বাক্সবন্দী চিঠি পর্ব -০৮

গল্প: #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখক: Ninika Jaman Noor
পর্ব:৮
ইতু কোকের বোতল সবার হাতে হাতে দিয়ে বললো,”এসব খাওয়া আমাদের পক্ষ অসম্ভব। আমাদের জন্য কোকই ঠিক আছে।”ইশা কোকের বোতলে চুমুক দিতে দিতে বললো,”আচ্ছা ইতু তুই আর আবির ভাইয়া সারাদিন ঝগড়া কেনো করিস বলতো? আবির ভাইয়া কতো কিউট একটা ছেলে।উনার সাথে কেউ ঝগড়া করতে পারে নাকি?”
ইশার কথাশুনে মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।ইতু দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”তো কি করা যায় উনার সাথে তুই বল।”
ইশা লাজুক হাসি দিয়ে বললো,”প্রেম।উনার সাথে জমিয়ে প্রেম করা যায়।একটু রাগি ঠিক কিন্তু এইসব রাগি ছেলেরাই খুব করে ভালোবাসতে যানে।”
ইশার লাজুক হাসি আর কথাগুলো শুনে ইতুর পায়ের নখ থেকে মাথার চুলগুলো পর্যন্ত জ্বলে উঠেছে। ইচ্ছে করছে ওকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।ওর কথায় পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিলো ও আবিরকে পছন্দ করে।
ইলা আবার ও বলে উঠলো,”আজ নীল পান্জাবিতে দেখেছিস কি সুন্দরটাই না লাগছিলো।আমার তো ইচ্ছা করছিলো খেয়ে ফেলি উনাকে।”
কথাটা বলে ইশা ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
ইতুর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো।ইচ্ছা করছে ওর চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।রাগে হাত পা কাঁপতে লাগলো।
ইতুর অবস্থা বুঝতে পেরে অনু গলা ঝেড়ে বললো,”আহা ইশা কি এইসব? তুই আমার সামনেই আমার ভাইকে নিয়ে কথা বলছিস? আর ভাইয়া কিন্তু সম্পর্কে তোর ও ভাই।তাই মুখটা সামলে কথা বল।
অহনা ও তালে তাল মিলিয়ে বললো,”আবির ভাইয়া তোমার ভাই হয়। এইসব বলা গুনাহ তোমার জন্য।আর এইসব যদি আবির ভাই শুনে কাঁচা চিবিয়ে খাবে তোমাকে।”রুপু ছি ছি করে বললো,”শেষে কিনা নিজের মামাতো ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছো? মামাতো ভাই হোক আর যাই হোক ভাই তো।”
ইশা অগ্নি চোখে রুপুর দিকে তাকালো।রুপুর কথাগুলো গায়ে আগুন লাগানোর জন্য যথেষ্ট।
অনু পরিস্থিতি সামলাতে বললো,”উফফ তোরা কি শুরু করলি? আমরা না পার্টি করতে এসেছে?আমার তো মনে হচ্ছে ভাইকে নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি।এইসব নিয়ে আর কথা বলবি না তোরা।”
রুপু মুখ ভেংচি দিয়ে চুপ হয়ে গেলো।অনু ইতুর হাত চেপে ধরে ইশারায় শান্ত হতে বললো।
অর্পিতা বললো,”পার্টি কিন্তু বোরিং হয়ে যাচ্ছে। ইতু একটা পার্টি সং প্লে কর।এখন উরাধুরা নাচ হবে।”
ইতু গান চালিয়ে দিলে ওরা নাচতে শুরু করলো।ইতুকে ও ডাকলো ও গেলো না। চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।কেউ দেখার আগেই সেটা মুছে ফেললাম।আবিরকে আবার দেখতে ইচ্ছা করছে।ছুটে আবিরের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে।ইতুর মনে হচ্ছে সে বেহায়ার চরম সীমানা পার করে ফেলেছে।এতোকিছুর পর ও কিভাবে কারোর জন মনটা ছটফট করে সেটা ইতু বুঝে উঠতে পারে না।
নাচ শেষে সবাই গোল হয়ে বসলো।এইবার সিগারেট টেস্ট করা হবে।
একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে সিগারেট জালালো।ইতু বসে বসে ওদের দেখছে।ইতুর ও একটু কৌতুহল হচ্ছিলো তাও নিজেকে সংযত করলো। ওরা একটান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে কাশতে লাগলো।সব ধোঁয়া এস পড়লো ইতুর গায়ে।ইতু উঠতে নিলে ইশা চেপে বসালো। ইশা একটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো ইতুর সামনে।ইতু অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকালো।ও দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।
