ভালোবাসি প্রিয় পর্ব ৫১+৫২

#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৫১
#সুলতানা_সিমা

লুপার পায়ে অনেক আঘাত পেয়েছে। মনে হচ্ছে পায়ের কোনো একটা হাড় আলাদা হয়ে গেছে। অসয্য ব্যথা নিয়ে চেয়ারে বসে আছে সে। একটু পর পর দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করছে। ব্যথাটা তো শুধু তাঁর পায়ে নয়, বুকেও ব্যথা করছে অনেক। ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা এটা। অরিন দূর থেকে একটু পর পর লুপার এসব দেখছে। খুব কষ্ট লাগছে তাঁর। ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে লুপাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পুরনো কথাগুলো মনে পড়লেই, লুপার থেকে অরিনের চোখ আপনাআপনি সরে যায়।

অনেকগুলা ছেলে মেয়ে একসাথে তালি দিয়ে উঠল। লুপা তাকিয়ে দেখে, নীল স্টাজে এসে বসছে। নীলের চোখ দুটো অনেক ফুলা। অস্বাভাবিক লাগছে তাকে। যেন সে বর নয়, কোনো জেল থেকে পালিয়ে আসা আসামী। নীলকে দেখে লুপার বুকের আগুন আরো দাউদাউ করে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। যে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই, মায়া কাটতে শিখতে হয়৷ নীলের আর শামুর স্টাজ আলাদা ভাবে করা হয়েছে। শামু একটু আগে উপরে গেছিলো এখনো উপরে আছে। এতোক্ষণ ধরে উপরে কী করছে কে জানে।

হলুদ লাগানো শুরু হলো। একে একে সবাই নীলের গায়ে হলুদ লাগিয়ে গেলো। নীলের মাঝে কোনো
প্রতিক্রিয়া নেই৷ অনুভূতি শূন্য মানুষদের মতো বসে আছে সে। বরাবরই লারা খুব দ্বায়িত্ববান। এখানেও তাঁর দ্বায়িত্ব কম নয়। অনেক বিষয় খেয়াল করে করছে সে। লারা এসে লুপাকে বলল “লুপা সবাই হলুদ লাগিয়েছে, যাও তুমিও লাগিয়ে দাও।” লুপা জোরপূর্বক হেসে বলল “না না ভাবী আমি আর কেন এসব দেবো।” লারা শুনলো না জোর করে নীলের সামনে নিয়ে গেলো।

নীলের সামনে লুপা বসতেই চোখ তুলে উপরে চাইলো সে। এখানে বসার পরে এই প্রথম চোখ তুললো উপরে। লুপাকে দেখে নীলের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। বুক ফেটে কান্না আসছে তাঁর। সেদিনে কথাটা কানে বেজে উঠল ” দেননা একটা বাচ্চা আমায়। একটা রাত ভিক্ষে চাইছি আমি। প্লিজ।” নীল শুকনো একটা ঢোক গিললো। কান্না আটকাতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। বুকের পাজর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে হলুদ হাতে নিলো লুপা। লারার ফোনে কল আসতেই ফোনে নিয়ে চলে গেলো অন্যপাশে। লুপার হাত প্রচন্ডরকম কাঁপছে। নীল ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে পারলো না,টুপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো।

নীলের ডান গালে হলুদের হাত রেখে জল ভর্তি চোখে তাকাল নীলের চোখে। দুজনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। নীলের চোখে অসহায়তা ভেসে উঠছে। চোখ বন্ধ করে নিলো লুপা। চোখে ভেসে উঠল নীলের দুষ্টুমির কিছু দৃশ্য ” সকাল সকাল মানুষের বাড়িতে চলে আসেন লজ্জা করেনা?
_আমার না একটুও লজ্জা করেনা,এই শাওন তোর করে?” চট করে চোখ খুলে নিলো লুপা। চোখ থেকে তাঁর জল বেয়ে এসে থুতনি ছুঁয়ে পড়লো। কান্নাজড়িত গলায় নীল বলল” কেমন আছো এখন?” লুপা কিছু বলল না।

ডান গাল থেকে হাত এনে বাম গালে হলুদ লাগালো। তাঁর মনে পড়লো শপিংমলের সেই কথাটা ”

পাগলামি করছো তুমি লুপা। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। আর আম্মুও তোমাকে মেনে নিবেনা। কারণ তুমি তোমার সুন্দর পরিবারকে নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছ। সেখানে কীভাবে কোনো মা রাজি হবে তাঁর ছেলের জন্য তোমাকে নিতে? তুমি বিয়ে করে নাও লুপা সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কথাটা মনে হতেই কান্না বেড়ে গেলো লুপার। কান্না চেপে রাখতে গিয়ে বার বার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। গালে হলুদ লাগিয়ে কপালে হাত নিলো লুপা। নীল এতোক্ষণে খেয়াল করলো লুপার ঠোঁট ফুলে আছে। নীল বলল “ঠোঁটে কী হয়েছে তোমার?” লুপা জবাব দিলোনা। নীল আবার বললো, “লুপা বলছো না কেন ঠোঁটে কী হয়েছে তোমার? রক্ত জমে আছে কেন?”

