বেটারহাফ পর্ব ১২+১৩

#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

|পর্ব ১২|

বৃষ্টির সন্দেহ এবার আরো গাঢ় হয়ে গেলো। তার মানে সাগরের মা তার আপন মা নন। তাহলে তার আপন মা কে?

বৃষ্টি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে সে সাগরকে জিজ্ঞেস করেই নিবে।এখন কাজ করা যাক। কিন্তু কাজে তার মন বসছে না,মাথায় প্রশ্ন টা ঘুরপাক খাচ্ছে।

★★
চারদিক দিয়ে বসন্তের হাওয়া বইছে। রাতের ঝড়বৃষ্টির পর খোলা আকাশ টা পরিষ্কার দেখাচ্ছে। আশেপাশের ছোট ছোট গাছপালা ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। ছাদের টবের শিউলি ফুলগুলো ঝরে নিচে পড়ে আছে। ছাদের কার্ণিশের পাশে দাড়িয়ে আছে সাগর আর মাহি। দুজন নিশ্চুপ। কারো মুখে কথা নেই। মাহির দৃষ্টি সেই ঝরে যাওয়া ফুলগুলোর দিকে। নিরবতা ভেঙে সাগর বলে উঠে,—“ছেলেটা কে?”

সাগরের এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় মাহি। সে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,—“কোন ছেলে?”

—“মাহি আমি সব দেখেছি রাতে। ”

মাহি এবার চুপ করে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে,—“ওহ, রাতের ওই ছেলেটার কথা বলছো?ও আমার ফ্রেন্ড। আমার বার্থডে ছিলো তো কাল তাই ও গিফ্ট নিয়ে এসেছিলো।”

—“ফ্রেন্ড? এত ঝড় বৃষ্টির রাতে কোন ফ্রেন্ড বাড়ীর নিচে এসে কান ধরে সরি বলে দাড়িয়ে থাকে?তাও আবার তুই নিচে নামা না পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলো।”

মাহি শুকনো ঢুক গিললো। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার। রাফিকে রাতে তাহলে সাগর ভাইয়া দেখে ফেলেছে? এখন নিশ্চই মা কে বলে দিবে। আর মা কে বললে মা বাবাকে, বাবা একবার এ খবর শুনলে আমাদের কারো আস্ত রাখবে না। যেদিন শুনবে সেদিনই টিকেট কেটে চলে আসবে। মাহির হাত পা কেঁপে উঠলো। সে সাগরের সামনে আচমকা হাত জোড় করে বলে,–“ভাইয়া,প্লিজ তুমি মা কে বইলো না। ”

সাগর মাহিকে ইশারায় হাত নামিয়ে শান্ত হতে বলে। মাহি চুপ করে যাই।

সাগর মাহির মুখোমুখি দাড়িয়ে সহজ গলায় বলায় বলে,—“ছেলেটা কে?”

—“রাফি, আমার বেচমেইট। ইটার্নি করার সময় ওর সাথে পরিচয়। প্রতিদিন একসাথে উঠাবসা করতাম। সবকিছুতে ও আমায় হেল্প করতো। সেদিন হুট করে ও আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি জবাব দেই নি, উল্টো ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। সে থেকেই ও আমার পিছন পড়েছে।”

—“ওহ, তার মানে তুই ওকে ভালোবাসিস না। আচ্ছা, সমস্যা নাই। আজকেই ওকে টাইট দিয়ে দিবো। ”

—“না,না ভাইয়া।ওকে কিছু বলার দরকার নেই।”

সাগর ভ্রু কুচকে মাহির আগাগোড়া স্ক্যান করে।

—“কেনো?”

—“না, মানে এমনি। আমি কাল ওকে বারণ করে দিয়েছিলাম, ও আর আমার পিছনে ঘুরবে না বলেছে।”

সাগর কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। এত ঠান্ডা, হাওয়া বাতাসের মধ্যেও মাহি ঘামছে। দুই হাতের আঙ্গুল কচলাচ্ছে। সাগর হাসলো মাহির অবস্থা দেখে।

—“তুই কি ওকে ভালোবাসিস?”

