প্রেমঘোর ২, পর্ব-১

প্রেমঘোর ২
পর্ব : এক
লেখক : নার্গিস সুলতানা রিপা

পুলিশ কনভেনশন হল ; রমনা।
ঢাকার সেরা কমিউনিটি সেন্টারগুলোর মাঝে অন্যতম। তুবার বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে এখানেই। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বাসায় করা হয়েছিলো। আজ বিয়ে অর্থাৎ কনে বিদায়ের দিন। নিপা আর ওয়ালিদ অনেক খুশী। একমাত্র সন্তানের বিয়ে বলে কথা! বাবা মায়ের আনন্দের দিন। তার সাথে অবশ্য হারানোর ব্যথাও অঢেল। ওয়ালিদের অবশ্য সার্থক বাবা মনে হচ্ছে নিজেকে। তেইশটা বছর মেয়েকে নিয়ে সুদূর কানাডায় থেকেছে। সবসময় চেয়ে এসেছে পাশ্চাত্যের উগ্রতা থেকে নিজের পরিবার আর একমাত্র সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখতে। পেরেছেও। তবে শেষ মুহুর্তে এসে যখন তুবার বিয়ের কথা উঠে-তখন ভয় হচ্ছিলো। নিপা আর ওয়ালিদের বরাবরই স্বপ্ন ছিলো বাঙালী কোনো ছেলের সাথে তুবার দাম্পত্য গড়ে দিতে। এমন একটা পরিবার যারা রুচিতে আধুনিক, বিশ্বাসে আল্লাহভীতু আর চলন-বলনে ইসলামিক ধারা বহল রেখে প্রকৃত বাংলাদেশী। মহান আল্লাহ তা’ আলা দোয়া কবুল করেছেন তাদের। তুবার বিয়ে হচ্ছে ময়মনসিংহে। বর একজন অধ্যাপক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি অনুষদ’- এ সদ্য যোগ দিয়েছে। তুবা কানাডায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি নিয়েই পড়াশোনা করেছে। দু-বছর গবেষণা করেছে আমেরিকান একটা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। সেখানেই তার বর রুকুনুজ্জামান কিরণের সাথে পরিচয় তার। দুজনের মাঝে কোনো প্রণয় গড়ে উঠে নি অবশ্য। তবে সবকিছু মিলিয়ে নিপার খুব পচ্ছন্দ হয়ে যায়। মেয়ের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পেয়েছিলো। তারপর পারিবারিক প্রস্তাব থেকে আজকের এই বিয়ে।

চারদিকে আলো। হল রুম ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, তুবা আর ওয়ালিদের বন্ধুবান্ধব যার মধ্যে কানাডীয়ান আর আমেরিকানও আছে অনেকে। সবার মাঝে আনন্দ-উল্লাস। বিদেশীরাও বাঙালী বিয়ের নিয়ম-কানুন বেশ ভালোই উপভোগ করছে। এতো আনন্দের মাঝেও একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কন্যা পক্ষের পরিবার। কেননা, আজ আট অক্টোবর। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে গতকাল সাত তারিখে। উপস্থিত সব চেনা-পরিচিত আর দূর আত্মীয়দের বিয়ে খাওয়ার পাশাপাশি কনের মামাতো বোন রাইসার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বেশ বচনশীল। রাইসার বাবা, মা, জেঠা, জেঠু বা ফুপু এমনকি তার ভাই-বোনদের পেয়েও জিজ্ঞেস করা হচ্ছে,
“কি গো? কাল তো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। তোমাদের রাইসাও না পরীক্ষার্থী ছিলো। ওর কি খবর? কোনো মেডিকেলে চান্স হলো? আমার ভাসুরের ছেলের শালার তো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হয়েছে।”
