ভালো তোকে বাসতেই হবে পর্ব ২৩+২৪

পর্ব ২৩+২৪
#ভালো তোকে বাসতেই হবে ❤️
#পরিধি রহমান বিথি❤️
#পর্ব-২৩

,,”মিস্টার রাত এবার বুঝবে এই সোনালী কি জিনিস!! হাড়ে হাড়ে টের পাবেন!!”

❤️
জেরিন বিছানা ছেড়ে আমার কাছে উঠে আসল । উদ্বিগ্ন গলায় বলল,,

,,”এই সোনু কি করবি তুই ,,?”

আমি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে জেরিনের গাল টেনে বললাম ,,

,,,”আগে আগে দেখো হোতাহে কেয়া!!”

রিয়াদ ভাইয়া ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করতে করতে প্রায় অজ্ঞান,,আমি আবার তার সাথে কথা বলা শুরু করলাম,,

,,,”হ্যাঁ ভাইয়া শুনতে পারছি,, শোনেন ভাইয়া আজ আমার ভাইয়ার মেহেন্দির অনুষ্ঠান। আপনি বিশেষভাবে আমার পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত। আপনাকে আসতেই হবে। কি আসবেন তো,,?

রিয়াদ ভাইয়া ছোট করে একটা হাসি দিলেন।আর বললেন,,,

,,”নিশ্চয়ই আসব।”

আমি ও উৎসাহ দেখিয়ে বলছি,,,

,,”ওকে ভাইয়া ,, আমি তাহলে আপনাকে এড্রেস মেসেজ করছি। ঠিক পাঁচটা মধ্য আপনাকে এখানে দেখা চাই কিন্তু,,(একটা হাসি দিলাম)

উনি সরল গলায় বললেন,,

,,”ওকে সোনালী,, এখন তাহলে রাখছি,,বাই।

আমি ও খুশি খুশি গলায় বলছি,,

,, “বাই”

টুত টুত,,,, ফোন কেটে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরলাম।চোখজোড়া বন্ধ। ইচ্ছে হচ্ছে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াই‌। মেঘেদের মতো ভেসে বেড়াই নীল আকাশে।মন বলছে হাড়িয়ে যাই কোনো এক অজানা দেশে। খুশি ‌আজ বাঁধ মানছে না। ভালোবাসার পরশে মাখাবো নিজেকে,,হ্যাঁ, আর কিছুক্ষণ মাত্র মিস্টার রাত,,!! আর মাত্র কিছুক্ষণ। আপনার মুখ থেকে যদি না বলিয়েছি না!! আমার নাম ও সোনালী না,,!!

রাত ভাইয়া এখানে এসে ও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যদিও বরের বন্ধু কিন্তু পুরোটা তাকেই সামলাতে হচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে চললো। বাড়ির প্রতিটা সদস্য নিজেকে তৈরি করে নিতে ব্যস্ত। আমি ও তার ভিন্নতর না। তার উপর আবার প্লেন মাফিক তৈরি হতে হবে। আবার জেরিন তো আছেই ,, কানের কাছে মাছির মতো ভ্যানভ্যান করছে।এই যেমন,, সোনালী কি করবি?,,রিয়াদ ভাইয়াকে ইনভাইট করলি কেন??,, রাত ভাইয়া তো সেদিন তোকে বলেই দিল কোনো ছেলের আশেপাশে না ভিরতে,,আজ যদি শোনে রিয়াদ ভাইয়াকে তুই ডেকেছিস,,তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস?? আমি মনে মনে বলছি,,

,,”সেটাই তো দেখতে চাই‌।”(একটা মুচকি হাসি দিলাম)

জেরিন চিন্তিত গলায় বলল,,

,,সোনু তুই হাসছিস??রাত ভাইয়া তোকে ভালোবাসে এটা শুনে তুই পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি??