মাহি নিরব। কোনো জবাব দিচ্ছে না সে। সাগর আবারো একই প্রশ্ন করলো। মাহি মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে বললো হ্যা। বলেই ও কেঁদে দিলো।

—“হেই,কুল। একদম কাঁদবি না। আমি তো আছি। ”

মাহি ফিকরে কেঁদে বলে উঠে,
–“বাবা মানবে না। বাবা আমার বিয়ে উনার বন্ধুর ছেলের সাথে ঠিক করেছে। ”

—“আমি সব জানি। একদম চিন্তা করবি না আমি ফুফার সাথে কথা বলে দেখবো।”

—” না,কিছু বলবে না তুমি। বাবাকে এ কথা বললে ঘরে আগুন লেগে যাবে। বাবা মা কে ছেড়ে দিবে সাথে আমাকেও। প্লিজ তুমি এসব বলে কোনো অশান্তি করো না। ”

সাগর নিরব। সে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। মাহি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। সাগর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পৃথিবী এমন কেনো? সবাই কেনো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর-সংসার করতে পারে না? পরিবার কেনো সকল সম্পর্কের বাঁধা হয়ে দাড়ায়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ শহরের অর্ধেক বিচ্ছেদের কারণ পরিবার!

★★

আয়নার সামনে দাড়িয়ে তৈরি হচ্ছে সাগর। বৃষ্টিকে নিয়ে সিলেট শহর ঘুরবে সে। অথচ বৃষ্টির এখনও কোনো খবর নেই। সে রান্নাঘরে ব্যস্ত। সাগর গলার টাই পরছিলো তখনই হুড়মুড় করে প্রবেশ করে বৃষ্টি। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ছে। শাড়ি কোমড়ে গুঁজে রয়েছে যার ফলে কোমড়ের পাশের অনেক অংশ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির সেদিকে হুশ নেই,সে নিজে নিজে বকবক করছে দেরী হওয়া নিয়ে।
সাগর হাসলে তার দিকে তাকিয়ে। দরজাটা লাগিয়ে এগিয়ে যায় বৃষ্টির দিকে, বৃষ্টি হতভম্ভ হয়ে ওর দিকে তাকায়। কোমড়ে গুঁজে থাকা শাড়ির আঁচল টান মেরে বের করে দিয়ে বৃষ্টিকে বলে,—“মাহিন সহ বাড়ীতে আরো ছেলে মানুষ আছে।সবার সামনে এভাবে ঘুরাঘুরি করা টা বেমানান।”

বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে সরে যায়। কিছু বলতে নিচ্ছিলো সে,কিন্তু সাগরের কর্মকান্ডে সেটা মাথা থেকে চলে যায়। ব্যাগ থেকে কালো সেলোওয়ার স্যুাট বের করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।

সাগর দরজা টা মিলিয়ে মাহির রুমের দিকে পা বাড়ায়। সাগরদের পাশের রুম টা মাহির। দুবার দরজায় কড়াঘাত করার পরেও ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স আসলো না।

সাগর জোর গলায় ডাক দিলো,–“মাহি!”

সাগরের গলার আওয়াজ পেয়ে মাহি উঠে দরজা খুলে দেয়।

—“কিছু লাগবে ভাইয়া?”

–“হু,লাগবে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম রেডী হয়ে আয়। ”

—“কি?কিন্তু কেনো? আমি এখন কোথাও যাবো না।”

—“আমি তোর পারমিশন চাই নি, অর্ডার দিয়েছি। ”

মাহি নাকচ সুরে বলে,–“কিন্তু ভাইয়া?”

