#ভালোবাসার_বহুরূপ
পর্ব:০২
লেখনীতে:ফারহানা আলম ফিমু
তানিমের অফিসের কলিগ কল দিয়ে বলল,
-ভাবি,কিছু মনে করবেন না।অনেক কষ্ট করে আপনার নম্বর কালেক্ট করেছি।আপনার সাথে কথা ছিলো।
-জ্বি ভাই,বলুন।
-আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন ভাবি।যা বলবো তার মধ্যে একটুও মিথ্যা নাই।
-আপনি বলুন।
আমার বুক ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে তখন।কি বলবে?কি এমন কথা!এদিকে ভাতের ফ্যান উপচে পড়ছে সেদিকেও আমার নজর নেই।আমার কেমন জানি ভয়ভয় লাগছিলো।
-ভাবি,আপনার সাথে তানিম সাহেবের সম্পর্ক কেমন?
-এটা কেমন প্রশ্ন?সে আমার হাজবেন্ড।তার সাথে তেমনই তো সম্পর্ক হবে।
-ভাবি,বলতে চাচ্ছি ইদানীং কেমন?
-আগে যেমন ছিলো তেমনই।
-কি বলেন!!চিন্তার বিষয় তো!
-প্লিজ,পেঁচাবেন না।কি বলবেন বলুন।
-তানিম সাহেব আবার বিয়ে করেছেন।৬মাস হচ্ছে বিয়ের।আর উনার দ্বিতীয় বউ প্রেগন্যান্ট ৩মাসের।
আমার হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো।ধুপ করে নিচে বসে পড়লাম।তারপর তড়াক করে উঠে বসলাম।মনে মনে তানিমের কলিগকে আচ্ছামতো ঝাড়লাম।ফোন উঠিয়ে নিলাম।ফোন অফ হয়ে গেছে।অন করে তানিমের কলিগকে কল দিলাম।
-ভাই,শান্তিতে আছি তা সহ্য হয়না?কেন আমাদের মাঝে ঝগড়া লাগাতে চাচ্ছেন?তানিমকে আমি চিনি।আপনার বলতে হবেনা কিছু।
ফোন কেটে দিলাম।মানে এসব কি!একজন সুখে সংসার করছে তা করতে দিবেনা কেউ!!কি অদ্ভুত!তানিম নাকি বিয়ে করেছে আর বউ নাকি প্রেগন্যান্টও।আজগুবি কথা বলে দিলেই হলো?
আজ তানিম আসুক।বলবো এসব কলিগকে এড়িয়ে চলতে।
সেদিন রাতে তানিম আসার সময় গাজরা নিয়ে এসেছিলো।পথে থাকতেই আমাকে বলেছে শাড়ি পরে হালকা কাজল দিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো তার জন্য অপেক্ষা করতে।
আমি সাথে আলতাও পরেছি।তানিমের জন্য তার ফেভারিট পুডিং বানিয়েছি।
তানিম এসে খোঁপায় গাজরা দিয়ে পেঁচিয়ে দিলো।কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-যাবে আমার সাথে বৃষ্টি বিলাস করতে?
এই মানুষ নাকি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে!অদ্ভুত না?কারো সুখের সংসারে আগুন লাগাতে পারলেই যেনো শান্তি পায় অনেকে।আমি আমাদের এই সুন্দর মুহুর্তে তানিমকে আর কিছু বলিনি।আর কি দরকার?আমি বিশ্বাসই করিনি।তাহলে কেন বলবো?ওর মন খারাপ হবে।
পরেরদিন তানিমের জন্মদিন ছিলো। তানিমকে সারপ্রাইজ দিবো তাই সুপার মার্কেটে গেছি কিছু জিনিস কিনতে।আমার কেনাকাটা শেষে বের হওয়ার সময় রাস্তায় তানিমের মতো দেখতে একটা ছেলেকে বাইকে দেখলাম।সাথে একটা মেয়েও ছিলো।আমার আবার ভয়ভয় লাগতে লাগলো।আমি কল দিলাম তানিমকে।তানিমের ধরতে একটু সময় লাগলো।এদিকে সেই বাইকটাও চলে গেলো।
তানিম কল ধরেই বলল,
-সামু, তোমাকে মিটিং শেষে কল দিচ্ছি।পাঁচ মিনিট,ওকে?