লুপা চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলো। এক পা টেনে টেনে হাঁটছে। নীল চট করে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে ডাক দিলো “লুপা।” নীলের ডাকে শুধু লুপা নয়, সবাই থেমে যায়। সবার চোখ নীলের দিকে। নীল দৌঁড়ে লুপার পায়ের কাছে বসে। লুপার পায়ে ধরতেই তাঁর হাতের হলুদ লেগে যায় লুপার পায়ে। পা ধরে দেখলো পা অনেকটা ফুলে আছে। রক্ত জখম হয়ে আছে। বৃদ্ধা আঙুলের নক ফেটে রক্ত শুকিয়ে আছে। নীল অস্থির হয়ে বলে “কী হইছে তোমার? এটা হলো কী করে? মনে তো হচ্ছে এক্সিডেন্ট করেছো।”

লুপা পা ছাড়াতে চায়। নীল ধমক দিয়ে বলে “বলনা কেন কী হইছে পায়ে?” দিহান সহ তাঁদের পরিবারের সবাই বোকার মতো তাকিয়ে আছে। নীলের মা এসে দাঁতে দাঁত চেপে নীলকে চাপা গলায় বলেন “নীল সবাই দেখছে।” নীল খুব চেঁচিয়ে বলে “হ্যাঁ দেখছে, তো কী হয়েছে? এখন সবাই তোমাকে অপমান করবে?” নীলের ধমকে তাঁর মায়ের মুখ ছোট হয়ে যায়। ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। লুপা বুঝতে পারছেনা নীল কেন এমন করছে? মায়ের চোখে পানি দেখে নীল দাঁতে দাঁত চেপে মাথা চেপে ধরলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে স্টেজে গিয়ে বসলো।

সবার জিজ্ঞাসুক চোখ লুপার দিকে আর নীলের মায়ের তীক্ষ্ণ চোখ। লুপার মাথা ঘুরে উঠে। রুহান এসে লুপাকে ধরলো। লুপা রুহানকে ক্ষীণ গলায় বলে “বাসায় চল রুহান।” লুপা রুহান চলে যেতে লাগে। শামু ডাক দেয় “দাঁড়াও লুপা।” শামুর ডাকে লুপা দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে শামু। এক হাতে ফোন এক হাতে ডাইরী। ডাইরীটা নীলের উপর ছুঁড়ে মেরে নীলকে টাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো।

উপস্থিত সবার চোখ এখন কপালে উঠে গেছে। এসব হচ্ছে কী এখানে কারো মাথায় ঢুকছে না। শামুর মা শামুকে ধমক দিয়ে বললেন “শামু এটা কী করলি তুই?” শামু কিছু বলেনা। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে। নীলের ফুপি এসে বললেন “এই মেয়ে তুমি ওকে মারলা কেন? ও কী করেছে?” শামু এবারও কিছু বলল না। নীলের মা শামুকে বললেন “শামু রিসোর্টের সবাই এখানে। এসব কী তামশা করছিস।”

শামু এবার নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। হাতের ফোন খুব জোরে ফ্লোরে আছাড় মেরে ফেলে, চিৎকার করে বলল”

_চুপ করেন আপনি। তিন তিনটা জীবন নিয়ে খেলা করে আমায় বলছেন আমি তামশা করছি? আরে তামশা তো আপনি করছেন। নিজের ছেলের জীবন থেকে শুরু করে আমার আর লুপার জীবন নিয়ে।”

লুপার নামটা শুনে লুপা আঁতকে উঠল। লুপার পরিবারের সবাই শামুর দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছেন। উনাদের চোখ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে লুপার জীবন নিয়ে কেমনে খেলছেন উনি। নীল ডাইরি দেখেই বুঝে গেছে শামু কীভাবে সব জানলো। একমাত্র এই ডাইরি তো তাঁর মনের কথাগুলো জানে।

শামু ফ্লোর থেকে ডাইরিটা তুলে আনে। কয়েকটা পৃষ্ঠা খুঁজে একটা পৃষ্ঠা বের করে নীলের মায়ের সামনে তুলে ধরে বলে “দেখুন আপনার ছেলের যন্ত্রণাগুলো কীভাবে চেপে রেখেছে মনে। আপনার নিষ্ঠুরতার কথা কীভাবে লিখেছে, পড়েন একবার। আপনি তো একজন মা হন, তাও শিক্ষিত মা। আপনি কীভাবে নিজের পছন্দকে ছেলের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলেন? এমন কাজ তো মূর্খ মায়েরাও করবে না। সন্তান কার সাথে ভালো থাকবে সেটা সন্তানকে জিজ্ঞেস করবেন, নিজেকে নয়। লুপাকে কেন আপনি খারাপ বলেন? ওর পরিবারের সাথে এমন করেছে বলে? কখনো ভাই হারিয়েছেন আপনি? বাবা মায়ের অবহেলিত চেহারা দেখেছেন আপনি? দেখেন নি। তাহলে কেমনে বুঝবেন ওর অবস্থাটা। আপনার ছেলে আপনায় সম্মান করে ও ভালোবাসে। তাই সে আপনার অনুমতি ছাড়া চায়নি তাঁর ভালোবাসাকে। আর আপনি কিনা নিজের ছেলের জীবন নিয়ে খেলছেন?

শামুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। লুপা বুঝতে পারছে না শামু এসব জানলো কেমনে। নীল কী সবকিছু ডাইরিতে লিখে রেখেছে? নীল তাচ্ছিল্য চোখে তাঁর মায়ের দিকে তাকালো। উনার মুখ ছোট হয়ে আছে। দিহান নীলকে জিজ্ঞেস করলো “নীল তুই লুপাকে ভালোবাসিস?” নীল ভেজা চোখে তাকাল দিহানের দিকে। নীলের মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। দিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে বর্ষণ করলো আরেক ফোঁটা জল। দিহান বুঝে গেলো নীলের চাপা কষ্টটা কোথায় ছিলো। শামু নীলকে বলল”

কেমন মানুষ তুমি? একটা মানুষ তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, আর তুমি তাকে খারাপ বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছো? ও যা করেছে ওর জায়গায় যে কেউ হলেই এটা করতো। আরে সাত খুন ওতো মাফ হয়। ও তো কাউকে খুনও করেনি। তারপরও কেন ওর সাথে এমন করছো? যুবক নির্দোষ ভাই হারিয়ে বেচারি পাগল হয়ে গেছিলো। ও তো অনুতপ্ত। ও তো বলছে ও ভুল করেছে। তবুও কেন ওর সাথে এমন করছো?”

