#ভ্রান্তির_অগোচরে
পর্ব ১৯
লেখা আশিকা জামান
মিমের প্রচন্ড কষ্ট হয় ইবতিহাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে। ছেলেটা পুরোদস্তুর সবুজের চেহারাই পেয়েছে। ওই ছোট ছোট হাত, পা, লম্বা নাক, চিকন ঠোট, কপালের ভাজ এমনকি কানদুটো সহ হাত পায়ের নখের গঠন ও একি রকম। এত মিল দেয়ার কি খুব দরকার ছিল?
কিছু বৈশিষ্ট্য ওর থেকে দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত। তাছাড়া ওর ভবিষ্যৎ ভেবেও মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু আপাতত ওর করার নেই। বাচ্চাটা এখন নির্বিঘ্নে ঘুমুচ্ছে। বাচ্চাটার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বারবার ওকে সবুজের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। মুছে ফেলা অতীতটা সামনে এসে স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে লাগলো।
” মিম, ইবতিহাজ কি ঘুমিয়ে গেছে?”.
নিয়াজের গলার স্বর শুনে মিম চমকে উঠে পিছনে তাকায়।
নিয়াজ মিমের মনেরভাব বুঝে উঠে ইতস্তত করে বললো,
” আসলে সদর দরজা খোলা ছিলো । আমি হুট করেই খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ি আর এদিক সেদিক তাকিয়ে তোমাকে দেখতে না পেয়ে বেডরুমে এসে পড়েছি। তুমি আবার কিছু মনে করোনি।”
” আরে, না কি মনে করবো। আপনারা আমার আর ইবতিহাজের জন্য যা করেছেন সারাজীবনেও এই ঋন শোধরাতে পারবোনা। ।” মিম সহাস্যে বলে উঠলো।
” কিসের ঋন? প্লিজ এইসব আর বলোনা। ঋন-দায়বদ্ধতা এই বিষয়গুলো আমি মন থেকে হেট করি।”
” ওই দেখুন কেমন মানুষ আমি? আপনাকে বসতেও বলিনি। প্লিজ কিছু মনে না করলে বসুন। আচ্ছা আপনার জন্য এক কাপ চা নিয়াসি?”
” নাহ্ থাক আর বসবোনা। তুমিতো জানো অফিস থেকে ফিরে ইবতিহাজকে না দেখলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা। অন্যসময় হলে মাই আসতো। কিন্তু বোন আসাতে মা একটু বিজি হয়ে পড়েছে। তাই আমাকেই আসতে হলো।
আচ্ছা তুমি জবে জয়েন করছ কবে থেকে?”
” এইতো কালকে থেকে?”
নিয়াজের কপালজুড়ে চিন্তার রেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগলো।
ওই এতটুকু ছোট্ট মানুষ কি করে ওর মাকে ছাড়া থাকবে?
হতবিহবল হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নিয়াজ,
” আচ্ছা ওকে এইভাবে ছেড়ে রাখতে তোমার কষ্ট হবেনা?”
মিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়াজের দিকে তাকায়। কথা ঘুরানোর জন্য জিজ্ঞেস করে,
” আচ্ছা আপনার বোনকেতো এতোদিনে একবারো দেখিনি? কোথায় গিয়েছিলো?”
” কানাডাতে গিয়েছিলো পড়তে। গতকালই দেশে ফিরেছে।”
কানাডার কথা শুনে কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠলো মিমের। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে বললো,
” ওহ, আচ্ছা এইজন্যেইতো নীলিমা আন্টিকে এতো ব্যাস্ত মনে হলো।”
নিয়াজ আর না দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে মিম পেছন থেকে নিয়াজকে ডাকে।
” দাড়ান, ইবতিহাজকে নিয়ে যান।”
———————————–
পুরো বাড়ী শুন্য মনে হচ্ছে। সব থেকেও আজ সবুজ বড্ড একা। নিজের অনুভুতিগুলোর কাছে বড্ড একা। এখানে এসে কষ্টটা আরো গানিতিক হারে বেড়ে চলেছে। পুরো ঘর এলোমেলো মাথাটা কাজ করছেনা। লাগেজ থেকে কাপড়চোপড় বের এখনো করে উঠতে পারেনি।
মাথা থেকে কিছুক্ষণের জন্য দুঃশ্চিন্তা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাপড়চোপড় বের করে আলমারি খুললো সবুজ। কাপড়চোপড় এমনভাবে গাদাগাদি করে এলোমেলো অবস্থায় আলমারিতে আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেকদিন এখানে কারো হাত পড়েনি। ওর হাতের ধাক্কা গেলে অবিন্যস্ত কাপড়চোপড় একে একে ওর উপর পড়তে লাগলো। হাত দিয়ে কাপড়চোপড় ধরতে গিয়ে মেডিকেল রিপোর্ট এর মত কিছু একটা ওর হাতে পড়লো।
সবুজ কিছুটা বিস্মিত হয়ে ফাইলটা ভালোভাবে হাতে ধরে।
পেশেন্টের যায়গায় মিমের নাম লিখা আছে। অজানা আশঙ্কায় ওর ভিতরটা কুকড়ে যেতে লাগলো। ফাইলটায় পাগলের মত পেজ উল্টাতে লাগলো। যা দেখলো তার জন্য ও প্রস্তুত ছিলোনা। মিম প্রেগন্যান্ট ছিলো!
