প্রেমনগর পর্ব ১৩

#প্রেমনগর
পর্বঃ১৩
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রৌদ্র। রাতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ছুড়িটা পেটের এক সাইডে লেগেছিল। মারাত্মক ভাবেই জখম হয়েছে। ডান হাতের বাহুতেও অনেকখানি ক্ষত বিক্ষত। তাৎক্ষনাত সময়মত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছেই বলেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। প্রচুর রক্ত ক্ষরন হচ্ছিলো। এখনো রক্ত আর সেলাইন দেওয়া চলছে। রৌদ্র জখম হয়ে রাস্তার ওপর পরে যাওয়ার পর মেঘকে ধরতে আসা ওই ওসি সাহেবই সেখান দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরছিলেন। প্রেমনগর যাওয়ার রাস্তা ভুল করে উনি উল্টো দিকে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার পথ হাড়িয়ে কোথায় কোথায় চলে গিয়েছিলেন উনি নিজেও জানেন না। সেখান থেকে ফেরার পথে রেস্তোরাঁর এক পাশে কিছু লোকের জটলা দেখতে পেলেন। একটি অল্পবয়সী মেয়েকে নিয়ে টানাটানি চলছে। রাস্তার ওপর একটি ছেলে পরে আছে। লোক গুলোর হাতে বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র। অবস্থা বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালালেন। তার সাথে থাকা সাব ইন্সপেক্টরসহ দৌড়ে গিয়ে লোকগুলোকে আটক করলেন। রেয়াকত আলীকে দেখে ওসির সন্দেহ হলো। একবার কিছু চোরাই মাল পাচার করার জন্য এটাকে আটক করা হয়েছিল। থানা থেকে আরও পুলিশ এসে সব গুলো কে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওসি সাহেব মেয়েটাকে নিয়েই মারাত্মক ভাবে আহত হওয়া ছেলেটাকে নিয়ে দ্রুত সেখানকার একটা হাসপাতালে ভর্তি করলেন। মেয়েটাকে জবানবন্দির জন্য কিছু জিগাসাবাদ করা হলে মেয়েটা কিছুই বলতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে সেও এক সময় চেতনা হারায়। তাকেও হাসপাতালের একটা বেডে ভর্তি করে স্যালাইন দেওয়া হয়। তারপর ভোরের দিকে ওর জ্ঞান ফেরে।
.
রাতেই ওসি সাহেব আহত ছেলেটার বাড়ির লোকজনের খোঁজ করছিলেন। এক পর্যায় ছেলেটির বাড়ির লোকের খোঁজ মিললো। খবর পাওয়া মাত্রই রৌদ্রের বাবা আফতাব চৌধুরী, চাচা আজগর চৌধুরী এবং বড় ভাই আকাশ চৌধুরী সেই হাসপাতালে ছুটে যায়৷ আর সকাল হতে না হতেই রৌদ্রের মা মনিরা বেগম সহ বাড়ির বাকি সদস্যরা হাসপাতালে এসে ভির জমিয়েছে । সবাই অপেক্ষা করছে রৌদ্রের জ্ঞান ফেরার।
.
ছোট ভাইয়ের এই অবস্থার কথা শুনে মেঘও হাসপাতালে চলে আসে। মেঘকে দেখা মাত্রই মনিরা বেগম চেচিয়ে উঠলেন, কোথায়? কোথায় ছিলি এই দুইদিন! একজন মারামারি করে হাসপাতালে পরে আছে আরেকটার দুই দিন থেকে কোনো খোঁজ নেই!! আকাশের বাবা আমি তোমার ছেলেদের নিয়ে আমি আর পারছিনা। আমার মরণ দেও!
আফতাব চৌধুরীঃ এসব তুমি কি বলছো, চুপ করো। আহা ছেলেকে তো আগে সুস্থ হতে দাও।
মনিরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, এই তোমার জন্যই সব হয়েছে। ছেলেদের মাথায় তুলে ফেলেছো। আজ ওর যদি কিছু হয়ে যেত! কি করতাম আমি।
মনিরা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।
মেঘঃ মা.. মা চুপ করো..রৌদ্র ঠিক হয়ে যাবে।
আফতাব চৌধুরীঃ আহা এতো কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবে তো তুমি।
.
ওসি সাহেব এসেছেন। তিনি এদিকে এগিয়ে এসে বলছেন, আপনিই আফতাব চৌধুরী?
আফতাব চৌধুরীঃ জি, হ্যাঁ বলুন।
ওসি সাহেবঃ আপনার ছেলে রৌদ্র চৌধুরী কাল রাতে মারামারি করেছিলো। সময় মতো আমি সেখানে ছিলাম বলেই ওকে বাঁচানো গেছে।
আফতাব চৌধুরীঃ আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই ওসি সাহেব৷
ওসি সাহেব তখনই বললেন, ঘটনাটা কাকতালীয়। আমি যাচ্ছিলাম আপনার বাড়িতেই। আপনার আরেক ছেলে মেঘ চৌধুরীকে ধরে হাজতে ভরতে।
.