তবে সত্যি বলতে এটাই প্রত্যেক প্রশ্নকর্তা জানেন যে রাইসার কোনো মেডিকেল কলেজে চান্স হয় নি। তার রেজাল্ট এসেছে ওয়েটিং-৩৪৩৬ তম অর্থাৎ ওয়েটিং পজিশন ২৭। তারপরও বারবার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে একই প্রশ্ন করা হচ্ছে। ছোটো বেলা থেকে নিজের জেঠিমনিকে দেখে দেখে রাইসা মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছার সূচনা হয়-বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে, সাদা এপ্রোণ পড়ে সেবা করবে মানুষের। যথেষ্ট চেষ্টাও করেছে সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে ওয়েটিং। রাইসার অবশ্য এতে খুব বেশি মন খারাপ হয় নি। কেননা তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশিত হয় গত পরশু। সেখানে রাইসার পজিশন এগারোতম। আর সাবজেক্ট চয়েস অনুসারে রাইসা তার প্রিয় সাবজেক্ট মাইক্রোবায়োলজিই বেছে নিয়েছে। আর মনে মনে ভেবেও নিয়েছিলো ডাক্তারের সাদা এপ্রোণ না হলেও কোনো সমস্যা নেই তার গবেষকের সাদা এপ্রোণ পড়বে সে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার DNA থেকে শুরু করে তাদের জীবনাবসান এমনকি প্রতিষেধক সব জানা থাকবে তার। আর তারপরও যদি এসবে মন না দিতে পারে তাহলে মেডিকেলে আবার পরীক্ষা দিবে। কিন্তু এতো কিছুর পর আজ মন খারাপ হয়েছে রাইসার। ভীষণ রকমের মন খারাপ। মানুষগুলো এমন কেনো? একজনের না পাওয়াটা চোখে আঙুল দিয়ে খুচিয়ে দিচ্ছে অথচ ভালোটার দিকে কোনো নজর দিচ্ছে না। রাইসার কান্না পাচ্ছে খুব। মা কোথায়? বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত খুব সে। তারপর ভাইবোনদের পাশ থেকে সরে গিয়ে মায়ের কাছে গেলো রাইসা। এতক্ষণের জমে থাকা কষ্ট মাকে জড়িয়ে ধরে বির্সজন দিলো।

নৌশিনের খারাপ লাগছে খুব। তার মেয়ে ঠিক কিসের জন্য কান্না করছে বুঝতে বাকী নেই তার। নৌশিন রাইসাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,
“মা, সোনা আম্মু আমার। কেঁদো না।”
রাইসা নৌশিনের মতোই হয়েছে। কাঁদলে শব্দ হয় না। রাইসা টিস্যু পেপারে চোখ মুছলো। বললো,
“আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান আর কতটুকু বাকী আম্মু? অনেক কি দেরী হবে?”
“না, আর বেশিক্ষণ লাগবে না তো। এক ঘন্টার মাঝেই বিদায় হয়ে হয়ে যাবে। তুমি একদম মন খারাপ করো না প্লিজ। এই যে কাঁদছো চোখের কাজলটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তো আমার মায়ের।”
রাইসার চোখ দিয়ে আবার পানি গড়িয়ে পড়লো। টিস্যু দিয়ে আবার মুছলো সে। বললো,
“আমাদের ক্লাসে পিংকি ছিলো না?”
“হুম।”
“ওর আম্মুকেও তোমারা দাওয়াত দিয়েছো?”
“ওরা তোমার ফুপির শশুড়বাড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাই এসেছে।”
“ও, পিংকির আম্মু বারবার শুনিয়ে শুনিয়ে আরেকটা আন্টিকে বলছিলো-পিংকির খুলনা মেডিকেলে চান্স হয়েছে। এটা বলুক সমস্যা নেই, কিন্তু আমার যে হয় নি সব জেনেও কেমন কেমন করে বলছে। পিংকি যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক্সামে পাঁচ হাজারেও টিকলো না সেটা তো বললো না, এমনকি এটাও বললো না যে আমি সেখানে এগারোতম হয়েছি। অথচ পিংকির মেডিকেল পজিশন ২০০০+ সেটা বারবার শুনাচ্ছিলো আমাকে ডেকে।”
“তুমি এটাতে একদম কষ্ট নিও না আম্মু। তোমার না অনেক ধৈর্য্য। অন্যদের কথা ধরলে চলে?”
