#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#ত্রয়োদশ_পর্ব
পায়ে হাত দিয়ে চোখ মুখ খিচে খাটের এককোণে বসে আছে সিরাত। পায়ের তালুর কাঁচ বিদ্ধ স্থান থেকে রক্তের লম্বা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে পড়ে থাকা ফোঁটা ফোঁটা রক্তের উপর চোখ পড়তেই আতকে উঠে চন্দ্রিকা।
– ” পূরবী? পায়ের মধ্যে কাঁচ বিধলো কি করে? কতখানি রক্ত বের হয়ে গিয়েছে! কি করে হলো এসব?”
প্রলাপ বকতে বকতে সাবধানতা অবলম্বন করে সিরাতের পাশে গিয়ে বসে পড়ে চন্দ্রিকা। পায়ের তালুর মধ্যে বড় এক টুকরো কাঁচ বিঁধে আছে। যার পাশ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।
– ” এক মিনিট, তুই এখানেই চুপ করে বসে থাক!”
বলেই বাইরে দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করে চন্দ্রিকা। মিনিট পাঁচেক পর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে সিরাতের পাশে পুনরায় বসে তুলোর সাহায্যে রক্ত মুছে নিল। হাতের সাহায্যে কাঁপা কাঁপা হাতে কাঁচের টুকরোর উপর স্পর্শ করতেই সিরাত ব্যাথায় ককিয়ে উঠে।
– ” একটু ব্যাথা হবে পূরবী! একটু ধৈর্য ধর! আমি কাঁচ টা বের করে দিচ্ছি।”
বলার সাথে সাথেই কাঁচের টুকরো ধরে টান দেয় চন্দ্রিকা। কাঁচের টুকরো বের হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। পায়ের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয় সে।
– ” এখানে চুপচাপ বসে থাক! কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডাক দিতি! এখন যদি আরো বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত তাহলে?
আচ্ছা আমি এই কাঁচের টুকরো গুলো সরিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
পরক্ষণেই নিচে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করে এক সাইডে রেখে নিল চন্দ্রিকা।
– ” আচ্ছা এবার বল তো আমাকে কি নিয়ে এত টেনশন করছিস? বিকেলের পর থেকেই দেখছি তোকে আতংকে আছিস!
রিপোর্টারদের ওসব কথায় টেনশন করছিস? আমি তো বললাম কিছু হবে না। চিন্তা করিস না! মিডিয়ার রিপোর্টারদের কথায় তো কিছু হয়ে যাবে না! কেননা তুই কিংবা মিস্টার ফাইয়াজ তো একে অপরকে ভালোবাসিস না।আর মিস্টার ফাইয়াজ ও তো এই ম্যাটার আগেই ক্লিয়ার করে দিয়েছে।”
– ” আমি জানি আপু! মিস্টার ফাইয়াজ আমাকে ভালোবাসেন না। আর না এই রিপোর্টারদের তিক্ত কথায় আমি ভয় পাচ্ছি। আমি তো ভয় পাচ্ছি অন্য কোনো কারণে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই নিউজটা যদি একবার রিয়ান ভাইয়া জেনে ফেলে তাহলেই তো সে আমাকে ধরে ফেলবে!
আর আমিও চাই না আবারো ঐ মুখোশধারী মানুষগুলোর মাঝে আবারো ফিরে যেতে! আর সেটার ভয়ই আমাকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। ”
ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো সিরাত।
পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে,,
টেবিলে বসে সবেমাত্র পরোটার একাংশ ছিঁড়ে মুখে পুরতে নিয়েছিল ঠিক এমন সময় পাশের চেয়ারে বসতে বসতে রিয়া বলে উঠে,
– ” মুগ্ধ, আমরা ঢাকা কবে ব্যাক করবো? আ’ম ফিলিং বোরড্ হেয়ার! আই ওয়ান্ট টু গো এ লং ড্রাইভ উইথ ইউ!”
