#প্রেয়সী 🤎(৩৩)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৬৪.
আজ ক্যালেন্ডারে ইংরেজির নয় চলছে। আমাদের বিয়ের তারিখটা আরও দিন পনেরো পেরিয়ে হওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু হঠাৎ করেই তা আর ৪দিনের মাথায় নির্ধারিত করার সঠিক কোনো কারন আমি এখনও ধরতে পারলাম না! বড় খালামনি,মেঝ খালামনি,চাচা-চাচি,বড় খালু,মেঝ খালু সব গুরুজনরাই বিয়ের তারিখ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন! গবেষণায় বের হলো আর চারদিন বাদে শুক্রবার-১৩ তারিখ। শুক্রবারে বিয়ে পড়ালে অগ্রীম সওয়াব মিলবে। তাই আগামী ১৩ তারিখই বিয়ের জন্য নির্ধারিত করা হলো। গুরুজনরা সবাই বসে থাকলেও আমরা ছোটরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম! অবশ্য আমি দাঁড়াতে চাইনি! কিন্তু খালামনির কঠোর আদেশে আমাকেও দাঁড়াতে হয়েছে। ১৩ তারিখ বিয়ের ডেট ফাইনাল হতেই হুল্লোড় করে উঠলো সবাই। আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম মুহুর্তেই! ব্যাপারটা যেন
ভ/য়ং/ক/র লাগছে আমার কাছে। এখানে আমার বিয়ের তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে আর আমি কিনা লজ্জা-শরম খুইয়ে হা করে বড়দের কথা গিলছি!
রাহিয়ানের বন্ধুরা উনাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছেন! আর এদিকে রাই,নিতু আপু,রিম্মি আপু,বউমনি তারাও কম যায়না! একেক জনে বালতি ভরে ভরে লজ্জা ছুড়ছে আমার দিকে! আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না! লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা মুখ-খানা লুকাতেই দৌড়ে পালালাম সবার থেকে! কিন্তু পালিয়েও কি শান্তি আছে? ঠিকই পেছন পেছন সব দৌড়ে এলো।
কাল হবে বিয়ের শপিং! সেই নিয়েই লিস্ট নিয়ে বসেছে বউমনি আর রিম্মি আপু। সাথে যোগ হয়েছে নিতু আপুও। বিয়ের ক’টা দিন চাচা-চাচি,নিতু আপু আর হিমেল ভাই সবাই এ বাড়তেই থাকবে। রানিকেও আনার কথা বলা হলে চাচি জানালো ওর মায়ের শরীরটা ভীষণ খারাপ! তাই ও গ্রামে গিয়েছে। বিয়ের দিন যদি সুযোগ হয় তবে ঠিকই আসবে। রাইকে আন্টির থেকে পারমিশন করিয়ে একদম সাতদিনের জন্য রেখে দিয়েছি। আমার সব কিছুতে মেয়েটা না থাকলে যেন শান্তিই পাই না।
ফাহিম ভাইয়া গাল ফুলিয়ে আছে! তারও ইচ্ছে তার প্রান প্রিয় বোনের বিয়েতে যেন তার প্রান প্রিয় সখী শুরু থেকে শেষ অব্দিই থাকে! কিন্তু হিয়া আপুর রা-গী বাবা মেয়েকে বাইরে রাত কাটানোর জন্য পারমিশন দিতে অমত করছেন। বিয়ে হোক আর যাই হোক সে কিছুতেই রাজি হবেননা বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। সেই দুঃখেই ভাইটা আমার কাতর। কি বলে স্বান্তনা দেয়া যায় ভেবে কল ঠুকে দিলাম হিয়া আপুর বাবার কাছে। তাও আবার যে সে কল নয়, একদম ভিডিও কল। আমি বিয়ের কনে হয়ে তার কাছে অনুরোধ করাতে মানুষ টা হঠাৎই পানির মতো গলে গেলো। মিষ্টি করে হেসে আমায় স্নেহ ভরা কন্ঠে বারবার ডেকে বলল,
—-” আমার মেয়েটাকে তোমার ভরসায় পাঠাচ্ছি মা। আমার আর কোনো চিন্তা নেই! বিয়ের পর নতুন জামাই-বউ অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবে কিন্তু।”
আমিও বিগলিত হেসে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম,
—-” হিয়া আপুর এ বাড়িতে কোনো সমস্যা হবেনা আঙ্কেল। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকবেন। আর আমরা অবশ্যই আপনাদের বাড়িতে আসব। খুব শীঘ্রই আসব। সব কিছু জোগাড়যন্তর করে রাখবেন কিন্তু।”
লোকটা হাসতে হাসতে কল কাটল। হিয়া আসছে শুনে ফাহিম ভাইয়ার মেজাজও এবার বেশ ফুরফুরে। এই মানুষটাই আমাদের সবার থেকে একটু বিপরীত ধর্মী। সারাক্ষণ হাসি-মজার মধ্যমণি হিসেবে কিন্তু উনাকেই পাওয়া যাব। আর তারই যদি কোনো কারনে মন খারাপ থাকে তা কি দেখতে ভালো লাগে?
