প্রেমঘোর ২
পর্ব : তিন
লেখক : নার্গিস সুলতানা রিপা
“বিজ্ঞান মানে কি?”
“বিশেষ জ্ঞান।”
“ভবদহ বিল কোন জেলায়?”
“উমমম, ভবদহ?”
“হ্যাঁ। এটা কোন জেলায়?”
রাইসার প্রশ্নের উত্তর মনে করার চেষ্টা করছে রাউনাফ। কিন্তু পারছে না। রাইসা বললো,
“পারবি কি করে? মনোযোগ দিয়ে তো পরিস না।”
রাউনাফ মন খারাপ করলো। এই একটা সময়, যখন রাউনাফ রাইসার সাথে বিন্দুমাত্র খারাপ ব্যবহার করে না। আর সে সময়টা হচ্ছে-রাইসা যখন তাকে আর অলিককে পড়তে বসায়। তবে সেটা ক্লাস বই না৷ রাইসা অলিক আর রাউনাফকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে পড়ায়। তারমধ্য রয়েছে সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, IQ, বর্তমান খবর যেসব ওদের বয়স উপযোগী আর মাঝে সাহিত্য এবং ইসলামিক কিছু বই দেয় ওদের পড়ার জন্য।
রাইসা অলিকের দিকে তাকলো। বললো,
“তুই পারিস? নাকি তুইও ওর মতো ভুলে গেছিস? এই সাধারণ জ্ঞানের বইটা সেই কবে দিয়েছি তোদের। এখনো ভালো মতো পারিস না।”
অলিক বললো,
“ছয়শো’র উপরে পৃষ্ঠা আপুনি। মনে থাকে না।”
“মনে তো কারোরই থাকে না। তাই বলে কি পড়বি না? পড়তে পড়তে দেখবি একসময় সব পারবি। এখন বল তো এটা পারিস কি না?”
“উমম, মনে তো হচ্ছে যশোর জেলায়।”
“হুম, হয়েছে। কিন্তু এভাবে বললে হবে না। সাহসের সাথে বলতে হবে।”
অলিক হাসলো। বললো,
“পড়তে পড়তেই সাহস হয়ে যাবে একসময়।”
“হ্যাঁ, তবে সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো। আচ্ছা এবার IQ বইটা দে তো। সেখান থেকে কিছু প্রশ্ন করি তোদের।”
IQ বই ছাদে নিয়ে আসা হয় নি। রাউনাফ দৌড়ে নিচে গেলো IQ বই আনতে। রাউনাফ বই আনলো। রাইসা বই হাতে নিয়ে দেখছে। কি প্রশ্ন করা যায় এদের। রাইসা প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে বললো,
“IQ বই থেকে প্রশ্ন করার কিছু নেই। বাইরে থেকে প্রশ্ন করার ভালো। তাহলে বিষয়টা আরো ভালো হয়।”
রাউনাফ বললো,
“তাহলে যদি না পারি?”
“সব সময় যে পারতেই হবে এমন কোনো কথা নেই ভাই৷ আমি প্রশ্ন করছি তোরা ভেবে উত্তর দিবি। না পারলে মাথা খাটাবি। মাথা খাটালে বুদ্ধি বাড়ে…..”
অলিক রাইসাকে সমর্থন করলো।
রাইসা বললো,
“ধর, তুই একজন ট্রাক ডাইভার। তোকে ৫০০ বস্তা চাল দেওয়া হয়েছে। তোকে আজ রাতেই বস্তাগুলো ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে হবে। সেখানে ৩০০ বস্তা চাল দিয়ে বাকী ২০০ বস্তা চাল পৌঁছে দিতে হবে ময়মনসিংহ। যেখানে যেতে তোর গাড়ির পেট্রোল পুড়বে ৪৫ লিটার। তাহলে – এখন তোরা আমায় বল, ড্রাইভারের বাবার নাম কি?”