দিহানের বড়মা লুপার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন “লুপা তুই নীলকে ভালোবাসিস?” লুপা মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ থেকে শুধু বেদনাশ্রু ঝরে পড়ছে। শামু চেঁচিয়ে বলল” আপনিই তো লুপার বড়মা তাইনা? আপনাদের করা অন্যায় সয্য করতে না পেরেই তো আজ ওর এমন হাল। নিজের মেয়েকে হারিয়েছিলেন বলে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন। তাহলে ভাবুন ওর ভাই হারিয়েছে ও। বাবার পরের ছায়া হারিয়েছে। ও কীভাবে সয্য করতো এটা?”

লুপা শামুর দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এসব তো সে তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ডকে বলেছে। তাহলে কী শামুই সে? শামু লুপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল” আমি জানতাম না লুপা তুমি নীলকে ভালোবাসো। নয়তো কখনো এ বিয়েতে আমি রাজি হতাম না।” চোখের পানিটা মুছে নীলকে বলল”

তুমি আমাকে বলতে পারতে নীল। আমি খারাপ হলেও এতোটা খারাপ নই। হ্যাঁ আমার চলাফেরা,চাওয়া পাওয়া সবার থেকে আলাদা। কিন্তু আমি জোর করে কিছু চাইনা। আমি কোনো সম্পর্কের ৩য় ব্যক্তি হতে চাইনা নীল। আমি চাইনা আমি এমন কারো জীবনে থাকি, যার জীবনে অন্যকেউ আছে। বাবা মা অনেক সময় সন্তানের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেন। শুধু সন্তানরা আবেগের বশে কিছু চেয়ে বসেনা। মাঝে মাঝে বাবা মাও চায়। তাই মাঝে মাঝে বাবা মায়ের অবাধ্য হতে হয়।

রিসোর্টের উপস্থিত সবাই শামুর দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই নিরব দর্শক। কে কী বলবে? এই অবস্থায় কার কী বলা উচিৎ সেটা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। শামুর মায়ের গর্ব হচ্ছে শামুকে নিয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পারে উনার মেয়ে। যাক সম্মান,বলুক লোকে কথা। তবু তো কারো সাথে অন্যায় হলোনা। শামু অরিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেহেতু লুপা তাঁকে অরিনের কথা বার বার বলতো। তাই অরিনকে কিছু বলার আছে তাঁর। অরিনকে শামু বলল ”

_লুপাকে ক্ষমা করে দাও অরিন।” শামুর কথায় অরিন কিছু বলল না। শামু আবার বলল”প্লিজ অরিন ক্ষমা করে দাও। আর কত রাগ থাকবে?” অরিন চোখের পানিটা মুছে বলল”
_রাগ তো তখন হয়, যখন পর কেউ ধোঁকা দেয়। কিন্তু যখন আপন মানুষ ধোঁকা দেয়,তখন রাগ হয়না। মন ভেঙে যায়। বিশ্বাস ভেঙে যায়। মানুষের মন পাথর হয়ে যায়।

_তোমার কষ্টটা আন্দাজ করছি অরিন। কিন্তু লুপার কষ্টটাও কম নয়। আজ তুমি দিহান ভাইয়ের ভালোবাসা। দিহান ভাইয়ের সন্তানের মা। ইন্ডিয়ার একজন নাম করা ডক্টর। সবকিছুর পিছনে কিন্তু লুপার হাত আছে। একবার ভাবো অরিন, লুপা তোমায় ব্যবহার না করলে তুমি দিহান ভাইকে পেতানা। ওর জন্যই আজ তোমরা স্বামী স্ত্রী। ক্ষমা করতে শিখো অরিন। ক্ষমা হচ্ছে একধরণের হারপিক। যেটা মনের সব ক্ষোভ, রাগ, অভিমান, মনের মরিচা,সব। মন থেকে মুছে দেয়। তুমি যতদিন লুপাকে ক্ষমা করতে পারবেনা, ততদিন পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়বে তোমার। আর যত এটা মনে পড়বে তত তোমার অভিমানের পাল্লা ভারি হবে। ক্ষমা করে দেখো। লুপাকে আর অপরাধী মনে হবে না তোমার। একবার ওর অবস্থানে নিজেকে ভাবো সবাই। দেখবে লুপা অপরাধী নয়,লুপা হচ্ছে সব থেকে অসহায় মেয়ে। যে মনের কষ্টটাও বলার মতো কাউকে পায়না।

এইটুকু বলে থামলো শামু। লুপার সামনে দাঁড়ালো, তারপর লুপাকে বলল” যে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তাকে কখনো অন্ধ প্রমাণ করনা। নয়তো সে সত্যিই অন্ধ হয়ে যাবে। তাঁর চোখে আর তোমার কষ্ট পড়বেনা। ”

শামু চোখের পানিটা মুছে নিলো। সবার চোখেই পানি। শামু যেন সবার চোখ খুলে দিছে। দিহান অরিনের হাত ধরে অনুরোধের চোখে তাকাল অরিনের দিকে। অরিন ডুকরে কেঁদে উঠল। সত্যিই তো শামু বলেছে, দিহানকে পেয়েছে তো লুপার জন্যই। লুপা তাকে ব্যবহার না করলে কীভাবে সে তাঁর এই প্রাণের স্বামীকে পেতো। নীল লুপা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। নীলের মা এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি ভেবেছিলেন লুপা উনার ছেলেকে এক সময় ধোঁকা দিবে। তাই তিনি চেয়েছিলেন শামুর সাথে বিয়ে দিয়ে লুপার ব্যাপারটা নীলের মাথা থেকে ঝেড়ে দিতে।

