#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
.
.
.
মুনিরার প্রিয় কয়েকজন মানুষের মাঝে সায়নীও একজন। আর দরজার ওপাশে রয়েছে সায়নী।
মুনিরার উদ্দেশ্যে মিষ্টি হাসি দিয়ে সায়নী বললো-
হু আসলাম।
.
সায়নী ভেতরে প্রবেশ করলেও মুনিরা তাকিয়ে থাকলো দরজার বাইরে।
পেছনে ফিরে মুনিরাকে দেখে হেসে উঠলো সায়নী। মুনিরা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
হাসছো কেনো আপু?
-এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই হয় আফরান কোথায়।
-না মানে দেখছি নাতো, একসাথেই তো আসার কথা।
-একসাথেই এসেছি বাবা! গাড়ি পাকিং করছে।
-ওহ তাই বলো!
-হু।
-খালা ভালো আছেন?
-হ্যাঁ ভালো আছেন। তবুও আজ রাত ওখানেই রাখছি। হাসি আছে সাথে।
-হুম ভালোই করেছো।
-আমার জন্য একটু চা করে দিবি? গোসলটা সেরে আসছি আমি।
-আচ্ছা।
.
সায়নী রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই আগমন ঘটলো আফরানের। তাকে দেখে মুনিরা বলে উঠলো –
চা খাবেন তো আপনি?
-কেনো নয়!
.
.
.
চুলে তোয়ালে প্যাচিয়ে সালোয়ার কামিজ পরে ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে আসলো সায়নী। তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আফরান বললো-
সে এমন একটা মেয়ে, যে পাহাড় কাটলেও মনেহয় তার মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়বেনা। অবশ্য অপ্সরী সর্বদা অপ্সরীই থাকে।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে সায়নী জিজ্ঞাসা করলো-
কার কথা বলছো?
.
সোফা ছেড়ে উঠে সায়নীর পাশে এসে মাথায় প্যাচানো তোয়ালে খুলতে খুলতে আফরান বললো-
তোমার।
.
মৃদু হাসলো সায়নী।
এদিকে আফরান তার ভেজা চুলের মাঝে মুখ ডুবোতে দেরী করলো না।
সায়নীর ভেজা চুলের স্পর্শ আফরানের কাছে বৃষ্টির ফোটার মতো মনেহয়। এই বৃষ্টিতে যেনো সারাদিন ভিজলেও শান্তি!
-শুরু হয়ে গেলো! মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখা না গেলেও বড্ড ক্লান্ত আমি। ছাড়ো এখন, চা খেয়ে আসি।
-উহু!
-কিসের উহু ফুহু! ছাড়ো তো আফরান!
.
কে শুনে কার কথা! সারাদিন দৌড় ঝাপের পর সায়নীকে কাছে পেয়ে যেনো সব ক্লান্তি ভুলে গিয়েছে আফরান। তাই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রয়েছে সে। এতোটা সুখ কেনো এই মেয়েটার মাঝে!
.
-আপু হলো তোমাদের?
.
মুনিরার ডাক কানে আসতেই আফরান ছেড়ে দিলো সায়নীকে। সায়নী হাসতে হাসতেই বললো-
চলো এখন।
-রাতে পুষিয়ে দেবে কিন্তু?
-সে দেখা যাবে।
.
.
.
ডাইনিং টেবিলে চা এবং নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে মুনিরা। সায়নী ও আফরান একইসাথে এসে বসলো চেয়ার টেনে। গরম গরম নুডলস দেখে সায়নী বলে উঠলো-
এটার দরকার ছিলো খুব বেশি!
.
সায়নী এক বাটি নুডলস নিয়ে খাওয়া শুরু করলে আফরানের উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
আপনি খাবেন না?
-আমার দু’বার ভাত খেতে হয়েছে। একবার এখানে আরেকবার হাসপাতাল সায়নীর সাথে। আচ্ছা তোমরা থাকো। চা টা রুমে নিয়ে গেলাম আমি। কিছু কাজ আছে।
.
