদম নাকের পাশে ছোটো একটা লাল দাগ। তিল বললে ভুল হবে জন্ম দাগ খুব সম্ভবত। মানুষটার মুখের ভাবভঙ্গি গভীরতার ছোঁয়া।
বহু বছর পর সায়াহ্ন কোনো পুরুষকে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রায় মিনেট তিনেকের মতো পর্যবেক্ষণ করে সে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে বলল,

‘সুপুরুষ আপনি।’

রাওনাফ মুচকি হাসলো। কারণ সায়াহ্নের পরবর্তী কথাটা কি হবে সে খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সায়াহ্নকে বিব্রত না করে একই আঙ্গিকে বসে রইলো সে। সায়াহ্ন সোজাসুজিভাব দ্বিধা বিহীন বলল,

‘বাহ্যিক সৌন্দর্যের মতো আপনার মন কতোটা সুন্দর মিস্টার.?’

‘মনের খোজ জানতে হলে মনে বাস করতে হয়।’

রাওনাফের এহেন জবাবে মোটেও বিব্রত হলো না সায়াহ্ন। সে হুট করেই হেসে উঠলো। হাসির ধ্বনি যেন সুর তুলছে চারিপাশে। তবে রাওনাফ জানে,এইটা তাচ্ছিল্যের হাসি।
রাওনাফ মাথার পেছনে দু’হাত দিয়ে সায়াহ্নের হাসি দেখছে। সায়াহ্নের হাসি তার নিকট অদ্ভু/দ সুন্দর লাগছে।
সায়াহ্ন হাসি থামিয়ে রাওনাফের মুখপানে তাকিয়ে রইলো। রাওনাফ উঠে বসলো সটান হয়ে। তার মুখের ভাবভঙ্গি অদ্ভুত ।
সায়াহ্ন কটাক্ষ করে বলল,’মনের অধিকার নিয়ে সেই অধিকার ছিন্ন করা বুঝি খুব ভালো মনের অধিকার?’

‘এইটা জানার জন্য মনটাকে দিতে হবে যে।’

সায়াহ্ন ভাবান্তর। তার নিছক লোকটাকে পা/গ/লের খাতায় ফেলার ইচ্ছা জাগ্রত হলো। অকপটে কতো কথাই তো বলা যায় । তবে সায়াহ্ন জানে সব মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের থেকে কতো ভয়ংকর ভেতরটা।
সায়াহ্ন মুখ ফুঁটে বলতে চাইলো,’জানেন মিস্টার.মানুষ নিজেকে ভালো দেখায় তার ভেতর টা লুকিয়ে। তাদের ভেতর টা হয় অপবিত্র আত্মার মতো কুৎসিত।’
রাওনাফ একই ভাবে ঠেক দিয়ে বসে রয়েছে। সায়াহ্নের মুখমণ্ডল রক্তিমতার ছোয়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অদ্ভুত স্বর্গীয় সৌন্দর্য ভর করেছে তার সর্বাঙ্গে।
রাওনাফ নিজের দৃষ্টি সংযত করে বসে রইলো। সায়াহ্ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরে যাবার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। রাওনাফ তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

‘উত্তর টা দিলেন না যে!’

সায়াহ্ন থমকে দাঁড়ালো। লোকটাকে সে মোটেও বুঝতে পারে না! প্রেমের প্রস্তাব সায়াহ্ন অনেক পেয়েছে তবে এই অজ্ঞা/ত লোকটা তাকে কি বুঝায় সে ভুলেও বুঝতে পারে না!
দোমনা করে সায়াহ্ন ঘুরে দাঁড়ালো। গলার স্বর খাদে ফেলে গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘আপনার মনে কি চলে মিস্টার? প্রেমের জোয়ার বইছে না’কি!’

সায়াহ্নের প্রশ্নে খানেক ভড়কে গেলো রাওনাফ। সায়াহ্নের চঞ্চল দৃষ্টি জোড়ার সামনে নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হওয়ার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই মাথা ডান পাশে ঘুরিয়ে গুনে গুনে তিনবার বড় বড় শ্বাস নিয়ে সামনে ঘুরে তাকালো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য রাওনাফ বলল,

‘শুধু প্রেমের জোয়ার বইছে না বিয়ের জোয়ার ও বইছে।’

সায়াহ্নের দৃষ্টি এইবার মিইয়ে গেলো।তবে রাওনাফের চোখে চোখ মেলে কিছু একটা খোজার চেষ্টা করেএ ব্যর্থ হলো সে। রাওনাফ পকেটে হাত গুজে শিষ বাজাচ্ছে। শিষের আওয়াজে সায়াহ্নের হু/শ ফেরে। সে কথার পৃষ্ঠে জবাব না দিয়েই আবারো ঘুরে দাঁড়ালো।
সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে,লোকটা তার সুযোগ নিতে চাইছে। আবার তার মন চাইছে সব ভেঙ্গেচূড়ে খুলে বলতে।
তার মনের প্রতিটি কোণায় যে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা । যা তাকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে বেড়াচ্ছে। পর মুহূর্তেই সায়াহ্ন নিজেকে দমিয়ে নিজ মনেই বলল,’দূর্বলতা প্রকাশে মানুষ তোকে দূর্বলদের কাতারে ফেলবে।’
এই কথা মনে হতেই সে সোজাসুজিভাবে রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘দয়া করে আমাকে আর জ্বালাতন করবেন না। এইটা আমার অনুরোধ।’

রাওনাফ মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলো। সায়াহ্ন আবার বলল,

‘মানুষের প্রতি আমার তৈরি হওয়া বিশ্বাস ভেঙ্গেচূড়ে গিয়েছে। তবে যতোটুকু বিশ্বাস রয়েছে ভাঙবেন না। আপনাকে আমার ভালো মনের মানুষ বলেই মনে হয়।’

সায়াহ্নের কথাতে এবারেও জবাব দিলো না রাওনাফ। তবে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,’প্লিজ সায়াহ্ন আমাকে সবটা বলুন।’

নিজ ইচ্ছাকে দমিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সে। সায়াহ্ন ও চুপ করে রইলো। তার কথার ঝুলি হাতড়ে কোনো কথাই যেন বের করতে পারছে না সে।
সে কি সত্যিই চায়! লোকটা আর না আসুক। যত্রতত্র ভেবে রাওনাফের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো সে উত্তরের অপেক্ষায়।
তবে রাওনাফ অ দ্ভু ত ভাবে অ/বা/ক করে তাকে উপেক্ষা করে চলে যাবার জন্য পাঁ বাড়ালো চলে যাবার জন্য। সায়াহ্ন ঘুরা তাকালো। আজকে লোকটা দ্রুত পায়ে হাটছে না।
তার যেন সব তাড়া ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে সায়াহ্নের সাথে তার অদ্ভুত সম্পর্কের রেশ। হ্ঠাৎ করেই সায়াহ্নের দু’চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অস্পষ্ট ভাবে ঠোঁট আওড়ালো,

‘আপনিও চলে যাচ্ছেন!’

অস্পষ্ট ভাবে সায়াহ্নের কথার উত্তরে যেন জবাব এলো,

‘মিস.রাখতে হলে থাকতে জানতে হয়,বিশ্বাস কর‍তে হয়,ভরসা করতে হয়। আপনি তো এক পাল্লায় মেপে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি।’

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here