গভীর রাত চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধা ছেঁয়ে আছে। কোথাও কোন জনমানবের চিন্হটুকুও দেখা যাচ্ছে না। শুধু রাত জাগা কিছু পাখি ও পোকামাকড় এর কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সাথে বহু দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের সেই লোমহর্ষক কান্নার শব্দ। যা শুনে যে কারো ই ভয়ে কলিজা কেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু এর মাঝেও পুরো বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে সারা শরীরে জরানো গয়নাগাটি এবং বেনারসি পড়ে সিলেটের পাহাড়ি এলাকার নিরব রাস্তা ধরে দৌড়ে চলেছে একটি মেয়ে। এই শীতের রাতেও সারা শরীর ঘেমে একাকার তার। সে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়ে চলেছে সামনের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গিয়ে নিজের প্রান বাঁচাতে সামনে এগিয়ে চলেছে সে। এভাবে অনেকটা পথ দৌড়াতে দৌড়াতে সে একটি পাথরের সাথে উস্টা খেয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গেলো। পড়ে যাওয়ার কারণে তার হাত অনেকটা কেটে গিয়ে ঝমঝমিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো সেখান থেকে।
মেয়েটি সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে পড়ে যাওয়ায় পায়ে ও অনেক ব্যথা পেয়েছে সে। তাই উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হল না। পায়ে হাত দিয়ে আবারও বসে পড়ল। হাতের কেটে যাওয়া জায়গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে চমকে উঠল সে। তাড়াতাড়ি রক্ত বন্ধ করার জন্য অন্য হাত দিয়ে কেটে যাওয়া হাতটা চেপে ধরলো। আর মনে মনে বলতে লাগল,
— ইয়া আল্লাহ এখন আমার কি হবে! এ রক্ত টাই তো আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
কথাটা বলতেই দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল মেয়েটির। সে বসে থেকে আশেপাশে তাকাতে লাগল আর জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। অনেকটাই হাপিয়ে গেছে সে এতটা পথ দৌড়ানোর কারণে। চারিদিকের পরিবেশটা হঠাৎ করে অনেক বেশি ভারী হয়ে এল। সেই সাথে একটি দমকা ঠান্ডা হওয়া এসে ছুয়ে গেল মেয়েটির শরীর। মেয়েটির আর বুঝতে বাকি রইল না যে এখন ওর সাথে কি হতে চলেছে। তখন’ই ওর সামনে এসে দাঁড়াল দুজন মানুষ। তাদের আসলে মানুষ বললে ভুল হবে। কেননা তাদের দেখে মানুষ বলে মনেই হচ্ছে না। তাদের দুজনেই রয়েছে কালো লম্বা জ্যাকেট পরে। তাদের হাতের নখগুলো ভিষন লম্বা ও ধারলো। সাথে মুখের মধ্যে রয়েছে লম্বা দুটি ভিষন সরু ও ধারালো দাঁত। চোখ গুলোর মনিগুলো যেনো অন্ধকারেও আগুনের মত জলজল করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেনো ওদের চোখের জায়গায় এক খন্ড করে আগ্নেয়গিরির লাভা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। লোকগুলোকে দেখে ভয়ে ছেচরিয়ে ছেচরিয়ে পিছন দিকে পিছাতে লাগলো মেয়েটি।
ওকে এভাবে ভয় পেতে দেখে সামনে থাকা লোক দুটো বিশ্রীভাবে অট্টস্বরে একটা হাসি দিল। তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল মেয়েটির দিকে। তাদের মুখ দিয়ে টপটপ করে লালা গড়িয়ে পরছে মেয়েটির গলার দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তে যেন এসে মুখের সরু দাঁত দুটো বসিয়ে দিবে মেয়েটির গলায়। একপা করে এগোতে এগোতে একসময় লোক দুটি ধরে ফেলল মেয়েটিকে। মেয়েটি প্রাণভয়ে শেষ বারের মত জোরে একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তখনই ঐ দুজনের মাঝের একজন তার গলায় নিজের সরু দাঁত গুলো বসিয়ে দিল। মেয়েটির গলার তিব্র ব্যথায় ধীরে ধীরে সেন্সলেস হয়ে যেতে লাগল। সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন প্রবল বেগে বাতাসের মতো কিছু একটা এসে সেই দুজনকে দুই দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে কোথায় যেনো উড়ে চলে গেল। মেয়েটির চোখ খুলে দেখার মত শক্তি ও খুঁজে পাচ্ছে না। এই অল্প কিছুক্ষণ সময়েই যেন তার শরীরের অনেক রক্ত চুষে নিয়েছে সেই লোকটি। মেয়েটি নিজের সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে অনেক কষ্টে কোনমতে চোখটা খুলে তাকালো। তাকাতেই তার সামনে একটি চেহারা ভেসে উঠলো। ঠিক চেহারা নয় শুধু চোখ দুটোই দৃশ্যমান। চোখ দুটোর মাঝের মণি দুটো গাঢ় নীল রঙের এবং জ্বলজ্বল করছে। মাথার চুলগুলো গোল্ডেন রঙের এবং অনেক সিল্কি। যা বাতাসের সাথে উড়ে চলেছে আপন-মনে। আর গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা। এতটুকু দেখেই মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আর তাকিয়ে থাকতে পারল না কোনোভাবেই। সে শক্তিটা ও যেন মেয়েটির মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই।