পানির গ্লাসে চুমুক দিতে নিয়েছিল মাত্র ধ্রুব। কিন্তু রিয়ার কথা শুনে বিষম খেয়ে বসে সে। এতে করে রিয়ার বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাইয়াজ। এদিকে বিষম খাওয়ার ফলস্বরূপ কাশতে কাশতে ধ্রুবের অবস্থা বেহাল। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
– ” আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে রিয়া! এখন আমার পক্ষে যাওয়া পসিবল না। আর তুমি ভালো করেই জানো আমার এসব পছন্দ না! ”
বলেই নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ফাইয়াজ। ফোন আর জ্যাকেট হাতে নিয়ে বাইরের দিকে গটগট করে হাঁটা শুরু করে সে। বাইরে বের হয়ে গাড়ির কাছে আসতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিতেই খেয়াল করে স্ক্রিনের উপর ফারু নামটা জ্বলজ্বল করছে।
– ” হ্যাঁ ফারু বল? সরি রে কাল রাতে ফোন সুইচড অফ ছিল চার্জ না থাকার কারণে! বাসায় সব ঠিকঠাক আছে?”
– ” কি ঠিক আছে ভাইয়ু সেটা বল! সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে গিয়েছে!”
– ” মানেহ্! কি বলছিস এসব? কি ওলোটপালোট হয়েছে আর কি ঠিক নেই? আমাকে সোজাসাপ্টা ভাবে বল ফারু!”
– ” পাপা তোর আর রিয়ার বিয়ের প্ল্যানিং করছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তুই ঢাকায় ব্যাক করলে তোর সাথে রিয়ার এনগেজমেন্ট করানোর কথা বলছে পাপা!”
– ” হোয়াট! আমার আর রিয়ার বিয়ে? হাউ ইজ দিস পসিবল! আমি এখনি বাবার সাথে কথা বলবো। আমার মতামত ছাড়া আমার বিয়ে রিয়ার সাথে ঠিক করার প্রশ্ন আসে কি করে! ”
– ” আরে ভাইয়ু আমার কথা তো শোন,,”
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই টুট টুট করে কল কেটে যায়। ফাইয়াজের রাগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে জাফর সাহেবের এমন অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত তার রাগের প্রধান কারণ।
রাগের মাথায় গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে একটা ঘুষি মেরে দিল ফাইয়াজ।
– ” ড্যাম ইট!! এখন কিছু একটা করতেই হবে নাহলে এই ম্যাটারটা নিয়ে বাবার এমন সিরিয়াস নেস ফিউচারে খুব একটা ভালো ফলাফল আসবে তা কখনোই সম্ভব না!”
বিড়বিড় করতে করতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।
সকালের আলোর প্রখরতা অনেকাংশে বেড়ে গিয়ে দুপুর গড়িয়েছে। বারান্দায় চেয়ারের উপর হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সিরাত। সূর্যের মৃদু আলো এসে চেহারায় আছড়ে পড়তেই নড়েচড়ে উঠে সে। গতকাল থেকে পায়ের ব্যাথায় রুমের মধ্যেই চুপচাপ বসে থাকতে হয়েছে তাকে।
– ” আচ্ছা ঠিক আছে ডক্টর রূপ! থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আমি এখনি পূরবীর সাথে কথা বলছি!”
ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করে চন্দ্রিকা। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে।
– ” কি হয়েছে চন্দ্রিকা আপু? রূপ ভাইয়া কি কিছু বলেছে আমার রিপোর্ট গুলোর ব্যাপারে?”
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো সিরাত।
সিরাতের উৎসুকতার প্রহরের অবসান ঘটিয়ে চন্দ্রিকা হাসি মুখে বলে উঠলো,
– ” হ্যাঁ পূরবী ডক্টর রূপ তোর রিপোর্ট নিয়েই কথা বলছিল। আর কি বলেছে জানিস! বলেছে তোর চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য যতটুকু ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব তা তিনি নিজেই করবেন এন্ড তোর চোখের অপারেশন ও তিনি ইমিডিয়েটলি করাবেন!
তুই আবারো সবকিছু দেখতে পারবি! তোর দৃষ্টিশক্তি আবারো ফিরে আসবে।”
চন্দ্রিকার মুখে এমন কথা শুনে সিরাত যেন পুরো শকড হয়ে যায়। তার নিজের চোখের দৃষ্টিশক্তি আবারো ফিরে আসবে ভাবতেই যেন অদ্ভুত আনন্দ লাগছে। তবে মনে থাকা আশংকার পরিমাণ যেন বিন্দু পরিমাণ ও কমে নি।
– ” কিন্তু আপু, যদি আমার চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে না আসে?”
খানিকটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল সিরাত। কপাল বেয়ে দুশ্চিন্তার ঘাম ঝড়ছে।
– ” এমন কথা বলিস না পূরবী! ইনশাআল্লাহ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তুই শুধু অপেক্ষা কর!”
