প্রেয়সী পর্ব – ৪+৫

#প্রেয়সী♥🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০৪

৭.

—-” এমন রোগা পাতলা লোককে কেউ চিতাবাঘ বলে ডাকে? হাউ ষ্টুপিড!”

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা কথাটা ভাগ্য সহায় হলো বলে স্যারের কান অব্দি পৌঁছালো না। স্যার গভীর মনোযোগ দিয়ে এসাইনমেন্টে সাইন করছেন। তবে স্যার বাদে বাকি তিনজনের কানে ঠিকই গেলো। বুঝতে পারলাম তিন জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অরিন আপু ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে নিবে কি তার আগেই স্যারের পিয়ন বলে উঠলেন,

—-” মাইনষের খাইয়ে-দাইয়ে কাজ কম্য নেই তো করবে ডা কি? এইসব করি বেরায়!”

আমি ফিক করে হেসে দিলাম। অরিন আপু আর কিছু বললেন না। রাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে স্যারকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। বুঝতে পারলাম এই মুহুর্তে ওর মাথায় যা ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক একই ভাবে তা আমার মাথায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে। পিয়ন আবারও বলে উঠলেন,

—-” আফনেরা আইছেন ক্যান? জলদি কথা কইয়া ক্লাসে যান!”

পিয়নের তাড়া দেখে এবার আমার কলিজা শুকাতে লাগলো। আমায় যে এখনি বাঘের মুখে থাবা দিতে হবে ভাবতেই পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো। আল্লাহ সহায় হও। আমি স্যারকে উদ্দেশ্য করে মৃদুস্বরে ডাকলাম,

—-” স্যার?”

স্যার তাকালেন না! একই ভাবে এসাইনমেন্টের খাতাগুলোতে সাইন করে চলেছেন। আমি, রাই আর অরিন আপুর মুখের দিকে তাকালাম। রাই ভ/য়ের দরুন ঢোক গিলছে বারবার। অরিন আপু কপাল কুঁচকে মুখে হাত চেপে বিরবির করে বললেন,

—-” এভাবে ম্যাঁও ম্যাঁও কেন করছো? ঠিক করো ডাকো?”

মেয়েটার শরীরে কোনো মায়াদয়া নেই! একদম মায়াদয়াহীন একটা মানুষ। আমার মতো এমন ইনোসেন্ট দেখতে একটা বাচ্চা মেয়েকে কিভাবে ফাঁ/সা/তে চলেছে এই বদের হাড্ডি গুলোয়। নাহ্ নিধি, ভ/য় পেলে হবে না বাচ্চু। তোর এই ভ/য়কেই জয় করতে হবে। হবেই হবে। এবার বেশ জোড়ালো গলাতেই ডেকে উঠলাম,

—-” স্যার, লায়লা ম্যামের সাথে আপনার প্রেমলীলা কেমন যাচ্ছে? ভালো তো?”

আমার অতি সাহসে বলে ফেলা কথাটায় ঠিক কত বড় বো//ম ব্লা/স্ট হবে তার কোনো ধারনা নেই আমার। ভ/য়ের চোটে রীতিমতো চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছি। রাই আমার ডান হাতটা খামচে ধরে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অরিন আপু চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির মতো করে আমার দিকে তাকালো। হয়তো তারও ধারনায় ছিলো না আমি এমন কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলবো। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হলেও স্যারের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না! ভ/য় টা আরও জাতাঁকলে পিষে নিচ্ছে আমায়। চোখ জোড়া খুললে কোন বাঁশ অপেক্ষা করছে আমার জন্য ভাবতেই অরিন আপুর চুল গুলো গুনতে গুনতে উগলানোর তীব্র বাসনা জাগছে মনে।

—-” অরিন? ক্লাস টাইমে তোমরা আমার এখানে? কোনো দরকার? আর এরা কি নিউ ব্যাচ?”

স্যারের নরম সুরে আমার কাশি উঠে গেলো। কাশতে কাশতে অরিন আপুর দিকে তাকালাম আমি। অরিন অনিচ্ছাকৃত হাসলো। আমার দিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো,

—-” জ…জ্বী স্যার!”

অরিন আপুকে বাদ দিয়ে এবার আমি স্যারের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। ভাবনার বিষয়, আমি স্যারকে এতবড় একটা কথা বলার পরেও স্যার এতো টা নর্মাল কি করে? কথাটা আমি যেভাবে বলেছি তাতে স্যারের এতক্ষণে আমাদের সিলিংফ্যানে বেঁধে পেটানোর কথা।কিন্তু না! স্যার পুরো অনুভূতি শূন্য। মুখের ভাব ভঙ্গিমাও বলছে না, স্যার কথাটা শুনে প্রচুর রে/গে গিয়েছেন। ব্যাপার টা গোলমেলে। হজম করতে ক/ষ্ট হচ্ছে। পাশ ফিরে পিয়নের দিকে তাকাতেই ঝাটকা লাগলো আমার। পিয়ন এমন করে তেড়ে বেঁকে খিঁচিয়ে আছে কেন? দেখে তো কেবল এটাই মনে হচ্ছে, তার খুব কষায় ধরেছে। আর সেই কষা বের করতেই সে এভাবে খিঁচিয়ে আছে।

—-” নাম কি তোমাদের?”

স্যারের প্রশ্নে পিয়ন কে নিয়ে আর গবেষণা করা হলো না। মিনমিনে গলায় বললাম,

—-” ন..নীলাদ্রিতা নিধি!”