আমার এবার খুব বিরক্ত লাগছে ওর কথা। যদিও মানুষ অতি খুশিতে আর অতি দুঃখে পাগল হয়। তবে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।তাই জেরিনের মাথায় একটা চাটি দিয়ে বললাম,,

,,”আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ইডিয়ট। তুই চুপচাপ রেডি হো।আর যদি একটা কথা বলেছিস না ,,একদম ছাদ থেকে ফেলে দেব।”

জেরিন মোটামুটি চুপ হল। আমি রাত ভাইয়ার দেওয়া সেই নীল শাড়িটা পড়েছি ,, হাতে নীল কাঁচের চুড়ি মধ্যে একটা সোনালী রঙের চুড়ি,, চুলগুলো খোলা (রাত ভাইয়ার ফেভারিট) হালকা মিষ্টি কালারের লিপস্টিক আর কাজল কালো চোখ।কানে এন্টিক ঝুমকো। সোনালী রেডি রাতের জন্য। জেরিন ও রেডি । খুব সুন্দর লাগছে তবে ওর সৌন্দর্য বর্ণনা করার সময় নেই আমার আর না আছে ইচ্ছা। একটু পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে। জেরিন দের হলে সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। আমি রুম থেকে বের হতেই চিপকুর সাথে দেখা।সিম্পল লেহেঙ্গা আর ওড়নাটা একপাশে পিন আপ করা উইথ এক কেজি আটা ময়দা মুখে মাখা।এ কখনো রাত ভাইয়ার পছন্দ হতে পারে না। দেখে মনে হচ্ছে কাউকে খুজছে।আমাকে দেখেই একপা দু’পা করে এগিয়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়েই বলে উঠলেন,,

,,”সোনালী,,?? রাতকে দেখেছ?? সেই কখন থেকে খুঁজছি কিন্তু খুঁজেই পাচ্ছি না!”

আমার এই চনমনে মেজাজটায় ,,ফুলকো বেলুনে পিন মেরে গ্যাস বের করে দেওয়ার মতো পিন মেরে দিল।আর কোনো কাজ নেই ।এই মেয়েটার সব সময় রাত ভাইয়ার আগে পিছে ঘুরে বেড়ায়। সেদিনের চুইংগামের পরেও শিক্ষা হলো না। তবে বেচারীর দোষ না।সে তো আর জানে না কোন দোষে তার শাস্তি হয়েছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলাম,,

,,”ভাইয়া কোথায় সেটা আমি কি কোরে জানবো? আমি কি রাত ভাইয়ার এসিস্ট্যান্ট??(বলে আই নিচে হলের দিকে হাঁটা দিলাম। এখানে থেকে বিরক্ত হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই)

হলটা আজ অসাধারণ লাগছে।মনে আনন্দ থাকলে খারাপ কিছু ও ভালো বলে মনে হয়। তবে এখানে পুরোপুরি সুন্দরের ভান্ডারে পরিণত হয়েছে।প্রোঃ হলটা তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। তার সাথে মিষ্টি আর সাদা রঙের কম্বিনেশনের নেট।সব মিলিয়ে অপূর্ব । তার থেকে ও অপূর্ব রাত ভাইয়া।কালো রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ুয়া,,হাতা বাজ করা রাত ভাইয়াকে দেখে আমি মুগ্ধ।ধলা কদু মার্কা একটা ছেলে,, তার ফর্সা সুঠাম দেহের এমন ঝলক দেখলে পাগল হওয়া বাঞ্ছনীয়।চিপকুর আর দোষ কি এই লোকটাই তো সব নষ্টের গোড়া। এমন সেজেগুজে বেরোলে মেয়েরা আর কি করবে??একা আমি না এখানে যত মেয়ে আছে তারা সকলেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি যে এতো সুন্দর করে সাজলাম যার জন্য সেই রাত ভাইয়া আমাকে দেখে ও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিল। মেজাজটা চড়া হয়ে গেল। তখনই গেট দিয়ে এন্ট্রি মারল আমার প্লেনের গুটি রিয়াদ ভাইয়া।রাত ভাইয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে,, একটা জোরে চিৎকার করে উঠলাম রিয়াদ ভাইয়া বলে।তাকে দেখে যেন আমি অসম্ভব খুশি,,

