ভালোবাসা রং বদলায় পর্ব -২১

#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — #মাহমুদ
পর্ব — ২১
*
-“কাল আমাকে দেখে এমনভাবে না দেখার ভান করে গেলে যেনো আমাকে চিনোই না।”
-“কখন?”
-“সকালবেলায়। তখন অবশ্য তোমাকে আমি পিছন থেকে ডাকতেও চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি যেমনভাবে হেঁটে বাসে উঠে গিয়েছিলে! ডাকার কোনো ইস্ক্রুপ’ই ছিলনা।”
-“ও। আসলে তখন আমার কলেজের জন্য দেরী হয়ে যাচ্ছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিলাম।”
-“খুব ভালো। তবে হাঁটার সময় একটু ডানে বামে দেখেশুনে চলতে হয়। বুঝলে?”
-“হুম।”
-“জানো? আমার কাছে আর কোনো ক্ষমতা না থাকলেও বিষেজ্ঞ একটা ক্ষমতা আছেই।”
ভ্রু কুঁচকালো নিলু। অনুসূচক কন্ঠে বলল,
-“যেমন?”
-“যেমন হলো, সেদিন রেস্টুরেন্টে একগাদা হরেক রকমের আইটেম অর্ডার করা, আবার সবগুলো একাই খেয়ে ফেলা, সবার সামনে তোমার রেপুটেশন নষ্ট করা সব মিলিয়েই তুমি আমার উপর বিরাট আকারের ক্ষেপে আছো। সেটা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি।”
-“তেমন কিছুই না। তুমি ভুল…..”
-“আমি ঠিকই ভেবেছি নিলু। সেদিনের জন্য আমি স্যরি। একটু বেশিই পাগলাটেদের মত আচরণ করে ফেলেছিলাম। আসলে সত্যি কথা বলতে সেদিন দিয়ে আমি মোট তিন দিন না খেয়েছিলাম। এজন্য….”
-“এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড। তিন দিন না খেয়েছিলে মানে?”
-“হুম। কিছুদিন আগে বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। সারাটাদিন এপাড় ওপাড় ছুটাছুটি করতে হয়েছে। বাবা ভাগ্যক্রমে বেঁচেও ফিরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাবা আর কখনওই কথা বলতে পারবেন না। কারণ বাবা…..”
-“চুপ হয়ে গেলে কেন? আংকেলের কী হয়েছে?”
শরৎ কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলো। তারপর নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বলল,
-“বাবা কোমাই চলে গেছেন।”
-“ওয়াট? একথা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”
-“তুমি ফোন ধরলে তো বলবো। তাছাড়া কাল তোমাকে খবরটা দেবার জন্যেই বাসস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমি তো…..”
-“স্যরি। আসলে পরিক্ষার চাপে আমি খুব মেন্টারলি ডিস্টার্ব ছিলাম। তাই কাল ওভাবে চলে গেছিলাম। আর ফোন তখন সাইলেন্ট রাখা ছিলো। তাই রিসিভ করতে পারিনি।”
-“সাইলেন্ট রাখা ছিলো বলে রিসিভ করতে পারোনি, সে না হয় বুঝলাম। অন্তত পরে কল ব্যাক তো করতে পারতে।”
-“স্যরি। ভুল হয়ে গেছে।”
-“ইটস ওকে। সমস্যা নেই। আর আমিও স্যরি। আজ একটু রুডলি তোমার সাথে কথা বলে ফেলেছি। স্যরি অ্যাগেইন।”
নিলু চুপ। শরৎও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। এরপর নীরবতা ভেঙে শরৎ বলল,
-“কাল রাজশাহীতে যাচ্ছি।”
-“ও।”
-“আজ একটু দেখা করতে পারবে?”
বিনাদ্বিধায় নিলু জানতে চাইল,
-“কোথায় আসতে হবে?”
-“আর এফ সি ক্যাফেতে।”
-“ওকে আসছি।”
বলেই নিলু ফোনটা কান থেকে সরিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো। খুব গরম লাগছে। এখন একটু শাওয়ার নিলে মন্দ হয় না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নিলু চটজলদি শাওয়ার নিয়ে বাথরুম ছেড়ে বেরিয়ে এল। আলমারি থেকে লাল সাদা মিশ্রণের একটা সালোয়ার কামিজ বের করে তা পরিধান করল সে। সামনে দিকে কিছুটা চুল রেখে, চুলগুলো পিছন থেকে ক্লিপ দিয়ে আটকে নিল সে। কোনোরকম সিম্পল ভাবে সেজেগুজে আলমারি থেকে পার্স বের করল নিলু। এরপর দেরী না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শরৎ এর সাথে দেখা করবার উদ্দেশ্য।

