ভালবেসে অবশেষে পর্ব -১০

#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ১০

সচরাচর মিলি শাড়ি পরে না, বিরক্ত লাগে। ঠিকমতো হাটতে পারে না, চলতে পারে না, কথায় কথায় উল্টে পরে। বিয়ের পর কয়েকটা দিন পরেছিলো যদিও, কিন্তু পরবর্তীতে রেনু বেগম নিজেই বলেছেন, মিলি যেটা পরে সাচ্ছন্দবোধ করে সেটাই যেনো পরে। এ নিয়ে তার কোনো বাঁধা নেই।
মিলি তারপর থেকে থ্রী পিস পরে চলাফেরা করে। শাড়ি না পরার আরও একটা কারণ আছে। সে শাড়ি ঠিকমতো পরতে পারে না। একেবারেই পারে না এমনটা না, সব ঠিক পারলেও কুঁচি গোছাতে পারে না। পেটের কাছে ফুলে থাকে। বিশ্রী দেখায়।
প্রতিবার নীরা এসে ঠিক করে দিতো। কিন্তু আজ নীরা ব্যস্ত, ডক্টরের কাছে গেছে। ঐখান থেকে একেবারে বিয়ে বাড়িতে যাবে।
সৌরভ সাথে গেছে। রেনু বেগমের রুমটা করিডরের শেষ মাথায়, ডাকলেও শুনবেন না। তাছাড়া তিনি গুরুজন। তাকে দিয়ে কুঁচি ঠিক করবে কিভাবে।
মিলি হতাশ হয়ে আবারও শাড়ি পরায় মনোযোগ দিলো।
সিয়াম ঘরে ঢুকলো,
“হয়েছে তোমার?”

মিলির দিকে লক্ষ্য করতেই আবার হুড়মুড় করে ঘর ছেড়ে বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
মিলি ঘরে ঢুকেছে দেড় ঘন্টার উপরে। সিয়ামের ধারণা এতক্ষণে দশবার শাড়ি পরা হয়ে যায়, আর এ মেয়েটা কিনা এখনও পরতেও পারলো না।
মিলি পিছু ডাকলো,
“শুনুন।”

সিয়াম পিছে ঘুরলো না। মিলির শাড়ি আধা খোলা। কুঁচি ফ্লোর ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। বুকে যেমন তেমন আচল টানা। নিজেরই কেমন অসস্তি হচ্ছে সিয়ামের। সাথে অস্থিরও লাগছে। সে গলায় হাত দিয়ে দেখলো ইতিমধ্যে ঘাম ছুটে গেছে।
বলল,
“কিছু বলবে?”

“আপনি শাড়ি পরাতে পারেন?”

“মানে?”

মিলি গলার স্বর উচু করলো। ভেবেছে আস্তে বলায় হয়তো সিয়াম শুনতে পায়নি।
“শাড়ি, শাড়ি! পরাতে পারেন?”

সিয়াম সোজা হয়ে দাড়ালো। তার কন্ঠে বিস্ময়।
“আমি কেনো শাড়ি পরাতে পারবো? আমি কী শাড়ি পরি?”

“কেনো? না পরলে বুঝি পরানো শিখতে নেই? শিখলে কী দোষ ছিলো? এখন আমাকে পরিয়ে দিতে পারতেন?”

মিলির অসহায় কন্ঠ শুনে সিয়াম নড়েচড়ে উঠলো।
“তুমি শাড়ি পরতে জানো না?”

“জানি, অল্প অল্প। ”

“তাহলে না হয় থাক, তোমার যা ভালো লাগে সেটাই পরো। শাড়ি পরার দরকার নেই।”

মিলি সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো,
“না না, আমি শাড়িই পরবো, আর এই শাড়িটাই পরবো।”

মিলির বলার ভঙ্গিমা দেখে সিয়াম মৃদু হাসলো।
মিলি হাসিটা লক্ষ্য করতেই বেশ লজ্জা পেলো। সিয়াম তার মনের কথা বুঝে ফেলল কী না কে জানে! আজকাল লোকটার প্রতি নতুন অনুভূতিগুলো লুকায়িত থাকতে চায় না। মিলি নিজেও প্রকাশ করতে চায় না। তবে প্রকাশ ঠিকই হয়, কথায়, কাজে…..