—“নো মোর ওয়ার্ডস। আমি ফুফিকে বলেছি।”

মাহি ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্তি নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো রেডী হওয়ার জন্য। সাগর হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে চলে গেলো রেহানা বেগমের রুমের দিকে।

রেহানা বেগম রুমে বসেছিলেন, সাগরকে দেখে তিনি এমন রিয়েক্ট করলেন যেনো এখন তিনি সাগরের কাছেই যেতে চাইছিলেন। সাগরকে টেনে রুমে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন তিনি।

সাগর জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,—“কিছু বলবে ফুফি?”

—“সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। ”

সাগর কপাল কুচকে বলে,–“কী বলে ফেলেছো?কাকে বলে ফেলেছো?”

রেহানা বেগম সাগরকে সকালের ঘটনার বিস্তারিত বললেন। সব শুনে তো সাগরের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়।

—“ফুফি,তুমি এটা বলতে কেনো গিয়েছো যে আমার থেকে যেনো জিজ্ঞেস করে!! কথা ঘুরিয়ে ফেললেই তো চলতো।”

—“কি জানি,আমার মাথায় কুলায় নি। আমি বলে ফেলেছি। এখন তুই কি বলবি?”

সাগর স্বাভাবিকভাবে বলে,–” সত্য চাপা থাকে না। একদিন না হয় একদিন ও জানতো এসব। আর কে বলেছে উনি আমার মা নয় উনিই আমার মা। ”

রেহানা বেগম সাগরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রেহানার ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী সাগরকে জন্ম দেওয়ার ছয়মাস পরেই মারা যান। সোহেল, শামিমের বয়স তখন দশ কী বারো! ছোট ছোট বাচ্চাদের শফিক সাহেব সামলাতে পারবে না বলে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করায় সাগরের দাদী। প্রথম বউ সোহানার চাচাতো বোন শাহিনুরকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। শাহিনুর বিয়ের জন্য রাজি ছিলো না, কিন্তু যখন ছোট্ট সাগরকে দেখেছিলেন তখন ই তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকেই তিনি সাগরকে নিয়ে ওভার পজেসিভ ছিলেন। ওর একটু সর্দি-কাশি উনার সহ্য হতো না। পাগলের মতো বিহেভ করতেন। সবসময় সাগরকে কোলে কোলে রেখেছিলেন। শাহিনুরের এমন কান্ডে রীতিমত সবাই অবাক ছিলেন। সৎ মা হওয়া স্বত্তেও ছেলের প্রতি এত টান সবাইকে অবাক করেছিলো। তাই সে ছোট থেকে সাগরের সবকিছুর উপর উনার অধিকার। তিনি দ্বিতীয়বার বাচ্চা নিতে চান নি। সাগরের আট বছর বয়সে শিফা তার গর্ভে চলে আসে, তিনি বাচ্চা টা রাখতে চান নি কিন্তু সাগরের দাদীর আর শফিক সাহেবের জেদের কাছে হার মেনে যান। শিফা জন্ম হওয়ার পরেও সাগরের প্রতি উনার একফোঁটা টান কমে নি। উল্টো সব বাচ্চা থেকে সাগরকে তিনি অধিক স্নেহ করতেন। যে বিষয়টা সবার চোখে পড়ত, কৌতুহল বশত সাগর তার ফুফিকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো তখন সে এসব জানতে পারে।

★★★

শিফার শশুড়বাড়ীর লোক চলে গিয়েছেন শিফাকে রেখে। শাহিনুর বেগম শিফাকে যেতে দেন নি, তিনি বলেছেন মেয়ে সুস্থ হলে পাঠিয়ে দিবে। তুষারের মা আর জোর করেন নি। কী দরকার? এখন নিলে শুধু শুধু কতগুলো টাকা ওর পেছনে খরচ করতে হবে। তাই তারা রেখেই চলে গিয়েছেন। রাত্রি এক মনে শিফার সেবা করছে। তা দেখে রেহানা বেগমের মুখটা উজ্জ্বল করে উঠলো। বড় বউকে তার মেয়ের জন্য এক গ্লাস পানির কথা বললেও সে নানা অযুহাত দেখিয়ে চলে যায়। আর মেঝো বউ সে তো তার স্বামী নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ীতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার আদৌ কোনো খবর তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে কী না কে জানে? এসব ভেবে শাহিনুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

.
রাত্রি ফাইল আর সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে শাশুড়ির সামনে। এ নিয়ে তিনবার সে শাহিনুরকে সব বুঝিয়ে বলেছে। শাহিনুর আড় চোখে কাগজ পত্র দেখছেন। পানের কৌটো টা টেবিলে রেখে রাত্রিকে প্রশ্ন করলেন, —” তা, চাকরী হইবো তো?”

