গল্প: #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখক: Ninika Jaman Noor
পর্ব:৯
অতিত,
দেখতে দেখতে ইতুর এইচএসসির পরীক্ষার রেজাল্ট এর দিন এগিয়ে এলো।যতো দিন এগিয়ে আসছে ইতুর টেনশন ততোবেশী হচ্ছে।কিছুক্ষন পর পর রেজাল্ট এর কথা ভেবে দরজা বন্ধ করে সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছে।খেতে গেলেও খাবার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না।
শারমিন বেগম ইতুর অবস্থা দেখে বার কয়েক বুঝালেন।
কিন্তু কারোর কথাই ইতুর মাথায় ডুকছেনা।
অন্যদিকে অনু বিন্দাস আছে।তার এইসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।
শারমিন বেগম ইতুর এমন ডিপ্রেশন দেখে কণা আফরোজকে ডেকে আনলেন।
“দেখো এই মেয়ের অবস্থা।সকাল থেকে বিছানায় পড়ে আছে।নাওয়া খাওয়া তো একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।হুটহাট রুমের দরজা বন্ধ করে থাকে।এতো বুঝালাম কোনো লাভই হচ্ছে না।এখন তো ইচ্ছা করছে কষে চড় লাগিয়ে দিতে।”
ইতু আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার কণা আফরোজে কোলে মুখ গুজে দিলো।
কণা আফরোজ বললেন,”উঠ।তোর জামা কাপড় গুছিয়ে নে।রেজাল্ট দিতে আরো দশদিন বাকি এই দশদিন তুই আমার বাসায় থাকবি।”
ইতু কোল থেকে মাথা তুলে কণা আফরোজের দিকে তাকালো।
“তাকিয়ে আছিস কেনো?যা।এখানে একা একা টেনশন করার থেকে অনু আর আবিরের সাথে থাকলে মনটা এমনিতেই ফ্রেশ হয়ে যাবে তোর।”
শারমিন বেগম ও সায় দিয়ে বললো,”হ্যাঁ ভাবি। তুমি বরং ওকে সাথে নিয়ে যাও।তোমার ওখানে থাকলে আমি চিন্তা মুক্ত থাকবো।”
কণা আফরোজ বললেন,”কি রে হা করে বসে আছিস কেনো?যা তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আয়।”
||
আছরের নামাজ পড়ে আবির আর তার বাবা ঘরে ঢুকলো।আবির চা দিতে বলে রুমে এসে দেখে ইতু আর অনু মুড়ি মাখা খেতে খেতে হাসছে আর অর্ধেক মুড়ি আবিরের বিছানায় ফেলছে।
আবির ওদের দেখে এক ধমক দিলো।
“এই তোরা এখানে কি করছিস?কার পারমিশন নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছিস?আর রুমের এই অবস্থা করেছিস কেনো?”
আবিরকে দেখে ইতু আর অনু ভয় পেয়ে গেলো।আবিরের রুমে কারোর আসার অনুমতি নেই।আবির কাউকে তার রুমে ঢুকতে দেয় না।আবির নামাজ পড়তে গেছে দেখে ইতু আর অনু সাহস করে ঢুকে গেছে। কিন্তু কথা বলতে বলতে সময়ের দিকে খেয়ালই রইলো না ওদের।
অনু বোল নিয়ে উঠতে উঠতে বললো,”আ…সলে ভাইয়া ইতুর তো মন খারাপ ছিলো তাই ভাবলাম তোমার বারান্দাটা দেখাই ওকে।তুই তো একটা ছোটখাটো বাগান করেছিস ওখানে।দেখতেও সুন্দর তাই ওকে দেখাতে আনলাম।”
“দেখা শেষে বিদায় হবি এখানে আমার বেডে নষ্ট করছিলি কেনো?তোরা দুই জন মিলে এখন বেডশীট চেন্জ করে এটা ধুয়ে দিবি।রুমটা ঝাড়ু দিয়ে মুছবি ভালো করে।এর আগে তোরা এই রুম থেকে বের হতে পারবিনা।”
অনু অসহায় মুখ করে একবার ইতু তো আরেকবার আবিরের দিকে তাকালো।
ইতু কিছু না বলে চুপচাপ বিছানা চাদর তুলে ওয়াশ রুমে রেখে এলো। কাবার্ড থেকে আরেকটা চাদর নিয়ে সুন্দর করে বিছিয়ে দিলো।আবির দাড়িয়ে দাড়িয়ে ইতুর কান্ড দেখছে।ইতুকে কাজ করতে দেখে অনু ওয়াশরুমে গিয়ে চাদর ধুয়ে দিতে গেলো।