এই কথা শোনার সাথে মনিরা বেগম আহাজারি করতে শুরু করলেন,এই দিন দেখার বাকি ছিল আমার! তার আগে আল্লাহ আমাকে তুলে নিলো না কেন! এক ছেলে মারামারি করে রাস্তায় পরে থাকছে আর আরেক ছেলে যাচ্ছে হাজতে। হায় আল্লাহ! আল্লাহ আমাকে তুলে নেও।
আফতাব চৌধুরীঃ আহা তুমি থামো!
মনিরা বেগম অচেতন হয়ে গেলেন। উনাকেও ধরে একটি কেবিনে নিয়ে গিয়ে স্যালাইন দেওয়া হলো।
.
ওসি সাহেব আফতাব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মেঘ চৌধুরীর কেস অবশ্য এখন ডিসমিস। তবে আপনার পুত্রদের একটু সাবধানে রাখবেন। দে আর ভেরি ডেঞ্জারাস! এক জনকে ধরতে এসে দেখি আরেকজন মারামারি করে পরে আছে৷ হাউ ডেঞ্জারাস!
.
তুলি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। অহনা পেশে থেকে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে দিয়ে চুল গুলো নেড়ে দিচ্ছে।
অহনাঃ তুই এতো ভেঙে পরছিস কেন!
তুলি আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমার লাইগাই তো উনার এমনডা হইলো। আচ্ছা উনারে কি এহন দেখন যাইবো?
অহনাঃ জ্ঞান ফিরলে তোকে যেতে দেবে। এখন শুয়ে থাক।
.
মেঘের ফোন বাজতে থাকে। নীলা ফোন করেছে। কলটা রিসিভ করতেই নীলার ঝাঝালো কন্ঠের আওয়াজ পাওয়া যায়।
নীলাঃ কোথায় তুই?
মেঘঃ আমি একটু ব্যস্ত আছি।
নীলাঃ ব্যস্ত? কোন মাগীর সাথে আছিস বল!
মেঘঃ দেখ তুই আমার সাথে আর কোনো রকম উল্টো পাল্টা কিছু করবি না! ফোন রাখ!
নীলাঃ কি?? কি বললি আমি পাগলামো করি? মাগীদের না দেখলে তো তোর ঘুম হয় না। যা মাগী দেখ।
মেঘঃ জাস্ট শাট আপ নীলা!
নীলাঃ তুই থাক তোর মাগী নিয়ে… তোর ওই….
নীলার কথা শেষ হওয়ার আগে রাগে মেঘ কলটা কেটে দিলো।
নীলা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পরে। তারপর রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরলো শ্যামপুরের উদ্দেশ্য। ওই ভন্ড কবিরাজের পানি পড়ায় কোনো কাজই হয়নি। আজ ওই কবিরাজকে শায়েস্তা করতেই হবে।
.
রৌদ্র চোখ খুলেই তুলির নামটাই আগে নিলো। চোখ অল্প একটু খুলে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে তুলির কথাটাই আগে জিগাসা করলো। আস্তে করে বললো, তুলি কোথায়? ওকে কি ওরা নিয়ে গেছে।
মনিরা বেগমঃ এখন কেমন লাগছে বাবা?
অহনা তুলিকে সামনে নিয়ে আসলো, এই যে তুলি!
রৌদ্র তুলির দিকে তাকায়,তুমি ঠিক আছো তো তুলি?
তুলি সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রের গায়ে হাত দিতে যাচ্ছিলো, কেমনে ঠিক থাকি কন, আপনের এই অবস্থা!
নার্সঃ আপনারা এখান থেকে যান তো। এখানে এতো জন ভীর করেছেন কেন! যান বাহিরে যান।
.
রাফিও এসেছে রৌদ্রকে দেখতে। কেবিনের বাহিরে বেড়িয়ে তুলিকে দেখে বলছে, তোমার সাথে আবার দেখা হবে জানতাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হবে সেটা ভাবিনি। ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করে নি তো?
তুলি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দেয়। এদিকে রাফির বুকের ভিতর প্রেমের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। তুলির কথা ভেবে ভেবে তার সারারাত ঘুম হয় নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমনকি মাঝে মাঝে বিছানা থেকে উঠে রুমের ভিতরেই হাটাহাটি করে একা একাই তখন তুলির কথা ভেবে হেসে হেসে রাত পার করেছে রাফি। কোনো ভাবেই কাল রাতের ঘটনা ভুলতে পারছেনা রাফি । তবে রৌদ্রের এমন মারাত্মক অবস্থাটা সে একদমই আশা করেনি।
.
