প্রেমনগর পর্ব ১

#প্রেমনগর
পর্বঃ১
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
ইদানীং আফতাফ চৌধুরী তার পুত্রদের নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে রয়েছেন। আফতাফ চৌধুরীর তিন পুত্র। আকাশ চৌধুরী, মেঘ চৌধুরী, রৌদ্র চৌধুরী। তিন পুত্রই দেখতে মাশাল্লাহ মারাত্মক সুদর্শন। বড় ছেলে আকাশ চৌধুরী পেশায় একজন ডাক্তার। বয়স ছাব্বিশ ছুঁই ছুঁই। শুধুমাত্র পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ছাত্রজীবনে প্রেম করার সময় পায়নি। মেডিকেলের অনেক সুন্দরী তরুণীরা তার পিছু পিছু ঘুরেছে। এমনকি এখনো তার বাড়িতে মেয়ের বাবারা তার সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। অতিরিক্ত বিয়ের প্রস্তাব সামলাতে সামলাতে আফতাফ চৌধুরী হিমশিম খান। রোজ রোজ বিভিন্ন মেয়ের বাড়ি থেকে টেলিফোন আসে৷ কিন্তু আকাশের মতামত ছাড়া তো আর বিয়ের দিকে এগোনো যায় না। বহু নারী আকাশের মন জয় করার জন্য পাল্লা দিয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আকাশের রুপের পাগল আর কেউ কেউ তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের। তাদের একটাই লক্ষ্য আকাশের সাথে প্রেম করা।
আকাশ রুগী দেখার জন্য চেম্বারে এসে বসলো। মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক একটা অল্পবয়সী মেয়েকে নিয়ে চেম্বারের ভিতরে এসে বসলেন। উনার শুকনো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি উনার মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তিত।
সব গুলো রিপোর্ট দেখে আকাশ বলে উঠল, সব কিছু তো নরমালই আছে।
মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে খিলিখিল করে হাসতে হাসতে বললো,আমার কোনো সমস্যা নেই তো! আপনি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন।
ভদ্রলোকঃ আমার মেয়ে অহনা রুমের ভিতর একা একাই নিজের সাথে কথা বলতে থাকে।সব সময় অদ্ভুত আচরণ করে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ছে। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে।পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না!কতবার বলেছি একটু বাহিরের হাওয়া বাতাস লাগা। কিন্তু কারো কোনো কথাই শোনে না।
আকাশঃ হুম বেশি পড়াশোনার চাপেই হয়তো এমনটা হয়েছে।
ভদ্রলোকঃ বাড়ি থেকে ওকে এখন বিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। রোগ বেড়ে গেলে যদি আর কেউ পাগলী ভেবে বিয়ে না করে৷
আকাশঃ দেখুন ওরকম পড়াশোনা আমিও করেছি। আমাদের দেখতে হবে ওর আচরণের ধরনটা কেমন। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপাতত ওকে কয়েকদিন পড়াশোনা থেকে দূরে রাখতে হবে। আমরা উনাকে হাসপাতালে এডমিট করছি৷
অহনাঃ উফ বাবা! আমার বান্ধুবিরা আমাকে বলেছে একটা প্রেম করতে। তাহলে নাকি আমি পড়াশোনা থেকে একটু দূরে থাকব। প্রেম নিয়ে ব্যস্ত থাকবো। হিহিহি আমি তো একটা প্রেম করার চেষ্টাই করছি! হাহাহা। আচ্ছা বাবা আমি যদি অনেক গুলো প্রেম করে ফেলি তাহলে আমি অনেক ব্যস্ত থাকবো তাইনা!
ভদ্রলোকঃ দেখুন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছে আমার মেয়ে! আপনি আমার মেয়েকে ভালো করতে পারলেন না?
আকাশঃ আমি কোনো কাজে ব্যর্থ হইনা। ভরসা রাখুন।
অহনা হাসতে হাসতে বললো, বাবা ডাক্তারটা খুব হ্যান্ডসাম তাইনা! আমার সাথে চলবে? আমি উনার সাথেই প্রেম করবো৷ করবোই করবো! আচ্ছা ডাক্তার, প্রেম কিভাবে করে?