,,”রিয়াদ ভাইয়া আআআআ ,,,,,,,,,,,,, কেমন আছেন??(একবার আড়চোখে রাত ভাইয়াকে দেখে) আমি সেই কখন থেকে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম (ন্যাকামি করে)।”

রাত ভাইয়া দূর থেকে তীক্ষ্ণ নজরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওনার হাতের মোবাইলটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। মোবাইলের যদি প্রান থাকতো তাহলে হয়তো এতক্ষণে বেচারা শ্বাস রুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতো। তবে সে যাই করুক তাতে আমার কি?? আমি তো মহাখুশি রিয়াদ ভাইয়াকে পেয়ে। এমন একটা ভান করে রিয়াদ ভাইয়ার হাতটা ধরে টেনে ভেতরে আনছি আর বলছি,,

,,রিয়াদ ভাইয়া আসুন আসুন ভেতরে আসুন।(মনে মনে আমার খুব খুশি লাগছে রাত ভাইয়ার ওই ভোঁতা মুখটা দেখে)

রাগলে না এই লোকটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে।রাগে রাত ভাইয়ার ফর্সা গাল দুটো লাল ডহয়ে গেছে।আর রিয়াদ ভাইয়ার হাত ধরে টেনে আনা দেখে হাতের ফোনটা আছাড় মারল মেঝেতে। তবে আমি খুশি। এটাই তো চাইছি। ইচ্ছে করছে রাত ভাইয়ার গালটা টেনে দি।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে একঘন্টা হতে চলল। আমি পুরো দুই হাতে মেহেদি পরেছি।রিয়াদ ভাইয়াকে পাশে বসিয়ে রেখেছি পুরো সময়টা। আর মজার ব্যাপার হলো যেই রাত ভাইয়াকে সারাদিন রাত ভাইয়াকে এক ঝলক ও দেখা যায় নি ,,সে সেই সন্ধ্যা থেকে আমার দিকে নজর এঁটে বসে আছে। চোখে মুখে তীব্র রাগ স্পষ্ট। কেউ ওনাকে এখান থেকে নড়াতে পারে নি। উল্টো যে এসেছে সেই তোপের মুখে পড়েছে।সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের উপর আছড়ে পড়েছে। আমি তো খুশি আমার প্লেন মাফিক সব চলছে। আমার মেহেদী পড়া শেষ।রিয়াদ ভাইয়া আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। বেশজোড়ে গান বাজছে। অনেকে নাচানাচি ও করছে।এমন সময় আমি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলাম,,,

,,,রিয়াদ ভাইঢয়াআআঅঅঅ,,,!!ওফফফ,, দেখুন না আমার চোখে কি যেন চলে গেছে ,,উফফ,, খুব জ্বলছে,, দেখুন না??(হাত পা ছড়িয়ে লাফালাফি করছি)

রিয়াদ ভাইয়া খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। আমার চোখের পাতায় হাত রেখে চোখ টেনে ধরে আমার চোখের কাছে নিজেকে মুখ এনে ফু দিতে লাগলেন।আর বলছেন,,

,, সোনালী কিছু তো দেখতে পারছি না। তাহলে তোমার অসুবিধে ,,,,,,

আর কিছু বলতে পারেনি তার আগেই রাত ভাইয়া তীব্র বেগে আমার দিকে এগিয়ে এলেন আর আমার দাঁত থুরি হাত(দাঁত ধরে আবার টেনে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি) টেনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে ছাদে নিয়ে ফেললেন। ছাদের দরজা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।চোখ আগুনের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।এমন কিছু রাত ভাইয়া করবে এর আশা আমি করিনি। খুব রেগে আছেন।আজ আমার খবর আছে। কিন্তু আমি কি করেছি তা আমি জানি না। আমি অবুঝ বালিকার মতো বলছি,,

,,রাত ভাইয়া কি হচ্ছে টা কি?? এভাবে টেনে এখানে আনার মানে কি??(আমি এখন চড়ম বিরক্ত)

রাত ভাইয়া তীব্র গলায় চেঁচিয়ে বলল,,

,,ও,, আমার সাথে এখানে আসতে তোর প্রবলেম না? আর এতোক্ষণ যে রিয়াদের সঙ্গে লেপ্টে ছিলি তখন??