আফরান চলে যেতেই সায়নী বললো-
তোর আজ অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা? একা সব সামলাতে হয়েছে।
-নিজের সংসারের কাজ করতে কিসের কষ্ট!
.
নিজের সংসার! কথাটি শুনে বুকে হালকা ব্যাথা অনুভব করলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে সায়নী বললো-
হুম সেটাও ঠিক। বাবা ভালো আছেন?
-হ্যাঁ আছেন।
.
.
খাওয়া শেষ করে সায়নী পা বাড়ালো আফজাল খানের রুমের দিকে।
আফজাল খানকে বিছানার উপরে বসে বই পড়তে দেখে সে বললো-
আমি এখন আসলে কি তোমার বই পড়ার ডিস্টার্ব হবে?
.
বই টা একপাশে রেখে তিনি জবাব দিলেন-
হবে বললেও তুই না এসে থাকবি?
.
ভেতরে প্রবেশ করে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে সায়নী বললো-
ঠিক বলেছো। তা তোমার কোনো অসুবিধে হয়নি তো? নিশ্চয় আমার হাতের চা অনেক মিস করেছো? বানিয়ে আনবো এখন?
-তোকে মিস করেছি কিন্তু চা মিস করিনি। মুনিরার হাতে বানানো চা একেবারেই তোর মতো। একসাথে থাকতে থাকতে তোর মতো অনেক কিছুই পারে সে।
.
আফজাল খানের কথা শুনে সায়নীর মুখের হাসি যেনো বিলীন হয়ে গেলো।
কথা না বাড়িয়ে সে বললো-
আমি এখন আসি। ক্লান্ত লাগছে।
-হুম আয়।
.
.
রুম থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো সায়নী।
এমন টাতো হবার কথা ছিলোনা! উন্নত চিকিৎসার জন্য আফরানের সাথে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলো সায়নী। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। মুনিরাকে দেয়া কথা সে রেখেছে। কিন্তু আফরান মুনিরার সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি। শুরুর দিকে মুনিরার দিকে আফরানকে ঠেলে দিতে চাইলেও ধীরেধীরে থেমে যায় সায়নী। কারণটা কি তা সে নিজেও জানেনা। তবে একটা কথা ঠিকই জানে। নিজের সব কিছু অন্য একটা মেয়েকে শেয়ার করা গেলেও স্বামী যায়না! আবার এটাও অমান্য করা যাবেনা মুনিরাও আফরানের স্ত্রী।
হয়তো বা কোনো একদিন আফরান ও তার মাঝে সবটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সেদিন ঠিকই সবটা মানতে হবে তার। এটাও ভুলে গেলে চলবেনা, মুনিরার বাবার জন্যই আফরান আজ তার হয়েছে। কেননা ছোট বেলায় পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচায় আফরান কে মুনিরার বাবা। আবার মুনিরার জন্য আজ সায়নী জীবিত রয়েছে। নাহলে সেদিনই হয়তো গাড়ির চাপায় প্রাণ হারাতো সে! তাছাড়া সমস্ত কিছুর উপরে বড় সত্য যেটা তা হলো, মুনিরাও আফরানের স্ত্রী!
মাথা থেকে সমস্ত খারাপ চিন্তা বের করে সায়নী বিড়বিড় করে বললো-
আমাকে শক্ত থাকতে হবে। মুনিরার অধিকার থেকে আমি ওকে বঞ্চিত করতে পারিনা!
.
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছে মুনিরা। তার পাশে এসে বসলো সায়নী।
মুনিরা বাংলা মুভি দেখতে অনেক পছন্দ করে। সায়নীর তা খুব একটা ভালো না লাগলেও মাঝেমাঝে মুনিরাকে সঙ্গ দিতে তার পাশে বসে।
বাংলা সিনেমা দেখলে অন্য কোথাও মনোযোগ দেয়না মুনিরা।
সায়নী যে তার পাশে এসে বসেছে খেয়ালই করেনি সে।
সায়নী হেসে বলে উঠলো-
আমিও এসেছি তোর সাথে ফিল্ম দেখার জন্য।
-ওহ আপু তুমি!
