#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন
পর্ব— ২৩
রোদেলা মুখ ফুলিয়ে পাহাড়ের কাছে একটা বেঞ্চে বসে আছে.. রাতের শিতল বাতাস তাকে ছোয়ে দিয়ে শাইশাই করে উড়ে যাচ্ছে আর রোদেলা আনমনে পানির ছলাৎছলাৎ শব্দ শুনছে !! হাসনাত রোদেলার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে রোদেলাকেই দেখছে!!! কোমড় সমান চুলগুলো বাতাসে মুখে বাড়ি খাচ্ছে তার.কিন্তু রোদেলার সেদিকে কোন খবরই নেয়.. হাসনাত রোদেলার পাশে গিয়ে বসতেই রোদেলা চমকে তাকালো তার দিকে.. হাসনাত রোদেলার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল.. তার বুকের ভিতরটা কষ্টে মোছড় দিয়ে ওঠলো..
রোদেলা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ফিরে নিজের চোখের পানিটা মুছে মৃদু হেসে বলল– আরে হাসনাত ভাই তুমি এইখানে,, কিছু কি বলবে??
হাসনাত জোরে নিশ্বাস নিয়ে তা আস্তে আস্তে ছেড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো.. পানির ছলাৎছলাৎ আওয়াজে নিজেকে বিলিয়ে কিছুখন শান্ত হয়ে বসে রইলো.. তারপর সেদিয়ে তাকিয়েই বলল– একটা জিনিস কি জানিস,, ভালোবাসা ওয়ার্ডটা যতটা ছোট তার মূলভাব ততটা ছোট না.. কারো কেয়ারিং, কারো কাছে আসায় হঠাৎ করে এটি জন্ম নেয়না..এই অনুভূতিটা হঠাৎ এমন একজনের ওপর জন্ম নেয় যাকে মনের কাছে খুব স্পেশাল মনে হয়.. তার কেয়ারিং টা দেখানোর দরকার হয়না তার চোখের দিকে তাকালেই তারসব কিছু বোঝা যায়.. আর মানুষ বারবার প্রেমে পড়ে এইটা যেমন সত্য,, তেমনি একজনের ওপর বারবার মোহিত হয় সেইটা ও সত্য.. এইবলে সে চলে গেল আর রোদেলা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রই্ল… হাসনাতের বলা কথাগুলো যেন তার ভিতর মন ভাল করার মেডিসিনের কাজ করলো.. নিজেকে খুব লাকি মনে হচ্ছে এই ভেবে যে হাসনাতের কাছে রোদেলা স্পেশাল…
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে রোদেলা কিন্তু কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না রোদেলার.. কেন যেন মনটা বড্ড ব্যাকুল.. অদ্ভূত কিছু ইচ্ছা মাথাটাই চাঙ্গা দিয়ে ওঠছে বারবার.. যেমন ঠিক এখন.. ঠিক এখন তার ইচ্ছে হচ্ছে গুটিশুটি মেরে হাসনাতের বুকে শোয়ে পড়তে.. অনেকটা কাছ থেকে তার স্মেলটা গায়ে মাখতে.. কিন্তু তা চাইলেই যে সম্ভব নয়.. কিন্তু রোদেলার মনে ব্যাকুলতা গ্রাস করে রেখেছে তার পুরো সত্তাটাকে..
তামান্নাটাও রুমে নেয় মেয়েটা কোথায় গেল আল্লাহ মালুম কিছু বলেও গেল না….. এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রোদেলার মাথায় খুব ভাল একটা বুদ্ধি চলে এলো..
