প্রেয়সী পর্ব – ২+৩

#প্রেয়সী❤️🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০২

৩.
পেছন ফিরে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে এলো মানুষ টা কে দেখে। ব্লু হোয়াইট সংমিশ্রণের ডোরাকাটা টি-শার্ট টা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে মানুষ টার সাথে। ডান হাতে ব্রান্ডেড ব্রেসলেট আর বাম হাতে পরম যত্নে ঝুলে আছে কালো ঘড়িটা। মুখের আদোল টা কোনো হিরোদের থেকে কম নয়। ফর্সা লম্বাটে মুখের আদোল,নাক টা বেশ উঁচু। মুখের চারপাশে জুড়ে চাপ দাঁড়ির খাঁজ খুব ভালো ভাবেই স্পষ্ট হয়ে আছে। আর চোখ জোড়ার প্রশংসা না করে তো পারছিই না আমি। চোখের কালার টা ব্রাউন সেই সাথে একই কালারের মাথার ঐ সিল্ক চুলগুলোও।

—-” নিউ স্টুডেন্ট হয়েও এতো অহংকার?”

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মানুষ টার বলে ওঠা তার দ্বিতীয় বাক্যটি শ্রবণগোচর হতেই দৃঢ় চোখে তাকালাম আমি। স্বাভাবিক সুরেই তাকে জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্য মুখ খুলবো ঠিক তখনই পেছন থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠ নিয়ে এগিয়ে এলো একটি ছেলে। চোখে মুখে চরম রা/গ ফুটিয়ে তুলে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—-” সি ইজ টু মাচ ষ্টুপিড দোস্ত। সিনিয়রদের কোনো রেসপেক্ট করতেই সে জানেনা! এই মেয়েকে তো তার উপযুক্ত শা/স্তি পেতেই হবে!”

ছেলেটার কথা শুনে আমার পায়ের র/ক্ত ছিটকে মাথায় চড়ে গেলো। এই ছেলের কত বড় সাহস দেখো, সে আমায় ইনিয়েবিনিয়ে নয় একদম ডিরেক্ট অপমান করছে! বেটারে তো কাঁচা গিলে খাবো আমি!

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা রুক্ষ স্বরে বলল,

—-” নাম কি?”

আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে ঘাড় টা হালকা বাঁকিয়ে রাইয়ের দিকে তাকাতে নিলেই সে পূনরায় বাক্য আওড়ালো,

—-” তোমাকেই জিজ্ঞেস করেছি। কি নাম তোমার?”

আমি কিঞ্চিৎ তব্দা খেয়ে উত্তর দিলাম,

—-” নিধি।”

—-” ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার আগে সিনিয়রদের ব্যাপারে ডিটেইলস নাওনি?”

শুনেছি মানুষ ভার্সিটি তে আসে তার হাজারটা স্বপ্ন পূরনের ইচ্ছে নিয়ে। তার ভার্সিটি লাইফের স্টাডি দিয়েই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় গুলো ঘুড়ে যায়। তার ফেলে আসা বাকি জীবনে যে ডিসিশন গুলো নিতে সে যখন পুরোটাই অক্ষম তখন ভার্সিটি লাইফে সেটা আপনাআপনিই তার লক্ষ্যে স্থির হয়ে যায়। জীবনের আসল সাফল্যের চাবিকাঠিই তৈরি হয় এই স্টেজ থেকে। কিন্তু এই ছেলের কথা শুনে তো আমার পুরো জীবনই মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে বেটার কথায় কেবল এটাই ঠাহর করতে পারলাম যে,ভার্সিটিতে আসার আগে তার অগোছালো স্বপ্ন গুলোকে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসা নয় বরং সিনিয়রদের সো কল্ড র‍্যাগিং সম্পর্কে পিএসচডি করে একদম ঠোঁটের আগায় মুখস্থ করে নিয়ে আসতে হবে।

—-” দেখ দেখ, কিভাবে তাকাচ্ছে দেখ একবার!”