প্রত্যুত্তরে চন্দ্রিকার প্রশ্নে শুধু ছোট করে হুম বলে উঠে সিরাত। কেন যেন মনে হচ্ছে সামনে কোনো একটা ঘটনা তার জীবনের মোড়টাকেই পাল্টে দিবে।
মাঝখান দিয়ে কেটে যায় আরো একটি দিন। পায়ের ব্যাথা আগের চেয়ে কিছুটা কমায় এখন স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটাহাঁটি করতে পারছে সিরাত। কলেজ থেকে এখনো ফিরে নি নিশাত। আর না ফিরেছে চন্দ্রিকা। একা একা ঘরে বসে থাকার মতো একঘেয়েমি কাজ বোধহয় আর নেই। একপ্রকারের বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বাসায় মেইন দরজায় তোলা তীক্ষ্ণ খটখট শব্দ কানে আসে সিরাতের।
– ” কটা বাজে এখন? আর কে এলো? বোধহয় নিশাত অথবা ইয়াসিন আঙ্কেল এসেছে। যাই গিয়ে খুলে দিয়ে আসি!”
দরজার খটখট শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
– ” আসছি, অপেক্ষা করুন!!”
হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দরজার দিকে এগোতে থাকে সিরাত। দরজার ছিটকিনি খুলে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– ” নিশাত এসেছিস! ”
– ” হুম এসেছি তবে নিশাত না পূরবী পাখি! ”
কোনো পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই পুরো শরীর হিম ধরে গেল সিরাতের। নড়াচড়া করার বোধশক্তি টুকুও নেই তার মাঝে। শুধু অস্ফুট স্বরে গুটিকয়েক শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
– ” র,র্,রিয়ান ভাইয়া!!”
লাগেজ প্যাকিং করে ঢাকায় ব্যাক করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল ফাইয়াজ। রেডি হওয়া শেষ হতেই খেয়াল করে ঘড়িতে চারটা বাজতে এখনো বেশ খানিকটা সময় বাকি। দুদিন যাবৎ ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে দূরে থাকলেও অবসর সময়টুকু পেতেই ফোনে স্ক্রল করা শুরু করে সে। সিরাতের সাথে দেখাটাও হলো না ভেবে মনটা বিষন্ন হচ্ছে বারবার। ফোন স্ক্রলিং করার এক পর্যায়ে একটা জায়গায় চোখ আটকে যায় তার। একটা নিউজ আপডেট সম্পর্কে একটা আর্টিকেল পড়তেই বিস্ময়ে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে তার।
– ” ওহ নো! শিট! স,স্,সিরাত!”
বলতে বলতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। …………….
#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#চতুর্দশ_পর্ব
সদর দরজার সামনে ফুলের গাছটা টবসহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো চন্দ্রিকা। দরজাটাও খুলে রাখা হয়েছে। ধীর পায়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে আশপাশে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। হলরুমে চোখ যেতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। শেলফে থাকা ফুলদানি গুলো নিচে মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আর তার খানিকটা সামনেই ছোপ ছোপ রক্তমাখা পদচিহ্ন। তার পাশেই নিশাত সেন্সলেস হয়ে নিচে পড়ে রয়েছে।
আঁতকে উঠে চন্দ্রিকা। মনটাও কেন জানি কু গাইছে। হাতে থাকা ব্যাগটা তাড়াতাড়ি পাশে সোফার উপর রেখে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে সে। দ্রুত পায়ে রুমে পৌঁছে বলে উঠে,
– ” পূরবী, এই পূরবী!”
কিন্তু রুমে প্রবেশ করার পর হতবাক সে। রুমের কোথাও সিরাতের কোনো চিহ্ন টুকুও নেই। পুনরায় নিচে নেমে এসে নিশাতের কাছে দৌড়ে যায় সে।
– ” নিশাত, এই নিশাত! চোখ খোল, কি হয়েছে?”
তাতেও নিশাতের কোনো রেসপন্স না পেয়ে ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতল বের করে সেখান থেকে পানি নিয়ে নিশাতের মুখে ছিটিয়ে দিতেই পিটপিট করে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করে নিশাত। তবে মাথার পেছনের অংশ এখনো ঝিমঝিম করছে। নিশাতের জ্ঞান ফিরতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চন্দ্রিকা।
– ” কি হয়েছে নিশাত? তুই এভাবে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলি কেন? আর পূরবী কোথায়?