রাউনাফ আর অলিক খুব মনোযোগ দিয়ে খাতায় চালের বস্তা, জায়গার নাম আর পেট্রোলের পরিমাণ লিখছিলো যেনো সঠিক উত্তর দিতে পারে। কিন্তু এতোকিছুর পর কি জানতে চাওয়া হলো-‘ড্রাইভারের বাবার নাম!’
অলিক-রাউনাফ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে৷ অলিক বললো,
“আপুনি, তুই আমাদের বোকা বানানোর জন্য এমন প্রশ্ন করিস নি তো?”
“তোরা দুজন তো বোকাই, নতুন করে আর কি বোকা বানাবো? বোকা না হলে কেউ এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না?”
অলিক আর রাউনাফ ভাবতে লাগলো। এরকম প্রশ্নে, প্রশ্নের মাঝখানেই উত্তর লুকায়িত থাকে৷ রাউনাফ বারবার খাতায় প্রশ্নটা লিখছে। রাইসা বললো,
“তোরা সোজা ভাবে চিন্তা কর। জটিল করে ভেবে মাথা গুলিয়ে ফেলছিস। এতো জটিল করে ভাবার কিছু নেই। প্রশ্নটা ভালো করে করে পড়, তাহলেই পারবি।”
এর মাঝে একজন কাজের মেয়ে এলো ছাদে। ওদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তোমগোরে সেই তহন থাইকা বড় মামী (অরূপ-অলিকের মা) ডাকতাছে।
রাইসা বললো,
“এই তো আসছি।”
“আসি না, এহনি আহো সবাই। সেই কখন থাইকা সবাই নাস্তা নিয়া বইয়া আছে। সব ঠান্ডা অইয়া গেলো। উডো, শুক্রবারের দিন আর পড়ালেহা করন লাগবো না।”
রাইসা উঠে দাঁড়ালো। অলিক-রাউনাফকে বললো,
“চল, এটা ওদের হোমওয়ার্ক রইলো। যে আগে উত্তর দিতে পারবে তাকে আমি আমার পুরানো ফোনটায় এক ঘন্টার জন্য পাবজি খেলতে দিবো।”
রাইসারা নিচে এসে দেখলো বসার ঘরে সবাই বসে আছে। রাইসা মুচকি হাসলো সবাইকে দেখে। সাদাদ বললো,
“কি ব্যাপার বাবাই? কখন থেকে ডাকা হচ্ছে তোমাদের?”
“সরি বাবাই, শুনতে পাই নি। পড়া ধরছিলাম ওদের।”
সাদাদ হাসলো। অলিক আর রাউনাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি রে? তোদের মুখের অবস্থা এমন কেনো? পড়া পারিস নি?”
অলিক আর রাউনাফ কথা বললো না। গম্ভীর ভাব নিয়ে সোফায় বসলো। রাইসা বললো,
“আমি ওদের দুজনকে একটা মানসিক দক্ষতার প্রশ্ন করেছি। ওরা দুজন সেটা নিয়েই ভাবছে।”
“ও আচ্ছা৷ কি প্রশ্নরে অলিক? যেটা এতো ভাবাচ্ছে তোদের।”
“কাকাই, প্রশ্নটা কেমন যেন অদ্ভুত রকমের।”
সাদ বললো,
“কি অদ্ভুত প্রশ্ন শুনি। আমরাও চেষ্টা করবো।”
রাউনাফ বললো,
“তোমরা বললে হবে না। এই উত্তরটা আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। আপুনি শর্ত দিয়েছে-কারো সাহায্য নেওয়া যাবে না। আর যে আগে উত্তর দিতে পারবে তাকে আপুনির ফোনে এক ঘন্টা পাবজি খেলতে দেওয়া হবে।”
হাসলো সবাই। রাফসা বললো,
“কচুরিগুলো সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খাও আর কথা বলো।”
নৌশিন সবাইকে ছোটো থালায় করে কচুরি আর সরিষা ফুলের বড়া পরিবেশন করলো। রাইসা সরিষা ফুলের বড়া দেখে হাসলো। বললো,
“আমি তো ভেবেছিলাম এখন শুধু ফেসবুক স্ক্রল করলেই সরিষা ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এখন সরিষা ফুল নিজেই আমাদের বাসায় হাজির।”
রাইসা কথায় আবারো হাসতে হলো সবাইকে। রাফসা তার শশুড়ের কাছে এসে বললো,
“বাবা, আপনি সরিষা ফুলের বড়াটা অর্ধেক খান৷ সরিষা ফুলে হজমে সমস্যা হবে আপনার।”
“আরে বউ মা! কত দিন পর সরিষা ফুলের বড়া করেছো, বাঁধা দিও না। ঔষধ খেয়ে নিবো, ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবে না।”
রাইসা সোফার উপর পা তুলে খাচ্ছে। খেতে খেতে রাফসাকে ডাকলো,
“জেঠিমনি….”