মেহমানদের মধ্যে দুজন চলে যাচ্ছিলেন। শামু বলল “দাঁড়ান কেউ যাবেন না। হলুদের অনুষ্ঠান হবে আজ।” শামুর কথায় নীল ধাক্কা খেলো। এতোক্ষণ কী বলল আর এখন কী বলছে? লুপার রুহানকে আস্তে করে বলল “রুহান চল।” শামু বলল “তুমি যেওনা লুপা। হলুদ তোমার আর নীলের হবে।”

শামুর কথাটা শুনে লুপা অবিশ্বাস্য চোখে শামুর দিকে তাকায়। শামু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। লুপা ছলছল চোখে হাসতে হাসতে রুহানের দিকে তাকায়। রুহানেরও চোখে পানি। বোনের খুশিতে সেও কেঁদে দিয়েছে। নীল একবার তাঁর মায়ের দিকে ছলছল চোখে তাকাল। শামু বলল” কারো অবিভাবকের কোনো মতামত চাইবোনা আমি। বিয়ে আমি দিবো।” নীলের মা তাঁর দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানালেন। নীল আর এক মূহুর্ত দেরি করলোনা। দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো লুপাকে। লুপাও যেন নীলের সাথে লাজ লজ্জা ধুয়ে ফেলছে। নীলকে আঁকড়ে ধরে সে কেঁদে দেয়। খুব শক্ত করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কত পাগল দুজন দুজনের জন্য সেটা তাঁরা নিজেরা ছাড়া আর কেউ জানেনা।

দিহান শাওন নীলের খুশি দেখে কাঁদছে। আর অরিন লুপার। নীলের মা আজ বুঝতে পারলেন উনি আসলেই ভুল করতে যাচ্ছিলেন। কই এভাবে তো ছেলেকে কখনো খুশি হতে দেখেন নি।

শামু চোখের পানিটা মুছে নিলো। এতোদিন লুপার সাথে সে ফেসবুকে কথা বলতো। সে জানতো এটা লুপা। কিন্তু নিজের পরিচয় দিতোনা। আজ যখন লুপার লাস্ট মেসেজ সিন করলো,তখন তাঁর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। লুপা নীলকে ভালোবাসে এটা সে জানতোইনা। ফোন নিয়ে দৌঁড়ে যায় নীলের রুমে। কিন্তু ততক্ষণে নীলকে স্টেজে আনা হয়। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলো নীলের বালিশের নিচে ডাইরির অর্ধেক বেরিয়ে আছে। ডাইরিটা পড়ে তাঁর পৃথীবি ওখানেই থমকে যায়। লুপার জন্য মায়া হয় তাঁর। এতদিনে সে এটা খুব আন্দাজ করেছে, লুপা জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। নীলকে হারিয়ে ফেললে তো সে মরেই যাবে। আর নীলের ডাইরির প্রতিটি পৃষ্ঠা জানান দিচ্ছে, লুপাকে নীল কতটা ভালোবাসে। শামুর এক ফ্রেন্ড এসে তাকে বলল”

_শামু তুই না নীলকে ভালোবাসিস, তাহলে এসব কী করছিস?” শামু ম্লান হেসে বলল, “আমি নীলকে ভালোবাসি। নীলকে পেলে আমি ভালো থাকবো। কিন্তু নীল যখন আমার সাথে সুখে থাকবে না তখন আমিও ভালো থাকতে পারবো নারে। ও সুখে থাকুক৷ আমি আমার জীবনে কাউকে মানিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু ওরা পারবে না।

নীল লুপাকে ছেড়ে লুপার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক চেপে কাঁদতে থাকে দুজন। শাওন দিহানকে ফিসফিসিয়ে বলল” এই বেটা এখন কী করতে চায়। হুস বুদ্ধি সব খেয়ে ফেলছে মনে হয়।” দিহান ওই দিকে থাকাচ্ছেনা। এদিকওদিক তাকাচ্ছে শুধু। নীলের লুপার কোনোদিকেই হুস নেই। ওরা যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও। আশেপাশের এতো হৈ চৈ যেন ওদের কানে ঢুকছে না। লুপার কাটা ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁটে চুমু খায় নীল। সাথে সাথে সবাই ওইদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৫২
#সুলতানা_সিমা

ভালোবাসা যদি সত্যি হয়। জয় তাঁর একদিন না একদিন হবেই। যত বাধা বিপত্তি থাকেনা কেন, এক সময় ঠিকই ভালোবাসার জিত হয়। তবে ভালোবাসাটা হতে হবে সত্যিকারের। নীলের আর লুপার মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিলোনা ঠিক। কিন্তু একজনের প্রতি আরেকজনের ছিলো তীব্র টান। ছিলো বিশুদ্ধ ভালোবাসা। তাইতো অবশেষে তাঁদের জয় হলো। জিতে গেলো তাঁরা। লুপার বাবা মাকে ফোন করে আনা হয়েছে। তাঁরা প্রথমে কিছুটা শকড হলেন। কিন্তু যখন জানলেন নীলের জন্যই লুপা এমনটা করছিলো তখন রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা। নিজের সন্তানের ভালো থাকার থেকে সুখ সম্মান বা নিজের চাওয়াকে বড় করে কখনোই দেখেন নি উনারা।

