#বিকেলে_ভোরের_ফুল
#পর্ব_৭
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
স্পর্শ ছোট ছোট চোখে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুল বারবার ঢোক গিলছে। স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
–“তুমি এখানে কি করছো??”
ফুল কোন উত্তর দিল না দেখে স্পর্শ আবার বলল,
–“এখন যদি আমি তোমার গালে থাপ্পড় দেই।”
ফুল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
–“ক কেন?? আমি কি করেছি??”
–“আমিও তো কিছু করিনি তারপরও তুমি আমার গালে থাপ্পড় মেরেছিলে। এখন যদি আমি মারি তাহলে??”
–“আগে আমাকে ছাড়ুন তারপর বলছি।”
ফুলের কথায় স্পর্শর ঘোর কাটল ফুলকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে। ফুল বলল,
–“আসলে আপনি যা দেখেছেন তা সত্যি না আমি আসলে,,,,,”
–“আসলে কি??”
–“আমি একটু ফ্যানের কাছে বসেছিলাম। পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হাতটা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।”
বলেই ফুল দূরে সরে কুশনটা জড়িয়ে ধরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলো। পাখাটা নেড়ে বাতাস খেতে লাগল। স্পর্শ কিছু বলল না ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ফুল এক ধ্যানে পাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ফুলের। সপ্তাহ খানেক হয়ে গেছে এই বদ্ধ ঘরে আটকে আছে ও। কবে এখান থেকে মুক্তি পাবে তার কোন ধারণা নেই ফুলের। জিবনের সাথে এই লড়াই কি ওর কোনদিন শেষ হবে না?? ফুল মনে মনে বিড়বিড় করছে,
–“আপু তোমাকে খুব মিস করছি। তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই লোকটা যে কথা বলতে দেবে না। এই ঘরে তো কোন জানালা নেই যে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার সাথে কথা বলব!! সেদিন তোমার সাথে আমাকে নিয়ে গেলেই পারতে। মা আমাকে সাথে নিলো না। এখন তো অন্য জায়গায় সুখেই আছে আমাকে ছাড়া আর তুমিও তো আকাশের তারা হয়ে শান্তিতে আছো। শুধু অশান্তিতে আছি শুধুমাত্র আমি।একেক করে আমার সব প্রিয়জনেরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আচ্ছা রাজির আঙ্কেল আন্টি স্পন্দন ভাইয়া আর,,,,,,আ র,,,,,স্পর্শ ওরা কেমন আছে??বারো বছর হয়ে গেল ওদের কাউকে দেখি না। কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে??রাজির আঙ্কেল কি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে?? নাকি এখনও পায়নি?? সেদিন বাবা মা দাদির সাথে সিলেট চলে আসার পর আর একবারের জন্যও ওদের দেখতে পাইনি। আচ্ছা স্পর্শ কি আমাকে মনে করে??আমি তো খুব মিস করি ওকে। নাহ আমি ভুল স্পর্শ আমাকে কেন মনে করবে?? আমার বাবার জন্যই তো ওদের অনেক বড় বিপদ হয়েছিল। এখন তো আমি ওই পরিবারের সবার শত্রু। আমি মিছি মিছি ভাবছি। কিন্তু,,,,,আমি যে ওদের খুব মিস করি। একবার ও কি ওদের কারো দেখা পাব না??”