ছেলেটির পাশ থেকেই আরেকটা ছেলে হাজারও আ/ক্রোশ নিয়ে বলে উঠলো কথাটা। এদের বিহেভিয়ারে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা। তবে সিনিয়র বলে কথা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললাম,

—-” বাবা সেরকম কিছু বলেনি!”

কথাটা শুনতেই সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বুঝলাম আমার বলাটা কথাটা এই সিনিয়র নামের বাঁশ দেওয়া লোকগুলোর মাথায় কিছুই ঢুকলো না।

—-” মানে?”

না বুঝেই তুমুল গতিতে প্রশ্ন ছুড়লো ছেলেটি। আমি মনে মনে খানিক হাসলমা। মুখে স্বাভাবিক ভঙ্গিমা টেনে বললাম,

—-” জ্বী, এখানে এডমিশন হওয়ার আগে এমন টাইপ কোনে কথাই বাবাকে বলতে শুনিনি। ইভেন বাবা তো আমায় এটাও বলেনি, ভার্সিটি এসে কারোর কথায় ওঠবস করতে।”

ছেলেটি ফুঁসে উঠলো। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-” র‍্যাগিং করার জন্য এসব ইডিয়ট কোথা থেকে ধরে আনিস বলতো।”

ডান পাশের ছেলেটা কাচুমাচু করে বলল,

—-” রাফিদ… দোস্ত….”

—-” জাস্ট শাট আপ!” (রে/গে গিয়ে)

তাকে ধমকেই হনহন করে জায়গা ছেড়ে প্রস্থান করলো ছেলটি। আর তার সাথে তার দলবলও। তাদের এভাবে চলে যেতে দেখে রাই বড় বড় করে দম ফেলতে লাগলো। আমাকে সেই প্রথম থেকেই এতোটা রিলাক্স মুডে থাকতে দেখে ওর ঠিক হজম হলো না মনে হলো। তাই দম আঁটকে রেখে আমার হাত ধরে চারশ চল্লিশ ভো/ল্টে/জের ঝাঁকুনি মে/রে বলল,

—-” তুই উনাদের সাথে এভাবে কথা বলে আমাদেরই বি/পদ বাড়ালি নিধি। তোর কোনো ধারণা নেই এরা কতদূর যেতে পারে। আজ তুই উনাদের সাথে যেমন বিহেভ করলি না জানি এর রি/ভে/ঞ্জ নিতে উনারা ঠিক কি কি করবেন আমাদের সাথে।”

রাই-এর কথা আমার ঠিক মগজ ছুঁতে পারলো না। আমি তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে রাই-এর দিকে ঘুরে তাকালাম। মেয়েটা অল্পপেই ভীষণ ভীতু। ওকে এসব ব্যাপারে আর টেনশনে না রেখে ব্যাপার টা ক্লোজ করাই হয়তো ভালো হবে। তাই ওর দু’গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললাম,

—-” চিল বেবি। এসব নিয়ে এতো ভাবারও কিছু হয়নি। সিনিয়ররা যদি আমাদের কথায় মাইন্ড করে থাকেন তবে আমরা নিশ্চয়ই তাদের সরি বলবো। কেমন?”

আমার কথাটা রাই-এর বেশ মনে ধরলো বলে মনে হচ্ছে। রাই আমার হাত দুটো ধরে বলল,

—-” সত্যিই?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ওর হাত ধরে বের যাওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

—-” ১২ টা বেজে গেছে। আমাদের তো যেতে হবে। হৃদ মনে হয় এতোক্ষনে চলেও এসেছে।”

রাই মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,

—-” হ্যাঁ চল।”
.
.
.🌺.