ইতু বিছানা করে রুম ঝাড়ু দিয়ে পুরো রুম ভালো করে মুছে দিলো।
আবির বিছানায় শুয়ে ফোনে স্ক্রল করার পাশাপাশি ইতুর কান্ড দেখতে লাগলো।ইতু তার একটু বেশীই চুপচাপ লাগছে।ইতু চাপা স্বভাবের এটা আবির যানে কিন্তু ইতু কাছের মানুষদের সাথে অনেকটাই খোলা বইয়ের মতো।যে কেউ তাকে পড়তে পারে।আজ ইতুকে অচেনা অচেনা ঠেকছে আবিরের কাছে।আগে আবিরকে দেখলেই আবির ভাই আবির ভাই বলে পাগল করে দিতো আজ কিছুই বলছেনা।আবির বেশ বুঝতে পারছে ইতুর কিছু একটা হয়েছে যেটা কাউকে বলছে না।
ইতু আর অনু কাজ শেষ করে চলে আসতে নিলে আবির আটকালো তাদের।
“অনু তুই যা ইতুর সাথে কথা আছে।”
অনু আর ইতু কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।
আবির চয়াল শক্ত করতেই অনু কোনো দিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে গেলো।
আবির বিছানা থেকে উঠে এসে ইতুর সামনে পকেটে হাত দিয়ে দাড়ালো। আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো ইতু।
“কি হয়েছে তোর?
আসার পর থেকেই দেখছি প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস।”
ইতু মাথা নিচু করে চুপ করে আছে
ইতুকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে আবিরের মেজাজ খারাপ হলো।
দাতে দাত চেপে বললো,”আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোকে।মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন?”
ইতু হাত কচলাতে শুরু করলো।তাও মুখ দিয়ে একটা কথাও বললো না।
আবির নাক ফুলিয়ে কপালে আংগুল দিয়ে ঘষে ইতুর দিকে আগ্নিচোখে তাকিয়ে বললো,”কানে নিচে একটা চড় দিবো।এই তুই বের হো আমার রুম থেকে।
তোকে কিছু জিজ্ঞেস করাই আমার ভুল হয়েছে।তুই মরে পচে থাক আমার কি।
তোকে যদি আমার রুমের আশেপাশে ও দেখি পা দুটো কেটে ফেলবো তোর।যা এখান থেকে।”
ইতু অবাক হয়ে গেছে আবিরের কথা শুনে।তার কি দোষ?সব কথা কি সবাইকে বলা যায়?আবিরকে কেনোই বা বলবে ওর সমস্যার কথা?
ওর জন্যই তো ইতু গাল ফুলিয়ে রেখেছে।
রেজাল্ট এর টেনশন তো আছে সাথে কিছু দিন আগে আবির ইতুকে দিয়ে কুহুকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলো।
ইতু কুহুকে অদের বাসার ছাদে নিয়ে যায়।আবির আগে থেকেই সেখানে ছিলো।
ইতুকে চলে যেতে বলে ওরা কথা বলতে লাগলো।
ইতু চলে যেতে গিয়ে ও ওদের এই ভাবে একা ছাড়তেও পারছে না।
ইতু সিড়ি দিয়ে নেমে আবার উঠে এলো।
উঁকি দিয়ে যা দেখলো তাতে ইতুর পায়ের নিচের মাটি কেপে উঠলো।
আবির আর কুহুকে চুম্বন অবস্থায় দেখে ফেলে।
আবির ইতুর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আর দুই হাত কুহুর গালে।
পিছন থেকে ওদের যে কেউ দেখলে এটাই বলবে।
ইতু সেদিন কাদতে কাদতে চলে গিয়েছিলো।
ঠিক করেছিলো আর আবিরের কথা ভাববে না।
ওকে পুরোপুরি ভুলে যাবে।
তারপর থেকেই ইতু আবিরকে ইগ্নোর করে চলে।
আবিরের নাম্বার ও ব্লক করে রেখেছে।
যদিও এতে আবিরের কিছু যায় আসে না।
আবির যে ওর ব্লক লিস্টে আছে সেটাও বোধ হয় যানে না।ইতু যে তাকে কিছুদিন ধরে ইগনোর করছে আবির বোধ হয় সেটা খেয়ালই করেনি।
মাঝে মাঝে ইতু ভাবে কাকে এতো ভালবাসে সে?