লুপাকে সাজানোর জন্য যখন নিয়ে গেলো, দিহান দিশাকেও সাজাতে পাঠালো। সে চায় এক সাথে দিশার বিয়েটাও হয়ে যাক। দিয়া যেহেতু সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, তাই আর সারপ্রাইজ প্ল্যান করে কী হবে? দিহানের বাবা মা ছেলের কথার উপর কোনো কথা বলেন নি। উনারা দিহানের উপর কথা বলা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। লুপার বাবা মা উনাদের পরিচিত কয়েকজনকে দাওয়াত দিলেন।

নীলের মাও লুপাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু উনার মুখ এখনো মলিন। ছেলের সামনে যেতে উনার লজ্জা লাগছে। জেদ দিয়ে ছেলেকে মানিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। ডাইরির পাতায় ছেলে লিখে রাখছে “তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন আম্মু।” সন্তান বাবা মাকে নিষ্ঠুর তখন বলে, যখন বাবা মায়ের থেকে অনেক আঘাত পায়। শামু ঠিকি বলেছে, উনি যা করতে যাচ্ছিলেন তা মূর্খ মায়েরাও করেনা। নীল কার সাথে ভালো থাকবে সেটা উনার বিচার করা উচিৎ হয়নি।

রাত দেড়টা বেজে গেলো। লুপা আর দিশাকে এনে স্টেজে বসানো হয়েছে। দিশা যে লেহেঙ্গা পরে আসছিলো ওইটাই রয়ে গেছে। লেহেঙ্গাটা অনেক দামী ও সুন্দর। হলুদের কনের জন্য পারফেক্ট। তাই আরেকটার প্রয়োজন পড়েনি। লুপাকে শামু তাঁর নিজের পরা লেহেঙ্গাটা পরিয়েছে। নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছে। শাওন আর নীলকে এক স্টেজে বসানো হয়েছে। হলুদ লাগানো শুরু করলো সবাই। এঁকে এঁকে সবাই এসে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শামু লুপা শাওন নীল। সবাই আজ কত খুশি। ওরা যেন পৃথীবির সব থেকে সুখী মানুষ। ভালোবাসার পূর্ণতা পেলো সবার। খুশি তো হবেই।

অরিন দিশা আর লুপার সামনে বসলো। লুপার সাথে এখনো কথা বলেনি সে। তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। হলুদ নিয়ে দিশাকে হলুদ মাখিয়ে দিলো। তারপর লুপাকে লাগানোর জন্য হাতে হলুদ নিলো। মাথা নিচু করে বসে আছে অরিন আর লুপা। অরিনের অভিমান দিচ্ছেনা কথা বলতে আর লুপার লজ্জা দিচ্ছেনা তাকে চোখ তুলে তাকাতে।

শামু এসে অরিনের পাশে বসলো। অরিনের মেহেদী হাত ধরে লুপার গালে লাগিয়ে দিলো। গালে হলুদ লাগতেই চট করে চোখ তুলে অরিনের দিকে তাকালো লুপা। অরিন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। লুপার চোখেও পানি। হলুদ লাগাতেই লুপার চোখে ভেসে উঠল ছ’বছর আগে ছাদের সেই কথাটা “তুই খারাপ কে বলেছে? তুই খারাপ নয়। আমার লুপা জানুটা কখনো খারাপ হতেই পারেনা।” কথাটা মনে হতেই লুপার বুকের যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়ে গেলো। অরিন তাকে কত বিশ্বাস করতো। আর সে কিনা এই অরিনকে এনেছিলো তাঁর প্রতিশোধ নিতে?

লুপার অন্য গালে হলুদ ছুঁয়ে দিলো অরিন। অরিনের চোখে ভেসে উঠল সেদিন লুপা তাঁর হাত নিয়ে যখন লুপার গলায় লাগিয়ে বলছিলো” মেরে আমায় প্লিজ। আমি যে নিজে মরার সাহস পাচ্ছিনা রে দোস্ত। তুই আমায় মেরে দে, মুক্তি দে আমায় এই বিষাক্ত জীবন থেকে। তুই সব সময় বলতি না, আত্মহত্যা কেন মহাপাপ। হ্যাঁ রে, আত্মহত্যা কেন মহাপাপ বল? আমার যে বাঁচতে ইচ্ছে করছে না রে। আমার মরণ কেন হয়না রে অরিন,আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

স্মৃতিরা সব জেঁকে বসতেই অরিন আর বসে থাকতে পারলো না। চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলো উপরে। লুপার ওই কথাগুলার মানে সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছে অরিন। কতটা যন্ত্রণা আর ঘৃণা জীবনের প্রতি এলে মানুষ এভাবে বলে তা অরিনের জানা আছে। লুপা যে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলো সেটা তাঁর এই কথাগুলা বলে দিচ্ছে।

একটা রুমে গিয়ে কান্না করতে লাগলো অরিন। লুপা একদিন তাকে বলেছিলো “অরিন আমার যখন বিয়ে হবে। তুই আমায় বউ সাজিয়ে দিবি। এমন ভাবে সাজাবি, যেন আমার বর আমায় দেখে চোখ ফেরাতে না পারে। আর তুই দেখিস,আমার বিয়েতে অনেক বড় আয়োজন করা হবে। অনেক অনেক গেস্ট আসবে। আর এই সবার মধ্যে একমাত্র তুই থাকবি স্পেশাল গেস্ট।” কথাটা ভেবেই কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলো অরিনের। কাল লুপার বিয়ে হবে। শান্তি নীড়ের তিন পরিবার এক হয়ে গেছে। সবাই মিলে দিশা আর লুপার বিয়েতে খরচ করবে। আয়োজন তো সত্যি অনেক বড় হবে। গেস্ট ও সত্যি অনেক এসেছে। শুধু অরিন স্পেশাল নয়। আর লুপার বউ সাজটাও হবেনা অরিনের হাতে।