.
অহনার বাবা এবার কান্নায় ভেঙে পরলেন। টেবিলের ওপর বারি দিতে দিতে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন৷ উনার কান্নার শব্দে দুইজন নার্স ভিতরে চলে এলো। অহনা খিল খিল করে হেসেই যাচ্ছে৷
অহনার বাবাঃ দেখছেন তো ওর অবস্থা! দেখলেন তো!এসব জানাজানি হলে ওকে আর কে বিয়ে করবে চাইবে। অবস্থা তো যা খারাপ হওয়ার তা তো হয়েই গেলো। বাড়িতে ওর মা ওর চিন্তায় বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে।
আকাশঃ আচ্ছা শান্ত হন৷ কাঁদবেন না। আপনার মেয়ের দায়িত্ব আমি নেব৷
.
এই কথা শোনার সাথে সাথে অহনার বাবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। শুকনো মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কারণ দায়িত্ব নেওয়ার কথাটায় উনি ভেবে নিয়েছেন ডাক্তার আকাশ চৌধুরী তার মেয়ে অহনাকে বিয়ে করবেন। মেয়েকে নিয়ে গিয়ে তিনি হসপিটালের একটা কেবিনে ভর্তি করালেন। আর বাড়িতে ফোন করে অহনার মাকে বললেন, অহনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফোনে কথা বলার সময় একজন নার্স এই বিষয়ের সবটা শুনে ফেললো। আর সাথে সাথে সে গিয়ে হসপিটালের ম্যানেজারকে এই সংবাদটা দিয়ে দিলো৷
.
ম্যানেজার সাহেব ডাক্তার আকাশ চৌধুরীর বাড়িতে ফোন করলেন।
ম্যানেজারঃ স্যারতো একজন মানসিক রোগীকে বিয়ে করছেন। স্যারকে আটকান।
আফতাব চৌধুরীঃ কিহ! আমাদের না জানিয়েই বিয়ে করছে!
.
পাশেই আকাশের মা মনিরা বেগম দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি চেচিয়ে বললেন, কে বিয়ে করছে!
আফতাব চৌধুরীঃ তোমার বড় ছেলে নাকি তার হসপিটালেরই একটা রোগীকে বিয়ে করছে।
আকাশের মা চিল্লিয়ে বলছেন, এইসব হয়েছে তোমার জন্য! কবে থেকে বলছি ছেলের বিয়ে দেও। বিয়ে দেও! আমার কথা শুনলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।
আফতাব চৌধুরীঃ চুপ করো তুমি!তোমার ছেলেরা তো কখনোই কোনো কথা শোনে না। শুনবে কিভাবে! লাই লাই দিয়ে তো ছেলেদের মাথায় তুলে ফেলেছো।
মনিরা বেগমঃ একদম আমার ছেলেদের নামে উল্টো পাল্টা কিছু বলবে না বলে দিলাম।
.
ওপর পাশ থেকে চেচামেচির আওয়াজ শুনে ম্যানেজার সাহেব তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিলেন। আকাশের বিয়ে নিয়ে প্রেমনগরের চৌধুরী মহল এখন খুবই উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে।
.
আফতাব চৌধুরীর মেজো পুত্র মেঘ চৌধুরী। ভার্সিটির বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের খুবই অ্যাকটিভ ছাত্র।বয়স সবে চব্বিশ। তার সুন্দর চেহারা আর আকর্ষনীয় বডির প্রতি ভার্সিটির প্রতিটি মেয়ের নজর। বাইক নিয়ে যখন সে ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢোকে, প্রতিটা মেয়ে তখন হা করে ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে থাকে। চোখে সানগ্লাস,গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর মায়া মায়া ভরা হাসিটা দেখলে মেয়েদের বুকে ঝড় উঠে যায়। ল্যাবে ব্যস্ত থাকার সময় মেঘের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মেঘ একটু সাইডে গিয়ে কলটা রিসিভ করে।
ফোন রিসিভ করার সাথেই…
মনিরা বেগমঃ সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা! তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়।
মেঘঃ কেন মা কি হয়েছে? ড্যাড কি কিছু করেছে?