হঠাৎ বিয়ের তারিখ পড়ায় বেশিরভাগ মেহমানই যেন খাদে পড়লেন। এই চারদিনে কি করে কি হবে বাড়ির লোকের থেকে তাদেরই যেন মাথা ব্যাথা বেশি। অনেকে তাড়াহুড়োর উপর এসে হাজির হয়েছে! আর বাকিরা আজকাল এসে যাবেন বলে জানালেন! অল্পবিস্তর লোকজনেই বাড়ির এক কোন যেন কোলাহলপূর্ন। বিয়ের আমেজে রঙ লেগেছে সবার মনে। কমবেশি মানুষের নজর এড়িয়ে হঠাৎ আমায় একলা ডেকে পাঠালেন মহাশয়! ছাদে মানুষের আনাগোনা এখনও তেমন নেই বলেই আপাতত ছাদের যাওয়ার বার্তা নিয়ে পাঠালেন ফাহিম ভাইয়ার হাত থেকে। ফাহিম ভাইয়া চোখ জোড়া সরু করে হাতে ছোট্ট চিরকুট খানা গুঁজে দিয়ে বলল,
—-” শোন বুড়ি, আজ তুই আমার একটা ফেভার করলি বলে আমিও তোর একটা ফেভার করে দিলাম! তোর হবু বরের চিরকুট! কেউ দেখার আগে টুপ করে পড়ে নে তো!”
আমি লজ্জায় মাথা নুইয়েই চিরকুটটাতে চোখ রাখতে দেখা মিলল তার গোটাগোটা অক্ষরের লেখা!
—-” পাঁচমিনিটের জন্য ছাদে এসো!”
লেখাটা পড়তেই মনের মধ্যে অদ্ভুত সব অনুভূতি হতে লাগল। ওলট পালট অনুভূতিগুলো কে সামলে যাবো কি যাবো না ভেবে ভেবেই পার করে ফেললাম আধাঘন্টা! অবশেষে যদিও বা গেলাম তবে একলা যাইনি! সঙ্গে করে পুরো একখানা গ্যাং নিয়ে হাজির হয়েছি। উনি আমার সাথে এতো মানুষজন দেখে ভড়কে গেলেন বুঝি! বোবা চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলে উঠলেন,
—-” কথাগুলো দেখছি বিয়েটা সেরেই বলতে হবে। অন্যথা এই সিকিউরিটি গার্ড আমার ইজ্জতের বারোটা বাজাবে।”
কথাগুলো বাকিরা স্পষ্ট না শুনলেও আমি বেশ স্পষ্টই শুনলাম! বেচারা আর কিছু বলতে না পেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাথা চুলকে নীচে নেমে গেলেন। আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকা পাবলিক গন উনার যাওয়া দেখে মুখ টিপে হাসতে হাসতে শ-খানিক লজ্জার বান ছুড়ল আমার দিকে।
সারারাত ধরে মানুষগুলো হুতুমপেঁচার মতো জেগে থেকে ক্যাটারিং থেকে শুরু করে বিয়ের রান্না-বান্নার কি কি আইটেম হবে তা অব্দি ঠিক করে ফেললেন। আমার ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ফাহিম ভাই আর হিমেল ভাইয়ের চেঁচামেচির আওয়াজে! ধড়ফড়িয়ে উঠে বিছানার চাদর আকড়ে বসে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর আবারও চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসতেই লাফিয়ে নেমে দৌড়ে এলাম ব্যালকনিতে। চেঁচামেচির আওয়াজ পেছনের গার্ডেন থেকেই আসছে! ব্যলকনি ধরে দাঁড়াতেই বোধগম্য হলো তারা রান্নার লোকেদের কাজ বোঝাচ্ছে! খুব সম্ভব তাদের টিম লিডার কানে কালা! ফাহিম ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া দাঁত কেলাতে কেলাতে চেঁচাচ্ছে তার সাথে! বারবার হিমেল ভাইও তাল মেলাচ্ছে উৎসাহিত কন্ঠে। আরফান ভাইয়া আছেন তাদের পাশেই। কান্ড দেখছেন বদের হাড্ডি গুলোর। আমি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পাশের ব্যলকনিতে তাকাতেই দেখি জনাবেরও একই দশা! গোছালো মানুষটা ঘুমের রেশ কাটানোর বৃথা চেষ্টায় অগোছালো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে যে একরাজ্য ঘুম নিয়ে দাঁড়িয়ে তা তার হাই তোলার ধরনেই বেশ বুঝতে পারলাম।
চোখে ঘুম থাকলেও মনের মাঝে চেপে আছে একরাশ বি-র-ক্তি! খুবই স্বাভাবিক, এই ভোর বেলায় কেউ কানের পাশে থেকে এভাবে চেঁচামেচি করলে রাগে দুঃখে পঁচা পানিতে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। তবে ইচ্ছেটা নিতান্তই তার করলেও আমার করল না। মেয়েদের বিয়ের দিন ঠিক হতেই নাকি তারা বিয়ে হওয়ার আগ অব্দি আর দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনা! তারা যে আগাম ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় মশগুল তা কিন্তু নয়! কেবলই অহেতুক ব্যাপার। এর বিশেষ ব্যাখা কার কাছে পাবো জানিনা। জানার আগ্রহও করলাম না! কেবল জেনে রাখলাম এটাই নিয়ম। বিয়ের আগ অব্দি মেয়েরা আর ঘুমোতে পারেনা মুলত এটাই নিয়ম। আমিও সেই নিয়মই পালন করে চলেছি। রাহিয়ান করছেন কি না জানিনা! তবে এই মুহুর্তে মুখের এমন দশা দেখে বোঝা যাচ্ছে রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি তার।
—-” সুপ্রতাম ম্যাডাম।”
উনার ঘুমঘুম কন্ঠে ভাবনার জগতকে ছুটি দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। উনার স্নিগ্ধ শীতল চাহনি আমাতেই আঁটকে আছে। ফাহিম ভাইয়াদের ছেড়ে কখন আমাতে আঁটকালেন খেয়াল করা হলো না। আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি জুড়লাম। চোখের ভারি পল্লব ফেলে নরম কন্ঠে বললাম,
—-” সুপ্রভাত।”
—-” রাতে ঘুম কেমন হলো?”
সত্যি বলা বাহুল্য হলেও মিথ্যে বলেই চালালাম। চোখ ঝাপটে মাথা নেড়ে বললাম,
—-” বিন্দাস ঘুম হয়েছে। এরকম বিন্দাস ঘুম বোধহয় কয়েক বছরেও ঘুমোইনি!”
