#প্রেমের_মরা_জলে_ডুবে
#তানিয়া
পর্ব:৫
শুভ্রর কলেজ ছুটি হওয়ার পর কলেজে কিছু কাজ থাকে সেগুলো শেষ করে সে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়।কলেজ রোড ছেড়ে এসে একটা লেক পড়ে।লেকটা যেমন সুন্দর তেমনি নির্জন।এ নির্জন লেকে বসে শুভ্র তার এবং তুরফার অদৃশ্য কথোপকথনে মন দেয়।কত সুন্দর আর প্রেমময়ী কথা বলে সে কল্পনার তুরফার সাথে। যেসব কথা সে তুরফার সাথে সরাসরি বলতে পারে না সেসব কথা সে কল্পনার তুরফার সাথে বলে।বেশ অনেক সময় কথা বলে সে বাড়িতে ফিরে বিকেলের দিকে। এটা তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছিল।একদিনের ব্যবধানে সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো।তার কল্পনা, তার প্রেম, তার স্বপ্ন সবটা ঐ বিয়ের আসরে এসে থমকে গেছে।
কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে শুভ্র প্রতিদিনের মতো আজো লেকে এসে বসলো।তবে আজকে তার কল্পনার তুরফা নেই। সে একা একা বসে আছে লেকেরপাড়ে।শুভ্র খুব সেন্সিটিভ পুরুষ। সবার সাথে খুব মেপে মেপে কথা বলে। কলেজের সবাই তাকে খুব পছন্দও করে। অনেকে তো তাকে সরাসরি আত্মীয়ের জন্য বিয়ের অফারও দিয়েছে। তবে শুভ্র সবটা নাকচ করেছে তুরফার জন্য। শেষে কিনা সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো? কলেজের বেশ কিছু টিচারদের সে বিয়েতে নেমন্তন্ন দিয়েছে তারা যখন দেখলো বিয়েটা পুরো গন্ডগোল হয়ে গেছে বিষয়টা নিয়ে কলেজে একটা গুঞ্জন শুরু হলো।তার ওপর বিয়ের জন্য ছুটি নেওয়া হয়েছিল অথচ বিয়ের পরদিন সে কলেজ জয়েন করেছে এটাও একটা ব্যাপার।সবাই শুভ্রর বিয়েটা নিয়ে আফসোস করছে কেউ কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে।যারা শুভ্রকে আড়ালে হিংসা করতো তারাই এখন সমবেদনাা নামে টিপ্পনী কাটছে।শুভ্র একদিনে অফিসঘরের অবস্থা টের পেয়ে গেছে। তার পক্ষে এখানে আর কাজ করা সম্ভব নয়।সে দ্রুত ট্রান্সফার হওয়ার কাজে মন দিলো।প্রয়োজনে টাকা দিয়ে হলেও সে এখান থেকে স্থানান্তর করে নিবে।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে এখনো শুভ্র বাসায় ফিরে আসেনি।নিপা অস্থির অস্থির করছে।সে ছেলেকে চিনে আত্ম সম্মান নিয়ে যে ছেলে এত ভাবে সেই ছেলের সাথে কিনা এত বাজে ঘটনা ঘটলো।তার সুন্দর পবিত্র আর সরল ছেলের সাথে যা ঘটলো সেটা মা হিসেবে নিপা মানতে পারছেনা শুভ্র কীভাবে পারবে? ভাবনার ছেদ পড়লো যখন শুভ্রকে বাসায় ঢুকতে দেখলো।তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন
“বাবা এত দেরী করলি কেনো,সেই কখন সন্ধ্যা নেমেছে?”
“মা একটু কাজ ছিলো, তাছাড়া শহরের কলেজে ট্রান্সফার হতে হলে অনেক গুলো ফর্মালিটির কাজ সারতে হবে সেসব নিয়ে দৌড়দৌড়ি চলছে।মা তাড়াতাড়ি এক কাপ কফি দিয়ে যাও তো ফ্রেশ হবো।”
শুভ্র মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা রুমে চলে গেলো।ব্যাগটা বিছানায় রেখে বসে পড়লো সোফায়।একটু পর কুটকুট আওয়াজ হলো।
“মা কফিটা রেখে যাও। একটু মাথাটা টিপে দাওতো মাথা ধরেছে।”
শুভ্র চোখ বন্ধ অবস্থায় কথা বলছে তাই জানে না কে তার রুমে এসেছে। মাথায় হাত দিয়ে কেউ মাথা ম্যাসাজ করছে কিন্তু মাথার ম্যাসাজটা যেন মনমতো হচ্ছে না।
“মা কপালের এ পাশটাতে ভালো করে করো।রগগুলো যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব। ”
শুভ্র হাতটা নিয়ে কপালের যে পাশে ব্যাথা করছে সেদিকে নিয়ে গেলো আর যার হাত তার সংস্পর্শে এসেছে সে যেন পাথর হয়ে গেলো।হাতজোড়া থেমে গেলো তার।শুভ্র চোখ খুলে পাশে তাকাতেই ব্যাঙ লাফে উঠে দাঁড়ালো।
“তুমি?এখানে কি করছো?তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে?”
