প্রেমঘোর ২, পর্ব-২

প্রেমঘোর ২
পর্ব : দুই
লেখক : নার্গিস সুলতানা রিপা

রাইসা ঘুমাচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষার পড়াশোনা, বিয়ের আয়োজন সব মিলিয়ে অনেক ধকল গেছে বেশ কয়েকদিন। তুবার বউভাতে ময়মনসিংহ গিয়েছিলো। সেখান থেকে ফিরে দুই দিন যাবত বিকালে বেশ লম্বা সময় নিয়ে ঘুমায়। তুবা আর কিরণ ফিরতি অনুষ্ঠানের পর আজ সকালে সিলেট বেড়াতে গিয়েছে। আলিভা একবার না বুঝেই বায়না ধরেছিলো সেও যাবে। অবশ্য সে ভেবেছিলো তুবা তার বর সহ তাদের বাড়িতে যাচ্ছে-তাই জেদ ধরে ছিলো। কিন্তু তারপর জানলো তারা বাড়ি যাচ্ছে না, রির্সোটে যাচ্ছে তখন আর জেদ করে নি। আলিভা ততটাও অবুঝ নয়।

আসরের আযান শুনে ঘুম ভাঙলো রাইসার। ওযু করে নামায পড়ে মায়ের ঘরে গেলো৷ নৌশিন তখনো জায়নামাজ থেকে উঠে নি৷ রাইসা শুয়ে পড়লো মায়ের বিছানায়। নৌশিন জায়নামাজ থেকে উঠে বললো,
“আবার কেনো শুচ্ছো?”
“উমম, এমনি। শরীর এখনো মেচমেচ করছে। মনে হয় আরো একটু ঘুমাই।”
“ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন দিন আরো বেশি চিকন হয়ে যাচ্ছো।”
রাইসা হাসলো। বললো,
“বেশি চিকন তো না আম্মু।”
“হুমম, আমাকে আর বলতে হবে না। বেশি ঘুমালে ক্ষুদা গ্রন্থির কার্যকারিতা কমে যায় আর এজন্যই তোমার খাওয়া কমে যাচ্ছে।”
“আমি কোথায় এতো কম খাই আম্মু? তিন বেলা তো ঠিকই খাই।”
“হুম তা তো দেখাই যাই। এখন উঠো তো, যাও বাগানে হাটাহাটি করো একটু।”
“বাগানে! সে উপায় আছে? রাউনাফ আর অলিক কাকে কাকে নিয়ে এসে ক্রিকেট খেলতেছে। আমি বাগানে যাওয়ার জন্যই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। তারপর জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি বাগানে পুরো ক্রিকেট টিম।”
“রাউনাফ আর অলিক বাগানে?”
“হ্যাঁ, দেখো।”
নৌশিন জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। রাইসাকে ঘরে বসিয়ে রেখে বাগানে গেলো। অলিক আর রাউনাফকে বকলো বেশ খানিকটা। নামাযের সময় হয়েছে এখনো খেলছে-তাই। রাউনাফ আরো একটু খেলার বায়না করছিলো। নৌশিন কথা শুনলো না, খেলা থামিয়ে সবাইকে বাসায় চলে যেতে বললো। রাগ হলো রাউনাফের। তবে মায়ের উপর না, বোনের উপর। কেননা রাইসা যখন জানালায় দাঁড়িয়েছিলো রাউনাফ এক নজর দেখেছিলো তাকে।
দুই ভাই বাসায় ফিরে একসাথে আসরের নামাজ আদায় করলো। আর নৌশিন ডুকলো রান্নাঘরে। রাইসা বসার ঘরে টিভি চালু করেছে তখন৷ পাঁচটার খবর হচ্ছিলো-সেটাই দেখছিলো। এরমধ্য রাউনাফ এসে হাজির,
“আপুনি রিমোট দে।”
রাইসা টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে জবাব দিলো,
“পরে, দাড়া খবরটা দেখে নিই।”
রাউনাফ কথা বললো না। রাইসার একপাশে রাখা লম্বা বেনুনী ধরে দিলো হেঁচকা টান,
“খবরে কি দেখিস এতো, দে।”