৪.
তার নাম অর্নব আহমাদ হৃদ। সবাই তাকে অর্নব নামে ডাকলেও আমি তাকে হৃদ বলেই ডাকি। একটু আনকমন লাগবে বলে। ভালোবাসার মাঝে সবকিছু কমন হলে মনে হয় একটা সময় গিয়ে বোরিংনেস চলে আসে। তাই তাকে আমি অলওয়েজ আনকমনের মাঝে একটু একটু করে ভালোবাসতে থাকি। আজ আমাদের ওয়ান-ইয়ার রিলেশনশিপ এনিভার্সারি। তার জন্যই আমরা আজ মিট করবো। শেষ বছর ঠিক এই দিনটাতেই সে আমায় প্রপোজ করেছিলো। শুধু এই দিনটাই কেন বলছি? বলা বাহুল্য তার আগেও সে আমায় অসংখ্য বার প্রপোজ করেছিলো কিন্তু আমি রাজি হয়নি। সত্যি বলতে রিলেশনশিপে যাওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছে আমার কোনো কালেই ছিলো না। হৃদের মতোই এমন অনেক মানুষের থেকে প্রপোজাল পাওয়ার সেই দূর্ভাগ্য আমার অনেকবারই হয়েছে। তবে সেরকম বলতে ব্যাপার গুলো আমার কাছে চরম হাস্যকর ঠেকতো। পাবলিক প্লেসে বা বিশাল বড় রেস্টুরেন্টে চারপাশে সফ্ট মিউজিকের মাঝে দাঁড়িয়ে ছেলে একহাতে গিটার আর অন্য হাতে রিং নিয়ে প্রপোজ করা আমার কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। তাই এমন এক্সপেরিয়েন্স অনেক হলেও কখনো কেউ মন জয় করতে পারেনি। তাই সবার মতো চোখ বুজে অর্নব কেও নাকচ করেছিলাম। কিন্তু সে তো সেই, আমার একশো একবার না পরার পরও সে হাল ছাড়েনি। রাজি তো আমায় সে করিয়েই ছেড়েছে। সেই দিন গুলো পেরিয়ে আজ ১ টা বছর হয়ে গিয়েছে। ভাবতেই এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে মনে।

—-” নিধু।”

ইবনাত গার্ডেনের চারপাশের সাজানো গোছানো দৃশ্যগুলো আমার কাছে বরাবরই নন্দনকাননের থেকে কিছু কম মনে হয়না। আমরা প্রতিবার এই জায়গাতেই মিট করি। চারপাশে একবার চোখ বুলালেই যেন জুড়িয়ে যায় অন্তর আত্না অব্দি। চারপাশের ফ্রেশ এয়ারের মাঝে নিজেকে ডুবিয়েই বসে ছিলাম। এরই মাঝে কানে এলো প্রিয় মানুষটির ভালোবেসে ডাকা নামটি।

পাশ ফিরে তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতেই দেখা মিললো তার ঠোঁটের ভাজে তৃপ্তিময় হাসি। বুঝলাম আমিও একই ভাবে তৃপ্তিময় হাসি হাসছি। হাত বাড়িয়ে তাকে পাশে বসতে ইশারা করে বললাম,

—-” লেট কেন করলে?”

হৃদ ঘড়িতে টাইম দেখে বলল,

—-” ক্লাস ছিলো ম্যাথের। মিস করার ওয়ে ছিলো না তাই একটু লেট করে ফেলেছি জান। সরি।”

আমি মৃদু হাসলাম। তার হাতটা ধরে নিজের কোলের উপর রেখে বললাম,

—-” ইট’স ওকে। বেশি লেট করো নি। মাত্র টেন মিনিট’স।”

হৃদ চমকে গেলো মনে হলো। আমার হাত ছেড়ে চটজলদি দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি অবাক চোখে তাকাতেই সে তার কান ধরে ওঠবস শুরু করলো। এক,দুই গুনতে গুনতে বলল,

—-” নেক্সট টাইম আর কখনো এমন হবেনা জান। সরি। তিন,চার,পাঁচ…”

