ভালোবাসার বহুরূপ পর্ব ৩

#ভালোবাসার_বহুরূপ
পর্ব:০৩
লেখনীতে:Farhana Alam Fimu

তানিম ফোনে কথা বলছিলো।তখন সে যা করলো তা দেখে একটু হলেই মেয়েটা কোল থেকে পড়ে যাচ্ছিলো।
প্রচন্ড ধমক দিয়ে বলল,
-সমস্যা কি তোমার?দেখছো তো ফোনে কথা বলছি তুমি রাখো তোমার মেয়েকে।অসহ্য হয়ে গেছি আমি!!
আমি অবাক হয়ে গেলাম।তানিম আজ পর্যন্ত একটা ধমক তো দূরের কথক,জোরে কথাও বলেনি আমার সাথে।তার চিৎকারে তানফি আর মা দৌড়ে আসে।তানফি বলল,
-কি হয়েছে ভাবি?
-ইলিনাকে কোলে নিতে বললাম,আমি একটু ঘুমাবো তাই।
-অদ্ভুত তো!তুমি ইলিনাকে তো আমার কাছেও রাখতে পারো।ভাইয়াকে বিরক্ত করছো কেন?
আমি অবাক হয়ে তানফির দিকে তাকালাম।মা এসে আমার কাছ থেকে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলো।তানফির চোখে মুখে বিরক্তি।আমি বুঝতে পারলাম না,কি করেছি আমি!বাচ্চাকে তার বাবার কাছে রাখতে গিয়েছি।এমন কি খারাপ কাজ করলাম!
আর ঘুম এলো না।প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর মন খারাপ নিয়ে রান্না বান্না করলাম।সারাদিনে একটা বারও তানিম কথা বলল না।আমিও চুপ করে ছিলাম।দুপুরে খেতে বসে খাবারে লবণ কম হয়েছে এই অজুহাতে সে আবার রাগ ঝাড়লো।
আমি উত্তর দিলাম,
-লবণ তো ঠিকই আছে…
তানফি উঠে বলল,
-ভাবি,ভাইয়া মিথ্যে বলছে?নিজের দোষটা স্বীকার করলেই তো হয়।
-তানফি,ডাল মা রান্না করেছে।
এইবার ভাইবোন দুজনই চুপ করে খেতে লাগলো।মা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন।কারণ আমি মিথ্যে বলেছি।সব আমিই রান্না করেছি।আমি শুধু দেখতে চেয়েছি তাদের কি রিয়েকশন হয়।আমি মায়ের দিকে তাকালাম।মার চোখে কষ্টের ছায়া দেখলাম।আর সেই কষ্টটা যে আমার জন্য তা বুঝতে আমার কোন সমস্যা হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর আসার পর আমাকে উনার রুমে ডাকলেন।ডেকে বললেন,
-তানিমের সমস্যা কি?সে নাকি আজ তোমার সাথে অশান্তি করেছে?
-বাবা,আমি জানিনা তার কি সমস্যা।কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তার সমস্যার কথা তানফি জানে।এজন্য তাকে সে ডিফেন্স দিয়ে যাচ্ছে।
-আমি তা জানি।
-কি জানেন বাবা!!
-আচ্ছা, আগে বলো তো তুমি জানো সেই মেয়েটা কে ছিলো?
-না বাবা।আমি আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেসও করিনি কখনো।
-ভুল করেছো।
-কিন্তু কেন বাবা!আমি তো তার এসব ভুলতে চেয়েছি।যদি না জানি কিভাবে কি হয়েছে তাহলে আর মনেও আসেনা এসব।তাই কখনোই জিজ্ঞেস করিনি।
-মেয়েটা তানফির বেস্ট ফ্রেন্ডের বড় বোন ছিলো।আর প্রথমে তানফি জানতো না।যার কারণে রেগে গিয়েছিলো।আমরা তানফির থেকেই শুনেছিলাম এসব।নয়তো কোনোদিনই জানতাম না।
-বাবা!!তানফির বেস্ট ফ্রেন্ডের বোন!!রুমার বোন???
-হ্যাঁ।
-কিন্তু ও এরকম কেন করলো?আর রুমার তো আমার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো।
-আসলে ভুলটা আমাদের।রুমা আমাদের বাড়িতে আসতো প্রায়।রাতেও থাকতো।মেয়েটা উচ্ছৃঙ্খল।আর নয়তো সব ঠিকাছে।পড়ালেখায় ভালো।দেখতেও খারাপ না।সেই সুবাদেই রুমার বোন রুহি আসতো এখানে।রুহি অহংকারী ছিলো খুব।রুমাকে নিতে আসতো সে।আমাদের দিকে ফিরেও তাকাতো না।কথা বলা তো দূর!একদিন তানিম খুব রাগারাগি করছিলো।জানতে চাইলে বলল,রুহি নাকি তানিমকে প্রপোজ করেছে।তানিম তানফিকে বলে দিয়েছে রুমা আর রুহি যেনো আর এই বাড়িতে না আসে।রুমা আর রুহি আসতো না।তবে মাঝে মাঝে তানিমকে কল দিতো রুহি।রুহি তানিমের সাথেই পড়তো তবে অন্য ভার্সিটিতে। একটা মেয়ের প্রতি একটা ছেলের দূর্বল হতে প্রতিদিন একটু কথা বলা ই অনেক কিছু।তানিমও ফেঁসে গেলো।তখন তানিম অনার্সে মাত্র।চাকরি নেই।পড়ালেখা নিয়েই পড়ে ছিলো।