-আচ্ছা।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম।যদি রাস্তায় থাকতো তাহলে তো গাড়ির আওয়াজ শুনতাম।আমার নিজের উপর রাগ হলো। কিভাবে আমি তানিমকে সন্দেহ করলাম!
সেদিন বিকলে তানিমকে বললাম তাড়াতাড়ি যেনো চলে আসে।কিন্তু তানিম আসতে পারলো না।ছেলেটা কেঁদেই দিলো সেদিন।
-সামু,এই প্রথমবার তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছো।আর আমি তাও পারলাম না।আজ সব কাজ আমার উপর।সামু, আমি কি জবাব দিবো তোমাকে?
-আরে,করছো কি?সমস্যা নেই তো।কাজ শেষ করেই আসো।অন্যদিন তাড়াতাড়ি আসবা।সমস্যা নাই।
ছেলেটা বড্ড পাগল।সেদিন সে আসলো ১০ টায়।আমি কেক সাজিয়ে বসে ছিলাম।একসাথে সেলিব্রেট করেছি দুজনে।সে এত্ত খুশি হয়েছিলো যে তার হাসিতেই বুঝা যাচ্ছিলো।
এই ছেলের পরেরদিন দুপুরেই চলে আসে ছুটি নিয়ে।দুপুরে বাসায় খায়।বিকেলে আমাকে নিয়ে বের হয়।দুজন ঘুরে বেড়াই অনেক।অনেক রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর ননদতে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে অবাক হই।বাবা বলেন,
-যাও মা,তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও।তানিমের সাথে একটু কথা বলবো।
আমিও বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেলাম রুমে।মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম।দেরি হয়েছে বাসায় ফিরতে তাই আজ মনে হয় বাবা তানিমকে বকা দিবেন।
আমি ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে রুম থেকে বের হতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই।বাবার কথা কানে আসছে আমার।
-তুই কি করে এটা করলি?সায়মার মতো মেয়েকে ধোঁকা দিচ্ছিস!মেয়েটা যদি শুনে তাহলে কি হবে ভেবেছিস??
আমি দৌড়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম।আমাকে দেখে বাবা কথা বন্ধ করে দেয়।
-বাবা,কি বলছিলেন?কি করেছে আপনার ছেলে?ধোঁকা দিচ্ছে মানে?
-না না।বলছিলাম,তোমার ক্ষতি হতে পারে রাত বিরাতে ঘুরলে।তাই বলছিলাম,তোমার ক্ষতি চায় নাকি!যাও ঘুমাও।
আমার মনে হচ্ছিলো বাবা কিছু লুকাচ্ছে।তানফি ঘৃণার চোখে তানিমের দিকে তাকিয়ে ছিলো।আর মায়ের চোখে ছিলো রাগ।আমার মাথা ঘুরে উঠলো অজানা আশংকায়।
তানিম আমাকে ধরে ফেলল।ধরে রুমে নিয়ে গেলো।সাথে তানফি এলো।আমি তানিমকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি করেছো তুমি?বলো আমাকে।
তানিম চুপ করে থাকে।
-তানফি,বলো তোমার ভাই কি করেছে?কি লুকাচ্ছো তোমরা?বলো প্লিজ!!
-সামু,চুপ প্লিজ।তোমার শরীর খারাপ করবে তো।
-করুক শরীর খারাপ।তুমি বলো,কি করেছো তুমি??
আমি তানিমের কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগলাম।তানিম নিচের দিকে চোখ নামিয়ে বলল,
-সামু,ঘুমাও।
-ঘুম!!ঘুমাতে বলছো তুমি!ঘুম আসবে আমার?
-ভাবি,কিচ্ছু হয়নি।শুধু শুধু রিয়েক্ট করছো তুমি।ভাইয়া কি করবে?তুমি ভাইয়ারকে চিনো না?
-না চিনিনা।তোমার এই ভাইয়াকে আমি চিনিনা।দেখছো না চোরের মতো মুখ লুকাচ্ছে?
আমি কাঁদতে লাগলাম।আমি জানিনা আমার সন্দেহই ঠিক কিনা।কিন্তু আমার মন খারাপ দিকই ইঙ্গিত করছিলো।
আবার তানিমের কলার ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
-আমাকে বলো,তুমি বিয়ে করেছো?বলো!!