রাত্রি কিছুটা আশা নিয়ে বলে,–“আম্মা, সঠিক জানি না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।”

শাহিনুর বেগম হেলাফেলা করে বললেন,–” কী দরকার এসব ইস্কুল,ফিস্কুল করার? এর থেকে ভালো তো আমাগো কম্পানি।”

রাত্রি মলিন হাসলো। শাশুড়িকে কয়েক টা কড়া কথা শুনাতে ইচ্ছা করলো তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললো না। কী লাভ হবে বলে?

সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে বলে,–” আসলে মা, আমি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে চাই।”
#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি

|পর্ব ১৩ |

সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে বলে,–” আসলে মা, আমি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে চাই।”

শাহিনুর বেগম আর কিছু বললেন না। সকাল সকাল রাত্রি বের হয়েছিলো বাড়ীর পাশের প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলের হেডমাস্টার শশুড়ের বন্ধু ছিলো। অনার্স পাশ সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে রাত্রি গিয়েছিলো স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার জন্য। হেডমাস্টারের সাথে আগে একবার যোগাযোগ হয়েছিলো, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যোগদান করার জন্য। সে সময় রাত্রি এত ভাবে নি, না করে দিয়েছিলো। শাশুড়ি দিবে না ভেবে। কিন্তু এবার সে ভাবলো এ ঘরে তার আর মূল্য নেই, যে কোনো সময় হয়তো তাকে চলে যেতে বলবে। তাই নিজের বাঁচার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করলো সে। অবাক করার ব্যাপার ছিলো শাহিনুর বেগম দ্বিমত করে নি। রাত্রির ধারনা, সেদিন শাশুড়িকে নিজের কষ্টের কথাগুলো বলায় উনার মন কিছুটা নরম হয়েছে তার জন্য।

তাছাড়া স্কুলে চাকরী করলে তার দুটো অভাব পূরন হবে। এক স্কুলের বাচ্চাগুলোকে নিজের বাচ্চার মতো পালবে,তাহলে হয়তো বাচ্চার অভাব টা কিছু কমবে তার জন্য। দ্বিতীয়ত তার সময়গুলোও কেটে যাবে। এ দুটো চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছ।

শাশুড়ি কে অনেক করুন সুরে বলে রাজি করিয়েছে সে। শাহিনুর বেগম ও ভাবলেন, ঘরে থাকলে তার জন্যই ঝামেলা যত কম থাকবে ততই ভালো তার সংসারের জন্য। সাগর বারবার রাত্রির কাছে আসতে চাইবে আর বৃষ্টি ও রাত্রিকে মানতে পারবে না, শুধু শুধু ঝামেলা।
কিন্তু তিনি সেটা রাত্রিকে বুঝতে দেয় নি। তিনি এমন ভান করলেন যেনো রাত্রির অনুরোধে তিনি রাজি হয়েছেন।

★★★

ঘন্টাখানেক থেকে পানির উপর হাঁটছে সাগর আর বৃষ্টি। সাগর প্যান্টের নিচ খানিকটা ফোল্ড করে রেখেছে, মাহি তাদের থেকে অনেকটা দূরে দূরে হাঁটছে। জাফলং জায়গা টা বেশ সুন্দর। আশেপাশে অনেক মানুষ। পানির ভেতরের পাথর গুলোর উপর শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। বৃষ্টি উরু হয়ে বসে সেই পাথরগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার কাছে এ জিনিস অনেক মজার লাগছে। ছোট ছোট সাদা পাথর গুলো কুড়িয়ে নিচ্ছিলো সে। জীবনে কখনো সে দেখে নি এসব,তাই স্মৃতি হিসেবে রাখতেই সে এসব নিচ্ছে। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছিলো কম বয়সী একটা ছেলে।