রাইসা ব্যথা পেয়ছে। রাউনাফ এই কাজটা প্রায় সময় করে। রাইসা যদি তার কথার উনিশ থেকে বিশ কসলো বা রাইসার কোনো কাজ রাউনাফের ভালো লাগলো না তখনি সব অত্যাচার চলে রাইসার চুলের উপর। এক্ষুনি ঠিক তাই হলো। রাইসা ছলছল রাগী চোখে তাকালো রাউনাফের দিকে। বললো,
“থাপ্পর চিনিস? সব সময় খালি বেয়াদবি!”
“আমি তো বেয়াদপ। তুই আম্মুর ভালো মেয়ে তাই না?”
“আম্মুকে ডাকবো আমি? যা এখান থেকে।”
“ডাক, ডাক। আম্মু তোর একার? আম্মু আমারও।”
“রাউনাফ! যা এখান থেকে না হলে সত্যি সত্যি থাপ্পর খাবি কিন্তু।”
রাউনাফ গেলো না। বরং ভেঙচি কাটলো রাইসাকে। রাইসা সাথে সাথে হাতের রিমোট দিয়ে আস্তে করে একটু আঘাত করলো তার হাতে। আর সাথে সাথে কেঁদে ফেললো রাউনাফ। রাইসা জানে-এটা অভিনয়ের কান্না। আম্মু যেনো এসে রাইসাকে একটু বকা দেয় এরজন্যই রাউনাফের এতো কারসাজি। রাউনাফ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে নৌশিনকে সাথে কান্না তো আছেই। নৌশিন হাতের কাজ ফেলে বসার ঘরে এলো। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই রাউনাফ বললো,
“আপুনি আমাকে মেরেছে। ওর হাতের রিমোট দিয়ে তিনটা পিটুনি দিয়েছে আমাকে।”
রাইসা বললো,
“আল্লাহ! মাত্র না নামায পরে আসলি তুই? এভাবে মিথ্যা বলছিস? আম্মু ও আমার চুল ধরে টেনেছে তাই একটু আস্তে করে হাতে আঘাত করেছি। বেশি জোরেও তো দিলাম না, তারপরও এমন অভিনয় করছে।”

নৌশিন রাউনাফের দিকে তাকালো। বললো,
“আপুনির চুলে ধরেছো কেনো আবার?”
“আপুনিও তো মেরেছে আমায়।”
“আচ্ছা বুঝলাম মেরেছে। আপুনি আগে মেরেছে না তুমি মেরেছো?”
“তাহলে আপুনি তোমাকে বিচার কেনো দিয়েছে? আমি তো খেলছিলাম৷ তাই মেরেছি।”
নৌশিন রাগী চোখে তাকালো রাউনাফের দিকে। বললো,
“তোমার আপুনি বিচার দেয় নি। আর তুমি তো নামাযের সময় খেলছিলে তোমার আপুনি বিচার দিলে ভালো করতো, তা না হলে নামায মিস হতো তোমার।”
রাউনাফ রাইসার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কিছু না বলে নৌশিন চলে গেলো রান্না ঘরে। রাইসা ডাকলো ভাইকে,
“আয় বস, কি দেখবি?”
রাউনাফ ঝারি দিলো,
“আমার দেখতে হবে না, তুই ই দেখ।”

রাউনাফ চলে যায়। রাইসা পাত্তা দিলো না। খবর শেষ, গান শুরু হয়েছে। রাইসা এই জিনিসটা নিতে পারে না, গান শুনতে অসহ্য লাগে ওর। “গান হলো অন্তরের মদ” এই কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে রাইসা। অনেককে দেখা যায় মন খারাপ হলে নানা রকমের স্লো মিউজিকের সেড সং শোনে। সাথে পরিবেশ তো আছেই-অন্ধকার রুম আর দু কানে হেড ফোন। পরিণতিতে দুনিয়ার সব কষ্ট মনে হয় আর এতো কান্না পায় যে কান্না শেষ হওয়ার পরের দিনও মাথা ব্যথা করে। অথচ গল্পটা যদি এমন হতো…মন খারাপের সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে জায়-নামায বসে ভক্তি আর বিশ্বাসে পরম করুণাময়ের কাছে সেজদা করা হয়, প্রার্থনা করা হয় তাহলে আর কষ্টগুলোই থাকে না। সমস্ত কষ্ট ঝরে যায়, নতুন আশায় ঘুরে দাঁড়ানো যায় আবার।