ছাদের দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সবাই সিগারেট ফেলে দিলো।ইতু ছিলো উল্টো দিকে মুখ করে।পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো আবির দাড়িয়ে আছে।তার একটু পিছনে রাফি।আমাদের দিকে তাকিয়ে ও দৌড় দিয়ে চলে গেলো। আবিরকে দেখে সবার বুক ভয়ে কাঁপছে।আজ যে কপালে শনি আছে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে ওরা।
আবিরকে এগিয়ে আসতে দেখে সবাই দাড়িয়ে গেলো।আবির এসে চারপাশে তিহ্ম নজরে দেখতে লাগলো।
ইতু মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো আবিরের নজর ইতুর পায়ের কাছে জ্বলন্ত সিগারেটের দিকে। অনু ইতুর হাত শক্ত করে ধরে কেঁপে যাচ্ছে।
আবির শক্ত গলায় বললো,”অনু আর ইতু বাদে সবাই নিচে যাও।”
ওরা একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলো।ইশা সবাইকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও দাড়িয়ে থাকলো।আবির সবাইকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হুংকার দিয়ে বললো,”আমি যেতে বলেছি তোমাদের।”
আবিরের বাঝখাই ধমক শুনে উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠলো।ইতু চোখের ইশারা করলো চলে যেতে।ইতু আর অনু বাদে সবাই মাথা নিচু করে চুপচাপ দরজার কাছে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অর্পিতা,রুপু, অহনা ওদের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে নিচে নামলো।
তখনো সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আছে আবির।লাল চোখ আর শক্ত চোয়াল দেখে ইতু আর অনু মনে মনে যতো দোয়া পারে পড়তে শুরু করেছে। ইতুর আর অনুর জান গলায় এসে পড়েছে।ইতু আবিরকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না।আগের ভাবটা দেখাতে গিয়েও ভাবলো এই মুহুর্তে এইটা চরম বোকামি ছাড়া আর কিছু হবে না।আবিরের রাগ ভয়ংকর জিনিস।রাগের মাথায় কখন কি করে কি বলে ঠিক থাকে না।আবিরের রাগের কাছে ইতুর ভাব চুনো পুটিও না।চালাকি দেখাতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায়না ইতু। আবির এখন কিছু বললেই সেটা ইতুর আর অনুর জান উড়ে চলে যাবে অবস্থা।
অনু তো এখন থেকেই কাঁদতে শুরু করেছে।
অনুর ভয় বুঝতে পেরে ইতু মনে সাহস জুগিয়ে আবির কিছু বলার আগেই বললো,”সিগারেট আমি আনিয়েছি।অনু খেতে চায়নি আমি জোর করে…”
পুরো কথা শেষ করার আগেই আবির ইতুর দিকে রক্তলাল চোখে এমন ভাবে তাকালো ইতুর মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।পিঠ দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।ঠোঁট কামড়ে চড় মারার জন্য হাত তুললেও নামিয়ে নিলো। রাগে ফুসতে লাগলো। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে।এটা তার পুরোনো অভ্যাস।রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এমন করে সে।ইতু অবাক চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে।আবির ওকে মারার জন্য আবার হাত তুলেছে? এইবার পার্থক্যটা হলো আগের বার চড় মেরেছিলো এইবার মারতে গিয়েও নিজেকে আটকেছে।ইতুকে চড় মারা জন্য হাত তুলতে দেখে অনু ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। আবির রক্ত চোখে ইতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুই যে এতোটা বখে যাবি আমি ভাবতেও পারিনি।”
ইতুর দুই বাহু এতো জোরে চেপে ধরেছে মনে হচ্ছে হাড় সব গুঁড়ো করে ফেলবে।ইতুকে ঝাঁকিয়ে বললো,”এই তোদের আড্ডা? এইসব করে বেরাস? সিগারেট খাস তুই? নিজে তো বখে গিয়েসি আবার আমার বোনটাকেও নষ্ট করছিস?”