বিয়ে বাড়িতে আসার পর থেকে মিলিকে সিয়ামের কাজিনেরা ঘিরে ধরেছে। এর আগে মিলির সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়নি। বিয়েটা হয়েছে অকস্মাৎ, কাউকে জানানোর সুযোগ ছিল না। সামনাসামনি মিলিকে দেখার পর থেকে সবগুলো হৈচৈ লাগিয়ে ফেলেছে। যদিও সিয়ামের সামনে কারো মুখ থেকে টু শব্দটি বের হয় না। তাদের ভাই বোনের ভেতর সিয়াম সবচেয়ে রাগী। একটু এদিক ওদিক হলেই ধমকা ধমকি শুরু করে। সিয়ামের কাছে ঘেরা দুরে থাক, পারলে দশহাত দুরে থাকে সবাই।
মিলিকেও তারা একফাকে সিয়ামের পাশ থেকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলো।
নীরা ঘরের বিছানায় বসে ছিলো। সৌরভের কড়া আদেশ, রুম ছেড়ে বেরুনো যাবে না।
মিলি এসে তার পাশেই বসলো৷ অন্যসব কাজিনরা কেউ বিছানায় আবার কেউ চেয়ার টেনে আনলো।
এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা অথৈ। মিলি যখন প্রথম তাকে দেখলো নিজেরই চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছিলো। গায়ের রং তার কী উজ্জ্বল!
অথৈ মিলিকে প্রায়,জাপটে ধরে বলল,
“সিয়াম ভাইয়ের সাথে থাকতে তোমার ভয় করে না ভাবি? তোমরা কী একরুমে থাকো?”

মিলির উত্তর দেবার আগে নীরা বলল,
“সেকি কথা অথৈ, একরুমে থাকবে না কেনো? ওরা হাজবেন্ড ওয়াইফ না?”

অথৈ বলল,
“না মানে, কী রাগি! বিছানায় থাকতে দেয় তোমায়? মানে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় না?”

পাশে বসা অন্য সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। একজন তো বলেই ফেললো,
“তোর উপর রাগারাগি করেছে বলে তার বউয়ের উপরও রাগারাগি করবে নাকি? বউয়ের কাছে সব পুরুষের রাগই পানি হয়ে যায় জানিস না?”

অথৈ লজ্জা পেলো খানিকটা। আসলেই সে বিরাট বর সাহসের কাজ করে ফেলেছিলো। আরিয়া যাওয়ার পর খুব সাহস নিয়ে সিয়ামকে প্রপোজ করেছিল। নেহাৎ সিয়াম মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না, নয়ত যে পরিমাণ রেগে ছিল নিশ্চিত গালটা লাল নীল হয়ে যেত। অথৈ বোকা হেসে মিলির দিকে তাকালো। মিলিকেও ভীষন মিষ্টি দেখতে। কেমন ফোলা ফোলা গাল!
সে বলল,
“সিয়াম ভাই তোমায় ভালবাসে ভাবী? যত্ন করে?”

এবারও মিলির উত্তর নীরাই দিলো।
“ভালবাসে না আবার? বউয়ের চিন্তায় সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকে। সেদিন কী হলো জানো?
মিলির হাত থেকে গ্লাস পরে হাতে কাচ ফোটায় ও যখন আর্তনাদ করে উঠলো তখন ভাই পড়িমরি করে ছুটে এসেছিলো। পরনে কী ছিলো জানো? টাওয়াল আর টি শার্ট। বেচারা বউয়ের চিন্তায় প্যান্ট পরার কথা অবধি ভুলে গিয়েছিলো। ভাবতে পারো কত ভালবাসে!”

