-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৬]
-‘ কেবল একটাকে শেষ করলাম।’
-‘জানি।’
-‘বলুন তো কে?’
-‘অভিরাজ রওশান!’
সুনয়না কিঞ্চিৎ অবাক হলো আবেশের কথা শুনে। অর্থাৎ সে সব জানে। তবুও ভাইকে বাঁচাল না? একটু মায়াও হলো না? নাকি এখানেও কিছু লুকায়িত রয়েছে যা সে অনুমান পারছে না। এসব মনে মনে আওড়িয়ে সে আবেশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্রোধেপূর্ণ তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। যদি এমন কিছু হয়’ও তাহলে আরো খারাপ কিছু ঘটবে। ঠিক তখনই
আবেশ ওকে এক ঝটকায় টেনে দাঁড় করিয়ে গলা চেপে ধরল। রাগে ওর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। যাকে এতদিন কত কী না করে রক্ষা করেছে, আজ সেই’ই স্বেচ্ছায় নিজের মৃত্যুকে আহ্বাণ করে এসেছে। বুকও কাঁপে নি, ওর কথা স্মরণেও রাখে নি। অনূভুতিহীন পাষাণ মেয়ে একটা! আজ আর একটুর জন্য সে জানে বেঁচেছে। নতুবা মোড়লেন হাতেই মারা পড়ত। অভিরাজকে খুন করে চিঠি লিখে নিজে মোড়লকে জানিয়েছে। মোড়ল ওকে এখন হন্য হয়ে খুঁজছে। মেয়েটার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারছে না আবেশ। সে একজনকে খুন করে এসেও ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বরং হাসছে সে। যে হাসি সহজে দেখা যায় না। তাছাড়া সুনয়না সবার সামনে হাসে না। তাকে মাঝে মাঝে বই পড়ার সময়ে হাসতে দেখা যায়। তাও মুচকি হাসি। অথচ সেই মেয়ে খুন করে এসে হাসছে। অর্থাৎ খুন করে তার মনেপ্রাণে শান্তি
মিলেছে। আবেশ রাগের বশে শক্তহাতে সুনয়নার গলা চেপে ধরেছে। যেন মেরেই ফেলবে। তবে সুনয়না ছটফট করলেও ছাড়ার আঁকুতি করল না। বরং ঠাঁই দাঁড়িয়ে’ই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। যখন ওর সুন্দর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসছিল, তখন আবেশ ওকে ছেড়ে চিৎকার করে বলল,
-‘সমস্যা কী তোমার ? কেন নিজের বিপদ ডেকে আনছো?’
সুনয়না গলা ধরে কাশতে কাশতেই হেসে ফেললো। অথচ তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। বড় বড় ফোঁটার অশ্রুজল বেয়ে পড়ছে ফর্সা গাল বেয়ে। আবেশ নিশ্চুপ হয়ে দু’ এক পা পিছিয়ে গেল। ধপ করে সোফায় বসে সে নিজের চুল খামছে ধরল। আসন্ন বিপদের কথা ভাবলেই ওর বুকটা কেঁপে উঠছে। অথচ মেয়েটি দিব্যি হেসেই যাচ্ছে। মোড়ল যে থেমে থাকবে না তা নিশ্চিত। থেমে থাকার কথাও না। উনার কলিজায় টান দিয়েছে সুনয়না। অভিরাজ মোড়লের দূর্বল পয়েন্ট। সে ছোট বিধায় তার করা অন্যায়ও পাপ। তাছাড়া
অভিরাজকে মারার কারণ অজানা। একমাত্র সুনয়না জানে অভিরাজকে কোন পাপের শাস্তি দিলো। এসব ভেবে আবেশ
আরো গম্ভীর হয়ে গেল৷ তাছাড়া যত যায়’ই করুন সরাসরি খুন! একটা মেয়ে হয়ে একা খুন করা কীভাবে সম্ভব? যতই হোক একটা মেয়ের শক্তি ছেলের কাছে পরাজয় মানে বাধ্য।
তাহলে কী ওর সঙ্গে আরো কেউ বা কারা আছে? থাকলেও উদ্দেশ্যে কি? নিশ্চুপ হয়ে এসব ভাবনায় মগ্ন আবেশ। তবে ওকে চিন্তিত দেখে সুনয়নার হাসির রেশ আরো বাড়ল। এই পরিস্থিতিতে লোকটাকে বদ্ধ উন্মাদের মতো লাগছে। তবুও
বেশ লাগছে! পৃথিবীতে এখনো কেউ ওর জন্য চিন্তিত দেখে
ভালোই লাগছে। যদিও এই আশা আর করে না সে। কারণ
থাকলেও পূরণ হওয়ার সম্ভবণা নেই। সুনয়না মেঝেতে বসে কাশছে আর গলাতে হাত বুলাচ্ছে। তখন আবেশ মাথা তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘চারদিন কোথায় ছিলে?’