আমি আরো একটু অভিনয়ের মাত্রা বাড়িয়ে। বিরক্ত গলায় বললাম,,

,,”আপনি এসব কি বলছেন।রিয়াদ ভাইয়াকে আমি ভালোবাসি ,, তার সাথে আমি যেমন খুশি তেমন থাকব তাতে আপনার কি??

ঠাসসসসস,,বলার সাথে সাথে আমার গালে ভালোবাসা পর আছড়ে পরল। খুব জোরে মেরেছে ,, পাঁচটা আঙুল গালে বসে গেছে। আমি গাল ধরে ছলছল চোখে মাটিতে বসে তাকালাম রাত ভাইয়ার দিকে।রাত ভাইয়া রাগী গলায় বললেন,,

,,, ভালোবাসা আজ তোকে ভালোবাসা দেখাচ্ছি।

আমার দুই বাহু ধরে ছাদের দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলেন শক্ত করে।মনে হচ্ছে এখনই মাংস গলে গলে পড়বে।ব্যাথায় আমি কুঁকড়ে উঠলাম।উনি একদম আমার মুখের কাছে এসে গেছেন।আমার চোখ ফেটে অশ্রু পড়ছে।রাত ভাইয়ার সেদিকে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। খুব অস্থির উনি। ঘনঘন বড় ড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হয়তো কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারিনি আমার বোকামোর পরিণত এমন হতে পারে।যা করে ফেলেছি তা আর ভেবে লাভ কি? বরং যা হচ্ছে তা সামাল দেই। আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু আমাকে তো ওনার মুখ থেকে কথা বের করতে হবে।তাই আবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,,

,, আমার ব্যাথা লাগছে ছাড়ুন আমায়। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি এটা শুনে আপনি এমন করছেন কেন?? আপনি ও তো অন্য কাউকে ভালোবাসেন। আমি তো আপনাকে কিছু বলিনি (নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।)

রাত ভাইয়া আরো জোরে চেপে ধরেছেন।আর দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে। তার ঠান্ডা নাকটা আমার গালে চেপে ধরে বললেন,,

,,ভালোবাসি খুব ভালোবাসি ,, আমি যে শুধু তোকে ভালবাসি।আর আমার একমাত্র ভালোবাসা তুই।(একটু শক্ত গলায় ) আর আমাকে ভালো তোকে বাসতেই হবে।শুনেছিস তুই ,,? ভালো তোকে বাসতেই হবে।আই লাভ ইউ সোনাপাখি আই লাভ ইউ❤️।(চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে)

ওনার ভালোবাসি কথাটা শুনে আমি একদম পাথ হয়ে গেলাম‌। পৃথিবীতে এতো সুন্দর করে কাওকে ভালোবাসি কথাটা বলা যায়,,না শুনলে হয়তো জানতাম না। আমার কান্নার মাত্র বেয়ে গেল। পরক্ষনেই নিজেকে একটু শক্ত করে নিলাম। মুখে মুচকি একটা হাসি এনে।রাত ভাইয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,,

,,আই লাভ ইউ টু রাত ভাইয়া(রাত ভাইয়া আমার কথা শুনে থ মেরে গেল। আমি ওনার চোখের সামনে এসে একটা চোখ মারলাম,, আর বললাম,,

,,কি কেমন দিলাম ?? মিস্টার রাত,,??

#পর্ব-২৪

,,কি কেমন দিলাম ?? মিস্টার রাত,,??

❤️
রাত ভাইয়া বোধহয় থতমত খেয়ে গেল।উনি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন,,,

,,”মানে?? তুই এসব কি বলছিস?? তুই না একটু আগে বললি তুই রিয়াদকে ভালোবাসিস?? তাহলে এটা কি ছিল??