শুভ্র চোখ মুখ শক্ত করে প্রশ্ন করলো তিমিরকে। তিমির কখনো শুভ্রকে এতটা শক্ত রূপে দেখেনি।তিমির তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে।
শুভ্র আরকিছু না বলে নিপাকে ডাকলো।ছেলের আওয়াজ পেয়ে নিপা দৌড়ে এলো।আর তিমিরকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
“এই মেয়ে তুমি আমার ছেলের রুমে কি করছো,তোমাকে না বলেছিলাম আমার ছেলের আশেপাশে তোমাকে না দেখি তুমি এখানে কেনো এলে?”
“আসলে ওনার কফিটা দিতে এসেছিলাম কিন্তু ওনি বললেন মাথাটা টিপ দিতে তাই..
”
“আমি তোমাকে বলিনি আমি মা ভেবে কথাটা বলেছিলাম।আর কখনো আমার কোনো কাজে হাত দিবে না।”
শুভ্র কথা শেষ করে চলে গেলো গোসলে।নিপা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তিমিরের সামনে।
“কফিটা আমি শুভাকে দিয়েছিলাম,তোমাকে কে দিলো?”
শুভা শুভা বলে নিপা চিৎকার দিলো।শুভা দৌড়ে এসে দেখলো তিমির আর নিপা মুখামুখি।ভয়ে শুভা আড়ষ্ট হলো।নিপা এগিয়ে এসে শুভাকে চড় লাগালো।
“হারাম*জাদী তোকে বলেছিলাম তুই নিজে এসে শুভ্রকে কফি দিয়ে যেতে আর তুই কিনা এ ডাকিনির হাতে পাঠালি?”
শুভা চড় খেয়ে একটু দূরে গেলো আর আড়চোখে তিমিরকে দেখলো।তিমির শুভাকে দেখে আড়ালে দাঁত ভেটকালো।সেটা দেখে শুভা আরো রেগে গেলো।সে ফোঁস ফোঁস করা শুরু করলো।
“কাজ না পারলে করবি না কিন্তু শুভ্রর কোনো কাজ এ মেয়ের হাতে দিবি না বুঝেছিস?”
শুভা কিছু বলার আগে তিমির ফোঁড়ন কাটলো।
“আন্টি কি বলছেন আপনি,শুভ্র ভাইয়া আমার হাসবেন্ড তার ভালো মন্দ খবর আমি রাখবো না?”
নিপা চোখ বড় করে তাকালো সেদিকে।
“বড় বেশি পেকে গেছো কিন্তু আমার সাথে ওসব পাকনামি দেখাতে আসবে না।আমার পরিবার আর আমার ছেলের সাথে তুমি যা করেছো তা আমি কখনো ক্ষমা করবো না।আমার ছেলের কাছে আসার চেষ্টা করবে না তাহলে ধাক্কা দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিব।বের হও এক্ষুনি। ”
তিমির আরকিছু না বলে বেরিয়ে গেলো যাওয়ার আগে নিপার দিকে তাকিয়ে একটা ডেভিল হাসি দিলো। তিমির যাওয়ার পর পর শুভাকেও ধমক দিয়ে বিদায় করলো।শুভা মায়ের ধমক খেয়ে দৌড়ে পালালো।
তিমির রুমে গিয়ে দরজা লাগানোর আগে শুভা চলে এলো।
“তিমির দরজা খোল,দরজা বন্ধ করবি না বলছি?”