নৌশিন আ রাফসা রান্নাঘরে। সবার জন্য চা তৈরী করা হচ্ছে। রাফসা সেখান থেকে জবাব দিলো,
“বলো মা।”
“আমাকে আরেকটা সরিষা ফুলের বড়া দাও, না না শুধু বড়া না আরো একটা কচুরিও দিও।”
নৌশিন বললো,
“আর না। এগুলোই খাও৷”
“আম্মু ছোটো ছোটোই তো। দাও আরো দুটো।”
“পরে রাতে খেতে চাইবে না।”
“খাবো, সত্যি বলছি। দাও প্লিজ।”
নৌশিন চা নিয়ে এলো সবার জন্য। সাথে রাইসার জন্য আরো একটা বড়া আর কচুরি।
রাইসা খুশী হলো। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো,
“জানো জেঠু, আমাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের দিন ক্যান্টিনে গিয়ে কচুরি খেয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম মজা হবে খুব। কিন্তু ঢাবির মতো ঢাবির কচুরি এতো সুন্দর নয়। তবে টিএসসির চা খেয়ে আমি বেশ মজা পাচ্ছি।”
সাদ বললো,
“তা ঠিক আছে মা। তবে তুমি বুয়েটের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস করবে না নাকি বলেছো?”
“হ্যাঁ।”
“কেনো?”
“আমি ভাবছি পরের বার আবার মেডিকেল দিবো। বুয়েটের পাশেই ঢামেক, আমি যদি এখন বুয়েটে ক্লাস করা শুরু করি তাহলে মেডিকেল কলেজ দেখে আমার খুব কষ্ট লাগবে।”
সাদাদের বাবা বললো,
“তারমানে তুমি সিউর যে আবার মেডিকেলে এক্সাম দিবে?”
“হ্যাঁ দাদু। আমি ভেবেছিলাম মাইক্রোবায়োলজিতে ভালো লাগবে আমার। সারাদিন ক্লাস আর বন্ধুদের সাথে কেটে যায় কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় খুব খারাপ লাগে আমার। মনে হয় মাইক্রোবায়োলজি না আমার এনাটমি পড়া উচিত।”
“ওকে, তোমার যা ভালো মনে হয়। তবে বুয়েটের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস টা করে আসো। আর তা ছাড়া তুমি যদি ডাক্তারই হতে চাও তাহলে বুয়েটে ভর্তি হয়ে যাও, মেডিকেল কলেজ দেখতে দেখতে তোমার ইচ্ছাটাও আরো জোড়ালো হবে।”
রাইসা দাদুর কথাটা ভাবলো। বললো,
“কথাটা খারাপ বলো নি তুমি। তবে…”
“তবে বলার কিছু নেই দাদুভাই। তোমার ঢাবি, বুয়েট যেখানে ভালো লাগে ক্লাস করো আমাদের কারো কোনো সে নেই। আর তুমি যদি মেডিকেলেই যেতে চাও তাহলে প্রথম থেকেই প্রিপারেশন শুরু করে দিও।”
“এখানেই তো সমস্যা আমার তো খালি ম্যাথ করতে মন চায়। হতে চাই ডক্টর কিন্তু করি ম্যাথ। এটার জন্য এবারে এই সমস্যাটা হলো।”
সাদাদ বললো,
“আচ্ছা, হলো অনেক পড়াশোনা হয়েছে। এবার চিল করো তো বাবাই। যা হওয়ার হইও তুমি। এখন চিন্তা করা বাদ দিয়ে খাও….”