-‘ব্যাক্তিগত কাজে গিয়েছিলাম। কাজ সেরে পুনরায় ফিরে এলাম।’
আবেশ ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বলল,
-‘মারলে কেন অভিরাজকে?’
-‘কুন্তিসহ গ্রামের অনেক মেয়েকেই সে ধর্ষণ করেছে। মূখ্য কথা, সেই মেয়েদের লাশের খোঁজ আজও পাওয়া যায় নি।’
-‘কুন্তি কে?’
-‘ছোট্ট মেয়েটা যে সর্বদা আমার সঙ্গে থাকত।’
তারমানে সুনয়না সব জানে। প্রথমে সুনয়না ভাবত, আবেশ কুন্তিকে মেরেছে। শুধু ওর পরিচয় ফাঁস করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আবেশ এসব কিছুই করে নি। অভিরাজের কথা বলার জন্যই কুন্তি ছটফট করত। এবং সেদিন অভিরাজের কথায় বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু বেচারি পারে নি তার আগেই কেউ তাকে গুলিবিদ্ধ করে। এবং কুন্তি সেই মুহূর্তেই মারা যায়।এই সত্যটা সুনয়না জেনেছিল রাঁধুনি রমেলার থেকে। তাও খুবই
সর্তকতার সাথে জোরাজুরি মাধ্যমে। কারণ কুন্তিকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে না পেরে রামেলা প্রাসাদে এসে কাঁদছিল।
সেদিন ওর কান্নার কারণ জানতে চাইলে সুনয়নাকে বলেনি।
বরং এটা ওটা বলে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু কুন্তি মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর, আরেকদিন এসেও রামেলা কাঁদতে কাঁদতে কাজ করছিলো। সুনয়না এবার কারণ জানতে চাইলে বলে,
এক সপ্তাহ হলো উনার ছোট্ট বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে
স্কুলে গিয়ে আর ফিরে নি। এত খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলাবলি করছে কারো সঙ্গে পালিয়েছে।
একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ রমেলার ছোট বোন দেখতে সুন্দর হলেও প্রতিবন্ধী ধরণের। তাছাড়া বুদ্ধিও কম। তাকে কে বা ভালোবাসবে? এইটুকু শুনে সুনয়না কোনো জবাব না দিয়ে চলে গিয়েছিল। এর কিছুদিন পর, রমেলাকে আড়ালে ডেকে সে সত্যি ঘটনা জেনেছে। ছোট্ট কুন্তিকে ধর্ষণের পরে, কতটা কষ্ট ভোগ করেছিল এবং মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কাউকে বলতেও নিষেধ করেছিল। এই ঘটনা সে এখন আবেশকেও জানাল। আবেশ নিশ্চুপ হয়ে সবটা শুনেও কিছু বলল না।
তখন সুনয়না ফট করে বলে উঠল,
-‘আপনিও কি নারী দেহের পাগল? আমাকে ভোগ করতেই বুঝি আপনার এত ছলাকলা?’
-‘এতে সন্দেহ নেই।’
সুনয়না হাসল। আবেশ আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।
ওর ক্লান্ত শরীর আর টলছে না। মাথাও ঘুরছে। ওর খাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই। আপাতত ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দরকার। তাই রুমে যেতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল। খুব শান্তভাবে সুনয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,
-‘আগামীকাল সকাল দশটায় রেডি থেকো।’
-‘কেন?’