একটুপরে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো দিহান। তাঁর এক হাতে হলুদ। দরজা বন্ধ করে অরিনের পিছনে দাঁড়ালো। অরিন জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। থাই গ্লাসটা খুলে থাকার কারণে কিছু মোলায়েম বাতাস এসে অরিনকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বাতাসের ছোঁয়া লেগে যেন খুশিতে নেচে নেচে উঠছে অরিনের চুল। দিহান পিছন থেকে গিয়ে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। আকস্মিক এভাবে কেউ ধরায় কেঁপে ওঠে অরিন। দিহানকে দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ মুছে নেয়। দিহান চোখ বন্ধ করে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সে ঘোরের মধ্যে আছে।

অরিন বলল” অজনি কই? কার কাছে দিয়ে আসলেন?” দিহান কিছু বলল না। অরিনের ঘাড়ে চুমু এঁকে ওড়নাটা পেটের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। ওড়না সরাতেই অরিনের পেট উন্মুক্ত হয়ে যায়। দিহান অরিনের পেটে হলুদ লাগিয়ে দেয়। অরিন দিহানকে বলে “কী করছেন এসব আমার ঠান্ডা লাগছে।” দিহান কোনো জবাব দিলো না। এক হাতে হলুদ লাগাচ্ছে অন্যহাতে অরিনের পিঠের চুল সরিয়ে পিঠে চুমু খেলো।

দিহানের হাত অরিনের পুরো পেটে হলুদ মাখিয়ে দিলো। পেটের থেকে তাঁর হাত অবাধ্য হয়ে অন্যদিকে চলে যেতে লাগে। অরিন চট করে হাত ধরে নেয়। কিঞ্চিৎ স্বরে বলে “কী করছেন এগুলা? কেউ আসবে,ছাড়ুন।” দিহান ছাড়লো না। অরিনকে তাঁর দিকে ঘুরিয়ে অরিনের কোমর জড়িয়ে ধরলো। অরিনের গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,”লাভ ইউ সোনাবউ।” অরিন কিছু বলল না। তাঁর চোখ থেকে পানি পড়ছে। দিহান অরিনের চোখ মুছে দিয়ে বলল,”কান্না করছো কেন?” অরিন মুখটা গোমড়া করে থাকলো। দিহান অরিনের ঠোঁটে চুমু এঁকে বলে,

“কেঁদো না বউ। বরং লুপাকে ধন্যবাদ দাও যে তোমার জায়গায় ও অন্য কাউকে বেছে নেয়নি। হ্যাঁ ও তোমার সাথে অন্যায় করেছে, কিন্তু ও যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে সোনা। আর এই অন্যায়ের কারণেই আমি তোমায় পেয়েছি। লুপার বয়স কম ছিলো এতোগুলা অন্যায় মেনে নিতে পারিনি তাই পাগল হয়ে গেছিলো। যা করেছে শুধু তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের বদলা নিতে করেছে। ওর জায়গায় থাকলে যে কেউ এমন করতো বউ। শুধু ভুল তাঁর একটাই সে সঠিক পদ্ধতি নিতে পারেনি। তোমাকে ব্যবহার করা তাঁর উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তোমাকে ব্যবহার করেছে বলে আমি তোমাকে পেয়েছি।” অরিন কেঁদে কেঁদে বলল “আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না।” অরিনকে জড়িয়ে ধরে দিহান বলে” সময় নাও সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকলো দুজন দুজনকে। দিহান অরিনকে ডাক দিলো “বউ।
_হুম।
_একটা কথা বলি?
_বলুন।
_চলোনা আমরা আরেকটা বেবি নেই। ” অরিন মুখ তুলে তাকাল। দিহান অনুরোধের স্বরে বলল”প্লিজ বউ না বলল না। একটাই নিবো।” অরিন গম্ভীর গলায় বলল “একটাই ভালো। আর দরকার নাই।”
_প্লিইইইইইজ বউ। আমার খুব ইচ্ছে করে, বেবি যখন তোমার পেটে থাকবে, আমি তোমার পেটে কান রেখে আমার বেবিকে অনুভব করবো। তোমার সেবা করবো। তুমি ভুল করলে তোমার পেটে মুখ রেখে আমাদের বেবির কাছে নালিশ করবো। ও আসার পরে ওর ছোট ছোট হাত পা ধরে খেলা করবো। ওর আদো আদো বুলিতে পাপা ডাক শুনবো। ওর ছোট ছোট পা পায়ের উপর রেখে ওকে হাঁটা শিখাবো। ” এইটুকু বলে দিহানের মুখ বিষন্ন হয়ে এলো। মুখটা একটুখানি করে বলল” অজনির বেলায় তো নিজের ভাগ্যে নিজেই লাত্তি দিয়েছি। ইচ্ছেগুলোও অপূর্ণ থেকে যায়। আমি জানি সোনা তুমি অজনির বেলার কষ্ট এখনো ভুলতে পারছো না। আরেকটা বেবি নেই প্লিজ। দেখবে অজনির বেলায় যে কষ্ট পেয়েছো সব দূর করে দিবো।