সবাই খুশী মনে খাচ্ছে। অনেক মজা করেই খায় এই বাড়ির মানুষগুলো। গল্প, আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে এই আনন্দবেলাতেও দুটো মানুষ এখনো গম্ভীর। অলিক আর রাউনাফ। তারা খাচ্ছে, সবার কথা শুনছে অথচ তাদের মাথায় রাইসার করা প্রশ্নটা এখনো ঘুরছে। কি হবে এর উত্তর? আপনারা উত্তরটা ওদের বলে দিন তো…..
প্রেমঘোর ২
পর্ব : চার
লেখক : নার্গিস সুলতানা রিপা
রাইসা কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে। পাশে সম্মানিত লেখক আরিফ আজাদের সম্পাদিত বই – ‘প্রত্যাবর্তন’। অসাধারণ একটি বই৷ অন্ধকার আর অবিশ্বাসের কালো ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে কিছু কিছু মানুষের স্রষ্টার দিকে প্রত্যাবর্তিত হওয়ার গল্প তুলে ধরা হয়েছে এখানে। গতকাল বইটা পড়া শুরু করেছিলো রাইসা। আজ শেষ করলো। শেষ করে প্রত্যেকটা লেখক আর বইটির সাথে সংযুক্ত প্রত্যেক মানুষের জন্য দোয়া করলো মনে মনে। যারা পাঠক সমাজকে এতো সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছে মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের হইকাল ও পরকাল মঙ্গলময় করুক। রাইসা দোয়া শেষে দরূদ পাঠ করলো। এতক্ষণ বই পড়ছিলো মনোযোগ অন্যদিকে থাকায় শীত করছিলো না৷ তবে এখন শীত লাগছে৷ তাই কম্বলের নিচে মাথা ডুকালো। এপাশ-ওপাশ করেও শান্তি পেলো না। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আট টা বাজে। মায়ের ঘরে গেলো। গিয়ে দেখলো নৌশিন অলিক আর রাউনাফ দুজনকে পড়াচ্ছে। নৌশিন রোজ সন্ধ্যার পর রাউনাফ আর অরূপকে নিয়ে পড়াতে বসায়। এখন মাঝে মাঝে সময় পেলে সাদ আর সাদাদও নিয়ে বসে। কেননা ওরা দুজনেই বোর্ড পরীক্ষার্থী এবছর। রাউনাফ পিএসসি দিবে আর অলিক জেএসসি। রাইসা মায়ের ঘরে বসলো না। বসলে আবার কথা বলতে মন চাইবে, পড়ার মনোযোগ নষ্ট হবে ওদের। শুধু মায়ের কাছে জানতে চাইলো,
“কি রান্না করেছো রাতে?”
নৌশিন রাইসার দিকে তাকালো। বললো,
“খিদে পেয়েছে এখনি?”
“না এতো পায় নি৷ তবে ঠান্ডা লাগতেছে খুব। খেয়ে নামায পড়ে শুয়ে পড়বো।”
“একা একা খাবে?”
“হুম। তোমরা তো পরে খাবে, আমি ঘুমিয়ে যাবো আগেভাগে।”
“আচ্ছা, তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”
“আসতে হবে না, তুমি পড়াও ওদের। আমি নিজে নিয়ে নিবো। কি কি করেছো?”