পেছন থেকে রাই মুখ উঁচিয়ে আমার থেকেও নীচু স্বরে বলল,

—-” আরিফা রাই।”

স্যার একই ভাবে তাকিয়ে রইলেন। আমাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে পিয়নের দিকে প্রশ্ন সূচক মুখ করে তাকালেন। পিয়ন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বেশ জোরেই বলে উঠলো,

—-” নীলাদ্রিতা নিধি আর আরিফা ইভা।”

স্যার মুচকি হাসলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—-” কে নীলাদ্রিতা নিধি আর কে আরিফা ইভা?”

আমি আর রাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। রাই আমার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলল,

—-” স্যার আমি রাই! (মোটা স্বরে)”

স্যারও হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

—-” আচ্ছা আচ্ছা! নাইস টু মিটিং ইউ গাইস।”

আমি চোখ মুখ কুঁচকে পিয়নের দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে পিয়ন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,

—-” স্যারের কানের মেশিনটা আজ ভুল কইরা বাসাত রাইখা আইছে।”

অরিন আপু অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” হোয়াট?”

পিয়ন বলল,

—-” জে। আফনেরা এখন যান। কফাল ডা আফনে গো ভালা। শুকর করেন।”

হাসবো নাকি কাঁদবো? এমন একটা সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে কিরকম রিয়াকশন দিলে আমার সাথে স্যুট করবে? স্যার কানে কালা? মেশিন ছাড়া মোটেও শুনতে পায় না?

বিকট শব্দে হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতে রীতিমতো গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। আমার হাসি দেখে রাই আঁতকে উঠে আমার মুখ চেপে ধরে বাইরে নিয়ে এলো। পেছন পেছন অরিন আপুও এলেন। আমি কেন জানিনা হাসি কন্ট্রোল করতে পারছিনা। হাসতে হাসতে কতক্ষণ রাইয়ের গায়ে ঢলে পড়ছি তো কতক্ষন অরিন আপুর গায়ে। আমার হাসিতে বোধকরি অরিন আপুর শরীরে আগুন ধরে গিয়েছে। জ্বা/লা/য় হয়তো ছটফট করছে মনে মনে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। শুধু অরিন আপু নয় আমি চাই সিনিয়রদের পুরো গ্যাংই আমার হাসি দেখে জ্ব/লে পু/ড়ে ম/রে যাক। বিশেষ করে রাফিদ ভাইয়া।

আমি হাসছি, রাইও হাসছে। শুধু হাসছে না অরিন আপু। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে উনি রা/গে রীতিমতো ফুঁসছেন। তাতে আমার কি? আমি তো আজ খুব হাসবো।

—–” ভাগ্য আজ তোমার সহায় হলেও নেক্সট টাইম নাও হতে পারে মিস নিধি!”

ঝড়ের বেগে কথাটা উড়ে এসে আমার হাসি কেঁড়ে নিতে যথেষ্ট হলো। রাই সটান হয়ে আমার হাত খামচে ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন রাফিদ ভাইয়ারা। সাদা চামড়ায় যা পড়ে সেটাই নাকি ফুটে থাকে। উনি হলেন তারই জলজ্যান্ত এক উদাহরণ। কালো টি-শার্টের উপর মেরুন রঙের শার্টটা উনার শরীর আঁকড়ে বসে আছে। যেন এই রঙটা কেবল উনার জন্যই বানানো হয়েছে। কেবল উনার গায়ে উঠবে বলেই এতদিনেও কারোর শরীরে এতোটা অ/হং/কা/র করে ফুটেনি এই রঙ। ছেলে মানুষ হয়েও সে এতো সুন্দর কেন? হিং/সে হচ্ছে আমার! চোখের মনিটা মার্বেল পাথরের মতো জলজল করছে। মাথার চুলগুলো সযত্নে পড়ে আছে আড়াআড়ি ভাবে। তার থেকেই কিছু অংশ বিশেষ তাদের বিশেষত্ব ফোঁটাতে বাতাসের তালে তালে কপালের উপর এসে পড়ছে। চোখে ঘন পল্লব। ডার্ক রেড ঠোঁট। দুগালে চেপে আছে খাঁজ খাঁজ দাঁড়ি। সে এক অন্য রকম মায়া তার চোখে মুখে।

—-” তবুও, তোমার অসীম সাহসের জন্য তোমার তারিফ না করে পারছি না!”

উনার বাঁকা হেসে ত্যাড়াব্যাকা কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আমার। শঙ্কিত চোখে উনার দিকে তাকাতেই ধাক্কা খেয়ে রাইয়ের দিকে ঝুঁকে গেলাম কিছুটা। পাশে তাকাতে দেখলাম, অরিন আপু বাঁকা হেসে রাফিদ ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধাক্কা টা উনিই দিলেন আমায়। বুঝলাম, আগাম বিপদের সতর্ক বানী দিলেন।

৭.

হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি হলো খুব। অসময়ে বৃষ্টি! ব্যাপার টা ভীষণ বিদঘুটে। রাস্তা ঘাট কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। পা ফেলারও জো নেই। তবুও হাঁটছি। সমসময় শহরের ঝনঝট পরিবেশে গাড়িতে চড়তে ভালো লাগেনা। রাইয়ের বাসা অব্দি এসে ওকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে আমিও নেমে গেলাম। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে ভিজতে ইচ্ছে হলেও বাবার কথা ভেবে আর হলো না। বাবা সমসময় বৃষ্টিতে ভিজতে বারন করে। কেননা, আমার আবার ঠান্ডায় ব্যামো রয়েছে। বেশি ঠান্ডা লেগে গেলে চেহারা ফুলে উঠে। মনে হয় ঠান্ডার সব পানি চেহারায় এসে জমে গিয়েছে। সেই সাথে মাত্রাতিরিক্ত জ্বর। এই অদ্ভূত রোগের নাম জানিনা আমি। যতদূর শুনেছি, এই নাম না জানা রোগটা মায়েরও ছিলো। একটু ঠান্ডা লাগলেই হতো ব্যস, এমন করুন দশা হয়ে যেত। মা আজ নেই! সেই শোকেই বাবাও দিনকে দিন একটু একটু করে নিজের অস্তিত্ব বিকিয়ে দিচ্ছে। তার শরীর আছে কিন্তু মন নেই। বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিলো। বাল্যকালের প্রথম এবং শেষ প্রেম। পাঁচ বছর প্রেম করে মাত্র দেড় বছর সংসার করেছে মা। আর তারপর আমি অভাগী দুনিয়াতে আসতে গিয়ে মাকে মে/রে/ছি। লোকে বলে আমি অ/ল/ক্ষু/ণে মেয়ে। মাকে খেয়েছি। কেমন শোনায় না কথাটা? আমি কি করে খেলাম মাকে? আমার কারনে মা যে এভাবে হারিয়ে যাবে জানলে তো প্রথমেই রবের কাছে ফরিয়াদ করতাম, আমায় দিও না ওদের টোনাটুনির সংসারে। একটা সন্তান না থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে? দিন শেষে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপর সব ঠিক! কিন্তু এখন যে তার থেকেও
ভ/য়ং/ক/র বাবার দিন শেষের সময়টা। তখন বুঝি সন্তান না থাকার সুপ্ত বাসনায় কাছের মানুষ টার বুকে মাথা রেখে কষ্ট ভুলতো। কিন্তু এখন যে সেই মানুষ টাই নেই। দিন শেষে যার কোমল স্নিগ্ধ হাসিটা দেখে অনন্তকাল পার করা যেত সেই মানুষ টাই আজ নেই। ভাবলেই খুব ক/ষ্ট হয়। খনিকের সুখের জন্য আমি একটা মানুষের জীবন কেঁ/ড়ে নিয়েছি! কতটা স্বার্থপর আমি! মাঝে মাঝে বাবা কে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে, আমি সরি বাবা!

—-” এই মেয়ে, একটু শুনবে?”

অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো মেয়েলি ডাকে ঘোর কাটলো আমার। মাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই ডাকটা মায়ের বলে আবিস্কার করে ফেললাম। মুহুর্তেই আশেপাশে নজর দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ টার খোঁজ চালালাম। দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন মা বেশী এক সুন্দরী রমনী। তার চোহারা দেখে আচমকাই কারোর মুখটা যেন ভেসে উঠতে চাইলো চোখের সামনে। মস্তিষ্ক সম্মতি দিলো না। ব্রেইনও এত দ্রুত কাজ করলো না! আমি শঙ্কিত মনে ঘুরে দাঁড়ালাম। উনি হাতে দুটো ইয়া বড় বড় গিফ্ট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। মুখে ম্লান হাসি দিয়ে বললাম,

—-” জ্বী বলুন?”

আমার সহিত উনিও মিষ্টি হাসলেন। কোমলস্বরে বললেন,

—-” আসলে আমি পথ ভুল করে ফেলেছি! এটা দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশ তাই না?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই উনি ব্যস্তভঙ্গিতে বলে উঠলেন,

—-” একদম ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি! আসলে আমি পূর্ব পাশ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড থেকে যেতে চাচ্ছি! কিন্তু কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছি। তুমি প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করবে?”

উনার অনুরোধ শুনে খুব মায়া হলো আমার। বেচারী রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে হয়তো। চারপাশে শীতল পরিবেশেও ঘামছেন উনি। আমি স্তিমিত হেসে উনাকে আস্বস্ত করে বললাম,

—-” অবশ্যই সাহায্য করবো আন্টি। আপনাকে এভাবে করে বলতে হবেনা। আপনি আসুন আমার সাথে! আচ্ছা আপনার সাথে আর কেউ আসেনি? আপনি একাই এসেছেন?”

—-” একা বলতে আমার ড্রাইভার আমার সাথেই ছিলো। খানিকক্ষণ আগেই আমি নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। ড্রাইভার আমায় খুব নিখুঁত ভাবেই বুঝিয়ে দিলো, ম্যাম এখান থেকে এখানে যেতে হবে। কিন্তু আমি সেই ঠিকই গুলিয়ে ফেলেছি।”

আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,

—-” ড্রাইভার আপনাকে মাঝরাস্তায় একা রেখে কোথায় গেলো?”