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলেন উনি। আমার ন্যায় মাথা নেড়ে বললেন,
—-” আমারও তাই। এমন ঘুম বোধহয় বারো বছরেও হয়নি!”
আমি উৎফুল্ল স্বরে বললাম,
—-” সত্যি?”
—-” হুম একদম সত্যি। দেখো, এমন ঘুম হয়েছে যে এদের সামান্য চেঁচামেচি শুনে বাড়িতে ডাকাত পড়ল কিনা সেই ভয়ে তেড়েফুঁড়ে আসলাম!”
আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম,
—-” আমি ভেবেছি মা/রা/মা/রি লেগেছে!”
আমার কথায় হেসে ফেললেন উনিও। মুহুর্তেই আর জবাব দিলেন না আমায়। ফাহিম ভাইয়াদের দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠে বললেন,
—-” কি রে ব্যাটা বিয়ের আগেই কি শান্তির ঘুমের ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দেওয়ার তালে আছিস নাকি?”
রাহিয়ানের গলা পেয়ে চমকে উঠে তাকাল সবাই। আরফান ভাই আর ফাহিম ভাই জিহ্বায় কামড় বসালেন তৎক্ষনাৎ। জিয়ান ভাই আর হিমেল ভাই মুখ চাওয়াচাওয়িতে ব্যস্ত। আরফান ভাই রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই উনার নজরে আমিও এলাম। বেচারার মুখখানা তৎক্ষনাৎ কালো হয়ে গেলো। হয়ত তাদের ভাবনাতেও ছিলো না তাদের গলা পেয়ে আমরা এভাবে উঠে পড়তে পারি!
জিয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
—-” ভাই, কয়ডা দিন একটু কষ্ট! তারপর সুখই সুখ!”
রাহিয়ান চোখ জোড়া সরু করে তাকালো। পাশ থেকে জিয়ান ভাইয়াকে ঠেলে আরফান ভাই বলে উঠলেন,
—-” সরি রে দোস্ত! আমাদের কথা যে তোদের রুম ভেদ করবে বুঝতে পারিনি! সরি নিধি!”
আমি না সূচক মাথা নেড়ে ছোট্ট করে হাসলাম। অর্থাৎ, চিন্তা নেই! আমার কোনো সমস্যা হয়নি!
রাহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-” বাট আমার অনেক সমস্যা হয়েছে! প্লিজ আমি ঘুমোতে চাই!”
উনার বাচ্চাসুলভ কন্ঠে আমি আরফান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। আরফান ভাইও হাসতে লাগলেন রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে। অতঃপর ভরসা চোখে তাকিয়ে বললেন,
—-” যা দোস্ত নিশ্চিন্তে ঘুমো। তোকে আর কেউ ডিস্টার্ব করবেনা!”
উনি হাসলেন মাথা চুলকে। আরফান ভাই তাদের কাজে মনোযোগ দিতেই উনি গলারস্বর টা খানিকটা নীচু করে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
—-” কাছে বউ থাকলে ড্যাম সিওর আমাকে কেউ টেনে হিঁচড়েও উঠাতে পারত না! কিন্তু কি করার? মাঝেমধ্যে বউয়ের টেনশনেও উঠে পড়তে হয়, বউটা আবার হারিয়ে গেলো কি না!”
কথাটা বলেই চোখ টিপলেন উনি। আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বললাম,
—-” মুখে অবশ্যই লাগাম টানতে হবে। এসব কথা কেউ বলে?”
উনি হেসে ফেললেন। মাথা চুলকে চমৎকার হেসে বললেন,
—-” বউয়ের সাথে মশকরাতেও কিন্তু ঝুড়িঝুড়ি সওয়াব আছে বিবিজান।”
৬৫.
কাঠফাটা রোদের মধ্যে একেক জনে হাতে কম করে হলেও দশটা দশটা শপিংব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় ফেরার তাড়া হচ্ছে। রোদকে মাড়িয়েই আস্তে ধীরে গাড়িতে উঠতে লাগল সবাই। আমি আগেই উঠে বসেছি জনাবের আদেশে। আদেশ কেবল উনার একার নয়, বাড়িসুদ্ধ সবার! বিয়ের কনে এভাবে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না।
বাকি গাড়ি গুলো আসতে আসতে ততক্ষণে আমাদের গাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হোক বলে বড়খালু এবং বড়খালামনির হুকুম। হুকুম পালনে রাহিয়ানও উঠে এলেন গাড়িতে। সেই সাথে উঠল ফাহিম ভাইয়া, হিয়া আপু,নিতু আপু আর রাফিন ভাইয়া। সকাল সকাল শপিংএর জন্য বের হয়ে বেশ তাড়াতাড়িই শেষ করা গেলো এই ঝামেলা। সময় কম হলেও কেউ বলতে পারবেনা এতোগুলো ড্রেস একত্রে কিনে কেউ ঠকেছে। সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিশেষ করে খালামনিদের।
মায়েরা বরাবরই এই শপিংএর ক্ষেত্রে বেশ কড়া। দোকানী যদি বলে,’আপা এই ড্রেসটা হাজার দুয়েকের নীচে হবেনা।’ দোকানীর রায় শুনে তারা বেশ স্বাভাবিক রিয়াকশন দেয় বটে কিন্তু বিপরীতে ঠিকই একখানা অস্বাভাবিক কথা বলে বসে। চুপচাপ শান্ত ভঙ্গিতে বলে বসবে, ‘চারশ দিলে দেন না দিলে উঠলাম!’ দোকানী অবশ্য থতমত খেয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন বটে। কিন্তু শেষ অব্দি মায়েদের ঠিক করা দামেই তারা ড্রেস প্যাক করে দিয়ে হাসি মুখে বলবেন, ‘আচ্ছা আপা আবার আসবেন কিন্তু।’ রিম্মি আপুর থেকেই শোনা মেঝ খালামনি নাকি বরাবর তাকে নিয়ে শপিংএ এসে এই কাজই করেন।
আজ যদিও টাকা খরচাতে কারোর কড়াকড়ি ছিলো না তবুও তাদের দাম মোতাবেকই দোকানীরা সব কিছু দিয়ে দিলেন। আমি তো কেবল দেখলাম আর অবাক হলাম। এতোসব কিছুর মাঝেও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সাক্ষী হলাম। আরফান ভাই রাইকে নিয়ে বেশ আগ্রহী। সবার নজর এড়িয়েই সে রাইয়ের বেশ ভালোই যত্নআত্তি করলেন দেখা গেলো। দেখতে বেশ লাগছিলো। আমার মনটা যেন না চাইতেও বলে উঠলো দু’জনকে বেশ মানাবে।
—-” তোমার এখনও ক্ষিদে পায়নি?”
