#বন্ধুত্ব_নয়_অন্যকিছু
#পর্ব_০৫
#লিখা_তৃষা_রহমান
আমি ওই দিন রাতের খাবারের সময় বাবা -মা কে বল্লাম, রবিনের করা রাজনীতির ব্যাপারে। বাবা- মা শুনেই দুজনে এক সাথে চিল্লিয়ে উঠলেন। একটা সময় প্রচণ্ড রকম যুক্তি তর্ক শুরু হলো।যখন বুঝতে পারলাম যুক্তি তর্কে আমি হেরে যাচ্ছি। তখন আমার সেই পুরোনো অভ্যাস টা কাজে লাগালাম। চোখের পানি ফেলে ছোটো খাটো একটা সমুদ্র বানিয়ে ফেল্লাম রুমের মধ্যে। আমার কান্না দেখে বাবা-মা দুজনেই রাজি হলেন রবিন কে রাজনীতিতে যাওয়ার জন্য।
এই পুরো সময় টুকু রবিন আমার পাশে বসে খুব মনোযোগ সহকারে ভাত খেলো। এমন একটা ভাব করে রইলো। যেনো রাজনীতিতে ও নয় আমি যাবো। তাই আমি নিজের জন্য এভাবে পারমিশন নিচ্ছি। ওর তাতে যেনো কিছুই যায় আসে না।
রবিন পরের দিন ভোরেই রাজশাহীতে চলে গেলো। আমার সাথে দেখা বা কথা কোনো কিছুই হয়নি। আমি ঘুম থেকে উঠে আমার বালিশের কাছে একটা কাগজ পেলাম। সেখানে লেখা ছিলো।
” বাবা-মা যে আমার রাজনীতির ব্যাপারটা এত সহজে মেনে নিবেন আমি কখনও কল্পনাও করি নি। তবে তোর প্রতি বিশ্বাস ছিলো যে তুই সব কিছু সামলাতে পারবি। একজন বন্ধু হিসাবে তোকে আমার সত্যি খুব ভালো লাগে। বাবা-মায়ের খেয়াল রাখিস। আমি রাজশাহী গিয়ে তোকে ফোন দেবো। ”
ব্যাস এতটুকুই, এর পরের দিনগুলো আমার জীবনে খুব চমৎকার ভাবে যেতে শুরু করলো। মনে হলো দাদীর কথা গুলোই বুঝি সত্যি হওয়া শুরু করেছে। আমি আর আমার একজন বান্ধবী মিলে অনলাইনে অর্নামেন্টস এর ব্যাবসা শুরু করলাম। কলেজ এ ক্লাস শেষ করে। আমি আমার বান্ধবীর বাসায় চলে যেতাম। ও একাই একটা রুম নিয়ে থাকতো। আমরা ওখানেই অর্নামেন্টস বানাতাম। বাসায় আসলে বাবা-মায়ের শাসন,আদর আর রাত হলেই রবিনের সাথে ফোনআলাপ। আমি সারাদিন কি কি করেছি সব কিছুই বলতাম।অপর দিকে রবিন ওর ভার্সিটিতে সারাদিন কি কি করেছে সমস্ত কিছু বলতেো সাথে নির্বাচনের প্রচারনার ব্যাপারে ও। সব মিলিয়ে আমার পরি পূর্ণ জীবন।
রবিনের নির্বাচনের আর দিন পনেরো বাকি। ইদানীং আমি ফোন দিলে রবিন কথা বলেনা ঠিক মত। ফোন দিলেই বলে ব্যাস্ত আছি না হলে কেটে দেয়। মাঝে মাঝে খুব বাজে ব্যাবহার ও করে। এই তো সদিন।আমি ফোন দিলাম ও ফোন ধরেই বল্ল,
-সমস্যা কি তোর ? এত বার বার ফোন দিচ্ছিস কেনো?