মনিরা বেগমঃআরে না! আকাশ নাকি তার হসপিটালেরই এক রোগীকে বিয়ে করে ঘরে আনছে।
মেঘঃ হাহাহা….মা তুমি এসব কি বলছো। ভাইয়া এমন কাজ কখনোই করবে না। সো রিলাক্স থাকো। মা আমি একটু ল্যাবে কাজ করছি।তোমার সাথে এই বিষয়ে পরে কথা বলবো৷ এখন রাখি মাই ডিয়ার সুইট মাদার।
মনিরা বেগমঃ হ্যালো হ্যালো……ধ্যাত কেটে দিয়েছে।
.
মনিরা বেগম এবার ছোট পুত্র রৌদ্র চৌধুরীকে ফোন করলেন৷ রৌদ্র চৌধুরী দেখতে যেমন স্মার্ট তেমনি কথাবার্তাতেও বেশ স্মার্ট। তার রুপ আর কথার জাদুতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্য যেকোনো অতি রূপবতী নারীও পটে যায়। বয়স মাত্র একুশ বছর। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ এখনো পর্যন্ত কোনো প্রেম না করলেও মেয়েদের সাথে তার মেলামেশা প্রচুর। কিন্তু কেউ তার মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। ফ্রেন্ড সারকেল নিয়ে হ্যাং আউট করার সময় মনিরা বেগম তাকে কল করেছেন৷ রিং হয়েই যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। এভাবে কয়েকবার দেওয়ার পর রৌদ্র চৌধুরী যখন পকেট থেকে ফোন বের করে সেলফি ওঠাতে যাবে তখনই মায়ের কল আসছে দেখে সাথে সাথে সেটা রিসিভ করলো।
রৌদ্রঃ উম্ম সরি মামমাম ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই দেখতে পাই নি৷ এখন আদেশ করুন আমার মাতা আমায় কি করতে হবে!
মনিরা বেগম এবার কড়া হয়ে ধমক দিলেন,কোথাই তুই! এক্ষুনি বাড়ি আয়৷
রৌদ্রঃকেন মা কি হয়েছে!
মনিরা বেগমঃ তোর ভাই তো কান্ড বাধিয়ে ফেলেছে। বাড়িতে গন্ডগোল চলছে। আকাশ হসপিটালের একটা রোগী মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসছে।
রৌদ্রঃ ওয়াট!ভাইয়াকে কিছু বলোনি?
মনিরা বেগমঃ বলার সুযোগ আর পেলাম কই। ফোনে তো ওকে পাচ্ছিনা। নিশ্চয়ই আমার ভয়ে বিয়ের খবরটা গোপন রাখতেই ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
রৌদ্রঃ ওকে ওকে। আমি আসছি।টেনশন নিও না।
.
আকাশের ফোনে চার্জ নেই। বাহিরের কিছু কাজ সেড়ে,দুপুরের খাবার খেয়ে আবার চেম্বারে এসে বসলো। আর ফোনটা চার্জে লাগিয়ে দিল। নার্সটা চেম্বারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,স্যার আসবো?
আকাশঃ হ্যা এসো ।
নার্সঃ স্যার আপনি কি সত্যি সত্যি বিয়ে করছেন?
নার্সের কথা শুনে আকাশের চোখ কপালে উঠে যায়।
আকাশঃ আমি বিয়ে করছি মানে! কি বলছো এসব!
নার্সঃ স্যার তখন যে রোগীটা এডমিট হলো যাকে আপনি দায়িত্ব নেয়ার কথা বললেন।
আকাশঃওহ হো আমি কি বিয়ে করার কথা বলেছি নাকি! আমি তো ওকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিতে চেয়েছি।
নার্সঃ কিন্তু উনার বাবা যে উনার বাড়িতে ফোন করে বললেন আপনার সাথে উনার বিয়ে।আপনি উনার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। আর এটা শুনে তো আমিও…
আকাশঃ কি আমিও?
