#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে কথা চৌধুরী❤️
#পর্ব_১০
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
চোখ কখন বুজে এসেছিল টের পাইনি নবাব। এখন হয়ত জেগে উঠার সম্ভাবনাও ছিল না কিন্তু বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুম জড়ানো চোখে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। রাত সাড়ে তিনটা। পাশে ফিরে দেখলো মিষ্টি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর মুখ বাম পাশে কাত হয়ে আছে তাই বোরকার আড়ালে দু’টো চোখও দেখতে পেল না নবাব।
পেট ডাক ছাড়ছে নবাবের। দুপুরে অনাহারে থেকে রাতেও কিছু পেটে পড়েনি। তাই খালি পেট খাবারের সন্ধানে হাঁক-ডাক করছে। মাথার ক্যাপ আর মুখের মাস্ক খুলে উঠে দাঁড়ালো নবাব। অন্ধকার বাসে আন্দাজে সে তার ব্যাগ হাতড়াতে লাগলো। ব্যাগটা মাথার উপরে জিনিসপত্র রাখবার সিটে অবস্থান করছে। কয়েক সেকেন্ড খোঁজাখুঁজির পর পানির বোতলের মতো কিছু একটা হাতে লাগতে স্বস্তি পেল নবাব। ক্যাপ আর মাস্ক আগেই কোনোমতে ব্যাগে পুড়ে ফেলেছিল। এখন কেবল পানির বোতল নিয়ে পুনরায় সিটে বসে পড়লো। খালি পেটে পানি ঢালতে গিয়ে পানির চলাচল সম্পূর্ণ অনুভব করলো। বোতল প্রায় অর্ধেক ফাঁকা করে পুনরায় ব্যাগে চালান করলো।
জানালার দিকে চোখ যেতে দেখলো সেটা বন্ধ আছে আর মিষ্টি সেখানেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। এসি বাস তাই জানালায় পর্দা ঝুলছে। হঠাৎ নবাবের ইচ্ছে হলো পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকানোর কিন্তু পর্দা সরাতে গিয়ে মিষ্টি নড়েচড়ে উঠলো। নবাব পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে পারেনি কারণ মিষ্টি এখন নবাবের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখেছে। নবাব বুঝতে পেরেছে মিষ্টি ঘুমের মাঝে নবাবের কাঁধে ঠাঁই নিয়েছে। প্রথমে নবাব যথেষ্ট অবাক হলেও এখন ঝুম বৃষ্টির মতো তার হৃদয়ে ছন্দপাত হচ্ছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে ঘুমন্ত মিষ্টিকে দেখে সে মনে মনে প্রশ্ন করলো, “মিষ্টি, ঘুমের মাঝেও কি আমাকে নিয়ে ভাবো? আমি মরে যেতে পারি এই শঙ্কায় কি শক্ত হাতে আমার বাহু চেপে ধরেছো?” আনমনে হেসে উঠে সিটে হেলান দিলো নবাব। মিষ্টিকে ডাকলো না, সরালো না উল্টো নিজে এখন বাম দিকে ঘাড় কাত করে, মিষ্টির মাথার উপর নিজের মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে দিলো।
“মা, আমি না গেলে হয় না?” সতেরো বছর বয়সী ছেলের মুখে না যাওয়ার কথা শুনে মিনারা বেগম জানতে চাইলো, “কেন বাবা?”
মুখ কুঁচকে ছেলে জবাব দিলো, “ভালো লাগছে না যেতে।”
“নবাব, আমরা রোজ তো যাই না। সবাইকে দাওয়াত করেছে তাই যেতে হচ্ছে। দুপুরে খেয়ে বিকালেই আবার চলে আসবো।”
“ধুর! ঐ বাড়িতে একা একা আমার একদম ভালো লাগে না।”
ইস্ত্রি করা কাপড় আলমারিতে রাখতে গিয়ে ছেলের দিকে ফিরে তাকালেন, “কেন? মিষ্টির সাথে গল্প করবি।”
কাঠের ওয়ারড্রবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নবাব। মলিন মুখে সে তার মাকে বললো, “মিষ্টি আপুর সাথে কী গল্প করবো? তাছাড়া আপুর সাথে কথা বলতে আমার সংকোচ লাগে।”
আলমারির দরজা লাগিয়ে বিছানায় এসে বসলেন মিনারা। শাড়ির আঁচলে মুখে জমে থাকা ঘাম মুছে বললেন, “শোনো ছেলের কথা! সংকোচের কী আছে? বোনের সাথে আড্ডা দিবি, লুডু খেলবি আর মিষ্টিও তো একা একাই থাকে। খেয়ে-দেয়ে ওর সাথে গিয়ে আড্ডা দিস তাও চল বাবা।”
কয়েক সেকেন্ড ভেবে একপ্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হলো নবাব, “এইবারই শেষ। আমি কিন্তু আর যাবো না ঐ বাড়িতে।”
“সেটা পরে দেখবো। এখন জলদি কাপড় বদলে আয়।”
মিষ্টির বাবাকে ভাই সম্বোধন করা মিনারা হলো সোবহানের আপন চাচাতো বোন। দুই ভাই-বোনের বসবাস একই জেলায় হলেও দেখা-সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। প্রায় প্রতিবছরই সোবহান ঈদের পর বোনকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। এবারও যথাক্রমে নিমন্ত্রণ করেছেন আর সেই নিমন্ত্রণে যাওয়া নিয়েই গোছগাছ করছেন মিনারা।
দুপুর একটা নাগাদ মিনারা তার ছেলে নবাবকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছেও গেলেন। রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন দোতলা বাড়ির দিকে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে কলিং বেল টিপে ছেলেকে বললেন, “নবাব?”