ড্রাইভিং সিটে বসে দু’হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে কথাটা বলে উঠলেন রাহিয়ান। আমার ভাবনার তাল ঘেঁটে গেলো। দৃষ্টি সামনের অদূর থেকে তুলে এনে উনার উপর আঁটকানোর প্রচেষ্টা করলাম। যতক্ষণে সফল হলাম ততক্ষণে পেট চেপে কাতর কন্ঠে জবাব দিল ফাহিম ভাইয়া,
—-” ভাইয়া খুব জোর ক্ষিদে পেয়েছে রে! আশেপাশে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে দাঁড় করা না গাড়িটা?”
কথাটা বলার প্রায় সাথে সাথেই তার পেট বরাবর গুঁতো বসালো হিয়া আপু। আর সামনে থেকে উনার ক্ষে-পা গলায় উত্তর গেলো,
—-” খেয়ে খেয়ে নিজের হাল টা কি করেছিস দেখেছিস একবারও? এই দশমিনিট আগেও দুই প্যাকেট চিপস্ আর দুই লিটারের কোকের বোতলটা তুই একাই শেষ করলি! আবার এক্ষনি বলছিস খুব জোর ক্ষিদে পেয়েছে? এতো খাবার যে খাস সব কোন রাস্তা ধরে হজম হয় বলতো?”
রাফিন ভাইয়া হেসে উঠলেন বেশ শব্দ করে। তাল দিলেন নিতু আপু আর হিয়া আপুও। ফাহিম ভাই আহত নয়নে তাকালো হিয়া আপুর দিকে।
—-” তো কি ক্ষিদে পেলে বলবো না?”
হিয়া আপু হাসতে হাসতে না সূচক মাথা নাড়ল! আমি এদের কান্ড দেখে ফাহিম ভাইয়ার সাইড নিয়ে বললাম,
—-” ঠিকই তো। ভাইয়ার ক্ষিদে পেলে বলবেনা? এমন করে কেন বলছেন ভাইয়াকে?”
আমার কথায় ফাহিম ভাইয়া বুক ভরে শ্বাস নিলো। রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই রাহিয়ান বলে উঠলেন,
—-” ওর এতো ক্ষিদে পাওয়া তো স্বাভাবিক নয় নিধি। বেয়াদবটা তো দিনদিন অস্বাভাবিকে পরিণত হচ্ছে।”
রাহিয়ানের কথাটায় আরও একদফা হাসির রোল পড়ে গেলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। ফাহিম ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে ভাইয়াকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে উনাকে বললাম,
—-” আপনি মোটেই আমার ভাইকে অস্বাভাবিক বলতে পারেন না বলে দিলাম। ভাইয়া কিন্তু মোটেই অস্বাভাবিক নয় এবং অত বেশিও খায়না। আরে বাবা সামান্য একটু ফাস্টফুডে কি পেট ভরে নাকি? ভারি কিছু খেলেই না পেট ভরবে! আপনিও না পারেন বটে।”
আমার কথার তালে তাল মিলিয়ে ফাহিম ভাইয়া কথা বলতে নিলেই আবারও বাঁধ সাধলেন রাহিয়ান। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
—-” তুমি কাল রাত থেকে না খেয়ে। ভোরের দিকে নিতু তোমায় জোর করে একটু খাওয়ালো বলে খেলে। তাও কি খেলে একটা রুটি আর এতোটুকু গাজরের ভাজি। তারপর থেকে কিন্তু এই দুপুর তিনটে বাজে এখনও অব্দি খাওয়ার নাম নাওনি তুমি। আমি ফাহিম কে অস্বাভাবিক বলছি কিন্তু আমি তো ভুল। উচিৎ তো তোমাকে অস্বাভাবিক বলা। না খেতে খেতে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছ তুমি। আচরনও কিছু অস্বাভাবিকের থেকে কম নয়!”
আমি জ্বলে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে উনার বিরূদ্ধে কিছু বলতে নিলেই ফাহিম ভাইয়া আমার হয়েই প্রতিবাদ করতে লাগল। লোকটা রীতিমতো আমাদের দুই ভাইবোনকে অস্বাভাবিক বলছে। অস্বাভাবিক মিনস প্রতিবন্ধী! দিস ইজ টু মাচ। উনাকে বোঝাতে হবে আমরা মোটেই অস্বাভাবিক নই! বরং উনি উনার এমন অদ্ভুত আচরণে প্রমান করে দিচ্ছেন যে উনিই অস্বাভাবিক। কিন্তু এমন কথা বলার সাহস যে আমি বা আমার ভাই কেউই রাখিনা। তাই ফাহিম ভাইয়ের প্রতিবাদ করা দেখে আমি চুপ করে রইলাম। কি বলব? কিছুই বলার নেই।
#প্রেয়সী 🧡(৩৪)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৬৬.