তিমির ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে হাসিতে ফেটে পড়লো।বেচারি শুভা,তার দোষেই মা*র খেলো।
শুভ্র মাকে যখন কফির কথা বললো তখনি তিমির ভাবলো কফিটা সে নিয়ে যাবে কিন্তু নিপা তাকে কখনো সেটা করতে দিবে না। তাই কৌশলে শুভাকে দিয়ে কফিটা নিয়ে নিলো তিমির আর শুভ্রর ঘরে গিয়ে কফিটা দিতে শুভ্র তাকে মা ভেবে মাথা টেপার কথা বলে।আর সেটা করতে গিয়েই শুভ্র তার হাত চেপে ধরে। তিমিরের হঠাৎ গায়ে কাটা দিয়ে উঠে শুভ্রর হাতের ছোয়া পেয়ে।তিমির চোখ বন্ধ করে মনে করে সেই ক্ষণটা।
সকালে উঠেই তিমির তৈরি হয়ে নিলো।কলেজ যেতে হবে। সাথে শুভাকেও জাগিয়ে দিলো।এতদিন ভিন্ন বাড়ি থেকে একসাথে কলেজ গেছে আজকে থেকে দুজনে এক বাড়ি থেকে যাওয়া আসা করবে।এখন সম্পর্কটা শুধু বান্ধবীর নয় ননদ ভাবির সম্পর্ক।তুরফাকে যখন স্কুলে ভর্তি করানো হয় তখনি শুভার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কবির সাহেব।প্রথম প্রথম শুভা একটু অহং দেখাতো তিমিরের সাথে কথা বলতো না কিন্তু একবার পরীক্ষাতে তিমিরের কাছে হেল্প চাইলে তিমির হেসে তাকে খাতা খুলে দেখায়।সেদিন শুভা বুঝেছিল তিমির বন্ধু হিসেবে কতটা আপন।সেই থেকে তিমিরের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যা এখনো চলছে।তুরফার সাথে যেহেতু শুভ্রর বিয়ের কথা সবাই জানতো তাই শুভা প্রায়ইশ আফসোস করতো,যদি তার আরেক ভাই থাকতো তাহলে তিমিরকে সে বিয়ে দিত।মজার ছলে একজন আরেকজনকে ননদ ভাবি বললেও বাস্তবতায় যে সত্যি তা হবে কেউই জানতো না।ইন্টারে উঠেই একি কলেজে চান্স হয় দু’জনের। তাই শুভা গাড়ি নিয়ে আসলে তিমির সহ একসাথে কলেজ যায়। কলেজ সবে শুরু হয়েছে নতুন স্টুডেন্ট হওয়ায় এখনো তেমন কারো সাথে আলাপ জমে নি তবে হাতে গণা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলেও দুজনে ব্যস্ত তাদের নিয়ে।
তৈরি হয়ে নিচে এসে বসতেই নিপা সরু চোখে তাকালো তিমিরের দিকে।কলেজের ড্রেস পরা অবস্থায় দেখে কপাল কুঞ্চিত হলো।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
“আন্টি এতদিন তো কলেজ যাওয়া হয় নি তাছাড়া পড়া চলে যাচ্ছে তাই ভাবলাম এখন তো আর কাজ নাই তাই কলেজে চলে যায়। তাছাড়া সবে কলেজে উঠেছি এখনি যদি এত গ্যাপ পড়ে তবে সামনে আগাবো কি করে তাই না?”
“সামনে আগাবে তা কীসের সামনে আগাবে পড়াশোনার নাকি বদমাইশির।তোমাকে তো ভালো কোনো কাজে দেখলাম না তাহলে কীভাবে বুঝবো সামনে যাবে নাকি পেছনে?’
“আন্টি এতদিন তো আমি আপনাদের সাথে ছিলাম না তাই আপনি জানতেন না এখন তো আপনাদের সাথেই থাকবো তাই পৃরমাণ হিসেবে দেখে নিবেন আমি কোনদিকে আগাবো।”
দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলো তিমির।তিমিরের হাসি দেখে রেগে উঠলো নিপা।
“বেয়াদব মেয়ে হাসির কি হলো শুনি,তাছাড়া ধাই ধাই করে যে কলেজ যাচ্ছো তোমার খরচ কে দিবে শুনি?’
“আন্টি শুভার খরচ কে দেয়?”
“কেনো?”
“বলুন না। কারণ শুভার খরচ যে দেয় তিনিই আমার খরচ চালাবেন।আমি তো আর বাইরের কেউ না,আপনারই ছেলের বউ।সেই হিসেবে আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া তো আপনাদেরই কর্তব্য তাই না?”