ফুল এক নাগাড়ে এসব ভাবছে আর চোখের পানি মুছতেছে। স্পর্শ ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে গেছে ওর। আজকে একজনের কথা ওর খুব মনে পড়ছে। যাকে এতদিন ধরে ভালোবেসে আসছে। কিন্তু তাতে কি যাকে ভালোবাসে সেই তো নেই। স্পর্শ মনে মনে বলছে,
–“আচ্ছা কি এমন দোষ হতো যদি আজকে পাপড়ির জায়গায় ফুল থাকতো। তাহলে তো আমি এতটা কঠোর হতে পারতাম না। ফুলকে সত্যি বলে দিতাম আমি সেই স্পর্শ যে তোমাকে ছোটবেলায় ‘বিকেলে ভোরের ফুল’
বলে ডাকতো। যার সাথে তুমি বৃষ্টির কাঁদা পানিতে লাফাতে, ছোটাছুটি করতে। যাকে ছাড়া তুমি এক মুহুর্ত ও থাকতে পারতে না। খুব মিস করছি তোমায় ফুল। এত জলদি কেন ছেড়ে চলে গেলে আমায়?? তোমাকে ছাড়া সত্যি আমি ভালো নেই। আমায় তুমি কথা দিয়েও কথা রাখোনি।”
স্পর্শ মাথার পাশে থেকে ওয়ালেট নিয়ে খুলল। ওয়ালেটের ছোট্ট একটা পকেটে স্পর্শ আর ফুলের ছোটবেলার একটা ছবি। যেখানে ফুল আছে বউয়ের সাজে আর স্পর্শ বরের সাজে। ছবিটাতে বুড়ো আংগুল বুলিয়ে মুচকি হাসলো স্পর্শ। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। স্পর্শ সবসময় ফুলের সাথে থাকতে পছন্দ করত। রাজির আর আজমল চৌধুরী দুজন দুজনের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। বিজনেস পার্টনার ছিল দুজনে। স্পর্শ ও ফুলের এমন বন্ধুত্ব দেখে স্পর্শ আর ফুলের বাবা মা ঠিক করেন ওদের দুজনকে বিয়ে দেবেন। এনিয়ে সবাই সবসময় মেতে থাকতো। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড় এসে যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিল। স্পর্শের ফুলকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আজমল চৌধুরী। পুরো পরিবার সহ বিজনেসের সব টাকা আত্মসাৎ করে তিনি পালিয়ে গেলেন। তখন স্পর্শর বাবা অসহায় হয়ে পড়লেন। টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলো ওনার উপর। রাজির আসরাফ সাহেবের আরও কয়েকজন বিশ্বস্ত পার্টনার ছিল।সবাই বিজনেসের জন্য টাকা দিয়েছিল। কিন্তু সেইসব টাকা নিয়ে আজমল চৌধুরী পালিয়ে যান। যার জন্য রাজির সাহেবকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে এবং সেই টাকার খোশারত দিতে বিনা দোষে দশটা বছর জেল খাটেন তিনি। স্পর্শর মা তখন পুরোপুরি ভেঙ্গে পরেন। ছোট ছোট ছেলে দুটো নিয়ে তিনি তার ভাইয়ের বাসায় উঠেন। অনেক কষ্টে ছেলেদের মানুষ করেন। দশটা বছর তিনি মানসিক রোগীর মতো কাটিয়েছেন। যেটা স্পর্শর মনকে আঘাত করেছে। আজমল চৌধুরীর প্রতি ঘৃণা রাগ জমেছে। প্রতিশোধের আগুন জ্বেলেছে স্পর্শর মনে। স্পর্শ একদিন ওর মায়ের কাছ থেকে জানতে পারল ওর মামা নাকি আজমল চৌধুরীর খোঁজ পেয়েছে। আর এও জানতে পারল যে ফুল নাকি টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। স্পর্শ সেদিন পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সব আঘাতের চেয়ে এই আঘাতটা ওর বেশি জখম করেছিল স্পর্শকে। ও বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ওর ফুল আর নেই। সেই কষ্ট বুকে চেপেই আজ প্রতিশোধের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ও।
পুরো রুমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। স্পর্শের চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে আর ফুলের ও। দুজন দুজনকে খুব মিস করছে অথচ দুজন দুজনের এতটা কাছে সেটা জানে না।
🍁🍁🍁
সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ খুলে তাকালো ফুল। হাত দিয়ে চোখ ঘষে চারিদিকে চোখ বুলায় কিন্তু স্পর্শকে দেখতে পায়না। ওয়াশরুমেও নেই। তারমানে স্পর্শ বাইরে চলে গেছে। ফুল উঠে ফ্রেশ হয়ে ঝাড়ুটা হাতে নিলো। পুরো রুমটা পরিস্কার করল। স্পর্শ এই কাজটা ওকে দিয়ে গেছে। না করলে আবার এসে বকাবকি করতে পারে।
আজমল চৌধুরীর ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
–“কেমন আছেন চৌধুরী সাহেব??”
আজমল চৌধুরীর আর চিনতে বাকি রইল না স্পর্শকে। তিনি রাগি গলায় বললেন,
–“আমার মেয়ে কোথায়?? তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে ফেরত দাও। তুমি যা চাইবে তাই পাবে।”
স্পর্শ হেসে বলল,
–“সত্যি যা চাইব তাই দেবেন।”
–“হুম।”
–“তাহলে ফিরিয়ে দিন রাজির আসরাফের জীবনের বারোটা বছর। ছোট ছোট দুটো ছেলের বাবার ভালোবাসা। ওদের মায়ের কষ্টে ফেলা চোখের পানি ফেরত দিন।”
আজমল চৌধুরী চুপ করে গেল। কারণ এসব কি আর ফিরিয়ে দেওয়া যায়??স্পর্শ আবার বলে উঠলো,
–“জানি আপনি এসব দিতে পারবেন না। আর এসব করতে আপনাকে বলব না। অন্যকিছু চাই আপনার কাছ থেকে।”
–“কি চাও তুমি বলো??”