মেয়েটিকে নিয়ে একটি বড় হসপিটালের সামনে গিয়ে থামল ছেলেটি। তারপর হসপিটালের সামনের ফ্লোরে মেয়েটিকে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় নিজের ডান হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু একটা বলল। সাথে সাথে মেয়েটির গলায় ক্ষত স্থানে একদম আগের মত সেড়ে উঠলো। অতঃপর হাতে থাকা কাটা জায়গায় একই ভাবে সারিয়ে দিল ছেলেটি। তারপর মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেয়েটির গলায় থাকা একটি চমৎকার লকেটের দিকে হাত বাড়ালো। লকেট স্পর্শ করার সাথে সাথে আচমকাই ঐ লকেট থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো নীল এক আলোকরশ্মি। যা সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা রাখে। এত রাতে হসপিটালে থাকা গার্ড ঐ আলোকরশ্মি দেখে ফেলে ওদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল,
— কে ওখানে? ওখানে কি হচ্ছে, কে ওখানে দাড়াও বলছি!
গার্ডকে এগিয়ে আসতে দেখে সেই ছেলেটি মেয়েটির গলায় থাকা লকেটটা ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ হাওয়ার বেগে কোথাও একটা চলে গেল। তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না সেখানে। গার্ড দ্রুত এগিয়ে এসে মেয়েটিকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আশেপাশের সবাইকে ডাকাডাকি করতে লাগলো।
——————–
সকালবেলা জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করল মেয়েটি। টিপটিপ চোখে আশেপাশে তাকিয়ে ওর আর বুঝতে বাকি রইল না যে ও এখন হসপিটালে আছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না ও জঙ্গল থেকে এখানে এলো কিভাবে? তখনই গতরাতের সমস্ত কথা একে একে মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়তেই যেন শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। সারা শরীর কুঁকড়ে উঠল ভয়ে। আশেপাশে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে ভয়ে ভয়ে উঠে বসে ভাবতে লাগলো গত রাতের কথা। গত রাতটা ছিল ওর জীবনের সবচাইতে কালো রাত। যে রাতে ও ওর নিজের পরিবার সহ সমস্ত আপনজনকে হারিয়ে ফেলেছে। একদম নিঃস্ব হয়ে গেছে ও। নিজেকে জীবিত অবস্থায় দেখে যেন রাগ হচ্ছে ওর। কালকে সত্যি সত্যি ঐ ভয়ানক লোকদের হাতে মরে গেলেই হয়তো ভালো হতো। এভাবে একা বেঁচে থেকে কি লাভ? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কান্না করতে লাগল মেয়েটি। দুচোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার।
তখনই সেই কেবিনে প্রবেশ করল একজন ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সি নার্স। ওকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে নার্সটি পাশে এগিয়ে এসে বললো,
— এখন কেমন আছেন আপনি? আপনার জ্ঞান ফিরলো কখন?
তার উত্তরে নিজের চোখের পানি মুছে ওনার দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে মেয়েটি বলল,
— আমি এখানে এলাম কিভাবে? কে এনেছে আমায় এখানে?
— সেটা তো আপনার কাছ থেকেই আমি জানতে চাই। আপনাকে কে এনেছে বা আপনি কিভাবে এখানে এসেছেন? আপনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন’ই বা কেন? কালকে মাঝরাতের সময় আপনাকে এই হসপিটালের সামনে পাওয়া গেছে সেন্সলেস অবস্থায়। তাও আমার সম্পুর্ন বিয়ের সাজে সাথে অনেকগুলো টাকা ও একটি চিঠি সহ।
অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওনার দিকে মেয়েটি। তারপর বলে উঠলো,
— হ্যা আমি বিয়ের সাজে ছিলাম এটা আমার মনে আছে। কিন্তু আমার কাছে তো কোন টাকা পয়সা ছিল না। আর কোনো চিঠিও না। তাহলে আপনি টাকা-পয়সা আর চিঠি কোথায় পেলেন?