হৃদের কান্ড দেখে মাঝে মাঝে অবাক না হয়ে পারিনা। যেকোনো ব্যাপারেই যে সে খুব ছেলেমানুষ। আর তার এই ছেলেমানুষীতেই মানুষ টার প্রতি ভালোবাসা আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। তাকে কান ধরে ওঠবস করতে দেখে আমার কিন্তু মন্দ লাগছেনা। আমার হাসি দেখে সেও মুচকি হাসলো। দশ অব্দি কাউন্ট করে পূনরায় আমার পাশে বসলো। আমার হাত নিজের হাতে নিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

—-” তোমার এই হাসিটাই যে আমার প্রান কাড়িয়া নেয় প্রিয়। সারাজীবন তোমার মুখে ঠিক এই হাসিটাই যেন থাকে প্লিজ।”

আমি হাসলাম আবারও। এই মুহুর্তে মানুষ টার কথার জবাব দেওয়ার থেকে তার বুকে মাথা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়া বেশি শান্তির মনে হলো।

#চলবে______________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]#প্রেয়সী♥
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০৩

৫.
দোয়েল পাখির মতো আকাশের দিকে পা তুলে সিটিয়ে আছি বিছানার উপর। দোয়েল পাখির মতোই মাথার উপর আকাশ ভে/ঙে পড়ার ভয়ে এমন কর্ম আমার। মনের মাঝে ছুটাছুটি করছে নিতু আপুর বলে যাওয়া কথাটা। সেটা শোনার পর মাথার উপর অলরেডি দুই-তিনটা ঠা/ডা পরে খনিকের জন্য একটু শান্ত হতে পারলেও আবারও যেন সেই একই কথায় পূণরায় মাথার উপর পুরো আকাশ ভে/ঙে পড়ার জোগাড়। নিতু আপু আমার বড় চাচার মেয়ে। অনলি ওয়ান পিস ধলা কাউয়া। আমি অবশ্য ওর মতো ধলা নই! আমি হলাম শ্যামলতা। বড় চাচীও ফর্সা। বড় চাচীর থেকেই নিতু আপুর গায়ের রং এমন। নিতু আপুর চেহারায় চাচীর কোনো মিল না পেলেও আমার বাবার ঘরের উত্তর দিক টাতে বিশাল আকারের যে ছবিটা টানানো, সেই ছবির অধিকারিনী মানুষটার সাথে বড্ড মিল পাই। যখনই আমি ঐ ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, ভেতরটা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে কেঁপে উঠে। কিছু একটা অনুভব করি। আমার শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় ঝিমুনি ধরে যায়। কেন জিজ্ঞেস করা হলে, উত্তর হবে জানিনা! কখনো জানতে ইচ্ছেও হয়নি। কারন ঐ অদ্ভুত অনুভূতি গুলো এখন আমার অভ্যাস। রোজ দু’বেলা ঐ ছবিটার সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে ভেতরটা খুব অস্থির হয়ে উঠে।