অরিন দিহানকে জড়িয়ে ধরে বলে,”নেবো বেবি তবে শর্ত আছে।
_কী শর্ত বলো। আমি মানতে রাজি।
_আজ না আরেকদিন বলবো।
_আজকেই বলো।
_উঁহু আরেকদিন।” দিহান অরিনের মুখটা তুলে বলল” বলোনা প্লিজ।
_না আজ না। অজনি কই?
_দিয়া আর রুহানের কাছে আছে। ও আর রুহান বসে গল্প করছিলো ওদের কাছে দিয়ে আসছি।
_হুহ্। খুব ভালো মানুষদের কাছে দিয়ে আসছেন। ওরা রোমাঞ্চ করবে নাকি আমার মেয়েকে দেখবে? ছাড়ুন আমায়।”।

_ওরা রোমাঞ্চ করবে মানে?” দিহানের প্রশ্নে অরিনের হুস আসে। মুখ ফসকে এ কী বলে ফেলেছে সে। দিহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকিয়ে আছে। এই চোখে সন্দেহ আর রাগ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। অরিনের বুক ছ্যাৎ করে উঠল। দিয়া অরিনকে কসম কাটিয়ে রুহানের কথা বলেছে। বার বার বলেছে বিশ্বাস করে বলেছি ভাবী ভাইয়াকে বলবেনা কিন্তু। এখন কিনা সে বলে দিলো?

দিহান কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে বলল”কী হলো বলো? ওরা রোমাঞ্চ করবে মানে কী? ওরা দুজন প্রেম করে?”
দিহানকে রাগান্বিত লাগছে। দিহানের রাগের বিষয়ে অরিনের খুব ভালো ধারণা আছে। দিহান আবার কিছু বলতে যাবে অরিন দিহানের ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। দিহান ছাড়াতে চায় অরিন ছাড়েনা। দিহানকে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আপাতত কথা এড়িয়ে যেতে এর থেকে ভালো উপায় জানা নেই তাঁর।

_________________________________

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই দিশাকে আর লুপাকে একটা রুমে দেওয়া হলো ঘুমানোর জন্য। ৬টা বেজে গেছে। কিছুক্ষণ ঘুমানো প্রয়োজন তাঁদের। দিশাকে কে এসে বলল তাকে নাকি কে ডাকছে,তাই সে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। দিশা বেরুতেই এসে নীল রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নিলো। দিশাকে সে বের করার জন্য ওই মেয়েকে সে পাঠিয়েছিলো। লুপা গায়ের অলংকার গুলা খুলছিলো। ওড়না খুলে রাখছে বিছানায়। যার কারণে তাঁর পেট পিঠ অনেকটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। নীল লুপার লোভনীয় পেটের দিকে তাকিয়ে বলল”

_ওয়াও, সো হট।” লুপা কানের দুল খুলছিলো। কথাটা কানে যেতেই তাকিয়ে নীলকে দেখে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে বুক পেট সব ভালো করে ঢেকে নিলো। নীল এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে। লুপা পিছাতে পিছাতে গিয়ে আলমারির সাথে আটকে যায়। নীল দুহাত লুপার দুপাশে রাখে। লুপা নীলের হাতের বেড়িতে আটকে যায়। নীল নেশা চোখে লুপার দিকে তাকিয়ে আছে। লুপার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না লুপা, আজ হঠাৎ করে এতো ভয় আর লজ্জা কাজ করছে কেন। নীল মুখটা নিচু করে বলল”

_তুমি এতো সেক্সি জানা ছিলোনা তো।”লুপা কিছু বলল না। নীল একহাতে লুপার গাল ঠোঁট স্লাইড করছে। নীলের ছোঁয়া লুপার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। বার বার কেঁপে কেঁপে ওঠে। নীলের ছোঁয়া তাকে অন্য রকম সুখ দিচ্ছে। মনের মধ্যে জাগাচ্ছে অজানা শিহরণ। তাঁর হার্ট এতো দ্রুত চলছে যেন পাজর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে যাবে। নীলেরও একই অবস্থা হচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ গুলা লুপাও শুনতে পাচ্ছে হয়তো। নীলের হাত গাল থেকে লুপার গলায় নেমে আসে। লুপা চোখ বন্ধ করে নেয়। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে। নীল কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে”

_এখন যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে রাতে কী হবে?” লুপা চট করে চোখ খুলে ফেলল। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। তাঁর সবকিছু জমে যাচ্ছে। নীলের ছোঁয়া হজম করতে পারছে না সে। নীল লুপাকে বলল”
_আগে তো যখন তখন জড়িয়ে ধরতা,চোখের সামনে পেলে চোখ ফেরাতা না। আজ কী হলো?” লুপা কিছু বলতে পারলো না। নীল লুপার ওড়নার ভেতর হাত ঢুকিয়ে পেটে হাত রাখলো। পেটে হাত লাগতেই লুপা লাফিয়ে উঠল। “ক্ক ক্ক কী করছেন এগুলা?”

বলেই লুপা জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। নীলের এতো কাছে থেকে এমনিতেই তাঁর হার্টবিট বেড়ে গেছে। এখন আবার নীলের এমন ছোঁয়া। দম তো তাঁর বন্ধ হয়ে যাবে। নীল লুপার কোমর জড়িয়ে তাঁর দিকে টান দিল। লুপার এসে নীলের বুকে পরলো। তারপর নীল বলল “কী করি বুঝনা? তোমার না একটা বাচ্চা চাই। একটা রাত ভিক্ষে চাই। আসো বাচ্চা দিবো তোমায়।” লুপা শুকনো এক ঢোক গিলে বলে,”আ আ আমি এসব ব ব বলিনি ছা ছাড়ুন আমায়।”
_আচ্ছা। বলনি? রেকর্ড শুনাই?
_আ আ আ আপনি এমন করছেন কেন?” নীল লুপাকে ফিসফিসিয়ে বলল”
_তোমার পেটটা অনেক সফট গো। ইচ্ছে করছে একটু খেয়ে দেখি।
_ছিঃ কথাবার্তার কী শ্রী। ছাড়ুন আমায়।
_কথাবার্তার শ্রী দেখলে কাজকর্মেরটা তো রাতে দেখিয়ে দিবো।

