প্রেমঘোর ২, পর্ব-৮

প্রেমঘোর ২
পর্ব : আট
লেখক : নার্গিস সুলতানা রিপা

“একটু ঐদিকে যা।”
রাউনাফে হালকা ঠেলে দিয়ে বললো রাইসা।
রাউনাফ জানালো,
“আমি যেতে পারবো না। তুই যা।”
“তুই সব সময় এমন করিস কেনো ভাই? যা না একটু ঐদিকে, তোর পাশে তো অনেক জায়গা খালি, আমি ঘুমের মধ্যে পড়ে যাবো তো।”
“পড়ে যা সমস্যা নাই শুধু মরিস না।”
“কেনো আমি মরলেই তো ভালো। আম্মু তখন সব আদর তোকে করবে।”
“না করবে না। তুই মরে গেলে আম্মু বলবে, ‘আমার রাইসা মা টা কি ভালো ছিলো! তুই কেনো ওর মতো হলি না?’ বুঝলি?”
রাইসা ফিক করে হাসলো। রাউনাফ পাশ ফিরে বললো,
“হাসছিস কেনো?”
“তুই একটা পাগল। আর পাগলের কথা শুনে সবাই হাসে।”
“আমি পাগল, তুই ভালো। ভালো আর পাগলের কখনো মিলমিশ হয় না। তুই তাহলে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমা।”
“ইশশ। তোর সমস্যা হলে তুই যা।”
“না তুই যা।”
“দেখ রাউনাফ, এতো রাতে শুধু শুধু বকবক করিস না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়। দেখি, ভালো করে কম্বল নে…”
রাইসা রাউনাফের গায়ে কম্বল ঠিক করে দিলো। আর রাউনাফ পা দিয়ে রাইসার গায়ের কম্বল ফাঁকা করে দিলো।
“কি করলি এটা?”
“তুই অন্য রুমে চলে যা আপুনি। আমি তোর সাথে থাকবো না। তোর জন্য আম্মু আজকেও মেরেছে আমায়।”
“আম্মু আমার জন্য তোকে মারে নি। তোর জন্যই আম্মু তোকে মেরেছে। একটু ঠিক হয়ে থাকতে পারিস না তুই?”
“তুইও তো আমাকে কত মারিস। কই, আম্মু তো তখন তোকে মারে না? কিন্তু আমি যদি তোকে মারি তাহলে আম্মু আমাকে বকে আর আজকে মারলোও।”
“আমি তোকে কোনোদিন জোরে মেরেছি? আর তুই দেখ, ধরে দেখ হাত দিয়ে এখনো আমার মাথাটা কতটা ফুলে আছে।”
রাউনাফ হাত দিয়ে দেখলো, সত্যিই অনেক ফুলে গেছে। মায়া লাগলো রাউনাফের। বললো,
“অনেক ব্যথা পেয়েছিস?”
“না পেলে কাঁদলাম কেনো?”
“ও, তাও তো ঠিক। আমি তো মাঝে মাঝে ব্যথা না পেলেও কাঁদি।”
রাইসা শব্দ করে হাসলো।
“আমি তো তোর মতো নাটক করতে পারি না।”
“নাটক করবি তুই?”
“কি বললি?”
“বললাম নাটক করবি? তুই না ডাক্তার না হয়ে নায়িকা হলে ভালো হবে আপুনি।”
“কেনো?”
“তোকে অনেক সুন্দর দেখতে।”
মুচকি হাসলো রাইসা। বললো,
“তাই?”
“হ্যাঁ, সত্যি বলছি।”
“তুই তো আমাকে পচ্ছন্দই করিস না। তাহলে সুন্দর বললি কেনো?”
“পচ্ছন্দ করি না কখন বললাম? তোকে না দেখলেও আমার ভালো লাগে না আর তোকে না কাঁদলেও ভালো লাগে না আমার।”
রাইসা রাউনাফের চুল টেনে দিয়ে বললো,
“তুই সত্যিই পাগল।”
রাউনাফ সরে গিয়ে রাইসাকে শোয়ার জায়গা দিলো। রাইসা ভালো করে কম্বল জড়িয়ে নিলে রাউনাফ ওর ঠান্ডা পা দুটো রাইসার পায়ের সাথে প্যাঁচিয়ে বললো,
“আপুনি?”
“কি?”