“রুটি, ভাত দুটোই আছে। আচ্ছা, যাও তুমি আমি আসছি।”
নৌশিন অলিক আর রাউনাফকে লিখতে দিয়ে রাইসাকে খাবার দিতে গেলো। রাইসা রুটি খুব একটা পচ্ছন্দ করে না। তার পচ্ছন্দ তালিকার শীর্ষে রয়েছে খিচুরী আর ভোনা গোস্ত। এগুলো অবশ্য আজকে রান্না করা হয় নি। রাইসা ভাত নিলো, সাথে দুপুরের গোস্ত তরকারী, এক ফালি লেবু আর ঘন মসুর ডাল। রাইসা খাওয়া শেষ করে নামায আদায় করলো। তারপর ঘুমাতে যাওয়ার পালা।
রাগ এগারোটা বাজে প্রায়। রাইসা ঘুমের মাঝে কিছুটা হলেও টের পেয়েছে যে রাউনাফ তার পাশে এসে শুয়েছে মাত্র৷ রাউনাফ এমনিতে আলাদা থাকে সারাদিন কিন্তু রাতের বেলা রাইসাকে ছাড়া ঘুমাতে চায় না। বাসার সবাই কত বলে অলিকের সাথে ঘুমাতে কিন্তু সেখানে খুব বেশি হলে সপ্তাহে একদিন। আর বাকী ছয়দিন রাইসার কাছে। রাইসা গভীর ঘুমের দিকে যাচ্ছে৷ আর তার ভাই নতুন করে প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ তো পাঠ্য পড়া হয়েছে, এবার প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে হবে। রাউনাফ খাতা কলম নিয়ে কিছুক্ষণ খুটুর খুটুর করলো। ভালো করে মনেযোগ দিলে হয়তো মাথায় উত্তরটা আসতেও পারতো। তবে সেটা হচ্ছে না, কারণ রাউনাফের মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। সে অপেক্ষা করছে কখন বারোটা বাজবে। তারপর সে তার নিজের কাজটা করবে। রাউনাফ একটু একটু ঘুম পাচ্ছে তারপরও সে জেগে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আর মাত্র সাত মিনিট আছে। এখন কাজটা করাই যায়।
রাইসা ঘুমাচ্ছিলোই৷ কিন্তু হঠাৎ অনুভব করলো আগের সেই উষ্ণতাটা এখন কাজ করছে না। অভ্যাসবসত হাত বাড়িতে রাউনাফকে কাছে টানতে চাইলে বুঝতে পারলো রাউনাফ তার পাশে নেই। মিটমিট করে চোখ খুললো রাইসা। রাউনাফ কি আজ ওর সাথে ঘুমায় নি? মনে করার চেষ্টা করলো রাইসা। রাইসার স্পষ্ট মনে হচ্ছে রাউনাফ তার পাশে এসে শুয়েছিলো। তাহলে এখন কোথায় গেলো। রাইসা টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। ঘড়িতে দেখলো ১২.০৫ বাজে। শহরে আহামরি রাত নয়। তবে রাউনাফ এগারোটার পর জেগে থাকে না। আর যখন জেগে থাকে তখন তার কোনো উদ্দেশ্য থাকে।
এইতো রাউনাফ তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। রাইসার এসএসসি পরীক্ষা তখন। একটার দিকে পড়া শেষ করে ঘুমাতে যায় রাইসা। ফেব্রুয়ারির রাত, গ্রামঅঞ্চলে হালকা পাতলা ঠান্ডা থাকলেও ঢাকা শহরে গরম। এতোটাও গরম ছিলো না অবশ্য। রাইসা ফ্যানটাকে ফুল স্পিডে চলতে দেখে পাওয়ারটা একটু কমিয়ে দেয়। সেদিন বিকালে রাউনাফের সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া হয় তার, এক-পর্যায়ে রাইসা রাউনাফে একটা থাপ্পরও দিয়েছিলো। যদিও দোষটা ছিলো রাউনাফের তারপরও সে জেদ ধরেছিলো। তাই অপেক্ষা করছিলো রাইসাকে শাস্তি দিবে সে। আর মাঝরাতে যখন রাইসা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফ্যানের স্পিড কমালো তখনি বুদ্ধিটা মাথায় এলো রাউনাফের। রাইসা শুয়ার দশ মিনিট পরেই উঠে বসলো সে। রাইসা কয়েলের গন্ধ নিতে পারে না, রাউনাফ একা একা নিচে গিয়ে কয়েল জ্বালিয়ে নিয়ে এলো। যদিও আধো আলো-আঁধারিতে ভয় করছিলো ওর কিন্তু বোনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভয়কে পাত্তা দেয় নি। কয়েল জ্বালিয়ে রুমে নিয়ে এসেছে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর একটা সাদা কাগজের উপর জলন্ত কয়েল রেখে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলো। সে