এর মাঝে একদিন এসে বলল সে রুহি কে বিয়ে করতে চায়।আমি তানিমকে শুধু বলেছি,যা করবি ভেবেচিন্তে করবি।সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ যদি চাস তাহলে আমি বলবো যে এর থেকে দূরে থাকিস।
তারপর তানিম আর রুহির কথা তুলেনি।তানিম যখন চাকরি পায় তখন আমরা ওর বিয়ের কথা তুলি।তানিম বলল,আমরা যাকে পছন্দ করি তাকেই সে বিয়ে করবে। তার কিছুদিন পর সে তোমার কথা তুলে। তোমাকে নাকি কলেজে যেতে দেখে সে।তার ভালো লাগে।আমরা সেদিনই তোমার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে পরেরদিন তোমাদের বাড়িতে যাই।পরের ঘটনা তো তুমি জানো ই।
– কিন্তু বাবা,তানিমই তো আমাকে পছন্দ করেছে।তাহলে সে আবার রুহির কাছে কেন গেলো?
-মোহ!তানিম যেখানে চাকরি করে সেখানেই রুহি চাকরি নেয়।তাদের মধ্যে আবার সখ্যতা গড়ে উঠে।আমার মনে হয় এখন আবার তাদের মধ্যে সম্পর্ক চলছে।
আমার গলায় যেনো আস্ত একটা আপেল আটকে আছে।চোখের পানি অনবরত বের হচ্ছিলো।বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-তুমি ওর লিগ্যাল ওয়াইফ।তুমি চাইলে ওকে ফেরাতে পারো।
-কিন্তু কিভাবে বাবা?
বাবা কিছু না বলে তানফিকে ডাকলেন।তানফি আসার পর বললেন,
-তানফি,তুই মনে হয় সব জানিস।রুহি আর তানিমের সম্পর্ক আবার শুরু হযেছে,তাইনা?
-না বাবা।রুহি আপুর তো আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি আর বাবা দুজনেই চমকে উঠলাম।তাহলে তানিমের এরকম আচরণের কারণ কি!!
-তাহলে কি চলছে ওর মনে?
বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
-আমি কিভাবে জানি?
-তুই সব জানিস।তুই বলবি নাকি আমি বলাবো??
-আরে অদ্ভুত তো!আমি জানিনা।
বাবা তানফিকে একটা থাপ্পড় দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-বল এখনই। তুই সব জানিস
তানফি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-রুমার সাথে সম্পর্ক চলে ভাইয়ার।আর এটা ২মাস ধরেই চলছে।রুমা আমাকে গত সপ্তাহে বলেছে।আমি না করেছি।কিন্তু সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে বিভিন্নভাবে।যদি আমি সাহায্য না করি তাহলে আমার ক্ষতি করবে।
-কি ক্ষতি করবে?ব্ল্যাকমেইল কিভাবে করছে?
তানফি চুপ করে থাকে।
-বলবি তুই?কিভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে??
-আমার কিছু ছবি আছে ওর কাছে। ভাইরাল করে দিবে বলছে।
বাবা চুপ হয়ে গেলেন।এদিকে আমার মাথায় ঢুকছে না,একটা মেয়ের কাছে অন্য মেয়ের এমন ছবি কেন থাকবে যা ভাইরাল করা যায়!
রুমার সাথে কথা বলার জন্য তার ফোন নম্বর নেয় বাবা।কিন্তু রুমার সাথে কথা বলার আগেই অঘটন ঘটে যায়।
পরেরদিন শনিবার,সন্ধ্যায় তানিম বাসায় আসে।তানিম একা না।সাথে রুমাও ছিলো।আর দুজনে বর বউ সাজে ছিলো।দরজা খুলেছিলাম আমি।খুলেই চিৎকার দিয়ে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাই।যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি হাসপাতালে।আমার আশেপাশে কেউ ছিলোনা।এটা দেখে খুব অবাক হলাম।বাবা আর মা তো থাকার কথা।গেলো কোথায় সবাই?
উঠে বসার শক্তি পাচ্ছিলাম না।কোনোরকমে উঠে বসলাম।তখনই আমার মা রুমে আসে ইলিনাকে কোলে নিয়ে।এসে কান্না জুড়ে দেয়।
-এতোদিন ধরে এসব হচ্ছে আর তুই আমাকে কিছু জানাস নি।কেন?আরও আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিলো।তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।
-মা,এরকম তো ভাবিইনি।ভেবেছিলাম তানিম ঠিক হয়ে যাবে।আবার যে এরকম কিছু করবে তা কখনোই ভাবিনি।ইলিনার দাদা দাদু কোথায় মা?
-থাক,পরে খোঁজ নিস।
-মানে?ওরা আসেনি?আমাকে হাসপাতাল কে এনেছে?
-তোর শ্বশুরই এনেছে।
-তো কোথায় ওরা?
-আছে।এখন ইলিনাকে খাইয়ে দে।মেয়েটা ক্ষুধায় কান্না করতে করতে ঘুমিযে গেছে।

