প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৯

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৯
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
‘মজা করছেন।’
সায়াহ্ন নির্লিপ্ত গলায় বলল। রাওনাফ মাথা ঝাকিয়ে ‘না’ উচ্চারণ করার পূর্বেই সায়াহ্ন অতিশীতল কন্ঠে বলল,

‘আমার ব্যাপারে কতোটুকু জানেন আপনি!’

‘জানি না। তবে জানার সুযোগ চাচ্ছি এই সম্পর্কের মাধ্যমে।’

রাওনাফ অতিশয় শীতল চাহনী তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সায়াহ্নের মুখপানে। মেয়েটার চোখেমুখে এতোক্ষণ যে উচ্ছ্বাস বা ভয়-ভীতি ছিলো সব যেন নিমিষেই বিদায় নিয়েছে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক স্থির। সে যেন জানতো এমন কিছু একটা ঘটবে তার সাথে। রাওনাফ জানে এইসব রোগীরা নিজেদের অন্তর আত্মা ছাড়া বাহ্যিক কোনোকিছু বিশ্বাসে আগ্রহী নয়। তাদের কাছে সবাইকে এক কিংবা নিষ্ঠু’র মনে হয়।
রাওনাফ মুচকি হাসলো। সায়াহ্ন সে হাসির দিকে লক্ষ্য করে বলল,

‘গত কয়েকদিন অনেক মজা করেছেন আমার সাথে মিস্টার। এবার বন্ধ করুন।’

‘কথাগুলো আপনার নিকট মজা হলে আপনার ভাইয়ার কাছে ফোন করে সত্যিটা যাচাই করে নিতে পারেন।’

সায়াহ্ন অবাক চোখে তাকাতেই রাওনাফ আবার বলল,

‘আপনার পরিবারের সবার সাথে কথা হয়েছে। তারা দ্বিমত করে নি সম্পর্কে আবদ্ধ হতে।’

রাওনাফের কথা শুনে সায়াহ্নের মে’জা’জ খারাপ হবার উপক্রম হলো। এই কারণের জন্যই নোভা এতো খুশিখুশি ছিলো। তার ভাইয়ের কাছে ফোন দেবার দরকার পড়লো না। পূর্বের ঘটনা মনে হলো। তার জন্মদিনের সারপ্রাইজ থেকে শুরু করে সব!
এইগুলা এই লোকের কারসাজি। সায়াহ্ন রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,

‘তার মানে আপনিই সেই লোক। যে এতোদিন যাবৎ এক এইসব সব করে আসছে!’

‘উঁহু! ভুল। আপনার পরিবার আমার সাথে ছিলো বলেই পেরেছি। একা নয়।’

‘আমার পাশে তো তারা ছিলো না!’ সায়াহ্ন কটাক্ষ করে বলল।
রাওনাফ চুপ হয়ে গেলো। আর কোনো কথা বাড়ালো না। সায়াহ্ন রাগে কথা খুজে পাচ্ছে না। পরিবারটা তাকে কখনো শান্তি দিবে না না’কি।
তার দায় দায়িত্ব সব এড়িয়ে এখন এতো দায়িত্ব পরায়ণ কেন হচ্ছে তারা! সায়াহ্ন রাগে উল্টো পথে পা বাড়ালো। আজ সরাসরি সে তার বাবার বাসায় যাবে। সবাইকে ডেকে জিগ্যেস করবে,কেন তার জীবন নিয়ে মেতেছে তারা! কেন আজ এতো ভাবছে তাকে নিয়ে। যখন তাকে নিয়ে মেতে থাকার দরকার ছিলো কিংবা তাকে নিয়ে ভাবার তাকে আগলে রাখার দরকার ছিলো সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে তাকে একা করে রেখেছিলো।
আজ সে একা বাঁচতে শিখে গেছে। সায়াহ্নের চলে যাবার পানে তাকিয়ে দু’পা বাড়িয়ে হাত ধরে নিলো রাওনাফ। পেছন থেকে হাতের টান অনুভব করতেই রাগের মাত্রা সীমা ছাড়ালো তার। ইচ্ছা হলো ঠাটিয়ে চ’ড় মে’রে দিতে লোকটার গালে।
তাকে কি পেয়েছে,হ্যাঁ! এতোদিন ধরে একটা অজানা অচেনা লোক হয়ে তার পিছুপিছু ঘুরছে। আজ এই লোকের সাথেও সব হিসেব মিটাবে সে।
পেছনে ঘুরার পূর্বেই রাওনাফ বলল,