“তারপর আমার কষ্ট লাগছে আম্মু।”
নৌশিন রাইসাকে আরো অনেকক্ষণ বুঝালো। তারপর আলিভা, রাফিন, অলিকদের বলে গেলো রাইসাকে সময় দিতে। আর খেয়াল রাখতে ওর। আলিভা এমনিতে সব সময় রাইসাকে খুঁচানোর তালে থাকে। কিন্তু গতকাল থেকে একদম ভালো আচরণ করছে তার সাথে। নানা ভাবে হাসি-খুশী রাখার চেষ্টা করছে তাকে। রাফিন কনভেনশন রুম থেকে বের হয়ে রাইসার মন খারাপ করার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এলো। রাইসা হাসলো এতে। দূরের মানুষগুলো সত্যিই একটু কেমন কেমন। আর আপনজনগুলো? এই যে বাবাই, আম্মু আর ভাইবোনেরা। একটু মন খারাপ দূর করার জন্য কতই না প্রচেষ্ঠা তাদের। রাইসার আলিভার সাথে আইসক্রিমটা শেয়ার করে খাচ্ছিলো। এরমধ্যে অচেনা একটা আন্টি এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। জানতে চাইলো,
“তুমি সাদাদের মেয়ে না?”
রাইসা ভদ্রভাবে উত্তর দিলো,
“জ্বী আন্টি।”
“ও কি তোমার বোন?”
“হ্যাঁ, রিদির আন্টির মেয়ে।”
“ও আচ্ছা, আচ্ছা। তোমরা দুইজন তো মাশাআল্লাহ খুব মিষ্টি দেখতে।”
রাইসা মুচকি হাসলো। সাথে আলিভাও। তবে সে হাসি তৎক্ষণাৎ হারিয়ে গেলো মহিলার প্রশ্নে,
“কাল তো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। কোন মেডিকেলে হয়েছে তোমার।”
রাইসা চুপ করে রইলো। আবার সেই এক-প্রশ্ন! কিন্তু রেগে গেলো আলিভা। খড়খড়ে গলায় বলে উঠলো,
“আপনি তো আপুনিকে চিনতেনই না ঠিক মতো। হঠাৎ করে এলেন। তারমানে নিশ্চয় কারো কাছ থেকে আপুনির রেজাল্ট শুনে তারপর খুঁজে বের করলেন আমাদের। তাহলে এখন আবার এখানে এসে কেনো কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করছেন।”
“না না মামনি, আমি কষ্ট কেনো দিতে চাইবো? আমারও তোমাদের বয়সী একটা ছেলে আছে….”
“ছেলে তো থাকবেই৷ আপনি আমার মাম্মামের বয়সী আপনার তো আমাদের বয়সী ছেলে থাকাই স্বাভাবিক। তা আপনার সেই ছেলের বুঝি মেডিকেলে চান্স হয়েছে? এটাই শুনাতে এসেছেন?”
“তুমি এমন করে কথা বলছো কেনো?”
“কেমন করে বলছি? আপনার মতো নেকামি করে বলব? শুনুন আন্টি আপুনির যে মেডিকেলে হয় নি আপনি জানেন আর এটা জানেন তারমানে আপনি অবশ্যই জানেন আপুনির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়েছে তাও আবার এগারোতম। কই সেটা তো বললেন না?”
মহিলা যথেষ্ঠ অপমানবোধ করছেন। আলিভা আরো কিছু বলতে নিচ্ছিলো, রাইসা আটকালো। আর এইফাঁকে মহিলাটি আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত অন্যপাশে সরে গেলো। তিনিও কথা বাড়াতে পারতেন কিন্তু তাতে ওনারই সম্মানহানি তো এটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। মহিলা চলে যাওয়ার পরও আলিভা রাগে গিজগিজ করতে থাকলো। রাইসা শান্ত করতে চাইলে আরো ক্ষেপে গেলো,
“তুই তো আর কথাই বলিস না আপুনি! সব সময় এতো ভালো হয়ে থাকিস কেনো বলতো? মুখে কি কথা ফুটে না তোর? যে যা বলবে শুনতে হবে?”