“তুই আসলেই অনেক সুন্দর।”
“আচ্ছা, হয়েছে এখন ঘুমা।”
“একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দে…”
“তুই না আমাকে ঘর থেকে চলে যেতে বললি তাহলে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলছিস কেনো?”
“ওটা তো রাগে বলেছি।”
“এখন রাগ কমে গেছে?”
“হুম।”
“আম্মু যে মেরেছে খুব ব্যথা পেয়েছিলি?”
“না, অল্প। বাবাইকে দেখে ইচ্ছা করে বেশি বেশি কেঁদেছি।”
রাইসা হাসলো। দেখাদেখি রাউনাফও হেসে ফেললো। রাইসা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো রাউনাফের চুলে। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো রাউনাফ। রাউনাফ ঘুমিয়ে গেলে কিছু সময় ফেসবুকে ঘুরাঘুরি করলো রাইসা। তারপর দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে এক সময় সে ঘুমিয়ে যায়।

রাইসা ‘উন্মেষ’ (মেডিকেল ভর্তি কোচিং)-এ কোচিং করছে সেকেন্ড টাইমের জন্য। আগেরবারও এখানেই করেছিলো। পারফরম্যান্সও ভালো ছিলো। কিন্তু ভাগ্য আর পরীক্ষায় প্রশ্নত্তোরে রাইসা নিজেই কিছু সমস্যা করে ফেলেছিলো তাই ওয়েটিং লিস্ট। রাইসার কোচিং এ পরীক্ষা আজ। পরীক্ষা শেষ করে রিকশা করে বাড়ি ফিরতে হবে আজকে। একটা গাড়ি সাদাদ নিয়ে গেছে, সাদাদকে দিয়ে এসে সে গাড়ি আবার রাউনাফকে আনতে যাবে। আর একটা রাফসাকে নিতে হয়েছে, মেডিকেল বোর্ডের কোনো একটা জরুরি মিটিং হবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। সেখানে থাকতে হবে রাফসার। আর তৃতীয় গাড়িটা নষ্ট হয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে। তাই রাইসাকে রিকশা করে কোচিং এ আসতে হয়েছে আজ। যদিও বাসা থেকে কোচিং খুব একটা দূরে নয়। তারপরও রিকশায় খুব একটা চড়া হয় না রাইসার। আর যখন চড়ে সাথে মা বা জেঠিমনি থাকে। কিন্তু আজ রাইসা বলেছে সে একা একাই আসবে। তাই নৌশিন আর কিছু বলে নি। একা একা চলেও শেখা উচিত।
পরীক্ষা শেষ করে রিকশার জন্য দাঁড়িয়েছে রাইসা। পাশে একটা চায়ের দোকান। কিছু যুবক ছেলে বসে আছে সেখানে। রাইসা সব-সময় বোরকা পড়ে চলাফেরা করে। তারপরও রাইসার মনে হলো ছেলেগুলো অদ্ভুতরকমভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাইসা হেটে ওভারব্রিজের দিকে আসছে। ঐপাশ থেকে তাড়াতাড়ি রিকশা পাওয়া যাবে। চলতে পথে ও শুনতে পেলো দোকানের ছেলেগুলোর মাঝ থেকে একজন বাকীদের বলছে,
“বোরকা পড়ছে খালাআম্মাগোর মতো। মাগার, ভেতরে কিন্তু কচি মাল…..”
রাইসার প্রচণ্ড রকম খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। ছিহ্! মানুষের ভাষা এতো খারাপ হয় কেনো? ভাষা তো মনের ভাব প্রকাশ করে। নিশ্চয় লোকগুলোর মনও তাদের ভাষার মতো কুলশিত তা না হলে এমন ভাষা মুখে আসতো না কখনো। রাইসা এপাড়ে এসে রিকশা পেয়ে গেলো। রিকশায় উঠে ভাবলো,
‘আর কখনো গাড়ি ছাড়া বের হবো না।’
পরক্ষণেই ওর মনে হলো ওর হয়তো গাড়ি আছে। তাই রাস্তায় ওকে এসব বাজে কথা শুনতে হবে না। কিন্তু যদি কোনোদিন গাড়ি ছাড়া বের হয়? আজকের মতো কি সেদিনও? আর যারা রোজ রোজ রাস্তায় পায়ে হাঁটে, রাস্তার ধারে রিকশা বা বাসের জন্য অপেক্ষা করে? সেসব মেয়েদের? ওদেরও তো রোজ এমন কত কত অপমানজনক কথা শুনতে হয়। যদি এমন হতো, খালি পায়ে হেটে প্রতিটি মেয়ে সম্মানের সাথে পথ চলতে পারতো! কুশলিত মানুষগুলোর মনে থাকতে আল্লাহ ভীত, নারীদের প্রতি সম্মান, মনে ভালোবাসা কতই না সুন্দর হতো। ভাবতে ভাবতে রাইসা খেয়াল করো রিকশা বাসার সামনে এসে গেছে প্রায়। রাইসা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে কফি খেলো একটু। রাইসা কখনো একটু কফি খায় না। আজ অর্ধেকেরও কম খেয়েছে। নৌশিন বললো,
“কি পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?”