-‘কারণ কাল তোমার আর আমার বিয়ে। হ্যাঁ, পারলে বিয়েটা আঁটকে দেখাও।’
কথাটা জোরালো কন্ঠে বলে আবেশ প্রস্থান করল। রাগে ওর মাথা বিগড়ে আছে। যাই যায় হোক সুনয়নার নিরাপত্তার দেওয়ার দায়িত্ব ওর। নয়তো মোড়ল ওকে ছিঁড়েছুঁড়ে খাবে। এতদিন শুধুমাত্র ওর জন্যই সুনয়নাকে ছাড় দিয়েছে। এবার আর সেই সুযোগ পাবে না। এসব ভেবে আবেশ ওয়াশরুমে চলে গেল। এখন মাথা ঠান্ডা করে কিছু ভাবতে হবে। নয়তো আসন্ন বিপদ ঠেকানো দুষ্কর হয়ে যাবে। সুনয়না ওখানেই চুপ করে বসে আছে। বিয়ের কথা শুনেও সে প্রত্যুত্তর করল না।
করেও লাভ হবে না তাই এনার্জি ক্ষয়ের প্রয়োজনবোধ নেই।
তাই সে আস্তে ধীরে উঠে ওর বরাদ্দকৃত রুমে যেতে যেতে মৃদু কন্ঠে বিরবির করল,
-‘একদা এক সময় আমার ব্যাক্তিগত চাওয়ার মধ্যে একজন পুরুষ ছিলো। মন থেকে চাইতাম তাকে! খুব শখ ছিলো তার রাজ্যের রাণী হওয়ার। সেই সঙ্গে প্রবল বাসনা ছিল, জীবন নামক লম্বা পথ একসঙ্গে পথ পাড়ি দেওয়ার। একে অপরের
শক্তি হওয়ার। তবে তা হয় নি পূরণ। আর হবেও নি। অপূর্ণই থেকে গেছে আমার ব্যাক্তিগত চাওয়া। সেই পুরুষটি বিষিয়ে দিয়েছে আমার মনপ্রাণ ও ইচ্ছে আকাঙ্খা । স্বযত্নে তছনছ
করেছে আমার রঙিন স্বপ্নগুলো। মেরে ফেলেছে আমার সব শখ আহ্লাদ। অথচ আজ সেই মন পেতে উন্মাদ আরেকজন প্রেমিক পুরুষ। হারানোর ভয়ে বন্দি রেখে আড়াইটা বছর।
দূর থেকে তার খেয়াল রেখেছে প্রতিনিয়ত। এই এক জীবনে পুরুষদের কত্ত রুপ দেখল, কেউ ছুঁড়ে ফেলে তো কেউ তুলে
স্বযত্নে আগলে রাখে।’
পরেরদিন সকাল দশটায় ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হলেও নির্বাচনের পরে সবাইকে জানানো হবে।
তাই নিকট আত্নীয় ছাড়া কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
নতুবা ব্যাপারটা পাঁচকান হতে সময় লাগত না।বিরোধিদলও নেগেটিভ কিছু রটাতে কৃপাণতা করত না। আবেশের কাছের বলতে ওর সহকারী সামিরসহ আরো তিনজন আর চাচীমা উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের কার্যক্রম যথাশীঘ্র শেষ করে উনারা বিদায় নিলেন। এরপরই আবেশও ফোন কল পেয়ে বেরিয়ে গেল। শুধু রইল সুনয়না। একাকী সময় কাটাতে জানালার ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে দু’চোখ বুলিয়ে কতশত কথা ভাবতে থাকল। মনে পড়ে গেল, ওর আর অভিরুপের
সুন্দর কিছু মুহূর্তের কথা। যেগুলো আজও স্মৃতির পাতায়
অতি যত্নে তোলা রয়েছে। অভিরুপের সঙ্গে ওর সম্পর্কের সময়সীমা মাত্র একুশ দিনের। এই একুশ দিনে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ছিল সে। তবে অভিরুপ ফায়দা উঠাতে অভিনয় করেছিল। অভিনয়ে সে খুবই পারদর্শী। হবেই তো মোড়লের
বড় ছেলে বলে কথা।
To be continue…..!!