-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৯]
আজ দুপুর আড়াইটায় আমজাদ হোসেনের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একদল ছেলেকে আদেশ দিচ্ছেন, আবেশকে মেরে ফেলার। এবং রেডিসন হোটেলে রুম বুক করে মেয়ের ব্যবস্থা রাখতে। এমনকি উচ্চপদের লোকদেরও নাম ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছেন। এছাড়াও উনি গরীবদের মাঝে যে খাদ্য বস্ত্র দান করছেন তা নিয়েও প্রচন্ড রাগ প্রকাশ করেছেন। বস্তির মানুষদের ছোটলোক সম্মোধন করেছেন। হঠাৎ এমন ভিডিও ভাইরাল হওয়াতে আমজাদ হোসেন হতভম্ব। ভিডিওতে লাইক, কমেন্ট, ও শেয়ারের যেন ঝড় বইছে। উনাকেও আমজনতা গালি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন।
নির্বাচনের আগ-মুহূর্তে এমন কিছু হয়ে যেন সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো।বস্তির লোকগুলো ক্ষেপে রাস্তায় মিছিল করতে
আরম্ভও করেছে। সংবাদিকরা সেটা লাইভে দেখাচ্ছে এবং আমজাদ হোসেনের প্রতি আমজনতার বর্তমান মনোভাবটা কেমন, তা সরাসরি আমজনতার থেকেই শুনছে। কেউ কেউ উনাকে গালি দিচ্ছে তো কেউবা উনার কাজে হতবাক। আর একজন তো বলেই ফেললেন, ‘প্রাণ থাকতে ওই কুত্তা** কে জীবনেও ভোট দিমু না।’
এছাড়াও উচ্চপদের লোকজনরা নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে লাগলেন। আমজাদ সাহেব নির্বাচন যেন করতেই না পারে সেই ব্যবস্থা করতে থাকলেন। উনারা গালি হজম করা মতো
ব্যাক্তি কেউ’ই নন। তাছাড়া দাপট উনাদেরও আছে তাহলে গালি হজম করবে কেন? উনি নির্বাচনে জয়ী না হতেই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে! জয়ী হলে তো কথায় নেই তাহলে। নির্বাচন থেকেই উনাকে বহিষ্কার করা হোক। এই নিয়েও তর্ক-বির্তক শুরু হয়ে গেছে। টেলিভিশনে ব্রেকিংনিউজ দেখে আমজাদ হোসেন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সব চাল এভাবে নষ্ট হবে কল্পনাও করেন নি। তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন কাজটি আবেশ করেছে। আবেশেরই এক লোক এখানে থেকে তথ্য নিয়ে আবেশকে দিয়েছে। আর আবেশ স্বযত্নে সেটা ভাইরাল করেছে। এতদিন নিশ্চুপ থেকে আবেশ জায়গা মতোই টোপ ফেলেছে। এখন ওর বিপরীতপ্রার্থীও নেই। অর্থাৎ আটকায় কে তাকে! এতদিন যারা টাকা খেয়ে নাম প্রচার করেছিলো উনার, তারাও পাল্টি খেয়ে সরে পড়েছে। তাদেরও বর্তমানে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ তাদের গুম অথবা গুন করে নি তারা স্বেচ্ছায় সরে গেছে।আমজাদ সাহেব উপায়ান্তর না পেয়ে ফোন বন্ধ করে বসে রইলেন। এরই মধ্যে উনার স্ত্রী’ও ঝগড়াঝাটি করে মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন।
যে লোক বাড়িতে বউ থাকতে বাইরে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করে, তার সঙ্গে উনি সংসার করবে না। এই লোক মানুষ না পশুর অধম। যার মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে বিবেক জাগ্রত হয় না, তার সঙ্গে সংসার করে জান কয়লা করার মানেই হয় না।এর পূর্বেও তিনি এহেন কাজ করেছিলেন। ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু আর না। কয়লা ধুলে ময়লা যায় না এটাই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। একদিনে একটার পর একটা ঘটনা ঘটাতে আমজাদ সাহেবের প্রেসার বেড়ে গেল। কোনোমতে, নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলেন। টাকাও গেল, ক্ষমতাও গেল, এমনকি সাজানো সংসারও।
সুনয়না রণকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখছে। এর মধ্যে রণের সঙ্গে ওর ভীষণ ভাব হয়েছে। বাড়ির প্রতিটা সদস্য কে কেমন তাও জেনেছে। রণ একটু বোকা টাইপের ছেলে। তবে খুব মিশুক। তার মনে খুব দুঃখ ছিল, সে চোখে চশমা পরে।
এতে নাকি অনেকে চারচোখ অথবা কানা বলে। এ নিয়ে খুব কান্নাকাটিও করেছে। কিন্তু আবেশ যখন বলেছে বুদ্ধিমানরা চশমা পড়ে। বুদ্ধির ভারে নাকি তারা চোখে কম দেখে।অর্থাৎ চোখে সমস্যা হলেও তারা প্রচুর বুদ্ধিমান। তারপর থেকে ওর সব দুঃখ চলে গেছে। এখন কেউ কানা বা চারচোখ বললেই সে মিটিমিটি হাসে। এর মানে, সে কানা হলেও বুদ্ধিমান এটা ভেবে বেজায় খুশি। এসব নিয়েই গল্প করতে করতে সুনয়না আবেশের রুমে প্রবেশ করল। পারিপাটি সুন্দর একটা রুম।
রুমটিতে নাকি কারো অবাধ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। তবে ওর জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে কারণ তার বৈধ লাইসেন্স আছে।
সুনয়না চারপাশে চোখ বুলিয়ে রণের পাশে বসে বলল,
-‘তোমার আবেশ ভাইয়ার একটা সিক্রেট বলতে পারবে?’