আমার বড় চাচা আসাদুজ্জামান খান। খান বাড়ির বড় প্রদীপ। আর আমার বাবা আহাদুজ্জামান খান। খান বাড়ির ছোট্ট প্রদীপ। যদিও প্রদীপ হয়েও কাজে কেউই আসতে পারেনি। আমার বাবা যাও একটু পেরেছেন,কিন্তু বড় চাচা সেটুকুও পারেননি। বড় চাচার অস্থির এক স্বভাব রয়েছে। দু’দিন বাদে বাদে নিতু আপুর জন্য বুড়ো দামড়া গন্ডার টাইপ লোক নিয়ে আসে বিয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের না থাকে কোনো চারিত্রিক সনদ আর না থাকে কোনো রূপের সনদ। শুধু গরুর মতো ইয়া মোটা একখানা পেট আর পেটের মধ্যে অগণিত টাকা। আর বড় চাচা সেটা দেখেই মুখিয়ে পড়েন সেদিকে। এবারও তার ব্যাতিক্রম নয়। হাম্পটি শার্মা টাইপ। নিতু আপু সেই কথা শুনতেই রা/গে ফুঁসতে ফুঁসতে ধলা কাউয়া থেকে এক নিমিষেই লাল কাউয়াতে পরিনত হয়েছে। পারলে তো রে/গেমে/গে ঐ বেটার মাথার চুল সব উগলিয়ে দিয়ে চলে আসে! অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তাকে ম্যানেজ করেছি! কিন্তু ওর শেষ প্ল্যান টা শুনে তো আমি আহাম্মক হয়ে গেছি। নিতু আপু বাড়ি থেকে পালাতে চায়। কি সাংঘাতিক কথা! রাফিন ভাইয়ার সাথে পার্মানেন্টলি পালাবে সে! কথাটা শুনতেই হার্টের বারোটা বেজে গেছে আমার। কথা হলো ও পালালে বড় চাচা নিঃশব্দে আমার গ/র্দা/ন নিবেন। কাউকে কিছু বলার সুযোগ টাও দিবেনা। উফফ আর ভাবতে পারছিনা। ঐ বেটা কুতুবউদ্দিনের জন্য নিতু আপুর পালানোটা মেনে নিতে আমার বদহজম হয়ে যাচ্ছে যে। এর রূপান্তর কিছু তো একটা ভাবতেই হবে।

—-” নিধি মা?”

এরে কে ডাকে অসময়ে! দরজার কাছ থেকে কারোর ছায়া ভেসে আসছে। গলাটাও বাবারই মনে হলো। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। বেডের পাশের বড় মিরোরটা থেকে দেখা যাচ্ছে বাবার স্যান্ডেল জোড়া। হ্যাঁ বাবাই।

—-” বাবা,এসো ভেতরে এসো!”

আমার ডাক পেয়ে বাবা মুখে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে ভেতরে ঢুকলো। বাবার হাসিতে আমার মুখেও আপনাআপনি হাসির রেখা ফুটে উঠল বুঝতে পারলাম। হাত এগিয়ে বাবার হাতটা ধরে পাশে বসাতে বসাতে অভিযোগের সুরে বললাম,

—-” আজ এতো লেট কেন হু? টাইম দেখেছো ক’টা বাজে? শুনো বাবা, এই রোজ রোজ তোমার লেট করে বাসায় ফেরা আমি কিন্তু মোটেও বরদাস্ত করবো না বলে দিলাম। তোমার বয়স হচ্ছে, বুঝতে হবে… সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত করে বাসায় ফেরা মোটেও ভালো ছেলেদের কাজ নয়।”

বাবা হেসে উঠলো। বুঝলাম, বাবা আমার শাসনটা সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। আমি কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা হাসতে হাসতে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো। কপালের মাঝখানে একটা চুমু খেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” আজ ভার্সিটির ফার্স্ট ডে কেমন গেলো? ফার্স্ট ডে-র এক্সপেরিয়েন্স বলতো দেখি শুনি একটু?”

“ফার্স্ট ডে-র এক্সপেরিয়েন্স” কথাটা মাথায় বেজে উঠতেই আরেকটা ঠা/ডা পড়লো মনে হলো। শব্দবিহীন ঠা/ডা যাকে বলে। আমি বাবাকে ছেড়ে উঠে বসলাম। প্রস্তুতি নিচ্ছি মাত্রা ছাড়িয়ে একখানা মিথ্যা কথা বলার। যা হয়েছে তা তো আর বলা যায় না! যা হয়নি সেটাই বলা বাহুল্য। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলাম। খামখা উত্তেজিত হওয়ার ভাব ধরলাম। যাকে বলে ওভার এক্টিং। মানে এমন বোঝাতে হবে যেন আমি কথা গুলো বাবার সাথে শেয়ার করার জন্য একদম ম/রে যাচ্ছি! আসলেই ম/রে যাচ্ছি। তবে সত্যি কথা গুলো বলা যাবেনা। বাবা ধরে না ফেললেই হলো।

—-” আর বলো না বাবা! সে কি বলবো তোমায়? ভার্সিটি গেলাম পরে এতো এতো মানুষ আমাদের সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো,ইশশ আমি তো মনে করো খুশির ঠেলায় জ্ঞানই হারাবো এমন অবস্থা হয়েছিলো। ফুল,চকলেটস,গিফ্টস নিয়ে সব স্টুডেন্টস্-রা একদম মুখিয়ে ছিলো। একজন ফুল দিচ্ছে তো, আরেকজন চকলেট দিচ্ছে।”

—-” কারা?”