নার্সঃ ম্যানেজার সাহেবকে বলে দিয়েছি।
আকাশঃ আর ম্যানেজার আমার বাড়িতে ফোন করে সবটা জানিয়ে দিয়েছেন তাই তো!
নার্সটা এবার মাথা নিচু করে উত্তর দিল, না মানে আসলে স্যার, আপনার বাবাই তো সব সময় এখানের সব খবর উনাকে জানাতে বলেন।
আকাশঃ হুম জানি। বাবা এই কাজ আগেও করেছে। ঠিকাছে তুমি যাও এখান থেকে৷ খুব ভালো গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়েছো। নাউ জাস্ট গেট আউট!
নার্সটা তড়িঘড়ি করে চেম্বার থেকে বেড়ি গেল। আর আকাশ কাপালের ওপর দুই হাত দিয়ে বসে রইলো। কারণ বাড়িতে এখন এটা নিয়ে তিঁল থেকে তাল হয়ে যাচ্ছে।
.
মেঘ চৌধুরী ল্যাব থেকে বের হতেই নীলা এসে মেঘের হাত ধরে ফেললো৷
নীলাঃ এ্যাই কোথায় যাচ্ছিস? তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
মেঘঃ এসব কি করছিস হাত ছাড়! এখানে এভাবে কেউ দেখে ফেলবে। আর আমাকে যেতে হবে। তোর কথা আমি পরে শুনবো।
নীলাঃ আজ বিকালটা তুই আমাকে সময় দে না। প্লিজ।
মেঘঃ উফ! আমাকে এক্ষুনি প্রেমনগর যেতে হবে।
নীলাঃ প্রেমনগর মানে!
মেঘঃ তোর মাথা! প্রেমনগর মানে আমার বাড়ি। বাড়িতে একটা বিষয় নিয়ে গন্ডগোল চলছে। আমাকে গিয়ে সামলাতে হবে৷ আসছি।
নীলা ভ্রু কুচকে মেঘের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
সময় রাত ৮ টা। আকাশ চেম্বারে বসে আছে। বাড়িতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো অহনাকে একবার দেখে আসা উচিত। নিজের চিন্তায় ওর ব্যপারটা মাথা থেকেই বেড়িয়ে গেছে। অহনার কেবিনে গিয়ে দেখলো। সে বেডে বসে আছে আর তার সামনে বসা কাকে যেন সে বলছে।
অহনাঃ না আমি আগে প্রেম করবো তারপর বাকিসব কিছু…
.
অহনার বাবা তখনই কেবিনের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে আকাশকে এখানে দেখে বলে উঠলেন,ওইতো আমাদের জামাইবাবা! যাও বাবা ভিতরে যাও।অহনার খালাতো বোন এসেছে।
.
গ্রাম থেকে আসা অহনার খালাতো বোন তুলি এদিকে ফিরে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,দুলাভাই!
এটা শুনে আকাশ জিব্বাহতে ছোট করে একটা কামড় দিল। অহনাকে দেখতে এসে আকাশ এক রকম লজ্জাজনক অবস্তুয়াতেই পড়ে যায় ।
.
আকাশ কি করবে বুঝতে পারছেনা। অহনার বাবা বিয়ের ব্যাপারটা বাড়িতে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের প্রস্তুতিও নাকি নেয়া শুরু হয়ে গেছে৷ উনি মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে শশুড়বাড়ি পাঠাতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। মেয়ে যে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে।কথায় কথায় প্রেম প্রেম করে। শেষে চরিত্রের দোষ ভেবে যদি আর কেউ বিয়ে না করে! অহনার বাবা আকাশের হাত ধরে বলছেন,তুমি আমাকে অনেক বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচালে বাবা। বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সেরে নেবে ততই ভালো। আমি এখন আসি৷ বাড়িতে সব আয়োজন ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখতে হবে।
আকাশ কিছু না বলে মুখে জোর করে একটু হাসি এনে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো।
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here