বন্ধুত্ব_নয়_অন্যকিছু শেষ পর্ব

#পর্ব_০৬

#বন্ধুত্ব_নয়_অন্যকিছু

#লিখা_তৃষা_রহমান

কথায় আছে ” ভালোবাসার লড়াই সব সময় দুজন এক সাথে লড়তে হয়। একা লড়াই করে কখনও জয়ী হওয়া যায় না “। আমার ক্ষেত্রে বোধহয় সেই কথাটাই প্রযোজ্য। যেহেতু আমি একা লড়ছি তাই আমার হার নিশ্চিত। ওই রাতের পর রবিনের সাথে আর কথা হয়নি। ও দুই দিন বাসায় ছিলো। আমি সেই দুই দিন ওর সামনে আর যায় নি। রাজশাহীতে চলে যাওয়ার পর ও আর ফোনে কথা হয়নি।

ইদানীং রবিনের ফেসবুকে আগের মত মেয়েদের সাথে ছেলেদের সাথে নিত্যনতুন ছবি দেখতে পাই৷

এভাবে প্রায় তিন মাস কেটে যায়। শুনেছি ভার্সিটির প্রতিটা টিচার, স্টুডেন্ট এর মুখে মুখে এখন রবিন এর নাম। বাবা- মা ও এখন খুব প্রাউড ফিল করে রবিন কে নিয়ে।

আজ-কাল নিজের মধ্যে অনেকটা চেন্জ বুঝতে পারি৷ আমার এই চেন্জ আমাকে বড্ড ভাবায়। নিজেরই থাকার কোনো জায়গা নেই আমার। আবার যে আসতে চায়ছে তাকে রাখবো কই ?

এর মাঝেই এক সন্ধ্যায় জানতে পারলাম, রবিনের দলের সাথে বিরোধী দলের মারামারি হয়েছে। মা-বাবা আমাকে কিছু না বলেই রাজশাহী রওনা করলেন। ফিরলেন পরের দিন সন্ধ্যায়। সাথে নিয়ে এলেন রবিন কে। রবিনের হাত,পা, মাথা সব খানেই ব্যান্ডেজ। মোটামুটি ব্যান্ডেজে মুড়ে চলে এসেছে রবিন।

তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, মা-বাবা রাজশাহী থেকে আসার পর আমার সাথে ঠিক মত কথা বলছে না। আমি নিজেই কথা বলেছি। আর তারা দায়সারা ভাবে শুধু উত্তর করেছে।

রাতে আমি নিজেই মায়ের রুমে গেলাম। মা কপালের উপর একটা হাত দিয়ে শুয়ে আছেন।
– মা,আসবো আমি
-হ্যা, এসো।
-মা, আমি কি কিছু ভুল করেছি যে আপনি, বাবা। আমার সাথে কথা বলছেন না।
– কিছুটা চিল্লিয়ে বল্লেন, তুমি কেন ভুল করতে যাবা। ভুল তো আমার। আমি অনেক বড় ভুল করেছি।
– আমি মায়ের কাছে গিয়ে, মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে বল্লাম,তুমি আমায় রাগ করো, প্রয়োজনে মারো। কিন্তুু আমার সাথে এমন চুপ চাপ ব্যাবহার করো না। আমার কষ্ট হয়।

– মা কিছুটা শান্ত হয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বল্লেন, আমার ছেলেটাকে আমি অনেক ভালোবাসি। ও যখন যা চেয়েছে তখন সেটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তোর দাদীর সাথে যখন কথা হয়। তখন বুঝতে পারলাম, আমার ছেলেটাকে আমার পর যদি কেউ ভালোবাসে সেটা তুই।ভেবেছিলাম তোর সাথে বিয়ে হলে ছেলেটা আমার ভালো থাকবে। তুই ও ভালো থাকবি। কিন্তুু এমনটা হলো না। বরং উল্টোটা হলো।তুই ভালো থাকতে পারলি না। অপর দিকে আমার ছেলেটা ও এখন দেশ ছাড়তে চাইছে।