– ” সিরাতকে আপুকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঐ রিয়ান ভাইয়া। আপু এখন কি করবো! রিয়ান ভাইয়া যদি সিরাত আপুর কিছু করে ফেলে তাহলে? আপু কিছু একটা করো!”
ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে নিশাত। চোখে মুখে বড় বোনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
– ” কি!! রিয়ান এখানে এসেছিল? ও মাই গড! কিন্তু তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি কি করে!”
– ” আমি যখন কলেজ শেষে এসেছি তখন দেখি রিয়ান ভাইয়া সিরাত আপুর হাত ধরে টানাটানি করছিল। ভাইয়াকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি কিন্তু পরমুহূর্তেই হঠাৎ করে একটা স্প্রে আমার নাকে দিতেই সবকিছু আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আর এর পরেই হয়ত রিয়ান ভাইয়া আপুকে নিয়ে চলে গিয়েছে এখান থেকে!”
বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে নিশাত। সাথে করে চন্দ্রিকার চেহারায় দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে।
চলন্ত গাড়ি এসে থামে ফজিলাতুন্নেসা অনাথ আশ্রমের সামনে। দরজা দিয়ে বের হতেই দ্রুত পায়ে ভেতরের দিকে হাঁটা ধরে ফাইয়াজ। ভেতরে দরজার সামনে যেতেই ভেতরে চন্দ্রিকা আর নিশাতকে চোখে পড়ে তার। গুটিগুটি পায়ে ভেতরে একরাশ ভয় নিয়ে প্রবেশ করে সে।
– ” চন্দ্রিকা আপু? ”
বাইরে থেকে কোনো পুরুষালী কন্ঠ কানে যেতেই চন্দ্রিকা মাথা তুলে তাকায়। সাথে করে নিশাতও।
ফাইয়াজ ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করতেই হলরুমের অগোছালো অবস্থা দেখে খানিকটা আশ্চর্য হলো।
– ” মিস্টার ফাইয়াজ আপনি?”
– ” হ্যাঁ আমি! আসলে আমি মিস সিরাতের সাথে একটু কথা বলতে এসেছিলাম। আমি কি করে যে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব ঠিক বুঝতে পারছি না! আমার জন্য পরপর দুবার তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে যার বিন্দুমাত্র অংশীদার সে নয়! আপনি যদি প্লিজ একটু মিস সিরাতকে ডেকে দিতেন!”
মাথা নিচু করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো ফাইয়াজ।
– ” পূরবী এখানে থাকলে তো আপনি পূরবীর সাথে কথা বলতে পারবেন মিস্টার ফাইয়াজ!”
ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে বলে উঠে চন্দ্রিকা।
– ” মানেহ! মিস সিরাত এখানে নেই? ”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ফাইয়াজ।
– ” না নেই! আমার বোনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে রিয়ান ভাইয়া। আর সেটাও শুধু মাত্র আপনার জন্য! আমার বোনের যদি কিছু হয়ে যায় আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না রকস্টার মুগ্ধ!”
একপ্রকার চিৎকার করে বলে উঠলো নিশাত। কন্ঠে তার ক্ষোভ স্পষ্ট। আর সেটা কর্ণগোচর হতে আরো এক ধাপ অবাক হয় ফাইয়াজ। কি বলছে এগুলো নিশাত?
– ” হোয়াট? আমার জন্য কে তুলে নিয়ে গিয়েছে মিস সিরাতকে? আর কেনই বা তুলে নিয়ে গিয়েছে!”
– ” হ্যাঁ আমার বোনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে! যার থেকে বাঁচার জন্য আমরা দু বোন ঢাকা শহর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম, সেই লোকটাই আজ মিডিয়ার এই একটা ভুলের জন্য খোঁজ পেয়ে নিয়ে গিয়েছে সিরাত আপুকে! আর লোকটা যত ভয়ঙ্কর, সিরাত আপুর কিছু না হয়ে যায়!”
নিশাতের বলা প্রতিটা কথা শুনে ফাইয়াজের মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
– ” আমি কিছু বুঝতে পারছি না মিস চন্দ্রিকা! নিশাত কি বলছে এসব? আমাকে সবকিছু ক্লিয়ার করে বলো নিশাত!”
– ” আমি বলছি মিস্টার ফাইয়াজ!”