যে যানেই না ইতুর মনে আবিরের জন্য এক আকাশ ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছে।
ইতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের কোনায় এসে দাড়ালো।
বুকটা ভার ভার লাগছে তার।
চোখ দুইটা ও জালা করছে।
অনু এসে কাধে হাত রাখলো।
“এইভাবে আর কতো?কেনো নিজেই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস বলতো?”
ইতু ফুফিয়ে কেদে উঠলো অনুকে জড়িয়ে ধরে।
“কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে রে অনু?
আমি তো এমন কিছু চাইনি।দূর থেকেই তাকে ভালবেসে যেতে চেয়েছি।তাহলে কেনো তাকে পাওয়ার নেশায় ধরেছে আমাকে?
কেনো তাকে অন্য কারোর সাথে সহ্য হচ্ছে না?এমনটাই তো হওয়ার ছিল তাই না?”
ইতু ফুফিয়ে কেদেই যাচ্ছে।অনু সান্তনা দেয়ার ভাষা খুজে পাচ্ছে না।তার চোখেও পানি এসে গেছে। অনু তো ইতুর ভালোবাসার সাক্ষী।মেয়েটা যে তার ভাইকে কতোটা ভালোবাসে সে যানে।আবিরকে এক নজর দেখার জন্য কতো পাগলামি করেছে মেয়েটা।
________________________________
রেজাল্ট এর আর একদিন বাকি।
ইতু এতো দিনে একবারও আবিরের সামনে পড়েনি।
আবিরকে না দেখে থাকতেও কষ্ট হয়েছে অনেক।
কণা আফরোজ ইতুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
“তোর কি হয়েছে বলতো ইতু?
তোকে তো আগে এতো চুপচাপ দেখিনি!
চোখ মুখের অবস্থাও ভালো না।
তোকে এখানে ভালো করার জন্য আনলাম এখন তো দেখি তোর অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে।
খাওয়া দাওয়া ও ঠিক করে করছিস না।তোর মা তো আমাকে বকবে।”
ইতু মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে।
অনু পরিস্থিতি সামলাতে বললো,”আম্মু রেজল্টের টেনশনে এমন হয়েছে।ওর একটা সাব্জেট খারাপ হয়েছে তাই টেনশনে আছে।”
“আরে পাগলি মেয়ে কিছু হবে না দেখিস।তোর রেজাল্ট খুব ভালো হবে।”
ইতু উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
ওদের খাওয়ার মাঝে হঠাৎ আবির এসে ইতুর পাশে বসে পড়লো।ইতু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আবিরকে দেখে।
আবিরের সে দিকে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে তার মাকে বললো, “আম্মু তাড়াতাড়ি খাবার দাও আমার কাজ আছে।”
ইতু দেখলো আবিরকে কেমন চিন্তিত লাগছে।
ইতু নিজের চিন্তা কে বাড়তে না দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো।
পরেরদিন ১টা বাজতেই ইতু আর অনু কলেজে চলে গেলো।
২টাই রেজাল্ট দিবে।ইতুর আর তার বান্ধবীরা সবাই একজন আরেকজনের হাত চেপে বসে আছে।মাঝে মাঝে অপিতা হাসির কিছু বলে পরিবেশটা হালকা করতে চাইছে কিন্তু লাভ হলোনা।
কিছু সময় পর ওদের রেজাল্ট দিলো।
এতো ভীড় যে রেজাল্ট যানা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অহনা গিয়েছিলো ওদের রেজাল্ট আনতে।
অহনাকে মুখ কালো করে আসতে দেখে ওদের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো।অহনা এসে সবার রেজাল্ট যানালো।ওরা পাশ করেছে কিন্তু ইতু,,,
ইতু অস্থির হয়ে বললো,”আমার টা বলনা।”
অহনা মুখ কালো করে বললো,”তোর নাম লিস্টে কথাও দেখিনি।”
অহনার কথা শুনে ইতুর মাথায় মনে হয় কেউ বাজ ফেলেছে।
সবার একি অবস্থা।
“এই তুই মজা করছিস তাই না?”
অহনাকে চুপ থাকতে দেখে ইতু মুখ চেপে কাদতে লাগলো।
হঠাৎ ইতুর নাম মাইকে শুনে ওরা চমকে উঠলো।
ওদের কলেজের প্রিন্সিপাল মাইকে ঘোষণা করছে ইতু ওদের কলেজে ফাস্ট হয়েছে।
ইতু অবাক চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে দেখলো অহনা মুচকি হাসছে।
ওদের সবার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো।
স্কাউট লিডারদের ডোলের তালে সবাই নাচছে। হঠাৎ কেউ ইতুর হাত ধরে টেনে চড় মেরে দিলো।