রবিন দেশে থাকবে না, একথা টা যেনো আমার রক্ত শীতল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমি মায়ের সাথে আর কোনো কথা না বলে রবিনের ঘরে চলে এলাম।

দরজায় দাড়িয়ে দেখি, রবিন ফোনে কিছু একটা করছে। আমাকে দেখেই খুব নিচু স্বরে বল্ল,
-ভেতরে আয়, তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে। একটু পরে আমি নিজেই তোর রুমে যেতাম।
-আজ তোর সব কথা শুনবো বলেই। তোর রুমে এসেছি।
-বুশরা তোর কি মন খারাপ। দেখ মন খারাপ করিস না। আমি একদম সুস্থ আছি। শুধু শুধু তুই চিন্তা করছিস।
– রবিন, তুই সত্যিই কি দেশের বাইরে চলে যাবি ? মা বল্ল,তুই হায়ার স্টাডির জন্য দেশের বাইরে যাবি। আমার মনে হয়, তুই আমার থেকে পালানোর জন্যই দেশের বাইরে যাবি।

-বুশরা,আমি যে কথা গুলো বলবো। তুই বোঝার চেষ্টা করবি। আমি জানি তুই খুব বুঝদার একটা মেয়ে। আগে যে পাগলামিটা করেছিস। এমনটা আর কখনও করবি না।

রবিন কিছুটা দম নিয়ে আমার দিকে ভালো করে ঘুরে বসে। আমার হাত টা ধরে বল্ল, বুশরা তোকে আমি আমার শুধু মাত্র একজন বন্ধু ভেবেছিলাম।ভেবেছিলাম বল্লে ভুল হবে। এখনও একজন ভালো বন্ধু ভাবি। যাকে আমার ভালো, খারাপ দুটো সময়েই চোখ বন্ধ করে পাশে পাবো এই বিশ্বাস টা আমার আছে। যার সাথে আমি দুটো কথা মন খুলে বলতে পারি৷ এই এত টুকুই এর বেশি আমি ভাবিনি কোনোদিন। আমি ভেবেছিলাম তোর মা কে খুঁজে বের করবো। তারপর তোকে তার কাছে রেখে আসবো। এর পর দুজনে সেপারেশন হয়ে। আমি দেশের বাইরে চলে যাবো। আর তুই ও তোর মত করে জীবন শুরু করবি। আমার বাইরে যাওয়ার কথা গতকাল মা ভার্সিটি থেকে জানতে পেরেছে। আমি চায়ছিলাম না। মা এত তাড়াতাড়ি জানুক সব।আর তোর একটা ভুল ধারণা আছে আমার প্রতি সেটা হলো, তুই মনে করিস আমি হয়তো রিলেশনে জড়িয়েছি। এটা আসলে তোর ভুল একটা ধারণা, তুই তো জানিস আমি ছোটো বেলা থেকেই সকলের সাথে মিশতে পছন্দ করি।তাই অল্প কথায় সবাই আমার বন্ধু হয়ে যায়। যাদের তুই আমার সাথে দেখেছিস তারা সবাই আমার বন্ধু। এর বাইরে কিছু না।

আমি রবিনের হাত থেকে নিজের হাত টা সরিয়ে বল্লাম, ছোটো বেলা থেকে আমি বাবা- মা কাউকে পায়নি৷ বুঝতে পারার পর থেকে দাদী ই সব আমার জীবনে। সবার বাবা- মা যখন তার সন্তানকে শাসন করতো, আদর করতো।আমার খুব আফসোস হত। মনে হত আমি কেনো এসব পাই না আমার সাথে তুই বন্ধু হিসাবে যে ব্যাবহার করেছিস৷ ওটা আমি অন্যকিছু ভেবেছিলাম।তোর হয়তো অনেক বন্ধু ছিলো। আমার বন্ধু একজনই সেটা তুই। তাই তোর করা আমার প্রতি কেয়ার টাকে আমি অন্য ভাবে দেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এটা বন্ধুত্ব নয় হয়তো অন্যকিছু। এজন্যই আমি তোকে হারাতে চায় নি। আমি এত দিন শুধু আমার নিজের কথাই ভেবেছি। এখন থেকে আমি তোর কথা গুলো ও ভাববো। তোর বিশ্বাসের মর্যাদাটা রাখবো।