আমি একটু অস্বস্তি দেখিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বললাম,,

,,সব বলব ,, আগে আমার হাত দুটো ছাড়ুন। আপনার হাত না যেন হাতুড়ি,,।”

রাত ভাইয়া অপরাধবোধ নিয়ে আমার দিকে তাকালো । এতক্ষণের খারাপ ব্যবহারটা হয়তো তার অপরাধবোধে কারন। আলতো করে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা আমায় কোলে তুলে নিলেন। আমার চোখগুলো ছানাবড়া হয়ে গেল এমন কিছু করবে তার প্রত্যাশা করিনি।রাত ভাইয়া একটু লজ্জা ও পেলেন না একদম শক্ত স্বাভাবিক মানুষ।উনি যে একটা উনিশ বছর বয়সী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছেন সে দিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওদিকে আমি তো লজ্জায় শেষ। লজ্জায় মুড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার চোখ,, মুখ ,, ঠোঁট শুধু কাঁপছে।ছাদে মরিচ বাতির সোনালী আলোয় উনি ঠিক আমার এই কাঁপা কাঁপা মুখটা হয়তো দেখতে পাননি। আমার ও চোখ বন্ধ। লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না।একটু পড়ে রাত ভাইয়া আমাকে ছাদের দোলনাটায় বসালেন। আমি ও চোখ খুললাম।রাত ভাইয়ার দিকে তাকানোর ইচ্ছে থাকলেও সাহসে কুলাচ্ছিল না। আমাকে বসিয়ে উনিও আমার পাশে বসলেন। আমি ভেবেছিলাম এবার বোধহয় উনি জিজ্ঞেস করবেন ,,,

,,”তারপর কি হলো বল??”

কিন্তু না ,,উল্টো রাত ভাইয়া হালকা মৃদু স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,,

,, “আইসক্রিম খাবি??”

যেকোনো মুহূর্তে আইসক্রিম ,, ফুচকা,, ভেলপুরি ,,এসব জিনিসকে না করা যায় না।নাম শুনলেই ,,”ইসসসসসস,,”জিভে পানি চলে আসে।আর এটা তো আমার ভালো সময় ছিল ।বলা যেতে পারে স্বরনীয় মুহূর্ত। আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাব তখন নাতি নাতনি দের বেশ জমিয়ে গল্প করবো। কিভাবে এমন একজন খারুসের কাছ থেকে ভালোবাসার কথাটা বের করেছি বুদ্ধি খাটিয়ে।কি যে মজা হবে তখন।রাত ভাইয়া একটু বিরক্তি নিয়ে আমার মুখের সামনে হাত নেড়ে বললেন,,

,,”কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলি??বল আইসক্রিম খাবি?? আমি ও খাব।”

রাত ভাইয়ার মুখে এমন একটা কথা মানায় না যদিও কারণ শুরু থেকেই উনি খুব হেলথকন্সিয়াস।তবে আমি খুশিই হলাম।আর একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথায় নাড়ালাম।যার অর্থ হচ্ছে,,হ্যাঁ আমি আইসক্রিম খাবো।রাত ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিয়ে যেন কাকে ফোন করলেন।আর বললেন দুটো আইসক্রিম নিয়ে যেন সরাসরি ছাদে চলে আসে। রাত ভাইয়া ঠাস করে আমার কোলে শুয়ে পরলেন। আমি বেশ অবাক হলাম। কোনো কথা বার্তা ছাড়াই কোনো ব্যাক্তি এমন আচরণ করলে তো অবাক হওয়ারই কথা।রাত ভাইয়া খুব স্বাভাবিক ।যেন কিছুই হয়নি হঠাৎ উঠে বসে বললেন,,

,, এবার বল তারপর কি হলো??