উনি একহাতে শাড়ির কুঁচি আগলাতে আগলাতে বললেন,

—-” আমার ছেলের ভার্সিটিতে।”

উনার দুইহাতে সবটা সমালাতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে উনার হাত থেকে গিফ্টের একটা বক্স আমার হাতে নিয়ে বললাম,

—-” আপনার হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে আন্টি। আমি আপনাকে সাহায্য করছি।”

আমার সহানুভূতিতে উনি খুব খুশি হলেন। ঝকঝকে দাঁতের হাসি দিয়ে অমায়িক সুরে বললেন,

—-” আসলে সমস্যা হলো, এমনিতে আমি বাসা থেকে একদমই বের হইনা আর বের হলেও গাড়ি নিয়ে যাই। যেখানে যাওয়ার ড্রাইভার নিয়ে যায়। গাড়ি ছাড়া কখনো বের হওয়া হয়না। তাই রাস্তা ঘাটও সেভাবে মুখস্থ না। আজ আমার মেজ বোনের মেয়ের এনগেজমেন্ট। সেখানেই হঠাৎ যাওয়া পড়লো। এদিকে আবার আরেকটা সমস্যা হলো! ছেলে আর তার বাবা কে নিয়ে! রাহিয়ানের বাবা যে গাড়ি করে গিয়েছেন সেটা তাকে অফিসে পৌঁছে আড়াই টা নাগাদ রাহিয়ানের ভার্সিটির সামনে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ উনার মিটিং আছে বাহিরে তাই গাড়ি আর গেলো না। আর রাহিয়ান সকালে আবার বাইক না নিয়েই চলে গেলো! কারন আবির ওকে ড্রপ করতে এসেছিলো
কি একটা সমস্যা দেখো, তাই আমি ভাবলাম রাস্তা তো বেশি নয়, আর ওদিকে সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে! ছেলেটা কি করে ফিরবে? তাই গাড়িটা পাঠিয়ে দিলাম।”

আমি কুঞ্চিত কপালে উনার দিকে তাকালাম। বিরস মুখে বললাম,

—-” আপনার ছেলে তো বাচ্চা নয় আন্টি? সে তো কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করতে পারতো? আপনি না হয় বাসায় পৌঁছেই উনাকে গাড়িটা পাঠাতেন? আর আপনার ছেলের বাসায় ফেরার তাড়া বেশি থাকলে সে না হয় রিক্সা করে চলে যেতো। সমস্যা তো ছিলো না! শুধু শুধু আপনি এভাবে প্রবলেমে তো পড়তেন না বলুন?”

উনি হেসে উঠলেন। একদম খোলা মনের হাসি। হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকালে আমি সামনের দিকে ইশারা করে বললাম,

—-” আপনার এলিফ্যান্ট রোড এসে গিয়েছি। এখান থেকে একটা বেবি ট্যাক্সি বা সিএনজি করে আপনি ঠিকানা বলে চলে যেতে পারবেন। আর সমস্যা হবেনা আশাকরি।”

উনি সামনের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদুহেসে বললেন,

—-” খুব উপকার করলে মা! তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ!”

আমি মলিন হেসে উনার দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,

—-” নেক্সট টাইম থেকে কিন্তু এমন আর করবেন না আন্টি। আজ হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করেছি। আমার মতো মানুষরা অবশ্য আপনাকে সাহায্য করবে কখনো না করবেনা। কিন্তু যারা আমার মতো নয় তারা কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ মা/র/তে ভুলবে না। আর আপনি একা অসহায় মা,কিছু করতেও পারবেন না। বুঝলেন? সো নেক্সট টাইম থেকে ছেলেকে গাড়ি পাঠাবো এতে চিন্তা না করে আগে নিজের গন্তব্যে সঠিক ভাবে পৌঁছবেন। দ্যেন ভাববেন। ছেলেকে গাড়ি পাঠাবেন কি পাঠাবেন না। কেমন?”

উনি আবারও হাসলেন। বুঝিনা বাপু, মায়েদের মতো মানুষ গুলো কথায় কথায় এতো হাসে কেন?
উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” ঠিকাছে মা, আমি তোমার কথা সর্বদা মাথায় রাখবো।”

আমি ঠোঁটের ভাজে মিষ্টি হাসি জুড়ে বললাম,

—-” ভালো থাকবেন আন্টি। আসি।”

উনি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে আমার হাত থেকে গিফ্টের বক্সটা নিয়ে নিলেন। আমি উল্টো দিকে ঘুরে বড় বড় ধাপ ফেলে এগোতে লাগলাম। বহুবছর পর আজ হঠাৎ এই মানুষ টা কে দেখতেই মা মা এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগছে মনে। বুক চিঁড়ে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসতে আরেকবার পেছন মুড়ে তাকালাম। ততক্ষণে উনি সিএনজি ধরে উঠে গেলেন। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই অদূরে হারিয়ে গেলেন উনার সবুজ রঙের সিএনজি টা।

#চলবে_____________________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]#প্রেয়সী
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০৫

৯.