-‘হুম, আবেশ ভাইয়ার পেটে প্রচুর কাতুকুতু। ‘
কথাটা বলে সে নিজেই খিলখিল করে হাসতে লাগল। এটা কারো সিক্রেট হতে পারে? একেই বলে বাচ্চা। সুনয়না মৃদু হেসে পুনরায় ওর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল। যা জানার নিজেই নাহয় জেনে নিবে। অযথা এনার্জি নষ্ট না করাই শ্রেয়। রণের সঙ্গে সময় কাটিয়ে সুনয়না নিচে গেল। ফুপি ও চাচী শাশুড়ি উনারা রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। সেও গেল হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে উনারা করতে দিলেন না বরং রুমে যাওয়ার তাগাদা দিলেন। সুনয়নাও বাধ্য হয়েই রুমে ফিরে গোসল সেরে বই নিয়ে বসল। সময়টা তো অতিবাহিত করতে হবে। আবেশের আর খোঁজ পায় নি সে। হয়তো ব্যস্ত খুব নয়তো ওর কথা স্মরণে নেই। অবান্তর ভাবনাকে সরিয়ে
সুনয়না বইতে মনোনিবেশ করল। শেষ বিকেলে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত শরীরে আবেশ বাসায় ফিরল। ড্রয়িংরুমে কাউকে না দেখে ওর রুমের দিকে পা বাড়াল।সুনয়না তখন ভাতঘুম দিচ্ছিল। আবেশ ওকে ঘুমাতে দেখে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেল। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে বারান্দায় মেলে বসতেই সুনয়না বলল,
-‘আপনার কী হারবালজনিত সমস্যা আছে? ‘
আবেশ ভ্র কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। এ আবার কেমন প্রশ্ন?
এমন কথা কেউ কাউকে বলতে পারে? আবেশও মুখচোরা তাই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘সন্দেহ হওয়ার কারণ?’
সুনয়না আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। শাড়ির কুঁচি দু’বার ঝাঁকি দিয়ে চিরুণী হাতে নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। ওর দৃষ্টি নিবন্ধ অদূরে থাকা নারিকেল গাছটার দিকে। একটা কাঠবিড়ালি দ্রুত গতিতে একবার উঠছে পরক্ষণেই নামছে।
এহেন কাজে হয়তো অবুজ প্রাণীটি ভীষণ মজা পাচ্ছে। এই দৃশ্যটা মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। আর আবেশ এখনো
ওর কথার মানে খুঁজছে। সত্যি বলতে, সেও কিছুটা সময় দিচ্ছে মেয়েটা যাতে সহজ হতে পারে। সম্পর্কটাও স্বাভাবিক হয়। দীর্ঘ আড়াই বছর চেনা হয়েও ওরা একে অপরের কাছে অচেনার মতোই। তাছাড়া, ঠিকমতো কথাও হয় নি তাদের। তাই হঠাৎ এমন কিছু পদক্ষেপ নিলে সুনয়না ভাবত, তাকে নয় তার শরীরকে ভালোবাসে। মূখ্য কথা, এই মেয়ের মুখে কিচ্ছু বাঁধে না, বলবেও সে। এসব ভেবেই নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। তারমানে এই না শারীরিক সমস্যায় ভুক্তভোগী সে। আবেশ পানি পান না করে গ্লাসটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। সুনয়না ততক্ষণে চুলে খোঁপা বেঁধে ফেলেছে। ওর দিকে তাকিয়ে আবেশ কিছু বলার আগে সুনয়না বলল,
-‘আপনার ফুপি আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি জবাব দিতে পারি নি। কি বলার উচিত বলে দিন পরবর্তীতে জিজ্ঞাসা করলে যাতে বলতে পারি।’
-‘ফুপি হঠাৎ একথা বললেন কেন?’
-‘নতুন বউদের মতো আমার স্কিণ চকচক করছে না তাই..!’
-‘তুমি কিছু বললে না?’
-‘বলেছি, তবে বিশ্বাস করেন নি। বরং উনি বললেন আপনার কোনো সমস্যা থাকলে জানাতে।এসব ব্যাপারে লজ্জা পেয়ে বসে থাকলে চলবে না।’
আবেশ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। তাই টিভি ছেড়ে
সুনয়নার কোলে মাথা রেখে হাত টেনে চুলের ভাঁজে রাখল। অর্থাৎ চুল টেনে দিতে হবে। সুনয়না কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ধীর গতিতে চুল টানতে লাগল। ভেজা চুলে পানিতে
জবজব করছে ভালোভাবে মুছেও নি। সুনয়না ওর শাড়ির
আঁচল টেনে মুছে থাকল। আবেশ চোখ করে আছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। টিভিতে তখন আমজাদ হোসেনের খবরটা
দেখাচ্ছে, ভিডিওসহ। সুনয়না খবরটা দেখে আবেশের দিকে তাকাল। আবেশ তখন চোখজোড়া বন্ধ করে বিরবির করে আওড়ালো,
অখণ্ডিত এক স্বপ্নমালা
সুখ রাজ্যেও পড়বে ভাটা।
রাঙা তরল শরীর বেয়ে
আত্মা কাঁপুক দর্শনেতে।
উপরোক্ত ছন্দ আওড়িয়ে আবেশ জিজ্ঞাসা করল,
-‘এর মানে কি?
-‘রক্ত।’
-‘কার?’
আবেশের প্রশ্নকে সুনিপুণভাবে এড়িয়ে সুনয়না হেসে বলল,
-‘আমি আপনাকে একটা উপহার দিতে চাই।’
-‘কী উপহার শুনি।’
-‘কবর।’
To be continue……..!!