সে নিজের কাধ চাপড়ে বিরবির করে বলল– বাহ রোদেলা তুই তো একদিন আইনস্টাইন হয়ে যাবি.. এতো বুদ্ধি নিয়ে ঘোমাস কিভাবে.. তারপর আনমনে হেসে ভাবলো—- এইজন্যইতো ভাবি কেন বালিশে ঘুম আসে না আমার!!! আসলে বুদ্ধির জন্যই তো বালিশ আমার মাথার ওজন নিতে পারে না…
এইসব ভাবতে ভাবতে সে হাসনাতের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা লাগালো.. হাসনাত যেন তার অপেক্ষায় ছিল এইভাবে সে দরজা খুলে অবাক হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইল.. রোদেলা হাসনাতের অবাক হওয়া ফেইসটা ইগনোর করে হনহনিয়ে রুমে ডুকে গেল…
হাসনাত মুচকি হেসে নিজের বা পাশে হাত বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল– আহ হাসনাত,, আজ তো তোর লাকি ডে রে..মনে মনে যেই রোদেলাকে চায়লি চলে এলো সে আর কিছু চায়লে হয়তো সেইটাও আজই পেয়ে যেতি.. আহা যদি নিজের বিয়েটা চায়তাম!!!!…
এইসব বিরবিরিয়ে জোরে নিশ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল সে.. এরপর নিজের এক্সাইটমেন্টটা হালকা কমিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে রোদেলার সামনে গিয়ে ব্রু কুঁচকে বলল– তুই এইখানে কেন??
রোদেলা কাচুমাচু করে— আমার রুমে ভূত হাসনাত ভাই!!!
হাসনাত পরম অবাকের সাথে বলল– তুই নিজের চোখে দেখেছিস??
রোদেলা— নাহ,, তবে অনেক শব্দ শুনেছি.. আমার বড্ড ভয় করছে ওখানে…
হাসনাত — তো তোর সেই বিয়াক্কল গুনধর বান্দবীটা কই??
রোদেলা মুখ বাকিয়ে বলল– নেই রুমে!! বেরিয়েছে.. নাহয় কি তোমার কাছে আসতাম নাকি আমি..
হাসনাত কিছু চিন্তা করে– ওকে তুই চল.. আমি তোর সাথে তোর রুমে ও আসা পর্যন্ত ওয়েট করবো.. আর তুই নিজেইতো একটা ভূত তোকে আবার কে খেতে আসবে. তারপর মুচকি হেসে বলল– . আর তোর মাংসতো তিতা সে টেস্ট পাবে না…
রোদেলা মুড অফ করে হাসনাতের দিকে তাকালো.. তারপর বিরবিরিয়ে বলল– কেন.. তোমার সাথে থাকলে কি তুমি অপবিত্র হয়ে যাবা.. তারপর জোরে বলল– কেন আপনি কি টেস্ট করে দেখেছেন নাকি যে তিতা না মিষ্টি… তিতা কেন হতে যাবে…
হঠাৎ হাসনাত মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে সামনে আসতে আসতে বলল– কেন? তুই কি তোকে টেস্ট করতে দিয়েছিস যে বোঝবো…
রোদেলা চমকে হাসনাতের দিকে তাকালো.. হাসনাতের চোখ চোখ পড়তেই কেপে ওঠলো সে.. হাসনাতের এই কথা আর তার তাকানোটা রোদেলাকে কাপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!!! রোদেলা মুচকি হাসার চেষ্টা করে হাসনাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল– আমি এখানেই ঘুমিয়ে যায়..
হাসনাতের মন যেন আপাতত ডান্স করছে.. কিন্তু সে নিজেকে স্হির রেখে বলল– নাহ,, একটা মেয়ে একটা ছেলের রুমে থাকতে পারে না.. তুই যাবি নাকি তোকে ধাক্কিয়ে বের করে দিব এখান থেকে??
রোদেলা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বলল– কিউট দেখতে একটি ছেলে যখন কোমল মনের একটা মেয়েকে কস্ট দেয় তখন কি হয় জানেন??
হাসনাত বুকের ওপর হাত গুঁজে বলল– কেন কি হয়??
মেয়েটা ধুম করে স্টোক করে মরে যাবে।। আর আপনি চিন্তা করেন আমার যদি কিছু হয় আপনার বিয়েতে ছাম্মা ছাম্মা গানে কে ডান্স করবে..রোূদেলা এইসব বিরবিরিয়ে বলে প্রচুর বেকাইাদায় পড়ে গেল সে..হাসনাতের চোখ মুহুর্তেই লাল হয়ে গেল.. এই গাধা মেয়ে কি কখনো ভাল হবেনা..এই মেয়ের বুদ্ধি সব হাটুর গোড়ায়!!! শুধু তরতরিয়ে বেড়ে তালগাছই হয়েছে বেকুবটা…
সে আচমকা শক্ত করে রোদেলার হাত ধরে বলল– তুই কেন আমার বিয়েতে নাচবি?? তুই নাচলে আমি বিয়েই করবো না….