“বলো মা।” ছেলে কন্ঠে বিরক্তির সুর।
“মামা আর মামীর সামনে কিন্তু বাসায় যাওয়ার কথা একদম তুলবি না। উনারা শুনলে কষ্ট পাবেন।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে নবাব জবাব দিলো, “ঠিক আছে মা।”
ছিটকানির শব্দের সহিত কাঠের দরজা খুলে গেল। হাসোজ্জ্বল মুখ থেকে শব্দ এবার নিসৃত হলো, “কেমন আছো ফুপি?”
“ভালো আছি মা।”
“ফুপা আসেননি?”
“না রে। তোর ফুপার অন্যত্র দাওয়াত আছে, সেখানেই গেছেন।”
“ওহ, ভেতরে এসো।”
“হুম চল।” বলেই মিনারা ভেতরে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার পথ অনুসরণ করে মিষ্টি সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে বিরক্ত হওয়া নবাবের মুখ প্রসন্ন হলো মিষ্টিকে দেখে। এখানে আসার কথা জানবার পর থেকে ওর মাঝে যেই বিরক্তি কাজ করছিল, সেটা হঠাৎ করে উবে গেল।
এক কদম সামনে এগিয়ে এসে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো মিষ্টি আপু?” নবাবের প্রশ্নে ফিরে তাকালো মিষ্টি। স্মিত হেসে জবাব দিলো, “ভালো, তুমি কেমন আছো?”
“এখানে দাঁড়িয়েই সব বলবো?”
হাসিটা দ্বিগুণ করে মিষ্টি বললো, “ভেতরে এসো।”
মিষ্টির রুমে পা রেখে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো নবাব। ওকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “দাঁড়িয়ে থাকবে না-কি বসবে?”
বিছানায় বসে নবাব বললো, “এগুলো কি তুমি বানিয়েছো?” হাতের ইশারায় দেয়ালে আটকানো কিছু কৃত্রিম প্রজাপতি দেখালো আর সেদিকে তাকিয়ে মিষ্টি জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”
“খুব সুন্দর তো। কী দিয়ে বানালে?”
চেয়ারে বসে মিষ্টি বললো, “রঙিন কাগজ দিয়ে। হাতের কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগে।”
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নবাব হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আপু, তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?” আচমকা এমন প্রশ্নে অবাক হলো মিষ্টি। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো, “বয়ফ্রেন্ড?”
“হ্যাঁ, নেই?”
মুখে হাসি বজায় রেখে নরম গলায় বললো, “নাহ, কারণ এসব তো সুন্দরী মেয়েদের থাকে, তাই না?”
“তুমি যে কী বলো না আপু? নিজেকে সবসময় তুমি এমন বলো।”
“আচ্ছা, আমার কথা বাদ দাও। তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে না-কি সেটা বলো। যদি না থাকে তবে ফুপিকে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
“আরে ধুর! কী বলছো তুমি এসব? মাকে এসব বললে মা আমাকে উল্টো ঝুলিয়ে পেটাবে।”
“তাহলে আমাকে এমন প্রশ্ন করো কেন সবসময়? দেখা হলেই শুধু জিজ্ঞেস করো বয়ফ্রেন্ড আছে কি-না?” ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিষ্টি। কিঞ্চিৎ চুপসে গিয়ে নবাব বললো, “না মানে তুমি তো ভার্সিটিতে পড়ো।”
আরেকটু গম্ভীর হলো মিষ্টি, “ভার্সিটিতে পড়লেই কি আজব প্রাণী পুষতে হবে?”
কাঁধ নাচিয়ে নবাব জানতে চাইলো, “এই, এই তুমি কি আমার উপর রাগ করলে আপু?”
অল্প হেসে মিষ্টি বললো, “এমন ফাজিল ভাইয়ের ওপর রাগ করা যায় না। তা তোমার এসএসসি পরীক্ষা কবে?”