মা কি যেনো লুকাচ্ছে।বুঝতে পারছিলাম না আমি।ইলিনাকে খাইয়ে মাত্র মার কোলে দিলাম এমন সময় তানফি ঝড়ের বেগে রুমে এসে বলল,
-খেয়েছো তো আমার বাবাকে শান্তি হয়েছে??আমার বাবা তোমার চিন্তাতেই শেষ হয়ে গেছে।কালনাগিনী তুমি।খবরদার,আমাদের বাড়িতে আসবেনা তুমি।
-মানে কি?তানফি,কি বলছো!!
তানফি যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো।মাকে জিজ্ঞেস করলাম,কি হয়েছে?
মার উত্তর শুনে আমার পুরো পৃথিবী যেনো ঘুরে উঠলো।
আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর বাবা, মা আর তানফি দৌড়ে আসে।এসে এসব দেখে বাবা তানিমকে বলে, এখনই রুমাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে।এদিকে মা আর তানফি আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।তানিম একটুও না দাঁড়িয়ে সোজা রুমাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।বাবা আমার বাবা মা কে কল দিয়ে আসতে বলে।অনেক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা করেও আমার হুঁশ ফেরাতে না পেরে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।হাসপাতালে যাওয়ার পথে হঠাৎ আমার শ্বশুরের নিঃশ্বাস বেড়ে যায়।হাসপাতালে আসার আগেই উনি মারা যান।তাও এখানে এনে পরীক্ষা করা হয়।ডাক্তার বলে,হার্ট এটাক করে মারা যান বাবা।
আমার পৃথিবীটা থমকে গেলো যেনো।আমার এখনো মনে আছে,বিয়ের দিন আমি তানিমদের বাসায় ঢুকার সাথে সাথে বাবা বলেছিলেন,আমাদের লক্ষ্মী এসেছে।
সেদিন বাবা বলেছিলেন,
-মা,তোমার যখন যা দরকার সব আমাকে বলতে পারবা।তোমার নিজের বাবাকে ছেড়ে এসেছো কিন্তু মনে রাখবা আমিও তোমার বাবা।তোমার বাবাকে যেমন কষ্ট হলে শেয়ার করতে তেমন আমার সাথেও করবা।