– না মানে,তুই ফোন ধরছিলিনা তাই।
-ফোন ধরছিলাম না যখন তখন তোর বোঝা উচিত ছিলো যে আমি ব্যাস্ত আছি।
– ব্যাস্ত থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। তুই তো ইদানীং আমার সাথে ঠিক মত কথাই বলিস না।
-আমি কথা না বল্লে কি তুই মরে যাবি ? যে তোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার কথা বলতে হবে।
– আসলে আমার বোধহয় ভুল হয়ে গেছে বুঝলি। তোকে এত বার ফোন দেয়া। আচ্ছা সরি। আর এভাবে এত বার ফোন দেবো না তোকে ।
– বুঝার জন্য ধন্যবাদ, এখন এই কথা গুলো তুই মনে রাখিস তাহলেই হবে।
এই কথা গুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলো। আর সেই সাথে আমার রঙীন দিনগুলো রঙহীণ হতে শুরু করলো।
এরপরের দিনগুলো আমার খুব বাজে ভাবে কাটতে শুরু করলো।প্রতিটা সময় মনে হতে লাগলো। এ আমি কি সম্পর্কে বেঁধে আছি। যেখানে নেই আমার জন্য একটু স্বস্তি। সব সময় মনে হয়। এই বুঝি রবিন হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।
নির্বাচনে রবিন জয়ী হয়েছে। বাবা-মা কে ফোন দিয়ে দোআ নিয়েছে। আর বলেছে দুই তিনদিনের মধ্যেই বাসায় একবার আসবে। রবিন এলো গুনে গুনে ঠিক নয় দিন পর। শ্রাবণের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজতে ভিজতে এক সন্ধ্যায় এলো। বাবা র সাথে অনেক সময় নিয়ে গল্প করলো। মায়ের কাছে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে খিচুড়ি খেতে চাইলো। মা সুন্দর করে ওর জন্য রান্না করলো।
রবিন বাসায় আসার পর থেকে আমার খুব অস্বস্তি হওয়া শুরু করলো। মনে হলো এই বাসায় আমি বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত একজন মানুষ। বাবা-মা এবং তার ছেলে। টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। একদম সুখী পরিবার তাদের। আর আমি বাড়তি একজন মানুষ। যার জন্য সংসারে অশান্তি ছাড়া কখনও শান্তি আসে নি।
রাতে সবাই খাওয়ার জন্য ডাকলেও আমি খেলাম না।বলেছি ভালো লাগছে না। সবাই হয়তো আমার মিথ্যেটাকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছে। তাই হয়তো আর কেউ ডাকে নি।
রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ার পর আমার রুমে রবিন এলো।
-কিরে রাতে খেলি না, আবার এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেছিস। শরীর কি বেশি খারাপ ?
-আমি শোয়া থেকে উঠে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।
-বুশরা,তুই কি আমার উপর রাগ করে আছিস ?
-না তো, রাগ করবো কেনো ।
-আমি বাসায় আসার পর থেকে দেখেছি। তুই আমার সাথে ঠিক মত কথা বলছিস না। কেমন একটা পালাই, পালাই করছিস ।
-এমনি ভালো লাগছিলো না তাই।
– এমনি বল্লে তো আর বিশ্বাস করছি না তোকে তো আমি খুব ভালো করেই চিনি। কিছু না হলে তো আর এভাবে চুপ করে বসে থাকার মেয়ে তো তুই নস।
-হুট করেই আমি রবিনের কলার ধরে একদম আমার কাছাকাছি নিয়ে আসলাম। আমার এমন ব্যাবহারে রবিন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। আমি রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বল্লাম, এত কিছু বুঝিস। তাহলে আমি যে তোকে ভালোবাসি সেটা বুঝিস না কেন বল ? পুরো পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে। আর তুই বুঝতে পারিস না কেন ? বলেই রবিন কে জড়িয়ে আমি কেঁদে ফেল্লাম।
রবিন আমার এমন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে বসে আছে। কিছু সময় পর বুঝতে পারলাম রবিনের একটা হাত আমার পিঠের উপরে। আমার কান্নার গতি যেনো আরও বেড়ে গেলো। জোরে কেঁদে ফেল্লাম।
-রবিন,আমায় একটু ভালোবাসবি প্লিজ। একটু ভালোবাস না আমায়। এই যে তুই আমায় ভালোবাসিস না এজন্য আমার খুব কষ্ট হয়। একটু ভালোবাস আমায় !
বাইরে সেদিন শ্রাবণের বৃষ্টি থাকলে ও আমার সমস্ত মন জুড়ে ছিলো বসন্তের হাওয়া। রবিন আমার সেদিনের অনুরোধ ফেলতে পারি নি। রবিন আমায় সত্যি সেদিন ভালোবেসেছিলো। ঠিক যতটা ভালোবাসলে পুরোপুরি ভাবে স্বামী -স্ত্রী হওয়া যায়। ঠিক ততটাই ভালোবেসেছিল। কে জানতো সেই পুরোপুরি কাছে আসাটাই একদিন দূরে যাওয়ার কারণ হবে৷
#চলবে