মেয়ের প্রেগন্যান্ট হবার কথা শুনে মহসিন সাহেব আর স্থীর থাকতে পারলেন না। সিলেট থেকে যেমন তেমন ভাবে বাস ধরে ছুটে চলে এসেছেন রূপার সাথে দেখা করবার জন্য। সঙ্গে কিছু ফলমূলও এনেছেন তিনি। মহসিন সাহেবের সাথে কুশল বিনিময় করবার পর একপর্যায়ে ফারজানা বেগম বললেন,
-“বিয়াই সাব এসবের আবার দরকার কী ছিল?”
মহসিন সাহেব শুধু হাঁসলেন। তারপর আশেপাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“রূপা কোথায়? ওকে তো দেখছি না।”
তৎখানিক রূপাও নিচে চলে এসেছে। বাবাকে দেখতে পেয়ে এক প্রকার ছুটে আসল সে। রূপার এহান কান্ডে বেশ অবাক হয়ে গেলেন মহসিন-ফারজানা। মহসিন সাহেব বললেন,
-“কী রে মা, এমনভাবে ছুটে এলি কেন? এইসময়টাই একটু সাবধানে চলতে হয়। এখন শুধু একার কথা ভাবলে চলবে না। তোর গর্ভে যে আরেকজনের প্রাণ আছে, এইটাও তোকে সবসময় মনে রাখতে হবে।”
ফারজানাও সায় দিলেন। বললেন,
-“হ্যা, বিয়াই সাব একদম ঠিক বলেছেন। এবার থেকে তুই সিড়ি বেয়ে নামা-উঠা আগের থেকে কমিয়ে দিবি। দরকার হলে যা লাগবে আমাকে বা নিলুকে ডেকে বলবি। আর চুলোর আশেপাশেও ঘেষবি না বলে দিলাম। তোর যা খেতে মন চাই আমাকে বিনাদ্বিধায় বলবি। আমি বানিয়ে দেব। কী বলেছি কানে গেছে?”
-“জ্বি মা।”
বলেই রূপা ছলছলে চোখে মহসিন সাহেবের দিকে তাকাল। কতদিন পর বাবার সাথে দেখা হলো তার। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে রূপার। মহসিন সাহেব মেয়েকে কাঁদতে দেখে তাকে বুকে আঁকড়ে ধরলেন। হালকা হেঁসে রূপার মাথা বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-“এই পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন?”
রূপা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“আমার কথা আজ মনে পড়ল আপনার?”
মেয়ের কথাটা শুনে ফিক করে হেঁসে দিলেন মহসিন সাহেব। রূপার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু একে দিলেন। বললেন,
-“পাগলী একটা।”
রূপা এদিকওদিক চেয়ে চোখ বুলিয়ে বলল,
-“বাবা নিপা কোথায়? ও আসেনি?”
-“না।”
-“ওকে আনলেন না কেন?”
-“আমি তো এ’কদিন বাড়ির বাইরে ছিলাম। সিলেটে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ধ্রুব বাবা তৎখানিক আমাকে সুখবরটা দিয়েছিল। আমি সেদিনই তোকে দেখতে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু একটা কাজে তখন আটকে পড়েছিলাম। আজ কাজ শেষ। তাই ভাবলাম একবারে তোকে দেখেই বাড়ি যাবো।”
রূপা মহসিন সাহেবের সামনে দাঁড়াল। বলল,
-“এত বড় জার্নি দিয়ে, কষ্ট করে আসার দরকার কী ছিল বাবা?”
-“দরকার ছিলো রে মা। আমার সেই ছোট্ট পরীটা মা হতে চলেছে আমি দেখতে আসব না? তা কখনও হয় নাকি?”

বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজারও নক্ষত্র। তার মাঝখান দিয়েই উঠেছে অর্ধ চাঁদ। হাজারও নক্ষত্রের মাঝে চাঁদের ঠিক পাশেই আছে একটা বড় আকারের তারা। এটাকে সবাই শুকতারা বলে থাকে। কিন্তু রূপার কাছে এটা তার সবকিছু, তার জীবন, তার ভালোবাসা, তার দ্বীপ।
অপার্থিব চাঁদের আলোয় চিকমিক করছে রূপার চোখের পানি। আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে দ্বিপকে। তিন বছর আগে ঠিক এইদিনে দ্বীপের সাথে দেখা হয়েছিল তার। কী অদ্ভুত ভাবেই না দ্বীপের সাথে দেখা হয়েছিল রূপার। ভাবতেই শব্দ করে হেঁসে দিল সে। এই একটাই মানুষ, যে তাকে কাঁদাতেও পারে আবার নিমিষে হাঁসাতেও পারে।
বিস্মিত চোখে শুকতারার দিকে তাকাল রূপা।
সে ছলমলে চোখে বলে উঠল,
-“আমাকে কাঁদাতে তোমার খুব ভালো লাগে না?”
বলতে বলতেই চোখটা ভিজে উঠল রূপার। চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে আবারও বলতে শুরু করল সে।
-“প্রায় একটা বছর ধরে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি দ্বীপ। একদিনও বাদ যায়নি যে আমি তোমাকে মনে করিনি। কিন্তু আর কত বলো? আর কত অপেক্ষা করাবে? তুমি তো কোথাও নিশ্চিন্তে আনন্দ ফূর্তি করছো। একবারও কী আমার কথা মনে পড়েছে তোমার? হয়তো পড়েছে, হয়তো পড়েনি। এমনটাও হতে পারে তুমি নতুন কাউকে পেয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছো। এটাই তো স্বাভাবিক। একটা মানুষ একবছর ধরে লাপাতা। তার মানে আমার ধরে নেয়া উচিত সে অন্য একটা মেয়ের সাথে….. নাহ! আর ভাবতে পারছি না আমি। তবে আজ তোমাকে কিছু কথা জানাতে চাই। আমি তোমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম দ্বীপ। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিলো না। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমি আর পারছি না। ধ্রুব নাকি দ্বীপ, এই দুটানা যেন আমাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। কিন্তু…..”
বলতে বলতেই রূপা পেটের উপরে একটা হাত রাখল। বলল,
-“যেদিন আমি জানতে পারি আমি মা হবো। সেদিন এক অজানা অনুভূতি আঁকড়ে ধরেছিল আমাকে। মা হবার অনুভূতিটা এতটা মধুরময় হয় আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। অবশ্য প্রথমদিন শুনে আমি ব্যাপারটা হজম করতে পারছিলাম না। খবরটা আমার জন্য সুখবর ছিলো নাকি দুঃসংবাদ ছিল এটা কোনোমতে মাথায় খেলছিল না। তবে, পরে যখন আমি পেটে ঠিক এভাবে হাত রাখি তখন টের পায় এখানটাই কারো অস্তিত্ব আছে। কেউ এখানটাই চুপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। সে আর কেউ নয় আমার সবকিছু, আমার সন্তান, আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব। একসময় তুমি আমার সবকিছু ছিলে। কিন্তু কিভাবে যেন ধ্রুব তার দিকে আমাকে টনিকের মত টানতে লাগল। নতুন করে ভালোবাসতে শেখালো। এরা দুইজন যে আমার জীবন, আমার সবকিছু। হ্যা! এইটা ঠিক মানুষটা আমার সাথে অনেক অত্যাচার করেছে। কিন্তু সে তো জেনেশুনে করেনি। তাকে অন্যকেউ ভুল-ভাল বুঝিয়েছিল বলে সে এমনটা করেছিল। তাকে নিজের বশে নিয়েছিল। মানুষটা যে তখন নিঃসঙ্গ হয়ে গেছিলো তার বাবা-ভাইকে হারিয়ে! তার জায়গায় যদি আমি থাকতাম, ঠিক একই কাজ করতাম। আমি ধ্রুবকে এখানে কোনো দোষ দেব না। কারণ সবকিছুর নাটেরগুরু ওই সৈকত। ওই-ই ধ্রুবের কান ভাঙিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। আমি ভাবতেও পারছি না যে সেদিনের প্রতিশোধ সে এভাবে নিবে।”
বলেই থামল রূপা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবারও বলতে লাগল,
-“তবে সৈকতকে আমি ছাড়বো না। কোনোমতে ওকে ছাড়বো না। ওর ভালো মানুষির আড়ালে যে জঘন্যতম রূপটা আছে তা আমি ধ্রুবের সামনে প্রমাণ করেই ছাড়বো।”
এইটুকু বলেই রূপা পেটে হাত বুলাতে লাগল। বলল,
-“মা শুনতে পাচ্ছিস? এই যুদ্ধে তুই তোর মায়ের সাথে থাকবি তো?”

চলবে,,,,,,,

লেখকের অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here