-ফিল্মের নাম কি রে?
-এক টাকার বউ।
-এক টাকার বউ বলতে? কাবিননামা এক টাকা?
.
সায়নীর প্রশ্ন শুনে মুনিরা তাকে সিনেমার কাহিনী শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে নাকি আগেও এই সিনেমা দেখেছে। এদিকে মনোযোগ সহকারে কাহিনী শুনে চলেছে সায়নী, মাঝেমধ্যে উচ্চ শব্দে হেসে উঠছে। মুনিরার বলার ধরণ খুব ভালো। ইমোশনাল সিনের কথা এমন ভাবে বলবে যে কেউ কাঁদতে বাধ্য হবে। আবার হাসির সিনের কথা এমনভাবে বলবে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে বাধ্য হবে মানুষ।
সায়নী খুব এনজয় করে এসব ব্যাপার গুলো।
.
.
ড্রয়িং রুম থেকে সায়নী ও মুনিরার কথা-হাসির শব্দ ভেসে আসছে আফজাল খানের কানে।
মৃদু হাসলেন তিনি। কেউ দেখলে তাদের সতীন বলেনা। বলে তারা একই মায়ের পেটের বোন! নাহলে দুইটা মেয়েই যেভাবে সংসারটা আগলে রেখেছে অন্য কোনো মেয়েদের পক্ষে এসব সম্ভব নয় এই যুগে।
সায়নী যখন আফরানের সাথে বিদেশ গমন করে, মুনিরা দিন রাত এক করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে সায়নীর সুস্থতা কামনা করে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সায়নীর মৃত্যুও কামনা করতে পারতো।
আল্লাহর অশেষ রহমতে সায়নী সুস্থ হয়ে আসে। মুনিরাকে দেয়া নিজের কথা রাখে সে। যেতে দেয়নি তাকে এই বাড়ি ছেড়ে।
সায়নীর সাথে ঘটা করে আবারো বিয়ে দেয়া হয় আফরানের। লোক সমাজ নানা কথা বললেও ধার ধারেননি আফজাল খান না ধার ধেরেছে সায়নী ও মুনিরা। তখন থেকেই এই দুই সতীন দুই বোনের মতো আছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি আফরানের মাঝে। অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো প্রথম বউ এর অনুমতি পাওয়ার পরেই দ্বিতীয় বউ কে সহজে আপন করে নিতো। তবে আফরান এই ১বছরেও মুনিরার সাথে সম্পর্ক টা আগাতে সক্ষম হয়নি৷
হয়তো বা কোনোদিন পারবে! এই আশায় আছেন তিনি সাথে মুনিরাও।
.
.
.
সারাদিন হাসপাতালে কাটানোর ফলে সায়নীর শরীরটাও ভালো লাগছে না। তাই আজ সে মুনিরার পাশে বেশিক্ষণ না বসে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
অফিসের কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি তে ব্যস্ত আফরান।
সায়নী তার পাশে বসে বললো-
কি করে সারাদিন এসব করতে ভালো লাগে তোমার? আজ সারাদিন হসপিটালে দিন চলে গিয়েছে। এখন অন্তত রেস্ট নাও।
.
সায়নীর কোলে মাথা রেখে আফরান বললো-
তুমি বললে ঘুমিয়েও যাবো।
-না এখন ঘুমোতে হবেনা। ভাত খেয়েই ঘুমোবে তুমি।
-আজ না একটুও খাবার খেতে ইচ্ছে করছেনা।
-মুনিরা এতো কষ্ট করে রান্না করেছে খাবেনা কেনো!
-তোমার হাতের রান্না বললে অল্প হলেও খেতাম।
-ঠিক আছে সরো, রান্না করে আসি।
-আরে আমি তো মজা নিলাম! মুনিরার রান্নাও খারাপ না।
-হু, তাহলে খেয়েই ঘুমোবে।
.
.