‘আপনাকে আমি জানি মিস.তবে আপনাকে আপনার মতো জানতে চাই। একজন বন্ধু হিসেবে। আমাকে ভরসা করতে পারেন।’

রাওনাফের কথাগুলো যেন অন্তত শ্রুতিমধুর শোনালো সায়াহ্নের নিকট। হৃদয়ের সমস্ত জমে থাকা রাগ ধূলিসাৎ হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলো যেন।
লোকটার কথায় কিছু একটা মোহ আছে। যা তাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়।
সায়াহ্ন শান্ত ভঙ্গিমায় পিছু ফিরলো। কোনো ভঙ্গিমা না করে বলল,

‘অন্যত্র যেতে পারি?’

রাওনাফ সম্মতি দিলো। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সে ভেবেছিলো মেয়েটা তাকে বুঝতে সময় দিবে না। আশ্চর্যজনক ভাবে তার পরিবারের নিকট হতে শোনা সমস্ত তথ্য ভুল বলে ঠেকছে তার কাছে।
মেয়েটাকে একটু জোর করলেই সব শোনে। তবে তার নিজের বাবা কেন বলল, মেয়েটা কারো কথা শুনে না। একগুঁয়ে ,জেদি। নিজের মন যা বলে সেটাই করে। এর জন্যই এতোকিছু।
রাওনাফ সব তথ্য সঠিক ভেবেই এতোদিন সায়াহ্ন কে ওইভাবেই ট্রিট করে আসছিলো। তবে দিন দিন তার মনে হচ্ছে,
মেয়েটা শাসন চায়,ভালোবাসা চায়।

বুনোফুলের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে চারিপাশে। হলদেটে ,সাদা এবং লাল মিশ্রিত বুনোফুল গুলো দেখতে অদ্ভু’ত সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে গোধূলির শেষ লগ্নে। ল্যাম্পপোস্ট টিমটিম করে জ্বেলে উঠছে একে একে। ক্লান্ত পথিক যানে করে নিজস্ব গন্তব্যে ফিরে যাবার জন্য ছটফট করছে। বাইরের দুনিয়ার ব্যস্ততা ছোটো এই ঝুপড়ির মতো ক্যাফে তে কোনো ফারাক ফেলছে না। দু’জোড়া কপোত-কপোতি সামনা সামনি বসে আছে কোনো তাড়া বিহীন । যান্ত্রিক শহরের ভীড় ঠেলে খোলা পরিবেশে একটা মাঝবয়সী লোকের ফ্যাঁসফ্যাসে আওয়াজে নিশ্চুপতার অবসান ঘটলো । লোকটা অগোছালো শার্ট টেনে একটা রঙচটা লাল রঙের কার্ড নিয়ে এসে বলল,

‘স্যার ম্যাডামের জন্য কিছু অর্ডার দিবেন না?’