–“আমি চাই আপনি সবার সামনে নিজের কুকির্তির কথা স্বীকার করবেন। বারো বছর আগে যে পাপ আপনি করেছেন সেই কথা নিজের মুখে সবাইকে জানাবেন। এটুকু করলেই এনাফ। তারপর আপনার মেয়েকে পেয়ে যাবেন।”
–“কখনোই না। আমি পারব না এসব বলতে।”
–“তাহলে আপনি যেমন ভাইরাল আর আপনার মেয়েও ভাইরাল হয়ে যাবে।”
–“তুমি কিন্তু আমার সম্মান নিয়ে খেলতেছো।”
–“ঠিক ধরেছেন। আপনি যেমন অন্য মানুষের সম্মান নিয়ে খেলেছেন তাই আমিও খেলছি। আমি আপনার মেয়েকে আরও আগে কিডন্যাপ করতাম। কিন্তু করিনি কেন জানেন??তখন যদি আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করতাম তাহলে ব্যাপারটা আপনি ধামাচাপা দিয়ে ফেলতেন। তাই বিয়ের দিন আপনার মেয়েকে তুলে এনেছি যাতে বিষয়টা সবাই জানে।”
–“নিজেকে খুব বড় খেলোয়াড় মনে করো তাইনা। বেশ আমিও দেখতে চাই তুমি আর কি কি করতে পারো।”
–“আমি কি করতে পারি আর না পারি সেটা পরে দেখে নেবেন। এখন রাখি।”
স্পর্শ কল কেটে দিলো। আজমল চৌধুরী রাগে থরথর করে কাঁপছে। স্পর্শ যে কাজটা করতে বলেছে সেটা উনি কিছুতেই করতে পারবেন না। তিনি অনেক ভাবলেন তারপর ফোন হাতে কাকে যেন কল করলেন।
স্পর্শ খাবার হাতে রুমে ঢুকে দেখল ফুল পান্তা ভাত খাচ্ছে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে। স্পর্শ ফুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–“এসব কি খাচ্ছো তুমি??”
ফুল স্পর্শর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“গরুর মাংস খাচ্ছি।”
–“ওয়াট??ইয়ারকি করছো আমার সাথে??”
–“দেখতেই তো পাচ্ছেন কি খাচ্ছি আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন??”
–“আমি যে খাবার কিনে আনলাম তার কি হবে??”
–“তার আমি কি জানি? আপনি কি আমাকে বলে গিয়েছিলেন??বলে গেলে তো বলতাম যে আমার খাবার আনা লাগবে না।”
–“উফফফ। তুমি এসব বাসি খাবার খাচ্ছো কেন??”
–“আমার ভালো লাগে। কালকের ভাত সব খাইনি। পেয়াজ মরিচ ছিলো তাই ভাবলাম খেয়েই ফেলি।”
–“তো এখন এই খাবারগুলো কি করব??”
–“ভারি জ্বালা তো। দিন আমার জন্য আনা খাবার আমাকেই দিন।”
ফুল হাত বাড়িয়ে দিলো স্পর্শ খাবারের প্যাকেট ফুলের হাতে দিলো। খাবারের প্যাকেট পাশে রেখে বলল,
–“এটা আমার দুপুরের খাবার। দুপুরে কোন খাবার আনবেন না ঠিক আছে। এখন সামনে থেকে সরুন যতসব।”
স্পর্শ কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। ফোন হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। একসময় স্পর্শ ঘুমিয়ে পড়লাম।
কেউ স্পর্শকে ধাক্কা দিতেই স্পর্শ লাফ দিয়ে উঠে বসে। স্পর্শকে উঠতে দেখেই ফুল দাঁড়িয়ে যায়। স্পর্শ তাকিয়ে দেখলো ফুল মুখ গোমড়া করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ওর চিন্তার ছাপ। তাহলে ফুলের কি কিছু হয়েছে?? আবার ও কি কালো বিড়াল দেখে ভয় পেয়েছে?? নাকি অন্য কিছু।
চলবে,,,,,,,,