“না আম্মু, ভালো হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।”
“তাহলে মন খারাপ কেনো?”
“ভালো লাগছে না আমার।”
“কেনো? কফি ভালো হয় নি? অর্ধেক খেলে যে।”
রাউনাফ ড্রয়িং রুমে বসে অংক করছিলো। রাইসা আর নৌশিনের কথার মাঝে কথা বললো ও,
“তোর কি মাথা ব্যথা করছে?”
“না।”
“তাহলে কি হয়েছে।”
“কিছু না রে। অংক কর তুই।”
রাইসা উঠে চলে আসলো। বারবার ছেলেটার বাজে কথা মনে হচ্ছে। মাথা থেকে সরাতে চাচ্ছে, কিন্তু তারপরও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নৌশিন রাউনাফকে কি কি অংক করতে হবে দেখিয়ে দিয়ে বললো,
“বাবা, তুমি অংকগুলো করো। আমি দেখে আসি, তোমার আপুনির কি জ্বর হলো কি না?”
“আচ্ছা।”
রাউনাফ অংক করছে। নৌশিন রাইসার ঘরে এলো। রাইসা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নৌশিন জানতে চাইলো,
“কি হয়েছে?”
“তেমন কিছু না আম্মু।”
“তেমন কিছু না, তারমানে কিছু একটা হয়েছে।”
“আমাদের গাড়িটা গ্যারেজ থেকে দিয়ে যায় নি?”
“না পরশুদিন দিয়ে যাবে।”
“আম্মু, তোমারও না একটা গাড়ি আছে। সেটা কেনো বাইরে? আমরা কেনো ব্যবহার করি না সেটা?”
“আমাদের বাসায় তো তিনটা গাড়ি আছে। সবগুলো তো লাগে না। তাই তোমার দাদু আর আর আমারটা বাইরে চলে।”
“ও, সেখান থেকে টাকা পাই আমরা?”
“তুমি এগুলো কেনো বলছো? কি হয়েছে?”
“না বলো না। আমরা কি টাকা পাই সেখান থেকে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেসব টাকা দুটো এতিমখানায় দেওয়া হয় মা। কেনো? তুমি কি একটা গাড়ি চাচ্ছো সব সময়ের জন্য?”
“বিষয়টা তেমন না আম্মু।”
“তাহলে? কি হয়েছে? বলো আমাকে।”
রাইসা নৌশিনকে জড়িয়ে ধরলো। মন খারাপ করা কণ্ঠে বললো,
“আমার খুব খারাপ লাগছে আম্মু।”
“কেনো? কি হয়েছে মা?”
“রাস্তায় একজন বাজে কমেন্ট করেছে?”
“কি?”
“হ্যাঁ।”
“কে?”
“আমি চিনি না আম্মু। আমি যখন রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন চা স্টল থেকে…..”
“বাজে মানুষের বাজে মন্তব্য, এরজন্য মন খারাপ করো না মা।”
“আমি করতে চাচ্ছি না। কিন্তু….”
“কি বলেছে?”
রাইসা অনেক সময় নিয়ে আমতা আমতা করে আম্মুর কাছে কথাটা বললো। নৌশিন আশাহত হলো খুব। রাইসা খিমার, হাতমোজা আর পায়ে গরম-শীত সব সময় ক্যাচ পড়ে শুধু চোখদুটোই যা দেখা যায়। রাইসাকে এমন করে পর্দা করতে কেউ বলে নি। সে নিজেই আগ্রহী হয়ে এইপথে চলছে। তারপরও কিছু নিচু মন মানসিকতার লোক!
