বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব-০৯
#Taniya_Sheikh
চরম অস্বস্তি মনে প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখল রজনী। পুনঃ পুনঃ মনে আওড়াতে থাকে তন্ময়ের দেওয়া গতকালের পড়া। এক এক করে সবার খাতা দেখছে তন্ময়। সুশ্রী মুখখানাতে কাঠিন্য বিরাজিত। দু’টো ছেলের খাতায় ভুল পেয়ে রেগে অগ্নিশর্মা। ছেলে দু’টোর ঘাড় ধরে ধমকে দাঁড় করে রাখল। রজনীর অবস্থা তাতে আরও করুন। ভীরু চোখের কোনা দিয়ে সে দৃশ্য দেখে তার কলিজা শুকিয়ে খরা দেখা দিল গলায়। তন্ময় যখন এক বেঞ্চ সামনে রজনীর কাঁপা কাঁপি অবস্থা। এমন ইতোপূর্বে হয়নি তা নয়। স্কুলের গণিত স্যার হারুন স্যারকে দেখলেও সবার এমন অবস্থা হতো। এমনও দিন গেছে পড়া হয়েছে তবুও দিতে পারেনি ভয়ে। কান ধরে উঠবস, জালি বেত অথবা কঞ্চির বাড়ি সবই খেয়েছে সে। শহরেও যে এমন ভয়ানক একটা হারুন স্যারের ডুপ্লিকেট থাকবে তা কে জানত? আচ্ছা এই তন্ময় স্যারও কী ওকে ধরে মারবে?
” স্টান্ড আপ।”
আচমকা তন্ময়ের ভারি গলার স্বরে চকিতে দাঁড়িয়ে যায় রজনী। তন্ময় ওর সামনে থেকে খাতাটা নিয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে লাল কালির সাইন দিচ্ছে। রজনী আড়চোখে একবার ভয়ে ভয়ে খাতা আর স্যারের হাতের দিকে তাকিয়ে আধোমুখে মনে মনে প্রার্থনা করছে,
” ভগবান, ভুল যেন না হয়। ভুল যেন না হয়। আরও ভালো করে পড়ব আমি। উঠতে,বসতে,ঘুমাতেও পড়ব। এ যাত্রায় রক্ষা করো আমায়।”
সত্যিই এ যাত্রায় রক্ষা পেল সে। সামান্য একটু ভুল হয়েছিল তাতে বকে নি তন্ময় ওকে। রজনী কিছুটা স্বস্তি পেল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার বুক ধুকপুক করছে, অকারণে ঘামতে শুরু করল তন্ময়ের জিজ্ঞেস করা তিনটে রুলস বলতে গিয়ে। এক নিঃস্বাসে গড়গড়া করে বলে গেল সে। বলা শেষ হতেই হাতের ইশারায় বসতে বলে পেছনের বেঞ্চে চলে গেল তন্ময়। তন্ময় এতোক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল। সে নজর সরতেই কিছুটা স্বস্তি বোধ করল রজনী। ভারী নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। সে জানে না পেছনে দাঁড়ান তন্ময় সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওরই দিকে চেয়ে ছিল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো রজনী। মনে এখন অনেকটাই জোর বেড়েছে ওর। ভয় কে জয় করার জোর। তন্ময় সবার পড়া ধরে পুনরায় বোর্ডের সামনের ফিরে এলো। নতুন পড়া বুঝিয়ে হোমওয়ার্ক বুঝিয়ে দিচ্ছে সে। তন্ময়ের চাহনী একদিকে স্থির নয় তবুও যখন রজনীর উপর পড়ে রজনীর বুক দুরুদুরু করে ওঠে। ঐ অন্তর্ভেদী চোখে চোখ রাখতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়।