হাওয়াই মিঠাই বৃষ্টি খুব প্রিয়। ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা তাকে প্রথম কিনে দিয়েছিলে, সে থেকেই এ জিনিস টা তার খুব পছন্দের। সব কিছু ভুলে সে বাচ্চাদের মতো বায়না করে ফেলে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার জন্য। সাগর অবাক হয়ে যায় তার কান্ডে তবুও কিছু বলে না। সে ছেলেটাকে দাড় করিয়ে দু প্যাকেট কিনে দেয় বৃষ্টি আর মাহিকে।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তারা। মাহি এসেই রুমে ঠাস করে শুয়ে পড়ে, তার এখন ঘুম প্রয়োজন। কাল রাতে একদম ঘুম হয় নি। ম্যাথা টা ধরে আছে তার, গা গুলাচ্ছে। সে বেশ বুঝলো তার শরীর এখন আরাম চাচ্ছে।

বৃষ্টি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দেখে সাগর বাহিরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে। হঠাৎ তার সকালের কথা মনে পড়লো। সে হাতের টাওয়াল টেবিলের উপর রেখে এসে সাগরকে বলে,—” আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

সাগর বৃষ্টির দিকে তাকায়। তারপর আগের মতো বাহিরে দৃষ্টি ফেলে বলে,–” আমি জানি কী কথা।”

বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে,—“আপনি জানেন? কী বলেন তো?”

–“আমার মায়ের বিষয় জানতে চাইছো,তাই তো?”

—“ফুফি আপনাকে বলেছে?”

–“হু।”

বৃষ্টি পাশের চেয়ার টা টেনে সাগর সামনে নিয়ে এসে বসলো। সাগর ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়।

–“তাহলে আমাকে বলেন। আমি জানতে চাই।”

কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো সাগর। এরপর সে সব বলে বৃষ্টিকে। সব শুনে বৃষ্টি হা হয়ে রইলো। সাগর আর কথা বললো না, বিছানায় গিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।

বৃষ্টিও কিছুক্ষণ পর এসে শুয়ে পড়লো। অনেক্ষণ তাদের মধ্যে নিরবতা বিরাজ করলো। কয়েক মুহূর্ত পর বৃষ্টি এপাশ ফিরে সাগরকে বলে,—“আপনি রাত্রি আপুকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?”

সাগর নিশ্চুপ। বৃষ্টি আবারো প্রশ্ন করে,–” আপনাদের লাভ ম্যারেজ ছিলো, তাই না?”

সাগর এবারো জবাব দিলো না। বৃষ্টি আবারো বলে,–” আমাকে কী বলা যায়?”

সাগর ওদিকে শুয়েই হালকা আওয়াজ করে বলে,–” হু।”

সাগর বলে,–“আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলবো, মনোযোগ দিয়ে শুনবা।”

বৃষ্টি অধির আগ্রহ নিয়ে বসে যায় শুনার জন্য। তার ভেতর কেমন খচখচ করছে এসব জানার জন্য। সাগর আধ শোয়া হয়ে বসে পড়ে বিছানায়।