গাল বরাবর পরপর দু’টো থাপ্পড় পড়তে আমার সামনেই হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে গেলো অরিন আপু। ভ*য়ং*ক*র রাগে আ*গু*নের লা*ভা গলে গলে পড়ছে রাহিয়ানের চোখ থেকে! আমি ভ*য়া*র্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বিছানা থেকে নেমে ঝাপটে ধরলাম উনাকে! কাশতে কাশতে গলা থেকে বুঝি র*ক্ত বেরিয়ে আসবে এক্ষনি। উনি অস্থির হয়ে শক্ত করে আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরলেন! আমার ভাবনাতেও ছিলো না উনি এমন সময় আমার ঘরে আসতে পারেন। আর অরিন আপুও হঠাৎ এমন কান্ড করে ফেলতে পারে! অবশ্য ইদানীং আমার ভাবনাকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, আজকাল যা কিছুই ঘটছে সবই আমার ভাবনার বাইরে।
রাত ৮টা বেজে ১৩ মিনিট। ঘড়িতে সময়টা দেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রাতে ঘুমটা ঠিকঠাক না হওয়াতে এখন বেশ ক্লান্তই লাগছে শরীরটা। শপিং থেকে বাসায় ফিরে আর রেস্ট নেওয়া হয়নি! তাই হয়তো আরেকটু বেশি ক্লান্ত লাগছে। বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে অনুযায়ী ছেলেরা খুব সহজেই আসতে পারলেও মেয়েদের বেলায় সবাই একটু গোড়ামি সবাই করে। হিয়া আপুর বেলায় তার বাবা যেমন করলেন ঠিক তেমনি অরিন আপু এবং অনন্যা আপুর বেলাতেও করলেন। গতকালই আরফান ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া আসতে পারলেও, আসতে পারলোনা অরিন আর আর অনন্যা আপু। তবে একদিন পেরোতেই তারাও এসে হাজির হলেন। পুরনো কথা আর মনে না রেখেই আমি অরিন আপুর সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললাম। একই ভাবে রাহিয়ানও নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার খাতিরে ভুলে গেলেন সেদিনের কথা। যদিও অরিন আপুর বলা একটা কথাও আমি তাকে জানায়নি! কেবল বলেছিলাম অরিন আপু তাকে ভালোবাসে। তবে সেটা সত্যিই ভালোবাসা ছিলো নাকি কেবলই কেশবের উসকানি ছিলো সে-ই হয়তো ভালো জানে।
আমি বিছানায় শুইয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে যেন ঘুম আসবে কিন্তু আসলে ঘুম আসছে না। ব্যাপারটা চরম অশান্তির। হঠাৎই আগমন ঘটল অরিন আপুর। আমি ঘুমাবো ভেবে এক এক করে সবাই রুম খালি করে দিয়ে চলে গেলো। উনাকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি উঠে বসলাম তৎক্ষনাৎ! মুখে মলিন হাসি দিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে তাকে ডাকলাম। সেও এগিয়ে এলো শুঁকনো মুখে। আমি আবারও ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
—-” কাউকে খুঁজছেন আপু?”
শুঁকনো মুখ করে থাকা মানুষটা আচমকাই ক্ষে*পে গেলো আমার উপর। আশেপাশে নীরবতা বুঝেই আচমকা গলা চেপে ধরল আমার। আমি বোকা মানুষ ভ*য়া*র্ত চোখে তার আ*ক্রো*শ দেখে ছটফট করতে লাগলাম। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আমি হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি! বাবাকে হারানোর মতোই তেমন এক কঠিন দুঃস্বপ্ন! দুর্বল শরীরটা এমন অকেজো হয়ে গেলো যে উনাকে ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারছিলাম না! কেবল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলাম। উনি হিং**স্র চাহনি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন,
—-” বলেছিলাম না বিয়েটা ক্যানসেল করে দাও!! শুনোনিতো আমার কথা? তাহলে এবার ম**রো তুমি! তুমি ম**র**লে তো বিয়েটা এমনিতেও ভন্ডুল হবে।”
বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার সময়টা ফুরিয়ে আসছে! চোখে জলের বদলে খন্ড খন্ড র**ক্ত জমাট বাঁধছিলো! গলার আওয়াজটা কেমন ফ্যাচফ্যাচ শোনাচ্ছিলো! আর তারপর হঠাৎ করেই রাহিয়ানের আবির্ভাব ঘটল! উনি কোত্থেকে এলেন জানিনা। কিন্তু উনি যে আমার জীবন বাঁচাতে ফেরেশতার মতো হাজির হলেন তা হলফ করে বলত পারি! আমি এখনও কাশছি! ভীষণ ক**ষ্ট হচ্ছে। গলার কাছটাতে এখনও মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চেপে আছে। এখনও নিঃশ্বাস নিতে ভারী ক**ষ্ট হচ্ছে! উনাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি! আমার কান্নার শব্দ কানে যেতেই উনি পা*গ*লে*র মতো করতে লাগলেন! আমাকে নিজের থেকে টেনে তুলে জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন,
—-” খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার জান? প..পানি! পানি খাবে! বসো?বসো বসো। আমি পা..নি দিচ্ছি তোমায়! প্লিজ কেঁদো না নীলাদ্রিতা! কেঁদো না! প্লিজ কেঁ,,দো না!”