এমন করেই সময় পার হলো। পরীক্ষা সন্নিকটে, রজনী দিনরাত এক করে পড়ছে। এরমধ্যে তিনচারদিন সে তন্ময় স্যারের বকা খেয়েছে পড়ায় সামান্য ভুল হওয়ায়। অবাক হয়েছিল সাথে সাথে কষ্টও পেয়েছিল তন্ময় স্যারের রুঢ় ব্যবহারে। ঐ সামান্য ভুল আরও দুএকজন করে মাফ পেলেও রজনী কেন পেল না, সে প্রশ্ন সবার ছিল। তবুও সেটা স্যারের সামনে প্রকাশ করার সাহস কারো হলো না। এমন করে করে প্রায় প্রায় ভুল ধরে ছুটির পর অবধি রজনীকে অন্যান্য ব্যাচের সাথে আটকে রাখল। পড়াটা ঠিকমতো আদায় করে তবেই ছুটি হয়েছিল রজনীর। রজনী রাতের অন্ধকারে একা যেতে যখন ভয় পাচ্ছিল, এই তন্ময় স্যার তাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ তার সামনে হাঁটতে হাঁটতে রুক্ষস্বরে বলেছিল,
” চলো বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। বেঁধে যখন রেখেছিলাম পৌঁছে দেওয়াও আমার দায়িত্ব।”
রজনী কোনো কথা না বলেই স্যারের পথ অনুসরণ করেছিল। এরপর যতোদিন তাকে ওভাবে আটকে রেখেছে, ততোদিন একইভাবে পৌঁছেও দিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কিছু কানাঘুষোও শুনেছে সে। লজ্জায় তার মুখ নত হয়ে গিয়েছিল সেসব শুনে। দু’তিনদিন কোচিং কামাই করেছে মিথ্যা অজুহাতে। তার ধারণা ছিল এরপর স্যার হয়ত তার দিকে ফিরেও তাকাবে না, কিন্তু সে ধারণা ভুল। স্যারের মধ্যে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। তবে আটকে রাখার শাস্তি থেকে সে রেহায় পেল তারপর থেকে। হঠাৎ তন্ময় স্যার নিরুদ্দেশ হলো। ক্লাসের স্টুডেন্টরা বলাবলি করছিল তিনি এমনি স্বভাবের। যখন যা মন চায় তাই করেন। বাবা- মা নেই বলেই তার স্বভাবটাই নাকি এমন ছন্নছাড়া। বাবা-মা নেই? আহাঃ রজনীর মনটা কেন যেন ব্যথা পেল কথাটা জেনে। অনাথই অনাথের কষ্ট বেশি উপলব্ধি করে বলেই হয়ত রজনীর ব্যথাটা লাগল। সে মনে মনে ভাবল, এজন্যই বুঝি এমন অতিশয় রুক্ষতার আবরনে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছেন তিনি। কাউকে আপন করে নিজের সুখ,দুঃখের ভাগিদার করতে অভ্যস্ত নয় অথবা মন থেকে বাধা পান নিজের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে। যে যাই করুক তাতে রজনীর কী! রজনী এসব ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে গেল। এমনিতেই স্যারকে নিয়ে কোচিংএর মেয়েদের অনেক বাজে কথায় শুনতে হয়েছে তাকে। তারউপর রাইসা ম্যামের তিরস্কারই কি কম ছিল? একপ্রকার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নিয়েছিলেন তিনি রজনীকে। রজনী এসবেরই আগামাথা বুঝল না, লজ্জা আর সংকোচে নিজেকে ছোট করতে লাগল ভেতরে ভেতরে। মনে মনে জোর প্রার্থনা করল সহজে যেন মাধ্যমিকের সময়টা শেষ হয়। ব্যস! তারপর সে এদিকে কোনোদিন আসবে না। বেচারা স্যারকে তারই জন্য এমন বিশ্রী কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে ভেবেই কষ্ট পেল।
মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা শুরু হলো। মাসির বাড়ি থাকে নি সে। রজনীর এক বান্ধবী ছিল পাশের গ্রামে,সেখানেই পরীক্ষার দিনগুলো থেকেছিল। মাসি দেখা করতে চেয়েছিলেন রজনীর ইচ্ছা হয়নি মনের অভিমানে।