বিকালেই নীলা শ্যামপুরে গিয়ে পৌঁছালো। কবিরাজের আস্তানায় ঢোকার আগে আরেকবার মেঘের মাথাটা ঝালিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। নীলা আবার মেঘকে ফোন দিলো।
মেঘঃ তোর সমস্যাটা কি?
নীলাঃ আচ্ছা তোর কি আমার জন্য কিচ্ছু ফিল হয় না?
মেঘঃ হ্যাঁ হয়! তোর চিকিৎসা দরকার। তোর মাথার একটু না অনেকখানি সমস্যা আছে। যা মাথার চিকিৎসা করা।
নীলাঃ কি???
মেঘঃ আমাকে আর কল দিবি না।
মেঘ কলটা কেটে দিলো। রাগে নীলা হন হন করে হাটতে হাটতে কবিরাজের আস্তানার ভিতরে ঢুকলো।
.
এদিকে আফতাব চৌধুরী নীলার বাবাকে ফোন করে বসেন,
আফতাব চৌধুরীঃ কোন সাহসে আপনি আমার ছেলের নামে কেস করেছেন!
নীলার বাবাও গলা উঁচু করে বলছে, সেটা আপনি আপনার ছেলেকেই জিগাসা করুন। ছেলেকে তো একটা লম্পট বানিয়েছেন।
এই কথা শুনে আফতাব চৌধুরী আরও ক্ষেপে গেলেন। ফোনেই তাদের দুইজনের কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হলো।
.
সন্ধ্যার দিকে রৌদ্র যখন চোখ খুলে তাকায়। তখন পাশেই তুলিকে বসে থাকতে দেখলো। সেদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বললো, তুমি বাড়ি যাও নি!
তুলি মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দেয়। রাফি আবার এসেছে রৌদ্রকে দেখতে। এই ফাঁকে তুলিকেও দেখে নেওয়া যাবে।
রৌদ্রঃ এই মেয়ে চেহারার এই হাল কেন তোমার! খাওয়া দাওয়া করোনি নাকি৷ যাও৷ বাড়ি যাও।
তুলিঃ আপনে আগে সুস্থ হইবেন তারপর আমি যামু৷ আমার লাইগাই তো আপনের এমনডা হইলো।
তুলি কাঁদতে শুরু করে।
নার্স এসে বলতে থাকে,আপনি বাহিরে যান। এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না।
রাফি তুলির দিকে তাকিয়ে বললো, এসো আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
তুলিঃ আমি যামু না। আমি এইহানেই বইসা থাকমু।
রাফিঃ তাহলে আমিও থাকি।
.
তুলি একটু একটু করে রৌদ্রের প্রতি দুর্বল হচ্ছে। এটা ঠিক প্রেম নাকি কৃতজ্ঞতা ঠিক বোঝা যাচ্ছে।
না।
রৌদ্রের ভার্সিটির কিছু মেয়ে বন্ধুরা রৌদ্রকে দেখতে কেবিনের ভিতর ঢুকলো।
নার্সঃ আহা এই যে আপনারা এতোজন এখানে ভির করছেন কেন। উনার সাথে এখন বেশি কথা বলা যাবে না। আপনারা সবাই যান বাহিরে গিয়ে বসুন৷ বের হন।
রাফি শুধু তুলির দিকে তাকিয়ে আছে আর তুলি রৌদ্রের দিকে। রাফির বুকে প্রেমের জোয়ার ভাটা চলছে৷
.
এদিকে সন্ধ্যা নেমে রাত হয়ে গেলেও নীলা এখনো বাড়ি ফিরলো না। ফোনটাও সুইচ অফ। চিন্তায় নীলার বাবা মা পুলিশে খবর দিয়েছে৷ আর সন্দেহ করছে মেঘকে।
মেঘ এইমাত্র বাড়ি ফিরলো। বাইক থেকে নামতেই ফোন বাজতে থাকে। শ্রাবনী ফোন করেছে। বিরক্ত হয়ে মেঘ কলটা রিসিভ করলো৷
মেঘঃ তোমার আর তোর বান্ধুবীর কি আমাকে ফোন দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?
শ্রাবনীঃ শোনো নীলাকে না খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ও কোথায় তুমি কি কিছু জানো??
মেঘঃ ওয়াট!! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কোথায় না কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে সেই খবর আমি করে জানবো?
শ্রাবনীঃ আমি মজা করছিনা মেঘ৷ সত্যিই ওকে নিয়ে সবাই চিন্তায় আছে। ও শ্যামপুর যাবার কথা বলছিলো। জানিনা সেখানে গিয়েছে কিনা। জায়গাটা ভালো না। ওই জায়গার খোঁজ আমিই দিয়েছি তাই নীলার বাবা মাকে বলার সাহসও পাচ্ছিনা। ওর কিছু হয়ে গেলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না।
মেঘঃ হোয়াট! এসব তুমি এখন বলছো!
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here