গভীর আবেগ নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,–“রাত্রিকে আমি প্রথম দেখি বিয়ের অনুষ্ঠানে।বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম আমি, সেখানেই দেখা। অবাক করার বিষয় কি ছিলো জানো? রাত্রি নিজেই পাত্রি ছিলো। খুব সাধারনভাবে রাত্রি সেজেছিলো তাই আমি বুঝতে পারি নি। আমার বন্ধু আর আমি আগেই চলে এসেছিলাম বিয়েতে। আমরা ডিরেক্ট কলেজ থেকে গিয়েছিলাম সেজন্য।বরযাত্রীর সাথে আমরা যাই নি। আমার বন্ধুর নাম শাকিল। তার কাছে শুনেছিলাম, মেয়েদের অবস্থা নাকি তেমন ভালো না। মেয়ের বাবা নাকি যে কেনো সময় মরে যেতে পারেন,তাই তিনি মরার আগে মেয়েকে সুখী দেখতে চান। শাকিলের বাবার নাকি মেয়ের বাবার পুরানো বন্ধু ছিলো সেজন্য শাকিলের বড় ভাইয়ের সাথে উনি বিয়ে টা ঠিক করেন। সেদিন বরযাত্রী তো এসেছিলো কিন্তু বর আসে নি। সে পালিয়ে গিয়েছিলো তার প্রেমিকার সাথে। শাকিলের ভাই তার বাবাকে খুব ভয় পেতো, তবুও দুবার মুখ ফুটে না করেছিলো কিন্তু তার বাবা মানে নি। তাই সে পালিয়ে যায়। বন্ধুর ভাই পালিয়ে যাওয়ায় বন্ধুর উপর দায়িত্ব এসে পড়ে বিয়ের। কিন্তু আমার বন্ধু এ বিয়ে করতে একদম নারাজ! তার কারন হলো আমাদের ব্যাচমেইট সূচির সাথে ওর তিন বছরের রিলেশন। আগেই বলি, রাত্রির বাবা হার্টের পেশেন্ট, ধাক্কা উনি সামলাতে পারবেন না তাই অগত্যা বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে বিয়ে টা আমাকেই করতে হয়েছিলো। রাত্রির বাবা, আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তার মেয়েকে জেনো দেখে রাখি, আমিও উনাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি উনার মেয়ের খেয়াল রাখবো। তখন অনেক কাহিনী হয়েছিলো। বিয়ের দিন মা মেনে নিয়েছিলো রাত্রিকে তবে মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরের দিন যখন ওর পরিবার সম্পর্কে শুনেন তখন থেকেই কেনো যেনো মা বিয়েটা মানতে নারাজ। কোনোভাবেই উনাকে রাজি করানো যাচ্ছিলো না। উনি মানবেন ই না, আমি জানি না কেনো!
অবশেষে রাত্রিকে মানার জন্য মা আমাকে কয়েকটা শর্ত দেন সেগুলো এমন, “এরপর থেকে যেনো আমি আমার মায়ের প্রতিটা কথা পালন করি। মা যদি উঠতে বলে আমি বিনা বাক্যে উঠে যাবো। ” উপায়ন্তর না পেয়ে আমি মার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হই, এরপরেই উনি রাত্রিকে মেনে নিয়েছিলেন।”

সাগরের কথা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে যায়। এরপর দম নিয়ে আবারো বলে উঠে,–“জানো,রাত্রি মেয়ে টা না একদম নিরব স্বভাবের। বুক ফাটবে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবে না। মা কোনো এক অদ্ভুত কারণেই তাকে সহ্য করতে পারতেন না। অনেক অন্যায়-অবিচার করতেন। যা আমার চোখে পড়তো।আমি সব দেখেও কিছু বলতে পারতাম না তার কারণ হলো আমি ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। তুমি হয়তো বলবে তাহলে চলে যাই নি কেনো রাত্রিকে নিয়ে কোথাও! তাহলে বলি, আমার ছোট বোনের খুব কম বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন। মা পারতেন অন্য সংসার করতেন, আমার মায়ের বয়স কিন্তু তখন খুব কম ছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র আমার কারণে তিনি এমন কিছুই করেন নি। সবাই বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি আমাকে ছেড়ে বিয়ে কখনোই করবেন না। অদ্ভুত কারণে উনার আমার প্রতি অধিক টান। আমি অনেক বড় হওয়ার পরেও মা আমাকে খাইয়ে দিতেন,আমার সাথে ঘুমাতেন। যে মা আমার জন্য সব করতেন সে মাকে আমি অন্য কয়েকদিনের পরিচয়ের মেয়ের জন্য ছেড়ে দিতাম? ”