সবাই একথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খেলেও মিলি লজ্জা পেলো৷ সত্যিই লোকটার পাগলামিতে সেদিন কী অসস্তিতে পরেছিলো। সৌরভের খোঁটা ছিলো ফ্রী। লোকটাও তাও কোনোমতো ধমকি ধামকি দিয়ে পার পেয়ে নিজের রুমে ছুটেছিলো আর মিলি? নীরা আর সৌরভের কথায় আটকে লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি। তবু তো মা বাড়ি ছিলো না। নয়লে কী যে হতো! লজ্জার পরিমাণ দশ গুন বাড়তো

….

সিয়াম বসে বসে বোর হচ্ছে। মিলি ভেতরে সেই কখন। আর ফেরার নাম নেই৷ শাড়িটাতে কী মিষ্টি দেখাচ্ছিল তাকে। সিয়াম আধা মিনিট হা করে তাকিয়েই ছিলো। কাজের মেয়েটার হাসির আওয়াজে হুশ ফিরেছিলো তার।
মিলিকে শাড়িটাও কাজের মেয়েটাই পরিয়ে দিয়েছিলো। সিয়াম সিদ্ধান্ত নিলো সেও শাড়ি পরানো শিখবে, আগে কাজে লাগেনি এখন তো লাগবে।
অনেকক্ষণ পরেও মিলি না আসায় সে উঠে বাড়ির ভেতর ঢুকলো৷ মানুষে গিজগিজ করছে চারিপাশ। নীরা বা মা ও আশেপাশে নেই, থাকলে মিলির কথা জিজ্ঞেস করা যেত।
একটা রুম থেকে অনেকের হাসাহাসির আওয়াজ পেতেই সে বাইরে গিয়ে দাড়ালো। গলা খাকারি দিতেই ভিতরে শান্ত হয়ে গেলো। সিয়ামকে সবাই যমের মত ভয় পায়।
একে অন্যের হাত খামচে মুখ চাওয়া চায়ি শুরু করলো।
সিয়াম বলল,
“মিলি আছে?”

কথাটা বলেছে কী বলেনি, সবাই এমনভাবে তাকালো যেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। সিয়াম নিজেও অপ্রস্তুত বোধ করলো।
মিলি বসে ছিল এককোনায়। সিয়ামকে দেখে উঠে বসলো। বলল,
“আপনি এখানে? কোনো দরকার?”

সিয়াম আমতাআমতা করে বলল,
“হ্যাঁ, আসলে একটু দরকার ছিলো৷ বাইরে আসো।”

সিয়ামের এমন শান্ত রুপ দেখে প্রত্যেকের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। নীরা মিটমিটিয়ে হাসছে।
মিলি খানিকটা লজ্জা নিয়েই বাইরে বেরুলো।
বলল,
“কী দরকার বলুন, জরুরি কিছু?”

সিয়াম মাথা চুলকে বোকা হাসলো। সে মুলত মিথ্যে বলে ডেকে এনেছে। এখন কী বলে সামাল দেবে ভেবে পাচ্ছে না।
মিলি আবার তাড়া দিলো,
“কি হলো বলুন?”

“ঐখানে কী করছিলে?”

মিলি তীক্ষ্ণ নজরে একবার পরখ করলো।
“সত্যি করে বলুন তো, অদৌ কোনো দরকারে ডেকেছেন আমায়?”

সিয়াম মাথা নেড়ে না সূচক উচ্চারণ করলো।

“তবে?”

“তোমায় অনেকক্ষণ দেখছিলাম না, তাই আরকি!”

মিলি শব্দ করে হাসলো। লোকটারও তার মতো একই অসুখে ধরলো নাকি! তবে তো চিন্তার অবসান হলো বোধহয়।
,

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here