পা তুলে বিছানায় বসলো নবাব। খাটের পাশে থাকা ছোট্ট একটা বল নিয়ে নাড়াচাড়া করে জবাব দিলো, “কয়েকদিন পরেই।”
“পড়াশোনা কত দূর শেষ হলো?”
বল বারবার শূন্যে ছেড়ে হাতে নিচ্ছে নবাব। বল দেখতে গিয়ে যখন ঘাড় পিছন দিকে কাত করছে, তখন কপালের চুলগুলো সরে যাচ্ছে; বল মুঠোয় বন্দী করে যখন সোজা হচ্ছে, তখন চুলগুলো আবার কপাল দখল করছে। মিষ্টির সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন নবাবের দিকে। উত্তরের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে থেকে এবার বিরক্ত হলো মিষ্টি, “ওটা রাখো না। কথা বলার সময় তোমার হাত-পা এত নড়েচড়ে কেন?”
নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই নবাব জবাব দিলো, “হাত-পা না নড়াচড়া করলে তোমার সাথে কথা বলতে পারি না।”
“কেন?” বুঝতে না পেরে।
স্থির হয়ে বসে নবাব বললো, “কোনও কিছুতে ব্যস্ত না থেকে আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি না।”
“সেই কারণটাই তো জানতে চেয়েছি।”
“কারণ আমার সংকোচ লাগে।” বলেই বল ছোড়াছুড়ি খেলায় মত্ত হলো নবাব৷ এদিকে মিষ্টি অবাক আর রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নবাবের মাথায় চাটি মেরে বললো, “ফাজিল ছেলে, বোনের সাথে কথা বলতে সংকোচ হয়?”
খুব একটা ব্যথা লাগেনি তবুও মাথায় হাত বুলিয়ে নবাব বললো, “বোন বলেই সংকোচ লাগে। বন্ধু হলে তো আর এসব সংকোচের কথা বলতাম না।”
“এমন বাচ্চা ছেলেকে আমি বন্ধু বানাবো?” চেয়ারে ধপাস করে বসে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।
নবাব কিঞ্চিৎ রাগ হয়ে বললো, “এই, তুমি বাচ্চা কাকে বলছো আপু? আই অ্যাম সেভেন্টি।”
“তো? দাদা নানা ডাকবো?… চার বছরের ছোট ছেলে আসছে আমার বন্ধু হতে।” মিষ্টির কথাগুলোতে এবার বেশ রেগে গেল নবাব, “ছোট ছোট আর বাচ্চা বাচ্চা করো না তো। তাছাড়া আমি তোমাকে বন্ধু হতে বলেছি, বউ হতে বলেছি কি?” মূলত রাগের বশে নবাব এমনটা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। কিন্তু বিষয়টা এখন বুঝতে পেরে অনেক বেশি লজ্জা অনুভব করছে। তাই মাথা নত করে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। টুঁশব্দ না করে মিষ্টির রুম ত্যাগ করলো গোমড়া মুখে। এদিকে মিষ্টি প্রথমে প্রশ্নটা শুনে অবাক হলেও এখন খিলখিল করে হাসছে, “পাগল একটা।”
চোখ পিটপিট করে তাকালো মিষ্টি। কোথায় আছে সে? মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। একটু নড়তে গিয়ে টের পেল ওর মাথার ওপর ভারী কিছু একটা আছে। হাত নাড়াতে গিয়ে দেখলো সেটা নবাবের দুই বাহু আঁকড়ে রয়েছে। মূহুর্তেই লজ্জা নামক অদৃশ্য জাল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মিষ্টিকে। নিজেকে নবাবের কাছ থেকে সরাতে গিয়ে নবাবও এবার নড়ে-চড়ে উঠলো। মিষ্টি বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো চুপটি করে যেন কিছুই হয়নি। এদিকে ঘুম ভাঙতে ডান হাতে চোখ কোচলে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে মিষ্টি?”
বোরকা পড়া মিষ্টির মাথা নুইয়ে আছে। ঘুম জড়ানো দুইটি চোখের পাতা লজ্জায় প্রায় বুঁজে আছে। কোনোমতে সে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালো। নবাব শরীরের আড়মোড়া ভেঙে আবার জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি কিছু হয়নি?”
“উঁহু।” মিষ্টির ছোট্ট জবাব।
“না হলেই ভালো। তা এখন কিছু খেয়ে নাও। কালকে থেকে অনাহারে আছো। এরপর অসুস্থ হলে অন্য ঝামেলা পোহাতে হবে।”
ধীরে ধীরে মিষ্টি বললো, “একেবারে পৌঁছে নাস্তা করবো।”
“বিছানাকান্দি যেতে এখনও অনেক দেরি।”
অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে, “বিছানাকান্দি মানে?”
…চলবে কি?