নৌশিন রাইসাকে বুঝালো অনেকক্ষণ। রাইসার মন আগের চেয়ে অনেক হালকা লাগছে।

রাতের সাদ আর রাফসার কিছু একটা নিয়ে কথাকাটি হয়েছে। বাইরে থেকে যা বুঝা যাচ্ছে, অরূপকে নিয়েই দুজনের ঝগড়া হচ্ছে। রাফসা রাগে কথা বলছে না সাদের সাথে। সাদ অরূপকে কল দিয়েছে,
“কি অবস্থা তোমার? তুমি কি এক সপ্তাহের জন্য দেশে আসতে পারবে?”
অরূপ অবাক হলো। কি বলছে আব্বু।
সাদ আবার বললো,
“আসতে পারবে না?”
“আব্বু? কি হয়েছে?”
“তোমার মা পারছে না আমাকে বাসা থেকে বের করে দিতে।”
“হয়েছে কি আব্বু?”
“কি আবার হবে? তোমাকে অনেকদিন দেখে না তোমার আম্মু। সে কানাডা যেতে চায়, আমাকে বলেছে আগামী মাসের কথা। আমার তো ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপারস্যাপার আছে নাকি? এটা বলতেই যুদ্ধ শুরো….”
রাফসা শুনছিলো সব। সাদের কাছ থেকে ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে বললো,
“শুনিস না তোর আব্বুর কথা। দিনদিন বুড়ো হচ্ছে আর মাথাটা যাচ্ছে….”
অরূপকে ফোনে রেখেই আবার তর্ক শুরু করলো দুজনে। অরূপ ভিডিও কলে থেকেই বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনছে। হাস্যকর ঝাগড়া। রাফসা বেশি রেগে গেলো এবার৷ জোরে চিৎকার করলো,
“চুপ, একদম চুপ। পিটপিটে বুড়োর খিটখিটে স্বভাব হচ্ছে দিন দিন।”
অরূপ হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিলো। সাদ আর রাফসার ঝাগড়া চললো আরো কিছুক্ষণ।

অরূপ বাংলাদেশ সময় রাত ১২ : ৪০ -এ ফোন করলো নৌশিনকে। নৌশিন রাইসা আর রাউনাফকে শুইয়ে দিয়ে ঘরে আসছিলো তখন।
“কি রে বাবা? এতো রাতে ফোন দিলি?”
“আম্মু আর আব্বুর ঝগড়া কমেছে?”
“তোকে ওদের ঝাগড়া করার কথা সে বললো? অলিক?”
অরূপ স্বহাস্যে জবাব দিলো,
“না, ওরা আমাকে ফোন দিয়ে ঝগড়া করছিলো।”
“এসব তুই মাথায় নিস না। তোর মাকে অনেক দিন দেখে না তোকে তাই এসব করছে।”
অরূপ হাসলো। বললো,
“আম্মুকে বলো, ‘কানাডায় আসার জন্য ওনিই কিন্তু সব চেয়ে বেশি জোর করেছেন।’ ”
“তা তো তোর ভালোর জন্যই বাবা। মা তো….”
“ওরা কি ঘুমায়?”
“ঘরের লাইট তো বন্ধ। তবে অলিক পড়ছে। কাল কোচিং এ পরীক্ষা। কথা বলবি ওর সাথে?”
“না, সন্ধ্যা সময় কথা হলো তো। তোমার ফোনেই না ফোন দিলাম।”
“ওহ, হ্যাঁ তো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে ঘুমাও।”
“আচ্ছা বাবা।”
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

ফোন রেখে অরূপ ডায়েরি বের করলো। হিসাব করলো তার কাজের আর কতটুকু বাকী। নিজের উপর কতটুকু চাপ দিলে কত কম সময়ের মাঝে সব কাজ শেষ করে দেশে ফেরা সম্ভব।
অরূপ দেখলো কোনো রকম সমস্যা ছাড়া নিজের সর্বোচ্চ প্ররিশ্রম দিয়ে কাজ করলে আরো সাত মাস কানাডায় থাকতে হবে তাকে। আর স্বাভাবিকভাবে করতে গেলে আরো এক বছর আড়াই মাস। অরূপ টার্গেট নিলো সাত মাসের। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বজনদের ছেড়ে একা একা আর ভালো লাগছে না ওর। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফেরা চাই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here