কথার মধ্যে বাবার কথা বলে ওঠায় থতমত খেয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথায় ‘অ’ থেকে ‘আ’ অব্দি এলো না। বোবা গলায় প্রশ্ন করলাম বাবাকে,

—-” অ্যা?”

বাবা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” কারা এতো সম্বর্ধনা করলো?”

বাবা আমার অতি চালাক। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মিথ্যে বললে বাবা ঠিকই ধরে ফেলে। কিন্তু আমিও তো তারই মেয়ে। এতো সহজে ধরা পড়া তো একদম চলবে না।

—-” কারা আবার! উফফ বাবা তুমি না কিচ্ছু বুঝোনা। কারা আবার সম্বর্ধনা দিবে? স্টুডেন্টস্-রা। হেহে, বললাম না মাত্র?”

বাবা চিন্তিত স্বরে বলল,

—-” কিন্তু নিধি মা, আমি যতদূর জানি ভার্সিটির ফার্স্ট ডে তে তো এতো কিছু দিয়ে স্টুডেন্টস্-দের সম্বর্ধনা দেয়না। তার জন্য একটা নির্দিষ্ট দিন থাকে। একটা নামও থাকে। কি যেন একটা!! হ্যাঁ___ মনে পড়েছে, সেদিনটাকে নবীন বরন বলে হয়তো? তাই না?”

আমি বলদার মতো তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। হাসবো না কাঁদবো ঠাহর করতে কষ্ট হচ্ছে। বিরহে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই জন্যই বলে অতি চালাকের গলায় দড়ি! ওভার এক্টিং করতে গিয়ে ঠিকই ধরা! হলো কিছু? এবার খুলতে হবে আরেকটা ওভার এক্টিং এর ডিব্বা।

—-” হ্যাঁ সেটা তো আছেই বাবা। কিন্তু, ঐ ভার্সিটির তো এটাই বিশেষত্ব। মনে করো যেদিন স্টুডেন্টরা প্রথম পা রাখে ভার্সিটিতে সেদিনই তারা এভাবে বরন করে। নবীনদের। মানে আমাদের যেভাবে করলো।”

বাবা কিছু একটা ভেবে অতি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

—-” তা হ্যাঁ রে মা, তুই কয় বক্স পেলি?”

বাবার উড়িয়ে ছোঁড়া প্রশ্ন মাথায় ঢুকলো না। তাই আবারও বোবা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

—-” কি বাবা?”

বাবার ভাব ভঙ্গিমার পরিবর্তন হলো না। একই সুরে আবারও একই কথা বলে উঠলো,

—-” কয় বক্স পেলি? কয় বক্স!”

আমি ভ্রু কুঁচকে নিলাম। ভাবনার জগতে হাতছানি দিয়ে ভাবতে লাগলাম,” কি কয় বক্স পেলাম?”

—-” কি রে বল?”

বাবার উত্তেজিত স্বরে আমার রীতিমতো কান্না পেয়ে যাচ্ছে। বাবার প্রশ্ন টা তো ঠিকঠাক ধরতেই পারছিনা। এখন কি কথা বলতে গিয়ে কি বলে ফেলবো? শেষে ধরা। এতক্ষণ যাবত এতো সুন্দর করে বানোয়াট কথা গুলো এক “ফু”-য়ে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যে। আমি দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললাম,

—-” বাবা, কি কয় বক্স পেলাম?”