রাহিয়ান দৌড়ে গেলেন পানি নিতে। পানি নিয়ে আবারও এসে হাজির হলেন আমার সামনে! আমার হাতে পানিটা দিতে দিতে ততক্ষণে উঠে দাঁড়ালেন অরিন আপু! আমার দিকে তেড়ে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলেন রাহিয়ান। অরিন আপুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আর পেছন ফিরে আমার দিকে না তাকিয়েই শান্তস্বরে বললেন,
—-” পানি টা খেয়ে নাও নীলাদ্রিতা।”
উনার দিকে ক্ষে**পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল অরিন আপু,
—-” খুব দরদ নীলাদ্রিতার জন্য তাই না? একটা দুইদিনের মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা কোথা থেকে আসে বল? এতগুলো বছর ধরে যে পা*গ*লের মতো করে তোকে ভালোবেসে এসেছি কই কখনো তো এমন দরদ করিসনি? কেন বলত? কেন তোর জন্য এতকিছু করেও তোর থেকে ভালোবাসা পাইনি! কেন তুই কখনও আমাকে ভালোবাসিসনি রাফিদ?(চিল্লিয়ে) ঐ বিশ্রী কালো দেখতে মেয়েটার মধ্যে তুই এমন কি পেয়েছিস যা তুই আমার মধ্যে পাসনি? আমি তো ওর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী! তবুও কেন ভালোবাসতে পারলি না আমাকে?”
রাহিয়ান থমথমে মুখে কতক্ষণ চেয়ে থেকে আবারও ঠাসস করে একটা চড় বসাল অরুন আপুর গালে। অরিন আপু ঢলে পড়ল খানিকটা! পূনরায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গালে হাত চেপে হিং**স্র চোখে তাকালো! দ*হ*নের আ*গু*নে পুড়তে পুড়তে আবারও তেতে উঠল সে।
রাহিয়ানের কলার চেপে রা*গে ফুঁসে উঠতেই আবারও এক রাম চড় মা*র*লে*ন রাহিয়ান! আমি এবার গ্লাস ফেলে দাঁড়িয়ে গেলাম! থাপ্পড়ের আ*ঘা*তে অরিন আপুর দু’টো গালেই স্পষ্ট দাগ বসে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরে আকুতি ভরা চোখে তাকালাম! কি হচ্ছে এসব? অরিন আপু অ*ন্যা*য় করলেও উনি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে কিছুতেই একটা মেয়ের উপর হাত উঠাতে পারেননা! এটা ঠিক নয়! যদি শা*স্তি দিতে হয় তবে অন্য ভাবে দিক! তবুও এভাবে নয়। আমার আকুতিভরা চাহনিতে উনি ভ্রুক্ষেপ ঘটাতে পারলেন না। আমাকে পাশ কাটিয়ে আচমকাই অরিন আপুর গলা চেপে ধরলেন উনি! আমি আঁ*ত*কে উঠে মুখ চেপে ধরলাম। অরিন আপু ছটফট করতে লাগলেন তৎক্ষনাৎ! অরিন আপু হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেও উনাকে নাগাল পাচ্ছেন না। আমি আবারও ছুটে গেলাম উনার দিকে। উনার শক্ত হাতটা ধরে টানাটানি করতে লাগলেই উনি হিং*স্র চোখে তাকালেন আমার দিকে! আমি ভ*য় পেয়ে চুপসে গেলাম। উনার চোখে দাউদাউ করে আ*গুন জ্ব*ল*ছে। উনি অরিন আপুকে এতো সহজে কিছুতেই ছাড়বেন না।
—-” তোর প্রশ্নগুলো বেশ ছিলো। কেন আমি তোকে ভালোবাসিনি? কাউকে ভালোবাসতে হলে তার মধ্যে রূপ নয় যেটা প্রয়োজন সেটা হলো তার সুন্দর মনমানসিকতা! যা তোর আজও নেই আর আগেও কখনো ছিলো না! তুই ভাবলি কি করে তোর মতো এত নীচু মন-মানসিকতার একটা মানুষকে রাহিয়ান রাফিদের মতো একটা ছেলে ভালোবাসবে? সব সময় তো বেশ বড়াই করে বলিস আমি হলাম বিশ্ব সুন্দরী, আমার মতো এতো সুন্দরী দুনিয়াতে আর দুটোও নেই! আচ্ছা কখনও তোর মাথায় এটা আসেনি রূপ তো আল্লাহর বরকত দানে পেয়ে গিয়েছি কিন্তু মানসিকতাটা নিজের থেকেই পরিবর্তন করতে চেষ্টা করি! আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি অরিন যেদিন তুই রাইয়ের ব্যাপারে রূপের কাছে উল্টাপাল্টা কথা বলে ওদের সম্পর্কটা ভে/ঙে দিয়েছিস। আজ যে রাই আর রূপ আলাদা সেটা কেবলই তোর জন্য!”
উনি থামলেন। রা*গে,হিং*স্র*তা*য় উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে! এদিকে আমি হতবিহ্বল চোখে কেবল উনার কথা শুনে যাচ্ছি। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল রাই আর রূপ ভাইয়ার কথাটা শুনতেই! তার মানে এই মেয়েটার জন্য রাই আর রূপ ভাইয়ার এই বিচ্ছেদ!