ইতু চুপ করে ছলছর চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আবির প্রত্যেকটা কথা গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে।
ইতুর হাত ছেড়ে আবির ওর গাল চেপে ধরে বললো,”একদম ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবিনা। আজকের পর থেকে তুই অনুর ধারের কাছেও আসবিনা।ওর সাথে কোনো রকম কথাও বলবি না।”
ইতু অবাক হয়ে আবির কথা শুনে যাচ্ছে।
অনু এইবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”ভা…ইয়া ওর কো…নো দোষ নেই।”
আবির একটা বাজখাই ধমক দিয়ে বললো,”অনু…তোকে কথা বলতে বলেছি? আজকের পর যদি তুই ইতুর সাথে যোগাযোগ করিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।যা নিচে যা।”
অনু অপরাধী চোখে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে।আবির তখনো ইতুর গাল চেপে ধরে আছে। অনু দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।
আবির এতো শক্ত করে চেপে ধরেছে যে গালে ব্যাথা করছে।কিন্তু এই ব্যাথার থেকেও মনের ব্যাথাটা বেশী লাগছে ইতুর।আবিরের চোখে স্পষ্ট রাগ,অভিমান দেখতে পাচ্ছে। চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে আছে।কপালের পাশের রগটা ফুলে আছে।
আবির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কবে থেকে করছিস এইসব? এইসব করার জন্য গেছিলি ওখানে?তোর থেকে এমনটা আশা করিনি।তুই তো এমন ছিলি না ইতু।”
আবিরের গলা এইবার নরম মনে হলো ইতুর কাছে।গাল থেকে হাত সরিয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট জ্বালালো আবির।ইতু অবাক চোখে আবিরকে দেখছে। আবিরকে কখনো সিগারেট খেতে দেখেনি ও।
ছাদের রেলিং এ ভর দিয়ে দাড়ালো আবির। ইতু আবার দেখে দুই হাত দূরেই দাড়িয়ে আছে।চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পারছে তার ভাবুকরাণীকে।এখনো কোনো ভাবনায় ডুবে আছে।চাঁদের আলো যেনো ইতুর শরীর থেকেই বেরিয়ে আসছে।
আবির ইতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”দুই বছর আগেই এইটা খাওয়া শিখেছি।শুনেছি মানুষ খুব বেশী কষ্টে থাকলে এটা কষ্টটা কমিয়ে দেয়।”
ইতু আবিরের কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ধীর পায়ে আবিরের পাশে এসে দাড়ালো।শান্ত চোখে আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো।
“কি দেখছিস এমন করে?আর এখানে দাড়িয়েছিস কেনো?আমাকে ভয় লাগছে না?”
ইতুর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো।আবির হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিলো।আবির ভ্রু কুঁচকে ইতু কি করতে চায় বুঝতে চেষ্টা করলো।
ইতু একটান দিয়ে কাশতে লাগলো। আবির ইতুর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিলো। ইতুর বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”খেতে পারিস না যখন নিলি কেনো? আর কখনো যেনো এইসব করতে না দেখি।যানিস না এগুলো খেলে ক্ষতি হয়।”
ইতু মুখে হাসি ঝুলি বলে,”তুমি ও তো খাচ্ছিলে।”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সোজা হয়ে দাড়ালো।ইতুর জন্যই মূলত সিগারেট খাওয়া ধরেছিলো।ইতুর জন্যই না হয় আবার ছেড়ে দিবে।
হঠাত্‍ কপালে কারোর ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো আবির।
ইতু জ্বর আন্দাজ করে গম্ভীর গলায় বললো,”তোমার জ্বর বাড়ছে আবির ভাই।এখানে দাড়িয়ে থেকে অসুখ বাড়িয়ো না।”
আবির ইতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”অসুখটা তো অনেক আগেই ধরেছিলো।তোর চিঠিগুলোর মতো আমিও অসুখটাকে বাক্সবন্দি করে রেখেছিলাম।এখন তোকে দেখে সেটা আর বন্দি হয়ে থাকতে চাচ্ছে না।”
ইতুর বুকে মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।শিরা উপশিরায় কাঁপন ধরেছে।
“জ্ব…র এসেছে তোমার।এলোমেলো কথা বলছো।রুমে গিয়ে ঘুমাও।” কথাটা বলে আর দাড়ালো না।এই মানুষটার প্রতি আর দুর্বল হতে চায় না।
আবির ইতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো।আশেপাশে কোথাও থেকে বেলী ফুলের গ্রাণ পাচ্ছে আবির।এইসময় ফুলের গ্রাণ পাওয়া কথা না।মনে হচ্ছ জ্বরটা আরো ঝেঁকে ধরেছে।মাথার মধ্যে কেমন জ্বালা করছে।আবির
রুমের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বললো,”আমাকে যে তোর অসুখে পেয়েছে ইতু।এই অসুখ সারতে যে আমার তোকেই লাগবে।”
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here