বাবা চারপাশে নজর দিতে দিতে বলল,

—-” আরে চকলেট চকলেট! কয় বক্স পেলি মা? জলদি বের কর আমিও একটু খাই। কতদিন ধরে চকলেট খাইনা। আজ বাপবেটি মিলে কব্জি ডুবিয়ে খাবো। কি বল?”

এই সেরেছে! এবার কি বলবো? বাবা যে আমার চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে। মিথ্যে বলে যে একের পর এক ফেঁ/সেই যাচ্ছি! এবার কি বলি?

—-” বাবা….”

—-” কয় বক্স পেলি মা?”

এবার আমি কেঁদেই ফেলবো। না না কেউ আঁটকাতে পারবে না আমায়। সত্যি কেঁদে ফেলবো।

—-” ত…ততিন!”

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো আরেকটা বো/ম। এবার এটা ব্লা/স্ট হলে আমায় কেউ খুঁজে পাবেনা। সেন্টি খেয়ে মাস দেড়েক বেহুঁশ হয়ে থাকবো শিওর। বাবার চোখ দুটো গোলাকার হয়ে উঠলো। অবাক কন্ঠে বলল,

—-” তিন বক্স?”

আমায় কেউ তুলে নাও। চল নিধি আরেকটা মিথ্যে ঝাড়।

—-” বাবা তিন বক্স নয়! তিন বলতে আমি তিনটে বুঝিয়েছি!”

বাবার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। গুমোট বাঁধা মুখে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-” তোর ভার্সিটির লোকগুলো এতো খা/টা/শ কেন? কেউ কাউকে সম্বর্ধনা দিতে গিয়ে মাত্র তিনটে চকলেট দেয়? তাদের তো বোঝা উচিৎ, যে তাদের বাসায় ছোট বড় অনেক মানুষ থাকতে পারে,তাদেরও ইচ্ছে হতে পারে চকলেট খেতে!”

আমি অসহায় মুখ করেই ফিক করে হেসে দিলাম বাবার কথায়। হাসতে হাসতে বলল,

—-” আসলেই বাবা,ভীষণ খা/টা/শ ওরা। একদম বুঝেনা।”

বাবা মুখ কালো করে মাথা নাড়লো। বাচ্চাদের মতো করে গাল ফুলিয়ে কিছু একটা বলতে নিলে আমি থামিয়ে দিলাম। বকার সুরে বললাম,

—-” অনেক কথা হয়েছে। এবার জলদি উঠো,ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসো। একসাথে ডিনার করবো। খুব বেশি ক্ষিধে পেয়েছে কিন্তু!”

বাবা চোখ দুটো গোল গোল ঘুরিয়ে বলল,

—-” জাস্ট ফাইভ মিনিটস মা। এই যাবো আর এই আসবো।”

আমি হেসে মাথা দুলালাম। বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললাম,

—-” ঠিক হে মেরি বাচ্চে।

৬.