উনি আবারও বলতে লাগলেন,
—-” বুুঝলাম, তুই না হয় আমাকে ভালোবাসিস বলে নিধির সাথে এমন জ*ঘ*ন্য আচরণ করেছিস কিন্তু রাই আর রূপের দোষ কি ছিলো? আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি যেদিন জানতে পেরেছিলাম অনন্যা আর ইভানের সম্পর্কটা ভে*ঙে যাওয়ার পেছনেও কেবল একমাত্র তু-ই দায়ী! ইভানের কাছে গিয়ে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের নামে এমন সব কথা বলেছিস যে ইভান অনন্যার সাথে ওর সম্পর্ক ভে*ঙে দিতে বাধ্য হয়েছে! এরপরও তুই জানতে চাস আমি তোকে কেন ভালোবাসিনি? কারন গুলো তোর সামনে সব তুলে ধরলাম। এবার বল এরপরও আমি তোর মতো এমন একটা নোং**রা মনের মানুষকে কি করে ভালোবাসতে পারি? শুধু এখানেই শেষ নয় অরিন! তুই এতোটাই খারাপ যে কেশবের মতো একটা ছেলের সাথে হাত মিলিয়েছিস! নিধিকে এই বিয়ে ভে*ঙে ফেলার জন্য নানান ভাবে মানসিক ট*র্চা*র করেছিস! কেশবের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দিতে বলেছিস! আমি এই সব কিছু জানা স্বত্বেও তোকে কোনো দিনও একটা পাল্টা প্রশ্ন করিনি! ভেবেছিলাম মানুষ সবসময় এক থাকে না! তুইও থাকবি না। একদিন ঠিকই তুই পাল্টাবি, তোর এই স্বভাব গুলো পাল্টাবে। কিন্তু না, আমি ভুল! তুই বরাবরের মতো আজও আমাকে ভুল প্রমান করে দিলি! আজ তোর সত্যি আর বাঁচার পথ নেই। আমার হাত থেকে তোকে বাঁচাতে পারবে এমন কারোর জন্ম আজও অব্দি হয়নি! তুই আমার কলিজায় হাত রেখেছিস! আমার কলিজাকে তুই আ*ঘা*ত করেছিস! মে**রে ফেলতে চাইতেও তোর বাঁধল না বিবেকে। কিন্তু নিয়তি বলেও কিছু হয় তাই না? যেখানে তুই শুধু আ*ঘা*ত করেই যাবি আর পাল্টা আ*ঘা*ত কখনও পাবিনা তা তো হয় না!”
উনার মুখে একটার পর একটা কথা শুনতে আমার মাথায় চক্কর কেটে উঠল! কি বলছে মানুষটা। অরিন আপু মানুষটা এতোটা নোং*রা মনমানসিকতা কি করে পো*ষন করে! কখনও কি নিজের মধ্যে অপরাধ বোধও কাজ করে না?
আমার পা থেকে মাথা অব্দি কাঁপতে লাগল। আমি আর নিতে পারছিনা এসব। নিজেকে কেমন পা*গ*ল পা*গ*ল লাগছে আমার! ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়তেই দৌড়ে এলো অনন্যা আপু,ফাহিম ভাইয়া, নিতু আপু রাই! আমি চমকে উঠে তাদের দিকে তাকাতেই দরজার সম্মুখে একগাদা মানুষ চোখে পড়ল। তারা কখন এলো? আমি তো কোনো শব্দ পাইনি! পেছন থেকে ভীর ঠেলে দৌড়ে এলো আরফান ভাইয়া, জিয়ান ভাইয়া, আর রাফিন ভাইয়া। রাহিয়ানকে আরফান ভাইয়া আর রাফিন ভাইয়া ধরে টেনে পেছনের দিকে আনার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন। ততক্ষণে অরিন আপুর ম*র*ন দশা! ফর্সা মুখখানা র*ক্তশূণ্য হয়ে বি*ভৎ*স লাগছে। আরফান ভাই রাহিয়ানকে একটু সরাতে পারলেই অরিন আপুকে হেঁচকা টানে বের করে আনলেন জিয়ান ভাইয়া! অরিন আপুর গলা থেকে হাত সরে যেতেই কাশতে কাশতে বেহাল অবস্থা হয়ে গেলো তার। রাহিয়ান আবারও তার দিকে তেড়ে যেতেই আরফান ভাই তাকে টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
—-” রাফিদ কি করছিস টা কি তুই? পা*গ*ল হয়ে গেলি নাকি? মেয়েটা ম**রে যাবে তো!”
ক্ষে*পা*র উপর পাল্টা জবাব দিলেন রাহিয়ান,
—-” আমার সামনে থেকে সরে যা আবির! ওকে আজ আমার হাতে ম*র*তে*ই হবে। ও যা করেছে তা…”
—-” মানছি ও অ*ন্যা*য় করেছে রাফিদ কিন্তু তাই বলে তো ওকে আমরা এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা!”
রাফিন ভাইও কথার রেশ টানলেন আরফান ভাইয়ের।
—-” একদমই তাই রাফিদ। ওর যেকোনো ভুলেই আমরা ওকে এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা।”
রাহিয়ান মানলেন না কারোর বারন। উনি হিং**স্র চোখে অরিন আপুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললন,
—-” রাহিয়ান রাফিদ চাইলে সব পারে।”
অবস্থা বেগতিক বুঝেই জিয়ান ভাইয়া অরিন আপুকে রুম থেকে বের করে দিলেন। রাহিয়ান অরিন আপুর যাওয়ার পানে তেড়ে যেতে নিলেই তার হাত ধরে ফেললাম আমি। টলমলে চোখে উনার সামনে দাঁড়াতেই মানুষটা নরম হয়ে গেলেন মুহুর্তেই। হয়ত বুঝলেন তার এই কঠিন রুপে আমার ভীষণ ভ*য় হচ্ছে। উনি আমার দু’গালে হাত রেখে কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ একে শান্ত কন্ঠে বললেন,
—-” কিচ্ছু হয়নি নীলাদ্রিতা। সব ঠিকাছে। ভয় নেই আমি তো আছি সবসময় তোমার জন্য।”
আমি মুখ উঁচিয়ে উনার তাকাতেই আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল উনার হাতে। উনি কোমল হাতে আমার চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে সবার সামনেই আলতো করে জড়িয়ে নিলেন।
৬৭.