এবার রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো নিপার।
“তুমি নিজেকে কি মনে করো, একটা ঠক হয়ে আমাদের পুত্র বধু হওয়ার শখ জেগেছে?তোমার মতো একটা কুৎসিত আর কালো মেয়েকে আমরা কোনেদিন বউ হিসেবে মানবো না।আর শুভ্র সে তো নয়ই।বড় কথা তোমার খরচ আমরা বহন করতে পারবো না।সেই তুমি যাই করো না কেনো?পারলে নিজের বাবা থেকে নিয়ে এসে খরচ চালাও।একটা টাকাও আমি তোমার পেছনে ব্যায় করবো না।তুমি কালসাপ, দুধ দিয়ে সাপ পোষার ইচ্ছে নেই? তুমি কীভাবে কি করবে তুমিই জানো,আরেকটা কথা নিজেকে এ বাড়ির বউ বলে পরিচয় দিবা না আমি বা শুভ্র কেউ তোমাকো মানি না?”
“আন্টি আপনি না মানলেও আমি মানি।তাছাড়া তিন অক্ষর কবুলে আমাদের বিয়ে হয়েছে তাই আপনার মানা না মানাতে কিছু যায় আসে না।আর হ্যাঁ আপনি খরচ না দিলেও আমার পড়া থেমে থাকবে না আমি নিজেই নিজের খরচ চালাবো।”
তিমির আরকিছু না বলে খাবারটা শেষ করে শুভাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।নিপা বেগম তিমিরের যাওয়ার দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিলেন।
ক্লাসে বসে তিমির ভাবছে কিভাবে সে নিজের পড়াশোনা চালাবে।তখনি শুভা ডাক দিলো
“এ তিমির কি ভাবছিস তুই?”
“ভাবছি কীভাবে টাকা পাবো সেটা।আমি নিশ্চিত বাবা আমার আর কোনো খরচ দিতে পারবে না কারণ মা বাবাকে আটকে রাখবে আবার নিপা আন্টিও কত গুলো কথা শুনালো।যদিও আঙ্কেল হয়তো দিতে চাইবে কিন্তু সেটা নিয়েও তাদের মধ্যে সমস্যা হবে।আমি চাই না আমাকে নিয়ে আন্টি আঙ্কেলের মধ্যে আর কোনো সমস্যা হোক।আমি সবকিছুকে হারিয়েছি আপাতত নিজের পড়াশোনাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই কারণ আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ বিদ্যায় হয়তো আমাকে পরবর্তীতে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে।”
‘তিমির তুই ভাবিস না আমি তোকে সাহায্য করবো বাবাকে বলবো তিনি যাতে তোকে টাকা দেন।”
“না রে তুই আঙ্কেল এমনিতেও আমার জন্য অনেক বকা খাস সেসব দেখতে খারাপ লাগে তারচেয়ে আমি টিউশন করবো সেগুলো দিয়ে মোটামুটি খরচ উঠে যাবে।”
“কিন্তু ভাইয়া যদি কিছু বলে বা নিষেধ করে?”
“শুভ্র ভাইয়া তো জানবেই না তাহলে মানা করবে কি?তিনি তো আমার সাথে কথাই বলে না সেখানে আমার কি লাগবে না লাগবে সেটা জানবে কি করে?বাদ দে আমি আজই কলেজ স্যারের সাথে আলাপ করে দেখবো যদি আমার জন্য কিছু করতে পারে।”
তিমিরের কথা শুনে শুভা চুপ হয়ে গেলো।যতই ফানি হোক না কেন তিমির, নিজের কিছু কিছু কাজে সে যা সিদ্ধান্ত নেয় সেগুলো কখনো এদিক ওদিক হয় না।পড়াশোনার জন্য খরচ যখন নিবে না বলেছে তখন সে তাই করবে।শুভার খারাপ লাগে তিমিরের জন্য। স্কুলে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে তিমিরের বাসায় গেলে সেখানে শান্তার ব্যবহার দেখে রীতিমতো শুভা ভয় পেতো কিন্তু তিমির কত অনায়াসে সেসব হজম করতো।অনেক কষ্ট সয়ে তিমির আজ এ পর্যায়ে।পড়াশোনার জন্য কতো বাঁধা পেয়ছে তবুও ছাড়ে নি।আর এখন মায়ের জন্যও তিমিরকে কষ্ট পেতে হচ্ছে দেখে শুভার মনটা প্রিয় সঙ্গীনির জন্য হাহাকার করে উঠলো।
,
,
,
চলবে……
৪.