চন্দ্রিকা বলে উঠলো।
একদম সূচনা থেকে শুরু করে সবটাই বলা শুরু করে চন্দ্রিকা। সিরাত আর নিশাতের প্রতি সেলেনা চৌধুরীর অপ্রীতিকর আচরণ, হুমকি দেয়া, তার পরের দিনই চট্টগ্রামে পালিয়ে আসার সব ঘটনার বর্ণনা করে সে। সবটা শুনে ফাইয়াজ যেন নির্বাক। মুখ দিয়ে টু শব্দ ও বের হচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক চুপ থাকার পর ফাইয়াজ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
– ” আমি ফিরিয়ে আনবো সিরাতকে! মুক্ত করবো সিরাতকে রিয়ানের ঐ বন্দী খাঁচা থেকে!”
– ” কিন্তু কি করে!”
– ” সেটা না হয় আমিই দেখে নিব। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি সিরাতকে ফিরিয়ে আনবোই। ”
ফাইয়াজের এমন দৃঢ় অঙ্গীকারে মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ফুটে ওঠে চন্দ্রিকার।
রাতের আকাশের টিমটিমে আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরের মধ্যে তীব্র শীত অনুভূত হতেই নড়েচড়ে উঠে সিরাত। চোখ খোলার চেষ্টা করতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রনা শুরু হয়। তবুও খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকায় সে। পাশে হাতড়ে হাতড়ে সব জিনিসপত্র ছুঁয়ে দিতেই সবকিছু চেনা পরিচিত মনে হতে শুরু করে তার কাছে। হ্যাঁ এটাতো তার ই ঘর। তার মানে কি রিয়ান তাকে নিয়ে আবারো ঢাকায় এসে পড়েছে? রিয়ানের কথা মনে পড়তেই ভয়ে শিউরে উঠে সিরাত।
খাট থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে সামনে পৌঁছাতেই কারো গম্ভীর কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসে।
– ” জ্ঞান ফিরেছে তাহলে?”
দরজার সাথে হেলান দিয়ে সিরাতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠল রিয়ান। রিয়ানের এমন গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায় সিরাত। ভয়ে শরীর হিম হয়ে আসছে।
– ” র,র্,রিয়ান ভাইয়া আপনি?”
– ” হ্যাঁ আমি! দেখতে আসলাম খাঁচার পাখি কি খাঁচায় বন্দী নাকি ফুরুৎ করে উড়ে গিয়েছে!
গতবার তো ছোট বোনের সাহায্যে পালিয়ে গিয়েছিলি, কিন্তু এবার? এবার কি হবে সিরাত পাখি?
আমার খাঁচা থেকে পালানো এতটা সহজ না। আর দরকার পড়লে ডানা ছেটে দিতেও আমি দুবার ভাববো না, মনে রাখিস!”
বলেই উল্টো দিকে পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে সিরাত বলে উঠে,
– ” আপনি কি চান? আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন! আমি থাকবো না এখানে!”
সিরাতের জোরালো কন্ঠ শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় রিয়ান। ধীর পায়ে এগিয়ে খানিকটা সিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠে,
– ” চাই তো অনেক কিছুই যেটা তোর কল্পনার ও বাইরে। আর সেটা তোকে জানতে হবে না। বেশি চালাকি করার চেষ্টা করলে এর ফল যে খুব একটা ভালো হবে না সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস সিরাত। ”
বলেই গটগট করে বাইরের দিকে চলে গেল রিয়ান। আর সিরাত অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন দেহ নিয়ে ধপ করে বসে পড়লো।
– ” কেন? আমার সাথেই সবসময় কেন হয় এমন? আমি তো চেয়েছিলাম সব কিছু যেন নতুন করে ঠিক করে নিতে! কিন্তু আমার এই নিষ্ঠুর নিয়তি আবারো আমাকে এই নরকযন্ত্রণায় ঠেলে দিল কেন? ”
বিড়বিড় করে বলতে বলতেই নিশ্চুপ কান্না জুড়ে দেয় সিরাত।
চট্টগ্রাম টু ঢাকার ফ্লাইটে ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ঢাকা এসে পৌঁছায় ফাইয়াজ, ধ্রুব আর রিয়া। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে ফাইয়াজ। এদিকে ধ্রুব ফাইয়াজের এমন নিশ্চুপতার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারলেও রিয়ার সামনে বিষয়টা নিয়ে তেমন একটা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। এদিকে ফাইয়াজের মনে সিরাতকে হারিয়ে ফেলার ভয় আর ক্ষোভ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে।………
#চলবে 🍂