“আলিভা! বিয়ের অনুষ্ঠান এটা চুপ কর। সবাই দেখছে তোকে।”
“তো দেখুক না। তোর কি তাতে? সবাই যখন বারবার জানা প্রশ্ন করছিলো তখনও তো দেখছিলো সবাই। বিয়ে খেতে এসেছে না মেডিকেল রেজাল্ট জানতে এসেছে আল্লাহ-ই জানে।”
রাইসা হাসলো এবার। আলিভার রাগ আরো একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
“ইশশ! আগে যদি জানতাম বোন তাহলে বাবাইকে বলে ঢাবি আর মেডিকেলের রেজাল্ট-টা একটা বিলবোর্ডে টাঙিয়ে দিতে বলতাম। তাহলেই আর এমন সমস্যা হতো না।”
আলিভা চোখ কুচকে তাকলো রাইসার দিকে। মুখ ভেঙচি দিতে চাচ্ছিলো তার আগেই কেউ এসে দুজনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো-কনে বিদায় শুরু হয়ে গেছে। রাইসা-আলিভা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিদায় দেখছে। পরিবারের সবাই কাঁদছে। খুব বেশি কাঁদছে-নিপা, কনের মা। রাইসার অবশ্য কান্না খুব একটা কান্না পাচ্ছে না। তুবাকে কাছে পেলো ভালো লাগে ওর। তবে সেই ভালো লাগা বছরে এক বার আসতো, আবার কোনো সময় দুই বছরে একবার। কিন্তু এখন এই ভালোলাগাটা আরো বেশি হবে। কেননা তুবা এরপর থেকে বাংলাদেশই থাকবে। তাই সবার কান্না দেখে একটু খারাপ লাগছে, কিন্তু আনন্দ হচ্ছে বেশ। রাইসা উৎসুক মনে দেখছে সবকিছুৃ। ফুপির জন্য খারাপ লাগছে খুব। কেমন করে কাঁদছে! আর ওয়ালিদ তো না কাঁদতে পারছে আর না কথা বলতে। মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশশ! রাইসার মায়া লাগছে খুব। রাইসা ওয়ালিদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলো। কিছু একটা বলে আঙ্কেলকে স্বাভাবিক করার ইচ্ছা হলো তার। কিন্তু যেতে পারলো না। কেননা তার আগেই উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলিভা স্বজোরে কান্না শুরু করলো। রাইসা তো অবাক! আলিভা তো এভাবে কান্না করার লোক নয়।
“এই কি হয়েছে তোর?”
আলিভা জবাব দিলো না। কাঁদতেই লাগলো। রিদি এসে দাঁড়ালো তার পাশে। বললো,
“আলিভা! এভাবে কাঁদতে নেই। তোমাদের তুবা বুবু তো এখন থেকে দেশেই থাকবে তোমার যখন ইচ্ছা ময়মনসিংহ যাবে আর বুবুকে দেখে আসবে।”
আলিভার কান্না থামলো না। জোরে জোরে টান টানলো সে। তারপর মাম্মামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার বুবুর জন্য কান্না পাচ্ছে না মাম্মাম। আমার না আমার বিয়ের কথা মনে হচ্ছে। আমাকে বিয়ে দিলে তোমরা সবাই কি এমন করেই কাঁদবে?”
রাইসা চোখ বড় বড় করে তাকালো আলিভার দিকে। সবার সামনে কিসব বলে আলিভা! সবে উঠলো কলেজে আর এখুনি! হাসি পাচ্ছে খুব রাইসার। কিন্তু চেপে গেলো। ভয়ে চেপে গেছে। এই মুহুর্তে যদি সে হাসে তাহলে আলিভা ঠিক মনে রাখবে এটা। আর তারপর ঠিক একদিন সুযোগ বুঝে শাস্তিও দিয়ে দিবে। যা ভয়ংকর মেয়ে এটা! কোনো বিশ্বাস নেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here