জানতো সকাল হলে ও ধরা পড়বে। আম্মুর কাছে বকাও খেতে হবে এর জন্য। কিন্তু তাতে ওর কিচ্ছু যায় আসে না। আপুনিকে তো শায়েস্তা করা যাবে! এতেই তার শান্তি। রাউনাফের শাস্তি দেওয়ার বুদ্ধি কাজে লেগেছিলো। রাত প্রায় আড়াইটার দিকে কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যায় রাইসার। সে ভেবেছিলো রাতের বেলা ভোল্টেজ বেশি হয়ে গেছে তাই হয়তো পাখা এতো জোরে ঘুরছে। লাইট জ্বালাতেই দেখলো ঘরটা ধোঁয়াধোঁয়া। কিছুটা ভয় পেয়েছিলো রাইসা। ঘটনা বুঝে উঠার আগেই হাঁচি শুরু হয়ে যায় তার। উঠে গিয়ে পাখা বন্ধ করে। কিন্তু ধোঁয়া কোথা থেকে আসছে। চারপাশ তাকাতেই দেখলো কাগজ আর কয়েল পোড়া দেখতে পেলো সে। এখান থেকেই ধোয়া হচ্ছে আর এজন্যই গন্ধ লাগছিলো। রাইসা পানি ঢেলে কয়েল নিভালো। একের পর এক হাঁচি আসছে। কে জানে কখন কয়েল জ্বালানো হয়েছে। এর্লাজির কার্যকলাপ শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রাইসা জানে এই কাজটা রাউনাফ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। বিকালের থাপ্পের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছে সে। রাইসা ইচ্ছা হলো রাউনাফকে টেনে হিঁচড়ে আম্মুর কাছে নিয়ে যাক। কিন্তু নিজের ভাই তারউপর আবার ছোটো মানুষ; মায়া করছিলো। তাই কিছু না বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। কিন্তু হাঁচির জন্য ঠিক মতো ঘুমাতে পারে নি। সকাল বেলা রাইসার চোখ মুখের অবস্থা দেখে নৌশিন জানতে চায়, আর কাজের মেয়ে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে পোড়া কাগজ আর কয়েল পেয়ে জানায় নৌশিনকে। নৌশিন বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলো রাউনাফের উপর। কিন্তু সকাল বেলা স্কুল থাকায় বকা খেয়েছিলো শুধু না হয়ে পিটুনি খেতো। সেদিন সকালে জীববিজ্ঞান পরীক্ষা ছিলো রাইসার। এর্লাজির ঔষধ খেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলো। তারপরও ঠিকমতো না ঘুমাতে পারার কারণে আর সঙ্গে হাঁচি তাই খুব কষ্ট করে পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো তাকে।
রাইসা ঘটনা মনে করতে করতে উঠে বসলো। কোথায় যাবে রাউনাফ। আম্মুর ঘরে চলে গেলো? নাকি ওয়াশরুমে। রাইসা ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো রাউনাফ নেই। বাইরে যেতে চেয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লাগনো। তারমানে রাউনাফ ভেতরেই আছে। রাইসার ঘরটা বেশ বড়, আর বারান্দাটাও। রাইসা ভালো মতো কান পারলো। পুনপুন আওয়াজ শুনতে পেলো। রাউনাফ কথা বলছে। কিন্তু তার সাথে? রাইসা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাউনাফের কানে ফোন! এতো রাতে ফোনে কার সাথে কথা বলছে ও? রাইসা কথা না বলে এগিয়ে গেলো। কিছুটা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলো রাউনাফ বলছে,
“আমি যে তোমার কাছে প্রশ্নের উত্তরটা জেনে নিলাম বাসায় কাউকে বলো না৷ তাহলে আপুনি আমাকে পাবজি খেলতে দিবে না।”
ফোনের ওপাশে কে ধরতে পারলো না রাইসা। ওপাশ থেকে কি উত্তর এলো সেটাও ধরতে পারে নি। তবে রাউনাফ যে জেতার জন্য IQ টার উত্তর অন্য কারো কাছ থেকে জেনে নিলো লুকিয়ে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সে। রাইসা রাউনাফকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। ভয় পেয়ে গেছে রাউনাফ। রাইসা জানতে চাইলো,
“কার সাথে কথা বলছিস? তাও আবার লুকিয়ে?”