আমি সংকোচবোধে ভুগছি‌।তাই লজ্জা রাঙ্গা মুখে আমতা আমতা করে শুরু করলাম ধীরে ধীরে পুরোটা খুলে বললাম। পুরো ঘটনাটা শুনে রাত ভাইয়া হাসিতে লুটিয়ে পড়েছে। খোলা আকাশের নিচে বসে আছি।তাই মনে হচ্ছে আকাশ কাঁপিয়ে হাসছেন উনি। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি রাত ভাইয়ার দিকে।,,ওফফ,,,এই লোকটা আমার মেরেই খান্ত হবে!!,,গালে হাত দিয়ে ঘার কাত করে ওনার অসাধারণ হাসি দেখছি। মাতাল করা সেই হাসি। মনে হয় এই হাসির জন্য সবটুকু বিলিন করে দেওয়া যায়। হঠাৎ হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললেন,,

,,, এভাবে তাকিয়ে থেকো না সোনাই ,,, নিজেকে যে সামলাতে পারবো না,,”(বলেই আমার হাসতে লাগলেন)

আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বসে রইলাম। মনে মনে ভাবছি ,,রাত ভাইয়া কি বলে ডাকলেন আমায়??,,”সোনাই,,”মনের মধ্যে কেমন যেন করছে।এতো ভালোবাসা নেওয়া যাচ্ছে না।হার্ট বিট বারছে। নার্ভসের আপডাউন বারছে। আমার শরীরের ভিতরের ফাংশানের এই অবস্থা তাহলে বুঝুন বাইরের কি অবস্থা??এমন সময়‌ ছাদের দরজায় টোকা পড়লো। আমি কেঁপে উঠলাম।রাত ভাইয়া আর আমি শুধু ছাদে।এমন সময় আমাদের কেউ ছাদে দেখলে রিতিমত লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে যাবে।তাই বেশি ভয় পেলাম। হঠাৎ রাত ভাইয়া উঠে দরজা খুলে দিলেন।রাত ভাইয়া খুব স্বাভাবিক। দরজা খোলা মাত্রই সুরসুর করে রিয়াদ ভাইয়া দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ।হাতে দুটো আইসক্রিম। তার মানে রাত ভাইয়া রিয়াদ ভাইয়াকে আইসক্রিম আনার জন্য ফোন করেছিলেন।রিয়াদ ভাইয়া বেশ খুশি।রাত ভাইয়ার হতে আইসক্রিম দিয়ে হালকা গলায় প্রশ্ন করলেন,,

,,স্যার আর কিছু লাগবে?

রাত ভাইয়ার মৃদু গলায় বললেন,

,,”না আর কিছু লাগবে না।”

কথাটা বলা মাত্রই রিয়াদ ভাইয়া দরজা ঢেলে বাইরে চলে গেলেন।আর রাত ভাইয়া আইসক্রিম নিয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসলেন। বিষয়টা দেখে আমার খুব হাসি পেল।রিয়াদ ভাইয়া এমনভাবে বললেন ,,”আর কিছু লাগবে স্যার??”যেন উনি একজন ওয়েটার আর আমরা কোন ফাইভ স্টার হোটেলের রুমে বসে আছি। ব্যাপারটা কি হাস্যকর!! কিন্তু এটা হাসার সময় না।রিয়াদ ভাইয়াকে ফোন করার আগে তো রাত ভাইয়া পুরো ঘটনাটা জানতেন না,, তাহলে আমার সাথে যতটা রাগ দেখালেন রিয়াদ ভাইয়াকে তো উল্টো আইসক্রিম নিয়ে ডাকলেন।কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।রাত ভাইয়া আমার ভাবনায় ছেদ করে একটা আইসক্রিম এগিয়ে দিলেন আমার দিকে আর ঠোট কাঁপিয়ে বললেন,,

,,”কি ভাবছো? রিয়াদের উপর আমি রাগ করলাম না কেন? (ভ্রু নাচিয়ে)

আমি হকচকিয়ে উঠে বললাম,,

,”,হ্যাঁ,,না মানে ,,হ্যাঁ,,।”

রাত ভাইয়া ছোট একটা হাসি দিয়ে বললেন,,

,,”এখনই এতো অবাক হচ্ছো?? বাকিটা শুনলে কি হবে??