নার্স ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে বললো,
— আচ্ছা দাঁড়াও আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট হবে তাই তুমি করে বললাম কিছু মনে করো না। একটু ওয়েট করো।
কথাটা বলে নার্সটি উঠে কোথায় যেন চলে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পরে একটি ব্যাগ আর একটি চিঠি নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো মেয়েটির। তারপর সেটা ওর কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— এটা পড়ে দেখো তাহলেই সব বুঝতে পারবে! আর এই ব্যাগটার মধ্যে তোমার অনেকগুলো টাকা ও গায়ের গহনাগুলো রয়েছে। যেগুলো তোমার সাথেই পাওয়া গিয়েছিলো।
ওনার হাত থেকে চিঠি ও ব্যাগটা নিয়ে ব্যাগ টা পাশে রেখে চিঠি পড়তে শুরু করল মেয়েটি। তাতে লেখা,
” আমি এই মেয়েটির একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। মেয়েটি ভীষণ অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওর কাছে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা রেখে গেলাম। আমি কোনো একটি কারণে এই মুহুর্তে কারো সামনে আসতে পারলাম না। তবে আশা করি এই হসপিটালে ওকে ভালো চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হবে। আর ওর যাবতীয় টাকাও ও সুস্থ হলে ওর কাছে হস্তান্তর করা হবে। আর একটা কথা কেউ ভুলেও এই টাকা পয়সার লোভে পড়ে ওর সাথে এমন কিছু করো না যার জন্য আমাকে সবার সামনে আসতে হয়। কারণ আমি যদি সবার সামনে আসি তাহলে এই হসপিটাল তো বন্ধ হবেই সেই সাথে সবাই সবকিছু হারিয়ে ফেলবে। সো মাইন্ড ইট অল”
চিঠিটা পড়ে বেশ অবাক হলো মেয়েটি। কারণ সামান্য এই চিঠির ভরসায় হাসপাতালে কেউ সত্যি করে টাকার লোভে পরে ওর কিছু করল না! এটা যেন কিছুতেই মানতে পারছে না সে। তাই ভ্রু কুঁচকে সামনে থাকা নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আচ্ছা আমি যে এখানে মাঝরাতে পড়েছিলাম তখন আমার আশেপাশে কি কেউ ছিল না? আপনারা কাউকে দেখেননি আমার সাথে? আর আপনারা জাস্ট এই চিঠির উপর ভরসা করে এতগুলো টাকা সহ আমাকে এভাবে চিকিৎসা’ই বা দিলেন কেন? আপনারা চাইলে তো টাকা গুলো নিয়ে আমাকে সেখানেই ফেলে রাখতে পারতেন?
মেয়েটির কথার কোন উত্তর না দিয়ে নার্স উল্টা প্রশ্ন করে বলে উঠলো,
— আচ্ছা বাদ দাও ওসব, এখন বলো তোমার নাম কি? আর তুমি কোথা থেকে এসেছো?
মেয়েটিও আর দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করল না নার্সকে। বরং ওনার কথার উত্তর দিয়ে বললো,
— আমার নাম চাঁদনী। আমি সিলেটে থাকতাম নিজের বাবা মা আর ছোট ভাই এর সাথে।
এতোটুকু বলতেই ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে নার্সটি বলে উঠলো,
— কি বলছো তুমি? তুমি যদি সিলেটের হয়ে থাকো তাহলে এতদুর ঢাকা হসপিটালে তুমি এলে কিভাবে? এই হসপিটাল টা তো ঢাকায় অবস্থিত। তাহলে তুমি সিলেট থেকে এত দূরে কিভাবে পৌঁছালে? তুমি তো একটু আগেই বলছিলে যে সিলেটের জঙ্গলে পড়েছিলে তুমি! তাহলে এখানে কিভাবে পৌঁছালে?
#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পার্ট_১
#M_Sonali
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক এর সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। আর হ্যাঁ গল্পটা অবশ্যই প্রথম সিজনের চাইতেও অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং এবং রোমান্টিক হবে। সেইসাথে ভীষণ ডেঞ্জারাস হবে ইনশাল্লাহ। আশা করি গল্পটা সকলের ভাল লাগবে। প্রথম পর্ব কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন সবাই। নইলে দ্বিতীয় পর্ব আর কষ্ট করে পোস্ট করব না। ধন্যবাদ