রকেটের গতিতে ব্রেন খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু ব্রেন যে আমার কচ্ছপের চেয়েও ধীরে চলছে! ঘন্টা খানিক বাদেই কুতুবউদ্দিন এবং তার পরিবার নিতু আপুকে দেখতে আসবেন। তারই তোড়জোড় চলছে পুরো বাড়িতে। চারপাশে সবার এতো উৎসাহ নিয়ে বাড়ি সাজানো দেখে মনে হচ্ছে তারা আজ নিতু আপুকে শুধু দেখতেই নয় বরং বিয়েটা সম্পূর্ণ করতে আসছেন। ব্যাপার টা গোলমেলে। চাচীকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপার কি চাচী? তারা কি মেয়ে দেখতে আসছে নাকি মেয়ে নিতে আসছে?” চাচী জবাব দিলেন না। মুখে কুলুপ এঁটে তরকারি নিয়েই ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন। ব্যাপার টা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছেনা! কিছু তো একটা আছে। নিতু আপুর ব্যাগ গোছানো শেষ! সব প্ল্যানও করা হয়ে গেছে। কুতুবউদ্দিন সাহেবরা আসবেন রাত আট টা নাগাদ। আর নিতু আপু প্ল্যান মোতাবেক তৈরি হতে যাবে ঠিক আট টায়। নীচে সবাই যখন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ঠিক তখনই নিতু আপু বারান্দা থেকে ব্যাগ নিয়ে মই বেয়ে নীচে নেমে যাবে। রাফিন ভাইয়া গাড়ি নিয়ে নীচেই অপেক্ষায় থাকবে। তারপর পাখিরা ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবে। সবটা ভাবলেই কেমন চক্কর কাটে মাথার মধ্যে। নিতু আপুর ভেগে যাওয়ার প্ল্যানে আমি থাকলেও আমার মনটা সায় দিচ্ছে না। মন বলছে বড় চাচার সাথে নিতু আপু আর রাফিন ভাইয়ার ব্যাপার টা নিয়ে একবার কথা বলি! কিন্তু বড় চাচা আমার একটা কথাও শুনবেননা। আপাদমস্তক এক ঘাড়ত্যাড়া লোক। সে যা ভাববে তাই হবে! ব্যস আর কোনো কথা নেই। পরমুহূর্তেই মনে হলো চাচীকে তো বলা যায়! চাচী তো নিতু আপুর মা। সে নিশ্চয়ই বুঝবে নিতু আপুর মনের কথা! উঠতে গিয়েও থমকাতে হলো আমায়! আমার ধারনা সম্পুর্ন ভুল। চাচী যে বুঝেও কিছু করতে পারবেননা। হ্যাঁ_____ শেষ একটা পথ অবশ্য আছে। হিমেল ভাই। আমাদের বংশের শেষ বাতি। যদিও কাজের না, তবুও শেষ অব্দি কাজে আসলেও আসতে পারে। গুটি গুটি পায়ে চলে এলাম হিমেল ভাইয়ের ঘরের সামনে। দরজা তো খোলাই আছে। সরাসরি ঢুকে যাবো? নাকি ভদ্রতা দেখাবো? অবশ্যই ভদ্রতা দেখানো উচিৎ! মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে হিমেল ভাইয়ের দরজায় হাত রাখতেই কারোর ফিসফিসানো শব্দে আমার মনোযোগ ন/ষ্ট হলো। দরজায় নক করতে ভুলে গিয়ে দুই হাত দিয়ে দরজায় লেগে কান পাতলাম। কন্ঠটা ফিসফাস করে কথা বলছে। বারবার স্পষ্ট তো বারবার অস্পষ্ট। তবুও শোনার বৃথা চেষ্টা চালালাম।

—-” আরে হ্যাঁ। ওর বিয়েটা আজই হয়ে যাবে। বাবা তো তাই বলল। না না ও জানে না! আরে ওর এতো জেনে কি হবে? মেয়ে মানুষের এতো জানাজানি ভালো না। বাদ দাও তো। হ্যাঁ ঐ লোকের অনেক টাকা। হুম। বাবা.. বাবা বলেছেন তো। চিন্তা করো না। নিতু কিছু জানতেও পারবেনা। আর পারলেই বা কি?”

বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার। যা ভাবছিলাম সেটাই হচ্ছে। বড় চাচা নিতু আপুকে মিথ্যে বলে ঐ কুমড়োপটাশের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এর একটা বিহিত না করলেই নয়! হয়তো নিতু আপুর ভাবনা গুলোই ঠিক। ওর পালিয়ে যাওয়াটাই উচিৎ হবে। হ্যাঁ, আমিই ওকে হেল্প করবো পালাতে।

দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলাম। হিমেল ভাইয়ার কথা গুলো বারবার বারি খেতে লাগলো মাথার মধ্যে। অসহ্য লাগছে খুব! হৃদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব!
আমার ফোনটা… ফোনটা পাশেই পড়ে আছে অসহায়ের মতো। বুক চিঁড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হতেই নিঃশ্বাসটা চেপে ধরলাম। ভ্রু কুঁচকে ফোনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। পরপর টানা আট বার কল এসেছে। আননোউন নাম্বার! কার এতো দরকার পড়লো নিধিকে? যে শ্বাস না নিয়েই এতোবার কল করেছে! আশ্চর্য! মাথায় এই অপরিচিত নাম্বারের কথাটা তুলে রেখেই হৃদকে কল দিলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছেনা! দু’বার রিং হয়ে এভাবেই কেটে গেলো। ধরলো না সে। হয়তো ব্যস্ত। আবারও দীর্ঘশ্বাস বের হতে চাইলো। এবার আর আঁটকাতে পারলাম না। হৃদকে তৃতীয় বার কল দিতে নিয়েও রেখে দিলাম ফোনটা। বাবা ফেরার সময় হয়ে গেছে! রাতের খাবারটা করে ফেলা যাক।

এসব ভাবনা নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে আসলাম। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের ডান হাতের নীচে কালো তিলটার উপর নজর পড়লো। এই তিলটা বড় রহস্যময় তিল। সবসময় এটা দেখিনা আমি। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। খানিক বাদে আবারও মিলিয়ে যায়। আজ হঠাৎ চোখে পড়াতে মনের মধ্যে কামড় দিলো। হয়তো খুব ভালো কিছু বা হয়তো খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। অদ্ভুত!