লুপা কিছু বলল না। শিহরণ,লজ্জা,ভয়ে সে জমে গেছে। নীলকে কাছে পাওয়ার এতো তৃষ্ণা থাকার পরেও কেন তাঁর এতো ভয় লাগছে এখন। নীল লুপার ঠোঁটে আঙুল স্লাইড করতে করতে মৃদু স্বরে বলল “can i kiss you” লুপার জবান দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। নীলের স্পর্শে নেশা ধরে গেছে তাঁর। আবার লজ্জা ভয় সব কিছু ঘিরে ধরেছে তাকে।

_চুপ থাকা কিন্তু সম্মতির আহবান জানায়।” লুপা এখনো চুপ। নীল লুপার ঠোঁট জোড়ায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। লুপা বাধা দিতে গিয়েও দিলো না। নীলকে তো সে আরো গভীর ভাবে কাছে চায়। নীলের প্রতিটি পশমও যে তাঁকে কাছে টানে। নীলের সবকিছুই আকৃষ্ট করে তাঁকে। কিছুক্ষণ পরে লুপা আর্তনাদ করে উঠতেই নীল লুপাকে ছেড়ে দিলো। লুপা ঠোঁটে হাত রেখে রাগি লুকে তাকিয়ে আছে। নীল জীভ কেটে বলল,”সরি বুঝিনি।” লুপা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো ঠোঁট অনেকটা কেটে গেছে। সারারাতে ঠোঁট ফুলাটা কমেছে এখন আবার নীল কামড় দিয়ে দিলো। দাঁত স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কয়েকঘন্টা পরে তাঁকে বউ সাজানো হবে, আর এখন কিনা তাঁর এই অবস্থা। কেউ দেখলে তো লজ্জায় মরে যাবে সে।

লুপা নীলের দিকে গরম চোখে তাকালো। নীল বলল” দেখো প্রথমে কিন্তু তুমি আমাকে দিয়েছিলে তারপর আমি দিছি। হিসাব সমানে সমান। শুধু এটাই তফাত যে তোমার ঠোঁট কেটে গেছে আমার কাটেনি।” লুপা তেড়ে গিয়ে নীলের ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। নীল উম্মম্মম বলে উঠে। ঠোঁট ছেড়ে লুপা ওয়াসরুমে চলে যায়। নীল আয়নায় তাকিয়ে দেখে কামড় দিয়ে দাঁত বসিয়ে দিছে। ওয়াসরুমের দরজার সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল” রাতটা আসতে দাও তারপর দেইখো কী করি।”

রুম থেকে বেরিয়ে আসে নীল। ভাগ্যিস কেউ ছিলোনা রুমের আসে পাশে। তাঁকে আর শাওনকে যে রুমে দেওয়া হয়েছে সে রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো। একটু একটু করে ঠোঁট ফুলে যাচ্ছে তাঁর। কিছুক্ষণ পরে দিহান আর শাওন এসে রুমে ঢুকলো। ওদের দেখে নীল চট করে হাত দিয়ে ঠোঁট ঢেকে নেয়। শাওন দিহান এসে নীলের সামনের বসলো। আরো কয়েকটা ছেলে এসে রুমে ঢুকলো। সবাই তাঁদের ফ্রেন্ড সার্কেলের।

শাওন অনেক্ষণ থেকে খেয়াল করছে নীল মুখে ধরে আছে হাত সরাচ্ছেনা। তাই সে বলল,”ওই শুন, মুখে রুমাল ধরে বিয়ে করার যুগ চলে গেছে। হাত নামা।” নীল হাত নামালো না। ইশারায় দিহানকে বুঝালো, মানে এখানে দিহান আছে। শাওন উল্টো বুঝলো, সে দিহানকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বলল”ওই দিহান তোকে নীল ডাকছে।” নীল চোখ বড় বড় করে না সূচক মাথা নাড়ালো। দিহান বলল “কী করতে না বলছিস মাথায় ঢুকেনি হাত নামিয়ে মুখে বল। নীল শাওনের দিকে রাগি লুকে তাকালো। শাওন বলল” আরে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কী করেছি? যা বলার মুখে বল।”

নীলের এবার ইচ্ছে করছে সব গুলাকে লাত্তি দিতে। সোফায় বসা একটা ফ্রেন্ড উঠে এসে বলল “ওই দেখি হাত সরাতো।” নীল সরালো না। ওই ছেলেটা নীলের হাত ধরে সরাতে চাইলে নীল হাত সরায় না। এবার সবার আগ্রহ বেড়ে গেলো নীলের হাতের নিচে কী সেটা দেখার জন্য। সব গুলা মিলের নীলের হাত সরালো। হাত সরাতেই নীলের ঠোঁটে কামড়ের দাগ দেখে এক সাথে হেসে উঠল। একজন বলে উঠল “কিরে নীল এখন থেকেই বেটিং শুরু করে দিলি। ভাই চক্কা টক্কা মারিস নাই তো।” বলেই হো হো করে হেসে উঠে সে। তাঁর সাথে সবাই হেসে উঠে। নীল রাগি লুকে শাওনের দিকে তাকায়। শাওন যদি আগে কথা না তুলতো তাহলে এমন হতোনা। দিহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বন্ধুরা সব ছোট বোনদের বিয়ে করে তাঁকে ফেলছে লজ্জায়। না মজা করতে পারে, না মজা করা দেখতে পারে। সবই কপাল।

চলবে………।
চলবে…..।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here