রজনীর মাধ্যমিক পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। ইংরেজি পরীক্ষার তিনদিন আগেই তন্ময় স্যার নাকি ফিরে এসেছে। চোখ মুখ পাংশু আর শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। রজনীকে এসব নূপুর মোবাইল করে জানিয়েছে। রজনী মিতুলকে এ’কথা জিজ্ঞেস করায় মিতুল জবাব দেয়নি। বিষন্ন মুখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কী যেন বিরবির করছিল রজনী শুনতে পায়নি৷ মিতুলের সাথে রজনীর বন্ধুত্ব হয়েছে। তবে অতোটা গাঢ় নয়। নাম্বার একচেঞ্জ করেছে পরীক্ষার আগে কোচিং থেকে যেসব সাজেশন দিয়েছে সেসব নেওয়ার জন্য। কারন গ্রাম থেকে এসে কোচিং করে পরীক্ষা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। মিতুলের সাথে রজনীর ব্যক্তিগত গল্প তেমন হয়নি। মিতুলরা এখানকান স্থানীয় বলা চলে। ওর ঠাকুরদাদার আমলের বাড়ি আছে কোচিংএর পূর্বদিকে। এই যে কোচিংএর বিল্ডিং এটা ওর জেঠুর, সেটা কিছুদিন আগে জেনেছে রজনী। এছাড়া আর তেমন কথা হয় নি ওদের। মিতুল পড়াশোনায় খুব মনোযোগী। পড়া ছাড়া অন্য কোনো কথা সে তেমন বলে না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মাসখানেকের মধ্যে তেমন যোগাযোগ নেই ওদের।
রুনা আপার ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান হয়েছে গত মাসে। রজনী কোল থেকেই নামাতে চাইনা বাবুটাকে। তার নিরস জীবনটা কিছুটা হলেও সরস হয়েছে বাচ্চাকে কাছে পেয়ে। বাবুর যতো কাজ সেই করে।এরমধ্যে জামিল ভাইয়ের মা এসে থেকে গেছেন এক সপ্তাহ। রজনীকে তিনি মন থেকে পছন্দ করেন নি, সেটা তার মুখ দেখেই বুঝেছে রজনী। সপ্তাহ শেষ হতেই মেয়ে বাড়ি থেকে জরুরী তলব আসায় চলে যান আবার তিনি। জামিল ভাই আগের মতো এখন আর বাইরে থাকেন না। ঘরের কাজ যতোটুকু পারেন তিনিও করেন। সেদিন খাবার শেষে টেবিল পরিষ্কার করছিল রজনী। ভেতর থেকে হঠাৎ নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়াল জামিল। বললো,
” তোমাকে একটা কথা বলব, বলব করে বলা হচ্ছে না।”
রজনী আধোমুখে অস্ফুটে বললো,
” বলুন।”
” ও বাড়ির খবর কিছু জানো?”
রজনী মাথা নাড়াল সে জানে না। তৎক্ষণাৎ তার মনে বিষাদের ছায়া নেমে এলো ও বাড়ির প্রসঙ্গে উঠতে। মনে পড়ে গেল সৌমিত্রের নিষ্ঠুর মুখখানা। “নির্দয়! পাষান!” বলে মনে মনে তিরস্কার করল সে। বাহিরে তার ছিটেফোটা দেখা গেল না। যেমন নিরব থাকে তেমনই থাকল। জামিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রজনীর মুখে ভাব বোঝার চেষ্টা করেও পারল না। দু’জনই চুপ রইল কিছুক্ষণ। নীরবতা ভেঙে জামিল আবার বললো,
” গতপরশু গিয়েছিলাম সেখানে। তোমার শাশুড়ির শরীর তেমন ভালো না। আমাকে নিভৃতে কাছে ডেকে বললো,তোমাকে যেন একবার সেখানে নিয়ে যায়।”
রজনী বিস্মিত স্বরে বললো,
” কিন্তু তা কী করে সম্ভব?”
” অসম্ভবের কী আছে?”