আমি রান্না পারতাম না।আমার শ্বশুর আমাকে শিখিয়েছেন।সব দেখিযে দিয়ে বলতেন,তোমার শ্বাশুড়িকে আবার বোলোনা যেনো!সে একটু রাগী তো!
আমার মাথার উপর ছাদটাই চলে গেলো সেদিন।বাবা ছিলেন তানিমদের বাসায় একমাত্র ভরসা আমার জন্য।আমি কার কাছে মাথা গুঁজবো এখন!!

আমাকে আমার শ্বশুরের লাশ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হয়নি।অথচ আমার দোষটা কোথায়?আমি বেহুঁশ হয়ে গেছি এটাই?কোন মেয়ে তার বরের পাশে অন্য একটা মেয়েকে বধু বেশে দেখে সহ্য করবে?তানিমকে তো ঠিকই বাবার লাশ দেখতে দেয়া হয়েছে।বাবার কবরে মাটি দিতে দিয়েছে।আমার দোষটা কোথা আমি বুঝতে পারলাম না।

আমার মা বাবা আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।আমাকে বললেন,আমাকে নিয়ে নিবেন।কোনো দরকার নেই ওই বাড়িতে যাওয়ার।যেখানে আমার দোষ না থাকা সত্ত্বেও দোষী বানানো হয়েছে সেখানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।আমার শ্বশুর থাকলে না হয় ভিন্ন থাকতো অবস্থা।

সেই ঘটনার পর তিন বছর কেটে গেছে। ডিভোর্স হবে হবে করেও হয়নি।আমিও গা দিইনি।কি হবে ওই কাগজে সই করে?করলেও যা না করলেও তাই। তানিম খোঁজ নিতে আসেনি একটিবারও।শুনেছি তানফির বিয়ে হয়েছে।আমাকে বলেও নি।আমি মাকে কল দিয়েছিলাম।কিন্তু মা কেটে দেয়।
মেয়েরা এতো বেহায়া কেন হয়?আমাকে তারা পাত্তাই দিচ্ছেনা জেনেও আমার মন সারাদিন তাদের কাছেই পড়ে থাকতো।মার সময়ে সময়ে ঔষধের কথা মাথায় আসতো আর বেদিশা হয়ে যেতাম,মা ঔষধ খাচ্ছে কিনা তা ভেবে।তানফির পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলে মনের মধ্যে ভয় এসে যেতো।ওর এসাইনমেন্ট আমিই রেডি করতাম।পরীক্ষার আগের রাতে ও নার্ভাস হয়ে যেতো।জ্বর এসে যেতো।বেচারি এখন কি করছে?ওর পাশে তো আমিই থাকতাম।এখন কি রুমা থাকে?

একদিন বিকেলে ছাদে ইলিনাকে নিয়ে খেলছিলাম।ইলিনা দৌড়াচ্ছে আমি তার পিছু পিছু হাঁটছি।ওকে ধরতে পারছিনা,এটা ভেবে ইলিনা খিলখিল করে হাসছে।মেয়েটার কোঁকড়া চুল বারবার সামনে এসে পড়ছে আর ও হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে।তানিমের চুল কোঁকড়া ছিলো।ইলিনার দিকে তাকালে তানিমের প্রতিচ্ছবি দেখি।নিজেকে সান্ত্বনা দিই,তানিমের একটা মহামূল্যবান উপহার আমার কাছে আছে।
ছাদে খেলতে গিয়ে হঠাৎ রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখি…..(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here