পরিশিষ্ট, একদিন কাক ঢাকা ভোরে রবিন দাড়িয়ে আছে একটা হসপিটালের করিডোরে।
পাশ থেকে তার মা একটা আধ হাত জীবন্ত মেয়ে পুতুল কে রবিনের সামনে বাড়িয়ে দিলো।বাচ্চাটা অনবরত কান্না করছে।

মেয়ের মায়ের উপর রাগ করেছিস। কিন্তুু মেয়ের উপর তো নয়। তাকে কেনো দেখবিনা ?

রবিন এবার আর রাগ করে থাকতে পারলো না। তার মায়ের কোল থেকে জীবন্ত পুতুল কে কোলে নিয়ে বল্ল,
বুঝলি তোর মা সারাজীবন এই চোখের পানি দিয়ে মানুষ কে বশ করেছে। যখন ভার্সিটিতে চান্স পেলাম তখন ভেবেছি এবার বুঝি তোর মায়ের থেকে দূরে যাবো। সেটা হয়নি, সে বিয়ে নামক সমুদ্রে আমাকে ডুবিয়ে দিলো। আবার যখন ভেবেছি। দেশ থেকে উড়াল দিয়ে অন্য দেশে যাবো। তখন দেখ, তোকে আমার কাঁধে উঠিয়ে দিলো। তুই এতটুকুন একজন মানুষ তোকে নিয়ে আমি কি করে উড়াল দেই বলতো। তুই তো পড়ে যাবি ?

বাচ্চাটা কি বুঝলো কে জানে, নানা রকম শব্দ করতে লাগলো। এমন একটা ভাব যেনো বাবার সব কথাই বুঝছে।

রবিন মেয়ের গালে দুটো চুমু দিয়ে বল্ল,তোর মায়ের জ্ঞান ফিরুক তারপর তাকে খুব শক্ত করে একটা কথা বলবো। আমাদের সম্পর্ক টা বন্ধুত্বের নয় অন্য কিছু ছিলো। আর এই অন্যকিছু টা হলো ভালোবাসা। এটা কেনো সেদিন আমায় বলে নি।

রবিনের মা তামিমা বেগম চোখের পানি মুছে। সৃষ্টি কর্তা কে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। সেদিন রবিনের সাথে কথা বলে আসার পর রাতে বুশরা তার দাদীকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে সব কিছু বলে। তামীমা বেগম তখন রবিনের জন্য খাবার নিয়ে ওর রুমে যাচ্ছিলো।বুশরা কান্না করছে বুঝতে পেরে। দরজার আড়ালে দাড়িয়েই সমস্ত কথা শোনেন।এবাং এটাও জানতে পারেন যে বুশরা প্রেগনেন্ট। তামিমা বেগম সেই রাতেই রবিন কে ব্যাপারটা জানায়।রবিন কিছুই সেদিন বলেনি। এবং বাকি মাস গুলোতে বাসায় আর আসে নি। হুট করে কাল রাতে বুশরা অসুস্থ হওয়ার পর। রবিন কে জানালে আজ ভোরে সবাইকে অবাক করে এখানে এসে হাজির।

-মা শোনো, (রবিনের ডাকে ধ্যান ভাঙে মিসেস তামিমা বেগমের।)
-হ্যা বাবা বল।
– বুশরা সুস্থ হলে, তুমি ওকে বলে দিও। ও যেনো আমার মেয়ের সামনে আর জীবনে না কাঁদে। আমি চাইনা ওর মত আমার মেয়ে ছিঁচকাঁদুনে হোক।

তামিমা বেগম হেসে বুশরাকে রাখা কেবিনের দিকে যান। বড্ড খুশি লাগছে আজ তার। বুশরা র জ্ঞান ফেরার পর যখন সে দেখবে রবিনের কোলে তার মেয়ে। তখন মেয়েটা কত খুশি হবে। ভাবতেই আবার হাসি পাচ্ছে তার।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here