হাত নামিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ালাম। কিসব অদ্ভুত কথা ভাবছি আমি। আমার এসব ভাবনাগুলো বরাবরই অর্থহীন। তবুও বোকার মতো ভাবতে থাকি। ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে আবারও মনের মধ্যে কামড় দিলো। আচমকা ফোনের রিংটোনটা বড্ড বিদঘুটে লাগছে কানে। দ্রুতে পায়ে এগিয়ে গেলাম ফোনটার দিকে। ভাবলাম হৃদ কল দিয়েছে। কিন্তু না, হৃদ নয়। সেই অপরিচিত নাম্বার টা। মনটা দোমনা ভাবছে। কলটা রিসিভ করবো কি করবো না? ফোনের ওপাশের মানুষ টা পরিচিত কেউ নাকি অপরিচিত? কলটা কি সে প্রয়োজনে করেছে নাকি অপ্রয়োজনে?

ধড়ফড় করছে মনের মধ্যে। অর্থহীন কিছু ভাবনায় নিজের কাছেও বিরক্ত লাগছে সময়টা। এতো দ্বিধা কেন করছি কলটা রিসিভ করতে? প্রয়োজনীয় হলে কথা বলবো আর অপ্রোয়জনীয় হলে কেটে দিবো। ব্যস এটুকুই তো! কলটা রিসিভ করেই কানে তুললাম ফোনটা। গলা ঝেড়ে সুন্দর করে একটা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কে?”

—-” নিধি আফা আম্মায় আফনেরে ডাকতিছে নীচে। আর রাতে আফনের বাবার জন্যি কিছু রাঁধতি বারন করিছে।”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফোনটার দিকে তাকালাম। রানির গলা ফোনের মধ্যে কি করে বাজছে? অদ্ভুত! ফোনটা আবারও কানে তুললাম।

—-” হ্যালো কে বলছেন?”

—-” ও নিধি আফা? হুনছেন?”

আবারও ভড়কাতে হলো আমায়। রানি এবাড়ির কাজের লোক। ও হঠাৎ আমায় কল করে এসব কথা বলবে কেন? যখন নীচে ছিলাম তখনও তো বলতে পারতো। সামান্য কিছু কথা বলার জন্য এতোবার করে কল করতে হয়? মেয়েটা কি আহাম্মক নাকি? আমি বিরক্ত গলায় বলে উঠলাম,

—-” রানি তুই?”

পেছন থেকে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে কেউ ঝড়ের বেগে সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে ঠাহর করতে না পেরে পরক্ষণেই আবার ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। একহাতে বিছানা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠতে রানি হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো। মুখটাকে সরু করে বলল,

—-” কি হইছে আফনের? কথা কন না কেন? আম্মায় নিচে ডাকছে আফনেরে। সন্ধ্যায় কিছু খাইছেন কিনা জিগাইছে!”

আমি বিরক্ত গলায় দিলাম এক ধমক। ও এতক্ষণ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বলছিলো কথা গুলো। আর আমি কিনা ভাবছি কলটা রানিই করেছে। নিজের বোকামির জন্য ধমকটা অবশ্য নিজেকেই দেওয়া উচিৎ ছিলো! কিন্তু নিজেকে না দিয়ে রানিকেই ধমকে দিলাম। আসলে মানুষ তো সবসময় অন্যকে নিজের অধীনে করতে পছন্দ করে। নিজেকে কারোর অধীনে রাখতে নয়। রানি আমার ধমক খেয়ে নড়লো না। এরকম ধমক রানি সচারাচর আমার থেকে খেয়েই থাকে! তাই বিশেষ ভাবাবেগ হলো না ওর। আমি মুখ কুঁচকে আবারও বকার সুরে বলে উঠলাম,

—-” তোকে আর কত দিন বলতে হবে রানি? কারোর ঘরে আসার আগে অবশ্যই দরজায় নক করতে হয়! এটা ভদ্রতা!”

রানি ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

—-” আই এতো ভদ্র নই আফা। আফনে নীচে চলেন। আম্মায় ডাকে। আইচ্ছা আফা? আফনে কি খাওন দাওন ঠিক ঠাক করেননা কন দেহি? দিন দিন তো চিংগি দিতাছেন!”

আমি ওর প্রায় অর্ধেক কথাই বুঝিনা! কিরকম করে যেন কথা বলে রানি। তিন চারটা অঞ্চলের কথা ও মিক্স করে ফেলে। তাই বেশিরভাগ সময় ওর কথা গুলো আমায় চাচীর থেকে ট্রান্সলেশন করে বুঝতে হয়।

আমি মুখ কুঁচকে বললাম,

—-” তুই যা আমি একটু পরে আসছি।”

রানি গেলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। আমি ওর কান্ড দেখে আবারও ধমক দিলাম। বললাম,

—-” দাঁড়িয়ে না থেকে যা ভাগ। আমি আসছি।”

রানি চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফেলে বলল,

—-” মা না থাওনের অনেক জ্বা/লা আফা। আই বুজি। আফনে সন্ধ্যাত্বন কিছুই খান নাই তাই না? আফনে জলদি নীচে আহেন আমি আফনের লিগা স্যূপ আর চপ বানাইতাছি। জলদি আহেন।”