দাঁড়িয়ে আছি শেখ ফরহাদ স্যারের ডিপার্টমেন্টের সামনে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের চিতাবা/ঘ স্যার। এক নামে সবাই চিনে। মানুষের ভালো করতে গিয়ে অলওয়েজ বাঁ/শ খাড়া। সে আর নতুন কি! কিন্তু এবার যে নিজের ফাঁদে নিজেই পড়লাম। মানুষ কখনো ভালো হবার নয়। ধারনাটা সব সময় একদম গেঁথে রাখি মগজের প্রত্যেকটা রগের সাথে। কিন্তু কোন খুশিতে যে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম আল্লাহ মালুম। ভালো মানুষ সাজতে গিয়ে সিনিয়রদের সরি বলতে গিয়েছিলাম! ভালোয় ভালোয় সরি বলে ফিরেও আসছিলাম কিন্তু শেষ মুহুর্তে দিলো একখানা বাঁশ চেপে। সব হলো সুশীল সমাজের অশ্লীল ছেলেপুলে। বলে কিনা চিতাবাঘ স্যারের সাথে নাকি বাংলা ডিপার্টমেন্টের শায়লা ম্যামের সাথে এফেয়্যার আছে। বুঝো ঠ্যালা। আমি যদি সে কথা চিতাবাঘ স্যারকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারি তবেই উনারা আর আমাদের পিছন লাগবেন না! বুঝলাম রাফিদ নামের ছেলেটা তাদের গ্যাং লিডার। অবশ্য হওয়াই উচিৎ। তার পার্সোনালিটি আর এটিটিউড মেয়েদের নাকি নিগড়িয়ে মা/রে। সত্যি বলতে আমিও ক্রাশ খেয়েছিলাম। কিন্তু তার খবিশের মতো আচরনে এক ধাক্কা মে/রে ক্রাশের লিস্ট থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রশ্নই আসেনা এমন ফালতু লোকের উপর ক্রাশ খাওয়ার। তবুও, আবলুস মন মানতে চায়না সে ফালতু লোক। আজকের এই ম/র/ন ব্যাধি ডেয়ারটা উনারই দেওয়া। ইচ্ছে হয়েছিলো পাশের বড় বটগাছ টায় চড়ে লাফিয়ে পড়ে ম/রে গিয়ে কিছুক্ষনের জন্য পেত্নী হয়ে তার ঘাড় মটকে দেই। কিন্তু হলো না। পাশের বিশাল জায়গা জুড়ে স্থান পাওয়া বড় বট গাছটা টেপুশ মার্কা। বেঁটে টাইপের। তাই ওখানে উঠে ঝাপিয়ে পড়ে ম/রে যাওয়ার ইচ্ছে তার শিকড়ের নীচেই চাপা দিতে হয়েছে।

রাইয়ের কাঁপা কাঁপিতে ভানায় ছেদ ঘটলো আমার। মুখ কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই ওর কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। মেয়েটা পড়েছে ফেসাদে। চিতাবাঘ নাম শুনেই একদফা বেহুঁশ হতে চেয়েছিলো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেইনি! ওকে সটান করে দাঁড় করিয়ে বিনা বাক্যে স্যারের ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে হাজির হয়েছি। পাশে কুম্ভকর্ণ দেখতে একটা আপু দাঁড়িয়ে। সিনিয়রদের দলের। নাম অরিন। দেখতে ভালোই। ছেলেদের চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তাকে আপাতত সুন্দরীদের লিস্টে ফেলে তারিফ করতে পারছিনা! স্যার কে কথাটা আসলেই জিজ্ঞেস করতে পারবো কি পারবো না সেটার সাক্ষী হতেই চলে এসেছেন উনি। মনডায় চায় চুল গুলো ছিঁড়ে শাকের মুড়িঘণ্ট বানাই। আমার রান্নার হাত বেশ পাঁকা। মা না থাকার সুবিধা আরকি। ছোট বেলা থেকেই শিখে পড়ে বড় হয়েছি। তাই আমি চাইলেই এই শাঁকচুন্নির চুল ছিঁড়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে মুড়িঘণ্ট বানাতে পারবো।

—-” দোস্ত!”

রাই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে ডেকে উঠলো। ওর ডাকে মায়া হলো বেশ। শান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ডাক পড়লো ভেতর থেকে। পিয়নের ডাকে রাই চমকে উঠে আমার হাত খামচে ধরলো। পাশ থেকে কুম্ভকর্ণ আপু মানে অরিন আপু রুক্ষ স্বরে বলল,

—-” স্যার ডাকছেন ভেতরে চলো।”

আমি রাই কে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বললাম। যা হবে ভালোই হবে। এই খাটাশ গুলোর ডেয়ার ডান করতে গিয়ে যদি কোনো প্রবলেম হয় তবে আমিও তাদের দেখিয়ে ছাড়বো কত ধানে কত চাল! হুহ্।

#চলবে____________________

[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here