রাইসা ফোন স্ক্রিনে ক্লিক করতেই দেখতে পেলো-কলটা মেসেঞ্জারে করা হয়েছে। আর আইডি নেম – ‘Mustafizur Chowdhury Arup’ রাইসা সাথে সাথে কলটা কেটে দিলো। অরূপ রাইসার ফেসবুক বন্ধুতালিকায় থাকলেও তাদের দুজনের মধ্য কখনো কল বা চ্যাট হয় নি। যা মাঝেমাঝে কথা হয় ফোনে সেটা নৌশিন বা রাইসার ফোনে। রাইসা রাগী চোখে তাকলো রাউনাফের দিকে। রাউনাফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাইসা বললো,
“তুই এতো রাতে ভাইয়াকে কল করেছিস কেনো?”
রাউনাফ নীচুগলায় বললো,
“কানাডায় তো একটু আগে রাত হয়েছে।”
“তুই আমার ফোনের ডাটা অন করে ভাইয়াকে কল করেছিস তাও আবার লুকিয়ে। এটা কি ঠিক করেছিস তুই?”
রাউনাফ ভয় পাচ্ছে। উত্তর দিলো না। রাইসার রাগ হচ্ছে খুব। তারপরও আর কিছু বললো না রাউনাফকে। চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। রাউনাফ তখনো বারান্দায় দাঁড়ানো। সে বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত? আপুনি কি সব শুনে ফেলেছে? যদি শুনে থাকে তাহলে কি খুব বেশি রাগ করছে?
রাইসা ডাকলো রাউনাফকে,
“ঠান্ডার মাঝখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এসে শুয়ে পড়।”
রাইসার খারাপ লাগছে। রাউনাফকে সকালে কিছু বলতে হবে। তা না হলে এই যে লুকিয়ে ফোন নিয়ে কথা বলা আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্য সে নিজে কষ্ট না করে একরকম চুরি করেছে সে।
রাউনাফ গুটিগুটি পায়ে এসে কম্বলের নিচে ডুকলো। প্রচণ্ড রকমের ভয় পেয়ে আছে সে। আপুনির খুব বেশি রাগ হলে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আর তখন খুব বেশি কষ্ট হয় রাউনাফের। আপুনি একটা থাপ্পর দিক তারপরও কথা বলুক। রাউনাফ রাইসাকে স্পর্শ করতে চাইলো, সরি বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার আগেই রাইসার ফোন বেজে উঠলো। রাইসা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অরূপ ফোন করেছে। এখন কি করবে রাইসা? তখন ওভাবে ফোন কেটে দিলো, অরূপের সাথে রাগ করার তো কিছু নেই। এখন কি আবার ফোনটা কেটে দিবে? ফোনে কথা বলতে খুব একটা ভালো লাগে না রাইসার। তারউপর অরূপের সাথে কথা বলতে এক রকম লজ্জা কাজ করে ওর মাঝে। ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো। রাইসা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ডাটা টা অফ করতে যাবে আবার তখনি কল বেজে উঠলো। এই শীতের রাত, আর মনের ভেতরের প্রচণ্ডরকমের খুচখুচানিতে শরীর কাঁপতে লাগলো রাইসার। এই অবস্থাতেই কলটা রিসিভ করলো রাইসা। কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
“হ্যালো।”
চলবে…