গলার স্বরটা কিছুটা উঁচু হওয়ায় মনে মনে লজ্জিত হলো রজনী। নিজেকে সংবরন করে নিচু গলায় বললো,
” আমাকে উনি ত্যাগ করেছেন জামিল ভাই। আমি তো তাদের কেউ না এখন। কোন অধিকারে সেখানে যাব আমি?”
জামিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” সৌমিত্রকে তুমি চিনলে না রজনী। চিনবেই বা কি করে। যে নিজেকেই চিনতে ভুলে গেছে তাকে আর দশজনে চিনবে কেমন করে। রজনী, আমার বন্ধুটিকে যতো খারাপ ভাবছ, সে তত খারাপ নয়। তোমাকে চিরতরের কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দিতেই এই কষ্টটুকু দিতে বাধ্য হয়েছে ও।”
জামিল এতোটুকু বলে রজনীর মুখে দিকে তাকাল। টেবিল মোছা ন্যাকড়াটা ধরে আগের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রজনী। জামিল আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” ভেবো না আমি ওর হয়ে উকালতি করছি,শুধু বলছি ওকে ভুল বুঝো না তুমি।”
” আমি তো নিজে থেকে কিছুই বুঝতে পারি না জামিল ভাই।” রজনীর অভিমানি গলার স্বরে জামিল কিছুটা প্রসন্ন হয়। তার বন্ধুটির ফেলে যাওয়া সম্পদটি এখনও সেইরকমই আছে ভেবে মনে মনে নিঃসংশয় হয়। মৃদু হেঁসে বলে,
” তা তো আমি জানিই বোন। তবুও বলছি, পুরুষ লম্বায়, বয়সে, বুদ্ধিতে যতো বড়োই হোক অনুভূতি জাহিরে মেয়েদের মতো ওতোটা নিখুঁত হয় না। সব ভাবনা সে অবলীলায় জাহির করতে পারলেও তোমার বেলায় তার মন উচাটন।”
রজনীর ঠোঁটের কোনে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠল। বললো,
” আমার বেলায় মন উচাটন! কিন্তু আমার তো ভিন্ন কিছু মনে হয়। আমার মনে হয় তার মন আমার দিকে নয় অন্য কারো দিকে আকৃষ্ট। আমাকে নিয়ে অনুভূতি জাহিরে বিপত্তি নেই তার বরং তার সকল বিপত্তির মূলেই আমি।”
রজনীর কথার ইঙ্গিত জামিল ঠিক বুঝল। অভিভূত হয়ে বললো,
” তুমি কি বলতে চাচ্ছ?”
রজনী জবাব দেয় না। নত চোখের কোনা ছলছল ওর। জামিল সেটা দেখতে পেল না। সে আবার একই ভাবে প্রশ্ন করাই রজনী নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বললো,
” আমার কিছু বলার অধিকারই তো নেই ভাই। তবুও যা বলেছি বেয়াদবী মনে করে ক্ষমা করে দেবেন।”
রজনী দ্রুত পায়ে রুমে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে নিরবে কাঁদছে। সেদিন রাতের কথা আজও ভোলেনি রজনী। তাকে স্ত্রীরূপে সম্পূর্ণভাবে স্পর্শ করেনি সৌমিত্র। কতোটুকু ছুঁয়েছিল রজনীর জানা নেই। তবে স্বামীর স্পর্শ এখনও তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে। সাথে কাঁটা হয়ে হৃদয়ে বিঁধে আছে একটা নাম। মায়া, মায়া! স্বামীর আক্ষেপের সুরে বলা সেই নামটা রজনী আজও ভোলেনি। মায়া কে, তা তো আর বুঝতে বাকি নেই ওর। এই কারনেই সৌমিত্র তাকে ত্যাগ করেছে সেটাও জানে রজনী। এক স্ত্রীই জানে স্বামী হৃদয়ে ভিন্ন রমণীর বাসে কতোটা পীড়া আর অপমানের। রজনীর সেদিন কেঁদে কেঁদে দিন-রাত পার হলো। জামিলের মুখে সব শুনে খুব রাগ করল রুনা। জামিলকে একপ্রকার শাসাল দ্বিতীয়বার সৌমিত্রের কথা রজনীর সামনে না তুলতে। জামিল স্ত্রীর কথার হ্যাঁ, না করল না। এই কথার তিনদিন পর এক দুপুরে সেখানে হাজির হলো অনুপমা। সাথে ছিল তার একমাত্র ছেলে অনীয়। রজনীকে দেখেই বাচ্চাটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রজনীর সাথের তিন চারদিনের সখ্যতা এখনো সে ভোলে নি। আশায় ছিল রজনী তাকে কাছে ডাকবে আর সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলবে,
” তুমি জানো কাকিমনি তোমাকে সবাই কতো মিস করে। আমিও করি। আমার বন্ধুদেরও বলেছি তোমার কথা। তুমি কি আর কখনো আমাদের বাড়িতে যাবেনা, বলো?”