রাওনাফ একবার দৃষ্টি উঠিয়ে সায়াহ্নের নিমজ্জিত মাথা দেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারো লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘পানি,খিচুরি সাথে ডিমভাজি নিয়ে আসেন।’

লোকটা কানে গুজে থাকা ছোটো পেন্সিল দিয়ে কিছু আঁকিবুঁকি করে মাথা নিচু করে চলে যেতেই সায়াহ্ন মাথা উঠালো। ধীর গলায় বলল,

‘কিছু খাবো না আমি।’

‘আপনার ফেভারিট ডিম ভাজি আর খিচুরিও না!’ রাওনাফ অবাক হয়ে বলল। সে যেন অষ্টম আশ্চর্য কিছু শুনে ফেলেছে এমন একটা মুখভঙ্গি করলো।
সায়াহ্ন একের পর এক জিনিস গুলো মেনে নিতে পারছে না।
তার মনের কোণে,’এই লোকটা জানলো কি’ভাবে!’ উদয় হবার পূর্বেই রাওনাফ বলে উঠলো,

‘আপনার মা আমাকে বলেছে। আপনি খিচুরি আর ডিমভাজি পেলে না’কি সবকিছু ভুলে যান।’

‘পূর্বের অভ্যাস এবং ভালোলাগা সবকিছুতেই এখন অনীহা।’ সায়াহ্ন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল।
রাওনাফ চেয়ার টেনে আরেকটু সামনা-সামনি বসলো। তার আর সায়াহ্নের দূরত্ব অল্পকিছু। রাওনাফ নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ওইসব কথা বাদ। আমি রাওনাফ আহরার।’

সায়াহ্ন কিঞ্চিৎ অবাক হলো। নামটা কোথাও দেখেছে বা শুনেছে এমন মনে হলো তার নিকট। তবে সে দিকে গুরুত্ব না দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল,

‘সায়াহ্ন আফরা।’

‘জানি।’ রাওনাফ গাল ভর্তি হেসে বলল। অদ্ভুত মোহময় হাসি। যে কাউকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সায়াহ্ন চোখ নামিয়ে ফেললো চটজলদি। রাওনাফ নিরবতা দূরে সরিয়ে বলল,

‘আপনার ব্যাপারে পাঁচটি বাক্য বলুন মিস.আফরা।’

‘কেন!’

‘কারণবিহীন। একে অপরকে চেনার মাধ্যম বলতে পারেন।’

সায়াহ্ন কিছু বলল না। নিরলস ভাবে চেয়ারে হালকা গা এলিয়ে দিয়ে চুপ করে।
শান্ত নির্জন পরিবেশ। কিছুটা দূর থেকে থালাবাসনের আওয়াজ ভেসে আসছে। একটা নেড়ি কুকুর কিছুক্ষণ পর পর ডেকে উঠছে আর্তনাদের মতো।
সায়াহ্ন হেলে বসা থেকে টেবিলে দু’হাত রাখলো।
রিনরিনে স্বরে বলল,

‘যেকোনো পাঁচটি বাক্য বললে হবে মিস্টার.রাওনাফ?’

‘অবশ্যই।’

রাওনাফের কথা সায়াহ্নের কর্ণকুঠরে পৌছাতেই সে আবার আগের ন্যায় বসে পড়লো। মিনিট এক পর সেই লোকটা খাবার এনে রাখলো টেবিলে । রাওনাফ কে স্যার বলে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে সায়াহ্নের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে আবারো চলে যেতেই রাওনাফ খিচুরি ঘ্রাণ নিয়ে বলল,

‘বলুন। এরপর আমিও বলব পাঁচটি বাক্য। ‘

সায়াহ্ন অদ্ভুত শীতল চাহনি তে তাকিয়ে বলল,

‘আমার সম্পর্কে প্রথম বাক্য হচ্ছে,আমি ধর্ষি’তা।
আমার সম্পর্কে দ্বিতীয় বাক্য হচ্ছে,আমি ক’লঙ্কিত।
আমার সম্পর্কে তৃতীয় বাক্য হচ্ছে,আমি দো’ষি।
আমার সম্পর্কে চতুর্থ বাক্য হচ্ছে,আমার চরি’ত্র ন’ষ্ট।
আমার সম্পর্ক পঞ্চম বাক্য হচ্ছে,আমি অন্তত খারা’প একজন মেয়ে,বোন।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here