রাইসা টিভি বন্ধ করে দিলো। নৌশিন চা নিয়ে এলো। মা, মেয়ের চা আড্ডায় যোগ দিলো রাইসার দাদুও। এমন সময় নৌশিনের ফোন বাজলো। অরূপ ফোন দিয়েছে। ভিডিও কল। রিসিভ করলো নৌশিন। রাইসা পাশ থেকে একটু সরে বসলো যেনো ওকে দেখা না যায়। অরূপ সালাম দিলো নৌশিনকে,
“আসসালামু আলাইকুম, নতুন বউ কেমন আছো?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মেয়ে কই? ও নাকি মেডিকেলে লাড্ডা পাইলো, কই দাও তো ওর কাছে ফোনটা।”
নৌশিন হাসলো। রাইসার দিকে ফোন ঘুরাতেই বললো,
“আমি বলবো না কথা। ভিডিও কল না।”
নৌশিন জোর করলো না। রাইসা চা শেষ করে উঠে চলে গেলো। অরূপ বললো,
“এমনিতে লজ্জা পায়। এখন আবার লাড্ডা খাইছে ডাবল লজ্জা হা হা হা। আবার আরেক কাজ তো ভালোই করছে ঢাবি তে এগারোতম। তোমার মেয়েকে বলো-কি লাগবে ওর? ঢাবিতে স্ট্যান্ড করছে, আমারও আগে সিরিয়াল কিছু একটা দেওয়া উচিত।”
“না বাবা, কিচ্ছু লাগবে না ওর। তুই কি করছিস?”
“কেনো লাগবে না। ও কি বায়না করে না এখন?”
“না করে আবার! কিছু পচ্ছন্দ হলেই কানের কাছে পুনপুন করা শুরু করে।”
“ওর কি মোবাইল জানি?”
“POCO. আগে Vivo ছিলো তারপর তোমার বাবা ঢাবির রেজাল্ট দেওয়ার পর শপিং এ নিয়ে গেছিলো-খিমার কেনার জন্য।”
অরূপ প্রশ্ন করলো,
“খিমার? এটা কি?”
“এখন বাংলাদেশ নতুন একটা বোরকা বের হয়েছে, সেটাই।”
“ও, তাই বলো। আমি ভাবলাম কি না কি!”
“হুম, তো খিমার কিনেছে। তারপর মলে গিয়ে ফোনের মডেল দেখে পচ্ছন্দ হয়েছে নাকি, বলেছে ওর জেঠুকে। গিফ্ট দিলো।”
“রাইসারই দিন এখন।”
হাসলো নৌশিন। অরূপ বললো,
“মন খারাপ করেছে সে? মন খারাপ করতে দিও না। ঢাবি বেস্ট, মেডিকেল হয় নাই ভালো হইছে। বুয়েটে এক্সাম দিবে ও না? ম্যাথ এতো ভালো পারে শুধু শুধু মেডিকেল কোচিং এ যে কোনো এডমিট করালা ওকে!”
“আমিও তাই বলেছিলাম, এতো ভালো ম্যাথ পারে বুয়েট কোচিং-ই করুক। ওর ইচ্ছা মেডি লাগবে।”
“আচ্ছা ওর যা ভালো লাগে। বুয়েটে এক্সাম তো দিবে? আগামীসপ্তাহে তো পরীক্ষা তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু পরে না তো।”
“আচ্ছা না পরলো, ম্যাথ-ট্যাথ দেখে এক্সামটা দিতে বইলো।”
“হ্যাঁ, এক্সাম দিবে বললো।”
“আচ্ছা, অলিক আর রাউনাফ কেমন আছে? আর দাদু?”
“সবাই ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। রাউনাফ রাইসার সাথে ঝগড়া করে উপরে বসে আছে। কি যে জ্বালায় রে বাবা! সারাক্ষণ দুইজনে মিলে আমার মেয়েটাকে তছনছ করে রাখে। রাইসা তো সহ্য করতে না পেরে মাঝে মাঝে কেঁদে দেয়।”
“হা হা, কি আর করার। আম্মুকে ফোন দিলাম-রোগী দেখতেছে।”
“হ্যাঁ, এই যে তোমার দাদু…চা খায়। চিনি একটু কম দিলেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।”
দাদা-নাতির মাঝে আবেগের আদান-প্রদান হলো বেশ খানিকক্ষণ।

ছেলেটা ফোন করলে ভালোই লাগে। ঢাবিতে চান্স হওয়ার এক বছর পরই একটা বৃত্তি পেয়ে কানাডায় চলে গেছে সে। সেখানেই নিউক্লওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া শেষ করে। এখন একজন শিক্ষানবিশ গবেষক সে। ব্যাস আর দেড়-দুই বছর তারপর বাংলাদেশে চলে আসবে। ইচ্ছা আছে কোনো ভার্সিটিতে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার পড়াবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here