রোদেলা নাকমুখ কুঁচকে হাসনাতের দিকে তাকালো আার বিড়বিড়িয়ে বলল– কেমন খাটাশ তুমি.. হাসনাত ভাই!! বিয়ের খাবার খাব বলি নি.. শুধু বলেছি নাচবো এতেই তোমার এতো প্রবলেম.. যাও তোমার বিয়েতে যাব ই না আমি….
হাসনাত চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আচমকা ওপর দিকে মুখ করে বিরবিরিয়ে বলল–ইয়া আল্লাহ,, তোমার বুদ্ধির ভাণ্ডার থেকে একচামচ বুদ্ধি এই আহাম্মকে দিয়ে দিলেই তো আজ হাসনাতের চুলগুলো বেচে যেত.. সব চুল বাতাসের সাথে ওড়ে যাচ্ছে এই গাধা মেয়ের টেনশনে… শেষে না জানি বিয়ের আগে টাকলু হয়..
রোদেলা হাসনাতের সামনে নিজের হাতটা নাড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে বলল– কি চিন্তা করছেন?? হাসনাত ভাই??
হাসনাত— হেই, ভাই ভাই করবিনা একদম.. ঘুসি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিব তোর.. আর তোর বিয়ে আমার বিয়ের দিন হবে বুঝছিস??..আর তোর জামাইকে বলে দিব তোর পায়ে শিকল পড়িয়ে দিতে যাতে বাদরের মতো লাফাতে না পারিস…যা এখন সোফায় সোয়ে পড়..আমি সোফায় আটবো না… এইবলে সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো…
রোদেলা রেগে হাত মুচড়ে বলল– আমি কি জানেন আপনি একজন শেষ্ঠ লেভেলের ফাজিল আর বেয়াদব…
হাসনাত দাত কটমটিয়ে — আই নো.. আর একটা সাওন্ড করবি তোকে বাইরে ভূতের সাথে রেখে আসবো.. ওর সাথে নাচিস.. ঘোমা এখন…
রোদেলা ভেঙ্চি কেটে ধুপ করে সোফাই শুয়ে পড়লো.. তারপর বিরবিরিয়ে হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলল– কিউট লিপসের একটা ছেলে যখন তার কিউট কিউট লিপস দিয়ে ওল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দেয়.. তখনও হুয়াট ড্রেসপড়া প্রিন্সেস কিছু মনে করেনা.. কিন্তু যখন ছেলেটি অন্য কাউকে বিয়ে করবে বলে তাও মেয়েটার বিয়ের সেইম দিনে!! তখন মেয়েটার মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছে জাগে সেইট কিউট ছেলেটিকে একশ বিচ্ছুর মাঝখানে ছেড়ে দেওয়ার. যারা কামড়ে কামড়ে লাল করে ছাড়বে তাকে…
ইফ্ফাত আর ইফতি বাইরে রাস্তায় হাটছে.. ইচ্ছেটা ইফ্ফাতেরই!! তারই ইচ্ছে হচ্ছিল পাহাড়ি আকাবাকা রাস্তায় ইফতির হাত ধরে হাটতে আর পাহাড়ের কিনারায় যেখানে নিচের স্বচ্ছ পানি দেখা যায় ঠিক সেইজায়গায় একটা বেঞ্চিতে বসে ইফতির কাধে মাথা রেখে মনরোম প্রকৃতি অনুভব করতে… নির্মল বাতাশ যখন তাদের পাশ কাটিয়ে শাঁইশাঁই করে উড়ে যাবে.. সেই বাতাসের তরঙ্গে তাদের ভালোবাসার স্নিগ্ধ তা মিশিয়ে দিতে!!