আমি বেশি অবাক উনি কথায় কথায় আমায় তুমি বলে সম্বোধন করছেন। কোনো প্রিয় ব্যাক্তি তুমি করে বলবে এটা স্বাভাবিক । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই বিষয়টা অত্যন্ত ভয়ংকর লাগছে।রাত ভাইয়া সব সময় আমাকে তুই করে বলেছেন।আজ হঠাৎ তুমি?? এটা ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কি?? তবে ওনার মুখে বলা প্রতিটা শব্দ আমার মনের ঘন্টায় নাড়া দিচ্ছে।তাই এতোটা হতভম্ব আমি।রাত ভাইয়ার কথাটা কানে যেতেই আমি রাত ভাইয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম,,।রাত ভাইয়া দুহাত ছড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বলছেন,,

,,বুঝলে সোনাই,,, তুমি যখন আমার ফোনটা না নিয়ে এসে অন্য কাওকে দিয়ে ফোন পাঠালে তখন আমার একটু সন্দেহ হলো।করন যে রাতের এক ঝলকের জন্য মেয়েরা যা কিছু করে সেই রাতে ফোন তুমি নিজে না নিয়ে এসে অন্য কারো কাছে পাঠিয়ে দিলে।তাই আমি ভালো করে ফোনটা চেক করলাম।চোখে পড়ল “MY LIFE”❤️ এর একটা কল। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে আপনি পুরোটা আঁচ করতে পেরেছেন।এ বাড়িতে পৌঁছানোর ১৫-২০মিনিট পর কল এলো রিয়াদের।কি কথা হলো তাও বলল আর তুমি যে ওকে আসতে বলেছো তাও জানালো। তারপর জিজ্ঞেস করল ,,রিয়াদ আসবে কিনা?? আমি জানতাম তুমি কোনো বোকা প্লেনিং করেছো। কিন্তু দেখতে চাইছিলাম কি?(আমার গালে হাত রেখে ,,আমার দিকে গভীর ভাবে তাকালেন)তাইতো বিকালে আমার নীলাঞ্জনাকে দেখেও না দেখার ভান করতে হলো। তবে না দেখেছি ভালোই হয়েছে
।আর বেশি দেখলে হয়তো অপূর্বর পরিবর্তে আমাদের বিয়ে হতো।”(গাল ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রইলেন)

আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। লোকটা কি ডেঞ্জারাস,,!!আমি ওনার কথা গুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত এক চোখে তাকিয়ে ছিলাম।কি জিনিস?? আমি কোথায় প্লেন করলাম ওনাকে ঘোল খাওয়ানোর ,, উল্টো উনিই আমাকে ঘোলের সাগরে ডুবিয়ে মারলেন,, নিজের উপরই নিজের বিরক্ত লাগছিল।,,ছি সোনালী ,,ছি,, একটা প্লেনিং ও ঠিক করে করতে পরলি না??উনি তো দেখছি উনি আগে থেকেই পুরোটা জানতেন।(হঠাৎ আমার মাথায় আর একটা কথা কড়া নাড়লো)উনি যখন পুরোটা জানতেন তাহলে আমাকে চড় দেওয়ার দরকার কি ছিল?? আমাকে আবার অবাক করে দিয়ে রাত ভাইয়া বলে উঠলেন,,

,,”কি ভাবছো তোমাকে মারলাম কেন??করণ এমন একটা বোকা প্লেনিং করলে যেখানে অন্য কোনো ছেলে তোমার গালে স্পর্শ করছে।তাই এটা ছিল তোমার ছোট শাস্তি।”

আমার বেশ অভিমান হলো। আমি অভিমানী সুরে বিরক্ত গলায় বললাম,,

,,হমমম,, আমাকে শাস্তি দেয়।আর উনি যে সারাদিন চিপকুর সাথে চিপকে থাকে তখন কিছু হয় না,,??(ভ্রু কুঁচকে)

রাত ভাইয়া বোধহয় একটু হতবাক হলেন।হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,

,,”আচ্ছা একটা কথা বুঝলাম না ,,এই চিপকুটা কে??”

আমি খিক করে হেসে দিলাম,,। ঝলমলে চোখে বললাম,,

,,আরকি প্রিতি আপুকে আমি চিপকু নাম দিয়েছি। আপনার সাথে চিপকে থাকে তো তাই!!”