আমি বোকার ন্যায় তাকিয়ে রইলাম রানির দিকে। রানি চোখের পলকে রুম থেকে চলে গেলো। কি বলে গেলো আমি সত্যিই বুঝিনি! আমি সত্যিই ওর বেশিরভাগ কথা বুঝতে পারিনা। হঠাৎ হাতে ফোনটার দিকে চোখ পড়লো! এই রে, কে যেন লাইনে ছিলো! রানির বকবকানি শুনতে শুনতে আমি তো কলের কথা বেমালুম ভুলেই গেছি! ফোনটা তৎক্ষনাৎ কানে তুললাম। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,

—-” হ্যালো! কে বলছেন? দেখুন আপনি অনেক্ষন ধরেই লাইনে আছেন কথা বলছিলেন না! তাই আমিও ব্যাপারটা একদমই ভুলে গিয়েছি! তার জন্য দুঃখিত। আপনি আপনার পরিচয় টা দিয়ে দিলে ভালো হতো! আমার মনে হয় আপনি কোনো দরকারেই আমাকে এতো বার করে কল করেছেন। আবারও দুঃখিত! এবার বলুন কে বলছেন? আর আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

ওপাশে পিনপতন নীরবতা। কারোর নিঃশ্বাস ফোলারও শব্দ আসছে না। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর আমি আবারও বলে উঠলাম,

—-” জ্বী বলুন? আপনি কে বলছেন আর কি দরকারে আমাকে এতোবার করে কল দেওয়া?”

কারোর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো। আশ্চর্য মানুষ! এতোক্ষণ লাইনে থেকেও একটা বারও কল কাটলেন না। আমার আর রানির কথা গুলো হয়তো সবটাই শুনেছেন উনি! একটা শব্দ অব্দি করলেন না। কে মানুষ টা? হৃদ নয়তো?

—-” হৃদ এটা কি তুমি বলছো? আমি তোমার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম। তুমি ধরলেনা ভাবলাম বিজি আছো! এটা কি তোমার নাম্বার? নতুন নিলে?”

—-” সন্ধ্যা হয় পাঁচ পয়তাল্লিশ মিনিটে। এখন সময় সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। বাসায় ফিরেছো দুপুর তিনটে নাগাদ। দুপুরেও হয়তো খাওনি! সন্ধ্যায়ও কোনো নাস্তা করোনি। ফোনটা রেখে দৌড়ে নীচে চলে যাও। ফটাফট কিছু খেয়ে দেন নিজের রুমে এসে আধঘন্টা রেস্ট নাও। এরপরে যা খুশি করো। কোনো সমস্যা নেই!”

আমি থতমত খেয়ে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নিলাম। হোয়াট দ্যা হেল ম্যান! ভয়েসটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। স্নিগ্ধ শীতল! খুব বেশি আকর্ষনীয়। তার এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথা গুলোয় মনে হলো আমার হাত পা ঝিম ধরে গেলো! কে উনি? আমি চটজলদি ফোনটা কানে তুলে কিছু বলতে নিবো তার মধ্যেই উনি উনার শেষ কথা টা বলে উঠলেন,

—-” একদম নাক বরাবর দৌড় দিবে।”

বলেই কলটা কেটে দিলো। কলটা কাটার শব্দে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো। ঝাঁটকার উপর ঝাঁটকা খেয়ে চলেছি! মন মানলো না! এভাবে করে কেউ অপরিচিত নাম্বার থেকে আমায় কল করে এসব বলতে পারেনা! পারেনা না পারেনা, কিছুতেই পারেনা! নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ! নাম্বারটায় ডায়েল করলাম। এক সেকেন্ড সময়ও এই মুহুর্তে এক ঘন্টার মতো লাগছে। রিং হচ্ছে না কেন! নেটওয়ার্ক প্রবলেম হয়তো! দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। এখানে নেটওয়ার্ক রকেটের গতিতে পাওয়া যাবে। আবারও নাম্বারটায় ডায়েল করলাম! অদ্ভূত এক শব্দ হচ্ছে, মন বলছে রিং হবে! কিন্তু আমায় হতাশ করে ওপাশ থেকে এক মহিলা রুক্ষস্বরে বলে উঠলো,

—-” দুঃখিত, কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। Sorry the number you dialled is currently unreachable!”

হতাশ চোখে ফোনটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে এলাম রুমে। মনটা ছটফট করছে খুব! কে হতে পারে মানুষটা?

১০.

শক্ত চোয়ালে খাবার চিবোচ্ছি। আর ঐ লোকটার কথা ভাবছি। এমন সময় ধরাম করে টেবিলে বসলো হিমেল ভাই। চোখ মুখ চিন্তায় কেমন অদ্ভুত হয়ে আছে তার। পেছন থেকে রানি পানির গ্লাস নিয়ে ছুটে এলো। বড় চাচাও দেখছি হাতে ফোন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার রান্না ঘরের দিকে। এই বুঝি চাচীও হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে এসে চাচার সামনে দাঁড়াবেন। মনের কথা মনেই রইলো মুখে আনার সময় মিললো না। চাচী আঁচলে হাত মুছতে মুছতে চিন্তিত মুখে এসে দাঁড়ালেন চাচার সামনে। চাচীকে আসতে দেখে হিমেল ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিরবির করে কিছু একটা বলছে চাচা আর হিমেল ভাই। আমার কান অব্দি তাদের কথা ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না! আমি তাদের রেখে চাচীর মুখ চেয়ে তাকালাম। চাচীর এক্সপ্রেশন বলে দিবে চাচা আর হিমেল ভাই তাকে কি বলছেন।

চাচী আঁতকে উঠে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। প্রথমদফায় আমার মাথায় যা এলো, “হয়তো কারোর হার্ট অ্যাটাক এসেছে!” কিন্তু হিমেল ভাইয়ের এক্সপ্রেশন তা বলছেনা! কেননা, কোন ব্যাক্তির শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার কোনো কালেই কোনো মাথা ব্যাথা থাকেনা। হোক সে খুব কাছের তবুও না। তাহলে এটা বাদ! চাচী মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে বলল,

—-” তাহলে এতো খাবার দাবার এসবের কি হবে? আর উনারা কবে আসতে পারবেন সেসব কি কিছু বলেছেন?”