ইচ্ছাগুলো হয়তো অনেক সাধারন কিন্তু ইফতির কাছে অসাধারন কিছু মুহুর্ত!! এইজন্যই হয়তো মেয়েটির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে সবসময়!! ডুবে যাচ্ছে তার মায়ার সাগরে দিন প্রতিদিন!!! একটা সাধারন মেয়ে যার নেচারাল রুপটিই অসাধারন!! ইফতি কখনো মেয়েটিকে ভারি মেকাপ করতে দেখে নি. মাঝেমাঝে চোখের নিচে হালকা কাজল আর ঠোটে হালকা পিংক লিপিস্টিক দিয়ে সাজে সে!! এতোটুকুই তার সাজসজ্জা!! কিন্তু তার সেই কাজলকালো চোখে ডুব দিতেই যেন ইফতি ভালোবাসে.. এ কেমন মায়া তার জানা নেয় তবে যদি কেউ তার থেকে জিঙ্গেস করে তার,একটাই উত্তর হবে… ভালোলাগে….!!
ইফতি ইফ্ফাত দিকে তাকিয়ে আনমনে মুচকি হাসছিল হঠাৎ সে তামান্নাকে দেখলো কারো সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে.. সে অবাক হয়ে ইফ্ফাতকে ইশারা করলো.. ইফ্ফাত সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল— হয়তো ওর বিএফ.. আমাদের বলেছিল ওর বিএফ কে দেখাবে.. হয়তো সে…
ইফতি– তবে চল যাওয়া যাক.. নিজ দ্বায়িত্বে দেখে আসি..
ইফ্ফাত ইফতির হাত ধরে টেনে বলল– এভাবে যাওয়াটা হয়তো ভালো দেখাবে না…
ইফতি— আরে চুপ করতো.. চল…
এইবলে তারা সেদিকে হাটা দিল.. যেই ওদের সামনাসামনি দাড়ালো ইফতির মুখ অটমেটিক হা হয়ে গেল.. তামান্না অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো.. সে ইফ্ফাতকে খুঁচিয়ে বলল– কি হল??
ইফ্ফাত মৃদু স্বরে বলল– আমার দেবর এটা.. ইফতির ভাই…
ইফতি— আচ্ছা ইভান,, তলে তলে টেম্পু চালাও আর আমি জিঙ্গেস করলে বল ডিজেল শেষ!!
ইভান — আরে ভাই,, তেমন কিছু না আসলে??
তামান্না ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো!! আর সাথে সাথে ইভানের গড়গড়িয়ে উওর— আমি ওকে ভালোবাসি.. ও ও আমাকে ভালোবাসে.. তোমাদের বিয়ের জন্য ওয়েট করছিলাম.. তোমাদের পর আমরা বিয়ে করে ফেলব…
ইফতি হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে!!! এইটা কি সত্যি তার ভাই!! এতোটা ফাস্ট!! তারপর আনমনে ভাবলো— শুধু হাসনাত ভাইটাই মাঠের মাঝখানে মাদুর পেতে বসে আছে.. বাকিরা সবাই ওনাকে টপকে চলে গোল দিচ্ছে কিন্তু ওনার গোলটাই হচ্ছে না..এটা কেমন বিচার..
ইফতির মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তাদের না বলা ভালোবাসাকে এক ধাক্কা দিয়ে ওপড়ে তুলে দেয় সে।। তারপর হঠাৎ তার মাথা একটা বুদ্ধি খেলে যায় . সে মুচকি হেসে রোদেলার বাবা আর হাসনাতের বাবাকে কনফারেন্স এ কল দিয়ে তাদেরকে নিজের প্লানের কথা বলে.. তারাতো খুশিতেই মেনে নিল..
ইফ্ফাত সব শুনে ব্রু কুঁচকে বলল– রোদেলা আপু জানলে তোমাকে উল্টা লটকিয়ে দিবে.. তুমি তখন হাওয়ায় লটকে থাকলে বড়জোড় আমি তোমাকে কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে ওভাবে দোল খাওয়াতে পারবো.. কিন্তু সেইখান থেকে নামাবো না. এইবলে সে হনহনিয়ে চলে গেল… আর ইফতি ঐখানে বসে মাথা চুলকে নিজে নিজে চিন্তা করতে লাগলো— যদি আমাকে ঝুলিয়ে দেয় তাহলে ইফ্ফাতকে সহ আমার সাথে ঝুলিয়ে দিতে বলব.. তারপর হাওয়ায় হাওয়ায় দোলনা খাব… আাহা….
চলবে