বৃষ্টি নিরব। সাগর হালকা হেসে বললাম,–“বাদ দাও। মূল কথায় আসি, মাকে অনেক প্রশ্ন করতাম আমি, উনি রাত্রিকে কেনো পছন্দ করে না, তিনি সবসময় এ বিষয় এড়িয়ে যেতেন। কখনো এর জবাব দেন নি। এদিকে রাত্রির সবকিছু আমার ভালো লাগতে শুরু করে, ওর প্রতি আলাদা টান অনুভব করতাম। ও নিজেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। রাত্রিকে ভালো আমি বিয়ের পর বেসেছিলাম। আমি জানি না ওর প্রতি আমার ফিলিংস দায়িত্ব নাকি ভালোবাসা ? তবে ওর জন্য সব করতে পারি আমি। এই যে দ্বিতীয় বিয়ে সেটাও ওর জন্যই করেছি। তোমাকে বিয়ে করার আগের রাতে ও আমার হাত ধরে শক্ত কন্ঠে বলেছিলো,–” সাগর, আপনি আমার স্বামী, আমি আপনার স্ত্রী। আমি কখনো মা হতে পারবো না, আপনাকে বাবার সুখ দিতে পারবো না। আমার খুঁত তাই আমি বিষয়টা মেনে নিবো, আপনার ভালোবাসা আমি তাই আপনি মেনে নিবেন। কিন্তু আপনার মা মেনে নিবে না, উনি যেহেতু দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চাইছেন তাই আপনার করা উচিত। অন্তত আমাদের সুখের জন্য হলেও করা উচিত। ওই বাচ্চা কি শুধু আপনার অন্য স্ত্রীকে মা ডাকবে? ও কী আমাকে ডাকবে না? আপনার সন্তান মানেই আমার সন্তান। কেউ যখন আমার দিকে আঙ্গুল তুলবে তখন আমি বুক ফুলিয়ে বলবো এই দেখে আমার বাচ্চা। আমার কষ্ট লাগব করতে হলেও বিয়ে করতে হবে। তাই আমার অনুরোধ আপনি দ্বিতীয় বিয়ে তে রাজি হোন। ”

ও আরো অনেক কিছু বলেছিলো। আমি জানি রাত্রির মুখের কথা এসব হলেও মনের কথা এগুলো ছিলো না। ওর গলা ভীষণ কাঁপছিলো, আমাকে শক্ত করে ধরেছিলো। ও হয়তো প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। ও জানে বিয়ে টা আমাকে করতেই হতো,তাই ও নিজ থেকেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। আমার কিছু করার ছিলো না বাধ্য হয়েই তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।”

সাগর কথাগুলো বলেই চুপ করে রইলো। তার পুরানো সবকিছু মনে পড়ে গেলো। না চাইতেও চোখ দুটো ভিজে উঠছে তার। এই মুহূর্তে রাত্রির কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মেয়েটা খুব অভিমানী! সে কোনো ভুল করলেই অভিমান করে মুখ টা ফুলিয়ে রাখতো। বেশিরভাগ সময় তার অভিমান হলে সে কথা বলা বন্ধ করে দিতো। বেশ খানেক সময় কথা বলতো না যতক্ষণ না তার রাগ ভাঙ্গবে। অবশ্য তার রাগ কেউ ভাঙ্গাতো না, সে নিজেই নিজেকে বুঝ দিয়ে নিজের রাগ ভাঙ্গাতো।

চলবে!
রিচেক করি নি। জানি,আজকের পর্ব অনেক আ-গোছালো,অনুভূতিহীন।তাই,আগেই ক্ষমাপ্রার্থী।
চলবে?
রিচেক করি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আর বেশি পর্ব নেই, অল্প কয়েকটা পর্ব রয়েছে।কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here