রাত ভাইয়াও খিলখিল করে হেসে দিলেন। আস্তে করে আমার কানের কাছে আনলেন তার মুখটা। ওনার নিঃশ্বাসের গরম স্পর্শে আমি শিউরে উঠলাম।ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,,

,,”আরে সোনাপাখি ওটাটো তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য।যাতে বুঝতে পারো তুমি আমায় ঠিক কতটা ভালোবাস।”

ওনার প্রতিটি নড়নচড়নে আমি দিশেহারা হয়ে যাই ।তার উপর অবাকের পরে ও অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার নাকের নিচ থেকে এতো কিছু হচ্ছিল আর আমি কিছুই জানিনা?? এতোক্ষণে আমার হাতের আইসক্রিম গলে টপ টপ করে নিচে পরছে।এটা আর খাওয়ার অবস্থায় মোটেও নেই ‌।তাই কি করব ভাবছিলাম রাত ভাইয়া এটোটা সখ নিয়ে আইসক্রিমটা আনলেন,আর সেটা কিনা গলে গেল??একটু ইতস্তত বোধ করছি।এমন একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রাত ভাইয়া আকাশ ছেড়ে আমার দিকে তাকালেন তারপর আইসক্রিমের দিকে।আর কোমল গলায় বললেন,,

,,”ছেড়ে দাও ।ওটা আর খেতে হবে না।আমরা একদিন রাত জেগে ছাদে পায়চারি করব আবার কিছুক্ষণ দোলনা তুমি বসবে আর আমি তোমার কোলে শুয়ে মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখব। কেমন?

আমি ও খুশি খুশি মুখে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। আমার এক ঘন্টা জাবত ছাদে । আমাদের তলপ যে একখনো কেউ করেনি তা বলা মুশকিল। তাই রাত ভাইয়াকে বললাম,,

,, ভাইয়া আমাদের বোধহয় এখন নিচে নামা দরকার ,,না হলে খোঁজাখুঁজি শুরু হতে পারে।”

রাত ভাইয়া যে থাপ্পড়টা মেরেছে তার দাগ ও তলিয়ে গেছে কিন্তু রাত ভাইয়ার চোখের সেই অপরাধবোধ কমেনি।তাই ছলছল চোখ নিয়ে বড় কষ্টে ঠোঁটে কোনায় একটা হাসি টেনে আমার দিকে তাকালেন।হাত দুটো আলতো করে ছুয়ে দিল আমার গাল । খুব হালকা সেই স্পর্শ। আমি অবাক চোখে তাকালাম।উনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,,,

,,সোনাই আমাকে ক্ষমা করে প্লীজ ,,। আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে চাইনি(সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত দিয়ে ঘুষি মারলেন দোলনার স্ট্যান্ডের সাথে)

হাত কেটে রক্ত পরছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না কি করব ,,।রাত ভাইয়া এমন কিছু করবে এ আমার ভাবনায় ও আশেনি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বুকের ভিতর থেকে কে যেন ঢিল ছুড়ে আহত করছে আমাকে।চোখ ফেটে কান্না আসছে। এবার আমি খুব কাঁদছি।চোখ মুখ বাঁকিয়ে কাঁদছি। এটা হল শব্দ ছাড়া কান্না শ্ রাত ভাইয়া আবার বলা শুরু করলেন,,

,,”সোনাপাখি আমাকে ক্ষমা করে দিও । প্লীজ সোনাপাখি,, প্লীজ,,”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই রাত ভাইয়ার হাতটা ধরলাম। আমার চোখ বেয়ে পানি করছে। শুধু ভাবছি,,সব তো ভালোই চলছিল তাহলে এসবের দরকার কি ছিল??রাত ভাইয়া আমার কান্না শুনতে না পেলেও অনুভব করতে পেরেছে।উনি সরল গলায় বলছেন ,,

,,”তুমি কাঁদছো?? তুমি কেঁদো না সোনাই,, প্লীজ তুমি কেঁদো না। আমি যে তোমার কান্না সহ্য করতে পারি না।””

,,,চলবে,,??❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here