হলুদের জন্য স্টেজ করা হয়েছে ছাদে। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির বাইরের গেট থেকে শুরু করে বাড়ির গার্ডেনও সাজানো হয়েছে চমৎকার রূপে। আর এসব কিছুর মাঝেই হলুদের বিশেষ উপলক্ষে ছাদটাকে করে তুলেছে ছোট্ট একখানা তাজমহল। চারপাশে ফুল,লাইটিং,বিভিন্ন রঙ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে ছাদটাকে।
সময় ঠিক ৭টা। আমি নিজের ঘরেই আছি। সাজসজ্জার পর্ব চলছে। নিয়ম মাফিক আমার পোষাক আজ সবই হলুদ। হলুদ রঙের দুই পার্টের লেহেঙ্গাটা রাহিয়ানের পছন্দে কেনা। উনার পছন্দের তারিফ এখন লোকমুখে। লেহেঙ্গার ডিজাইনটা যেই দেখছে সেই হা করে মিনিমান পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আমায় দেখে। অতঃপর ছোট্ট একখানা মুচকি হাসি দিয়ে বলে রাহিয়ানের পছন্দ আছে কিন্তু। গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠার কথা হলেও বিপরীতে লজ্জায় লাল হতে হয় আমাকে। আমার পাশে অতিশয় ভদ্রমহিলারা লজ্জায় মে*রে ফেলছে আমায়। দেখেছো, হলুদ রঙ গায়ে উঠতেই ভীষণ ফুটেছে মেয়ের চেহারা,আমাদের রাহিয়ান দেখলে তো আজই বিয়েটা করে ফেলতে চাইবে গো! লাল বেনারসি অব্দি হয়তো আর ক/ষ্ট করতে হবে না!
লাইক এমন টাইপ কথা গুলো যখন শুনি তখন মনের ভেতর কি বি*ভ*ৎ*স রমকের যে হাতুড়ীর বারি পরতে থাকে তা কেবল আমিই জানি! এই অতিশয় ভদ্রমহিলা গুলো যাও একটু চুপ করে থাকবেন কিন্তু আজ আর চুপ থাকবেনা রাই,নিতু আপু,রিম্মি আপু,হিয়া আপু আর অনন্যা আপু। তারা আমাকে লজ্জায় লজ্জায় মে*রে ফেলবেন বলে বিক্ষোভ শুরু করেছেন একেবারে। সত্যি বলতে আমার এখন রুম থেকেই বের হতে ইচ্ছে করছেনা!
তাজা গাঁদাফুলের টিকলিটা ক্লিপ দিয়ে আঁটকাতে আঁটকাতে হঠাৎ মুখ টিপ হাসতে লাগলেন অনন্যা আপু। আমি প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন ছুড়লেন নিতু আপু,
—-” কি গো অনু, হাসছ কেন?”
অনন্যা আপু টিকলির কাজ শেষ করে মুখে হাত চেপে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল,
—-” নিধিকে আজ এত্তো বেশি কিউট লাগছে কেন বলোতো? তবে কি বিয়েটা আজই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?”
পেছন থেকে রিম্মি আপু অনন্যা আপুর কথার রেশ টেনে বলল,
—-” আমি তো জানি মেয়েদের বিয়ের দিনই সবচেয়ে বেশি কিউট লাগে। এটাই নিয়ম!”
নিতু আপু বলল,
—-” আমিও তো তাই জানি! তবে কি…”
নিতু আপুর কথার মাঝেই রাই বলে উঠলো,
—-” না গো না! আমাদের নিধিকে আজ হলুদে এতো সুন্দর লাগছে ভাবো কাল লাল বেনারসিতে কতটা মা*রা*ত্ম*ক সুন্দর লাগবে। আজকের চেয়েও অধিক সুন্দর লাগবে।”
আমি গোলগাল চোখ করে সবার দিকে তাকালাম। আস্তেকরে বললাম,
—-” তোমরা আমায় নিয়ে এতো গবেষণা করছো কেন বলোতো? প্লিজ এবার তো চুপ করো!”
আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো সবাই! অনন্যা আপু হাসতে হাসতে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,
—-” বিয়ের কনে হলে তাকে এগুলো শুনতে হয় সোনা। শুধু এগুলো নয় আরও অনেক কিছু শুনতে হয়। কি গো বলবো না কি? হু হু? বলি?”
আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে বললাম,
—-” ধ্যাৎ!”
আর ওমনি দেখা মিলল তাদের ঝংকার তোলা হাসি। হাসতে হাসতে সবাই ঝাপটে ধরল আমায়।
স্টেজের মাঝ বরাবর পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছি আমরা দুজন। উনিও হলুদ শেরওয়ানী পড়ে আছেন। দেখতে বেশ লাগছে কিন্তু। দুই হাতে জায়গা পেয়েছে হলুদ রঙের দুটো ফুল। মাথার চুল গুলো ছাদের মৃদু বাতাসে বার-বার উড়ে এসে কপালের সাথে লেপ্টে বসে পড়ছে। চোখ জোড়া চিকচিক করছে খুশির আমেজে। মুখে মন কাড়ানো মিষ্টি হাসি। চঞ্চল ঠোঁট জোড়া একজন আরেকজনের উপর চেপে আছে। এক এক করে সবাই হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছেন সেই সাথে তার কানে কানে কিছু বলেও যাচ্ছেন। বিশেষ করে তার বন্ধুগন। উনি কথাগুলো শুনতে শুনতে আঁড়চোখে আবার আমাকে দেখে নিচ্ছেন। অতঃপর মুচকি হাসি দিয়ে পলক ঝাপটাচ্ছেন। এমন কান্ড দেখে স্টেজের নীচে বেশিরভাগ মানুষই মুখ টিপে টিপে হাসছেন। আমি বুঝতে পারছিনা সবাই হঠাৎ করে আমাকে এতো লজ্জায় কেন ফেলছে!
#চলবে____________________
#চলবে____________________
[ গল্পটা কি সামাজিক পর্যায়ে আছে নাকি অসামাজিক পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছে? ]