তার সেসব ভাবনা পণ্ড হলো। চুপচাপ নত মুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল তার কাকিমনি। অনীয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেঁসেছিল কিন্তু কাছে ডাকে নি। অনীয় মন খারাপ করে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে রইল। অনু আগে থেকেই চেনে রুনাকে। আসা যাওয়াও হয়েছে এ বাড়িতে ওর। তাই সহজভাবেই কথাটা তুললো সে। রজনী বাড়ি থেকে আসার পর থেকে সারদা দেবী মনোকষ্টে দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ইদানিং আরও বেড়েছে তা। সারাদিনে সামান্য দু’দিন চামচ সুপ আর ওষুধই তার আহার। শরীর ভেঙে পড়েছে। এখন বিছানা ছেড়ে নামতেও তার কষ্ট হয়। খুব করে বলেছেন একবার যেন রজনী তাকে দেখতে যায়। রুনা এ’কথার বিপরীতে কিছু বলবে তার আগেই জামিল রজনীর মত জানতে চাইল। রজনী বিস্মিত এবং অসহায় চোখে চেয়ে রইল রুনার দিকে। স্বামীর উপর যথেষ্ট রাগ হলো রুনার। তার স্বামীর মনে কী চলছে সেসব তার অজানা নয়। ধরে বেঁধে রজনীকে আবার ঐ বাড়ি পাঠাতে পারলেই যেন সব ঝামেলার অবসান। বোকা লোক, এতোটুকু বুঝল না,মরুভূমিতে গাছের ছায়া পাওয়া যেমন দুস্কর তেমনিই ও বাড়ি গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবাটাও বোকামী। সৌমিত্র থাকলেও একটা কথা ছিল,কিন্তু সে তো স্বত্ব ত্যাগ করে বিদেশ পড়ে আছে রজনীকে এখানে দিয়েই। রুনা রজনীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অনুকে বললো,
” সৌমিত্র’দায়ের কি খবর? মা’কে দেখতে এসেছিলেন তিনি?”
” হ্যাঁ, গতমাসে এসেছিল। তিন পাঁচেক থেকে আবার চলে গেছে। দাদারও মনে হয় শরীর ভালো না।”
কথাটা বজ্রপাতের মতো কানে বাজল রজনীর। চকিতে চোখ তুলে তাকাতেই রুনা সেদিক খেয়াল করে অনুকে বললো,
” কেন? তার আবার কী হয়েছে?”
অনুপমা আক্ষেপের সুরে বললো,
” আপনরা তো জানেই তাকে। কোনোদিন কিছু বলেছে কাউকে? মায়া ভাবির অপরাধে সবাইকে সে শাস্তি দিচ্ছে। আচ্ছা বলুন, আমরা না হয় পর কিন্তু তার মা। তাকে কী এমন করে কষ্ট দেওয়া সাজে?”