-হুম…
আমি চুপ হয়ে গেলাম।তানফি দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তানিমের দিকে।তানিম চোখ নামিয়ে রাখলো।তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।এগুলো কি তার অনুতপ্তের পানি নাকি নাটক আমি জানিনা।আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো তখন।আমার মাথা কাজ করছিলো না।
কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।চুপ করে শুয়ে পড়লাম।মানুষ চিন্তায় নাকি ঘুমাতে পারেনা।আমার তো দিব্যি ঘুম এসে গেছে।আমি ঘুমিয়ে গেছি।আমি চাচ্ছিলাম এসব যেনো স্বপ্ন হয়।ঘুম থেকে জেগেই যেনো দেখি যে সব স্বপ্ন ছিলো।
পরেরদিন সকালে উঠে দেখে তানিম রাতের মতোই আমার পাশে বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে।আমি হেসে উঠলাম।
-কি দেখছো?সেই মেয়ে বেশি সুন্দর নাকি আমি তা দেখছো?
তানিম হকচকিয়ে উঠলো।আমি তার এসব এড়িয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেলাম।স্বাভাবিকভাবেই নাস্তা বানিয়ে সবাইকে দিলাম।অন্যদিনের মতো কোনো আনন্দ নেই।তানিমকে কেউ খেতে ডাকেনি।আমি রুমে গিয়ে দেখি সেভাবেই বসে আছে সে।তার পাশে গিয়ে তার হাত ধরলাম।
-ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।
সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলো।আমার কান্না আসছেনা।আমার কষ্টও হচ্ছেনা।কেমন জানি একটা অনুভূতি।
আমি মুচকি হেসে তাকে সরিয়ে দিলাম।তাকে বললাম,
-চলো,সব নতুন করে শুরু করি।
-তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে তো?
-আমি তো তোমাকে ক্ষমা করেই দিয়েছি।ভুল হয়ে গেছে তোমার।তুমি অনুতপ্ত।এটাই তো অনেক।
সেদিন সে অফিসে যায়নি।তার অফিসের কলিগের কথাই ঠিক।তবে ওই মেয়ে প্রেগন্যান্ট তা ঠিক না।তানিম ২মাসের মধ্যেই সেই মেয়েকে ডিভোর্স দিলো।আমি একটাবার জিজ্ঞেস করিনি কিভাবে কি হলো বা মেয়েটা কে!কেমন!কি নাম!
যদি জানি সব,তাহলে হয়তো সেই মেয়ের নাম উঠিয়ে তানিমকে কষ্ট দিয়ে দিতে পারি।তাই আমার শ্বশুর আর তানিম মিলেই সব সমাধান করেছে।
তারপরের বছর আমাদের কন্যা ইলিনা এলো।তানিম বাচ্চাদের মতো হাসছিলো সেদিন।আমার সব কাজ সে করতো।পুরো প্রেগনেন্সির টাইমে সে আমার খেয়াল রেখেছে। বাবু হওয়ার পর বাবুর যত কাজ সব সে করেছে।আমার কষ্ট হতে দেয়নি।
আমাদের বাবু তখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছে।আর তানিমও পরিবর্তন হতে লাগলো।বাবুর দিকে বেশি খেয়াল রাখায় আমি তার পরিবর্তনটা ধরতে পারলাম না।
যখন ধরতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।সেদিন ছিলো শুক্রবার।ইলিনার আগেররাতে খুব জ্বর এসেছিলো।রাতে খুব কান্না করেছিলো,ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।তানিমও ঘুমাতে পারেনি।সে সকালের দিকে একটু ঘুমিয়েছে।তারপর উঠেই ফোনে কথা বলছে বারান্দায় গিয়ে।এদিকে ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো।আর তো কোনো তাড়াহুড়া নেই নাস্তা বানানোর।তাই মাও বলল ঘুমিয়ে নিতে।ইলিনা তখন ঘুমিয়েছে মাত্র।আমি তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।কিন্তু একটু পরই মেয়েটা কেঁদে উঠলো।আমি মেয়েটাকে নিয়ে তানিমের কাছে বারান্দায় গিয়ে বললাম,
-ওকে একটু রাখো না,ঘুমাবো একটু।
তানিম ফোনে কথা বলছিলো।তখন সে যা করলো তা দেখে আমি এতোটা অবাক হয়েছি যে একটু হলেই মেয়েটা কোল থেকে পড়ে যাচ্ছিলো….(চলবে)
(