.
সেনোয়ারা বেগমকে সারা রুমে পায়চারী করতে দেখে নুরুল আলম বললেন-
আমি সায়নীর সাথে কথা বলবো। সে যেনো মুনিরাকে রাজী করায় আরেকটা বিয়ের ব্যাপারে।
-ওই মেয়েই তো যত নষ্টের মূল।
-এভাবে বলছো কেনো তুমি!
-কিভাবে বলবো? যে আশ্রয় দিছে তারই ক্ষতি করে দিছে এই মেয়ে। এভাবে গোপনে কোন ভালো মেয়ে বিয়ে করে বলো?
-আফজালের কিন্তু সায়নীকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার সম্মান রাখতে গিয়ে সে আফরানের সাথে জোরাজোরি করেছে মুনিরাকে বিয়ে করতে। তবে এর আগেই যদি জানতে পারতো সায়নী ও আফরান একে অপরকে ভালোবাসে তাহলে সে নিশ্চয় মেনে নিতো। দোষ টা আফরানের। সে তার বাবাকে চিনতে ভুল করেছে। আসলে আফরানের দোষও বলা যায় না। পরিস্থিতিটাই হয়তো খারাপ ছিলো।
-হু দোষ কারো না। দোষ আমার মেয়ের কপালের। তুমি ভাবছো? সায়নী যদি পোয়াতি হয় তবে মুনিরার কি হবে?
-তোমার মেয়েই যদি এসব না ভাবে আমার কি করার আছে বলো?
-তোমার আপাতত কিছু করতে হবেনা। আমাকে ভাবতে দাও কি করা যায়।
.
কথাটি বলেই আবারো পায়চারী করা শুরু করলেন সেনোয়ারা বেগম। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন নুরুল আলম।
.
.
.
রাত ১১টা…
খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে ঘুমোতে চলে গেলেও চোখে ঘুম নেই মুনিরার। ঘুমটাও যেনো তার সঙ্গী হতে নারাজ।
শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের চাঁদের আলো উপভোগ করলো সে।
হঠাৎ পানি খেতে ইচ্ছে হলে রুমে এসে দেখতে পেলো পানির জগটা খালি। জগ নিয়ে সে এগিয়ে গেলো ডাইনিং রুমের দিকে।
ডাইনিং রুমে আসতেই কানে বাজলো মুনিরার আফরানের গাওয়া গান-
এই আকাশ কে সাক্ষী রেখে
এই বাতাসকে সাক্ষী রেখে
তোমাকে বেসেছি ভালো
তুমি মোর নয়নের আলো।
.
এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আফরান যেনো তার জন্যই গানটি গেয়েছে। কিন্তু না, এই এক বছরেও এই সৌভার্গ্য লাভ করেনি মুনিরা।
ডাইনিং রুমটা আফরানের রুমের পাশের হওয়ায় ভেতরের শব্দ বাইরেও চলে এসেছে। আর এমনটা যে মুনিরা প্রথম শুনেছে তা নয়। কোনোদিন শুনে আফরান ও সায়নীর হাসি ঠাট্টার শব্দ, কোনোদিন একইসাথে গান করার, কোনোদিন আজকের মতো আফরানের গান।
তার জীবনে কি এমন দিন কখনো আসবেনা?
ভাবতেই বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো মুনিরার।
ভালোবেসে আফরান তাকে একটা গান না শোনালে যেনো মরেও শান্তি পাবেনা সে। যদিও এটা কখনো সম্ভব কিনা তার জানা নেই। কেননা আফরান শুধু সায়নীকেই ভালোবাসে। সবটা জেনেও সে পড়ে আছে এই বাড়িতে। আশা করছে একদিন তাকেও আফরান ভালোবাসবে, এভাবে গান শোনাবে। এসব কি খুব অন্যায় চাওয়া নাকি বেহায়াপনা? যদি তাই হয়ে থাকে, হোক না সে একটু বেহায়া নিজের বৈধ সম্পর্কের জন্য!
.
(চলবে)