পুনরায় মায়া নামটা শুনে যতোটা না আঘাত পেল। তারচেয়ে বেশি আঘাত পেল মায়া নামের সাথে ভাবি যুক্ত হওয়ায়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে এদের তিনজনের দিকে চেয়ে থাকল সে। প্রশ্ন করবে সেই সাহসটুকুও হলো না রজনীর। ওরা তিনজনেই রজনীর মুখের ভাব বুঝে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অনুপমার একবার ইচ্ছা করল মায়া সম্পর্কে সব বলে দিতে,পরক্ষনেই মন পাল্টে ফেলল সে। যেখানে অনুপমা কিছু বললো না, সেখানে এই দম্পতিরও কিছুর বলার থাকে না। অনুপমা উঠে রজনীর হাত ধরে বললো,
” যাবে তো বড়দি? মা পথ চেয়ে আছে তোমার।”
রজনী যন্ত্রণাময় মুখটা আরো নামিয়ে নিল। মৃদু গলায় বললো,
” আমি গেলে তিনি যদি রাগ করেন?”
” সোম’দা জানলে তো রাগ করবে। আমরা তো বলব না তাকে কিছু। চলো না।” অনু রজনীর হাতে মৃদু চাপ দিতেই রজনী আরক্ত মুখ তুলে রুনার দিকে তাকিয়ে রইল। উপস্থিত আরও দু’জনও রজনীর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই রুনা বিরক্ত গলায় বললো,
” আমাকে এসবে কেন টানছিস? তোর জীবন তুই বুঝিস। যেতে হলে যাবি, না হলে যাবি না। আমি কাউকে নিষেধ করি নি।”
কথাটা শেষ করে স্বামীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জামিল সব বুঝেও মৃদু হেঁসে রজনীকে বললো,
” তুমি যাও বোন। আজ হোক কাল হোক ওটাই তোমার আপন ঠিকানা। আপন ঠিকানায় যেতে আসতে এতো ইতস্তত করার দরকার নেই।”
রুনা চমকিত স্বামীর কথায়। মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও বাহিরে সে নির্বিকার। রজনী মনের বিরুদ্ধে গিয়েই অনুপমার সাথে যেতে রাজি হলো। তার কোনো ইচ্ছাই ছিল না সৌমিত্রের বাড়ি যাওয়ার। কিন্তু তার মায়ের আকুতিও অগ্রাহ্য করতে পারল না। মনে মনে নিজেকে এই বলেই সান্ত্বনা দিল সেখানে সৌমিত্রের মুখোমুখি হতে হবে না তাকে। পুতুলের মতো ব্যবহার করেছে মানুষটা রজনীকে। মনে মনে একটা সূক্ষ্ম আশা ছিল তার হওয়ার কিন্তু আজ সব ধুলোয় মিশে গেল। সে দ্বিতীয় পক্ষ এটা জেনেই তার যতোটা না কষ্ট হলো, তারচেয়ে ঢের হলো তার শূন্য সিঁথি আর কব্জি দেখে। তাকে উচ্ছিষ্ট জ্ঞান করে ফেলে গিয়েছে আজই মনে হলো রজনীর। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, “এই শেষ, আর কোনোদিন হবে না ও বাড়িমুখো। সে যতোই যা হোক।”
রজনী গাড়িতে চড়ে বসল। এই সেই গাড়ি, এই গাড়ি করেই শেষবার একপথে চলেছিল সৌমিত্রের সাথে। আজ ড্রাইভিং সিটে সে নেই তবুও তার উপস্থিতি রজনীর ধ্যানে,জ্ঞানে। তাকে তো ভালোবাসে না অথচ কী গভীর টান তার জন্য সবসময়ই অনুভব করে। যতোই জাহির করুক বীতশ্রদ্ধা কিন্তু শ্রদ্ধার সিংহাসনেই সেই আসীন। এই যে অনুপমার মুখে তার অসুস্থতার কথা শুনেছে, তারপর থেকেই চিন্তিত মানুষটার জন্য। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেখানেই থাকুক তার বিবর্ণ সিঁদুর অক্ষুন্ন থাকুক।
চলবে,,,