চাচা ক্ষেপে গেলেন চাচীর উপর! চোখ লাল করে বেশ জোরেই বলে উঠলেন,

—-” এই মহিলা কি আহাম্মক নাকি?”

চাচা কথাটা বলেই আশেপাশে নজর দিয়ে গলার স্বর নীচু করে নিলেন! তারপর আর কিছু শোনা গেলো না। চাচীর মুখভঙ্গি এবার খুব স্বাভাবিক! কিছু ঘটছে বা ঘটেছে তা আর চাচীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। আমিও নিরাশ চোখে তিনজনকে পর্যবেক্ষণ করে বাকি খাবার টুকু ফেলে রেখেই দৌড়ে গেলাম নিতু আপুর কাছে। নিতুর আপুর দরজা অর্ধেক খোলা। আশেপাশে নজর দিয়ে নীচু স্বরে ডাকলাম আপুকে। ভেতর থেকে আপুর উচ্ছ্বসিত কন্ঠটি ভেসে আসলো,

—-” নিধু? আয় আয়।”

আমি সাবধানতার সহিত পা টিপে টিপে আপুর ঘরে ঢুকলাম। দরজাটা চাপিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম জামাকাপড়ে ভরপুর দুটো লাগেজ রাখা জায়গাটা আপাতত শূন্য হয়ে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে আপুর দিকে তাকাতে দেখলাম আপুও সিম্পল সাজে বিছানায় গা এলিয়ে শুইয়ে আছে। সব ব্যাপার গুলোই আমার মাথার দশহাত উপর থেকে যাচ্ছে। যা ঘটছে সবটাই আমার আড়ালে।

—-” আপু.. তুমি এখনো রেডি হওনি? আটটা তো বেজে গেলো! কুতুবউদ্দিন সাহেবরা তো চলে আসবে একটু পরই! এখানে না তোমার লাগেজ ছিলো? কোথায় রাখলে? আর.. আর জানো? নীচে সবাইকে কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত দেখলাম! চাচা, হিমেল ভাই খুব টেনশনে আছে।”

নিতু আপু লাফ দিয়ে উঠে বসলো। দরজার পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি নিতু আপুর দৃষ্টি অনুসরণ করছি। আপু আমার দিকে তাকাতেই আমি আবারও কিছু বলতে নিলাম! কিন্তু আপু আমার কথা থামিয়ে দিয়ে দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

—-” নিধু নিধু নিধু আমাদের সব প্রবলেম সল্ভ নিধু! আমাকে বিয়ে করার জন্য ঐ কুমড়োপটাশ আর আসতে পারবেনা! ওর যাত্রার মাঝপথেই ইতি ঘটে গেছে! আমার কি যে আনন্দ হচ্ছেরে নিধু বলে বোঝাতে পারছি না।”

আমি বোবা স্বরে প্রশ্ন করলাম,

—-” মানে?”

আপু আমোদিত গলায় বলল,

—-” রাফিন আর ওর ফ্রেন্ডরা মিলে বেটার বিয়ের সাধ একদম ঘুচিয়ে দিয়েছে। উফফ, আমার যে কি শান্তি লাগছেরে নিধু। রাফিন দশমিনিট আগে এসেছিলো আমার রুমে! নিজের মুখে সবটা বলে আমায় শান্ত করে গেলো। এখন আমি একদম চিন্তা মুক্ত। আর কোনো সমস্যা নেই বল। এখন আমার বাকি স্টাডি টুকু কমপ্লিট করতে করতে রাফিনও একটা ভালো জব পেয়ে যাবে। দ্যেন আমরা বিয়ে করে নিবো।”

আমার মাথা কয়েক মুহুর্তের জন্য হ্যাং হয়ে গেলেও নিতু আপুর স্বস্তিরময় মুখখানা দেখে আমারও মনটা ভরে গেলো। যাক, আপাতত কোনো ভাবে তো আঁটকে গেলো আপুর বিয়েটা।

—-” হ্যাঁ রে নিধু? কাল তোর ক্লাস আছে? না থাকলে চল না আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি!”

আমি ঘোর কাটিয়ে বললাম,

—-” ক্লাস! হ..হ্যাঁ ক্লাস তো আছেই।”

নিতু আপু চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বলল,

—-” আচ্ছা তাহলে নেক্সট যেদিন তোর ক্লাস থাকবে না সেদিন আমরা ঘুরতে যাবো। কেমন? এই তুই নাস্তা করেছিস?”

আপুর প্রশ্নে আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ভাবনার জগতে! ঐ অপরিচিত মানুষ টাও ফোন করেছিলেন কিছু একটা বলবে বলে! কিন্তু বলল না। হঠাৎ করে বললেন নাস্তা করে নিতে! আমার অবচেতন মনটা কেবল একটা প্রশ্নই করছে,

—-” কে সেই লোক?”

#চলবে____________________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here