আর ই ডি ডি ডেইট অনুযায়ী ওর এতদিনে বেবিও হয়ে গেছে। ডেট অনুযায়ী হিসেব করতে বসে গেলো সবুজ। সেইরাতের কথা ওর স্পষ্ট মনে হয়ে গেলো। বিয়ের পর ওই একটা রাতই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মিমকে কাছে পেয়েছিল ও। সবুজের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যেতে লাগলো। ওহ্ শিট এইরকম একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় কোথায় আছে কিভাবে আছে? আমাকে একটাবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করলোনা। এইভাবে বাড়ী ছেড়েই বা কেন গেলো? এখন এই এতো সব প্রশ্নের উত্তর কে দিবে আমায়?
সামনে পড়ে থাকা কাপড়চোপড় সজোরে লাথি দিয়ে ফেলে দিলো সবুজ। কাপড়ের ফাক দিয়ে নীল খামে মোড়ানো কিছু একটা সবুজের চোখে পড়ে। উঠে গিয়ে খামটা খোলতে যায় সবুজ। একটা চিঠি ওকেই উদ্দেশ্য করে লেখা। পুরো চিঠিটা হন্তদন্ত হয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললো সবুজ। ওর ওয়ালেট থেকে মিমের দেয়া পূর্বের চিঠিটা বের করে মিলিয়ে নিলো সবুজ। আগের চিঠিটা মিমের দেয়া নয়! যে চিঠি পড়ে এতোদিন মিমের প্রতি এক আকাশ অবিশ্বাস আর ঘৃনার পাহাড় জমিয়েছিলো তিলে তিলে, এক নিমিষেই বালুকণার ন্যায় ঝুরঝুরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়তে লাগলো ঘৃনার পাহাড়। নিজের বোকামোর জন্য নিজের চুল ছিঁড়তে লাগলো সবুজ।
ছিঃ মেঘ! তোকে আমি ছাড়বোনা! আই উইল কিল ইউ! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!
আমার লাইফটাকে নিয়ে এইভাবে ছিনিমিনি খেলার শাস্তি তোকে পেতে হবে।
শাস্তিতো ওর ও পাওনা আছে। এত এত কষ্ট দেয়ার শাস্তি হ্যা ওকেও পেতে হবে। মেয়েটাকে কোথায় খুজবে ও। বউ বাচ্চাকে কি কোনদিনও খুঁজে পাবেনা?
সামনে রাখা ফ্লাওয়ার ভাসটা ছুড়ে মারে সবুজ। হাতের কাছে যা পাচ্ছে সব ছুড়ে মারতে লাগলো।
ছেলের রুমে এতো ভাংচুরের শব্দ শুনে শিউলি সোহেল দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে।
” কি হয়েছে বাবা? রুমের এই অবস্থা কেন?”
উদ্বিগ্ন হয়ে শিউলি ছেলেকে প্রশ্ন করে।
সবুজ অগ্নিচোখে মা আর বাবার দিকে তাকায়। দুজনেই চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। ছেলের এই রুপ ইতিপূর্বে ওরা দেখেনি।
সবুজ রিপোর্টটা শিউলির দিকে ছুড়ে মারে। শিউলি ছেলের অসভ্যতামি দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। রিপোর্টটা পায়ের কাছ থেকে হাতে তুলে হাতে তুলে নেয় শিউলি। রিপোর্ট খুলে দেখতে লাগে শিউলি। মুহুর্তেই সোহেল রিপোর্ট টা ছু মেরে নিয়ে নেও। কিছুকাল পর দুজনেই স্তব্ধ হয়ে যায়। চারপাশে পিনপতন নীরবতা।
শিউলি আমতাআমতা করে কিছু একটা বলতে যায় কিন্তু সবুজ থামিয়ে দেয়।
” আচ্ছা তুমিতো মেয়ে। সত্যিকরে বলতো তুমি একবারো বুঝোনি মিম প্রেগন্যান্ট? ”
সোহেল গমগম করে বলে উঠে।
” দেখ হ্যা ও একটু অসুস্থ ছিলো কিন্তু আমি সবুজের চিন্তায় আমি এতোটাই বিভোর ছিলাম যে ওর দিকে তাকানোর সময় আর পাইনি।”
” প্লিজ মা, তোমার যুক্তি বন্ধ করো। আমি কি চিরদিনের জন্য চলে গিয়েছিলাম। তোমার কোন আইডিয়া আছে মেয়েটা এখন কোথায় আছে? কি অবস্থায় আছে?
আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব।”
” শিউলি তুমিতো অন্তত মেয়েটার অসুস্থতার কথা আমাকে জানাতে পারতে। তোমার থেকে এটা আমি অন্তত আশা করিনি।”
সোহেল গলা উঁচিয়ে বলে উঠলেন।
বাবা-ছেলে যেভাবে কথায় বুলেট শিউলির দিকে ছুড়ে দিচ্ছে তাতে ও কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে উঠলো,
” তোমরা যেভাবে মুখিয়ে আছো মনে হচ্ছে আমি দায়িত্ব নিয়ে মিমকে চলে যেতে বলেছি।”
” থাকার মত অবস্থাওতো রাখোনি। তোমাকে এইসব বলতে হচ্ছে বলে আমি প্রচণ্ডভাবে সরি।”
সবুজের চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো।
” মানে কি বলতে চাচ্ছিস তুই? ক্লিয়ার করে বল?”
শিউলি আমতাআমতা করে বলে উঠলো।
” কিছু বলার নেই। মেঘকে আসতে বলেছি, তারপর কিছু বলবো।”
সবুজ উঠে ব্যালকনিতে চলে যায়। শিউলি ওখানেই বসে পড়ে । সোহেল চৌধুরীকে এদিকওদিক পায়চারী করতে দেখা যায়।
কিছুকাল পর মেঘ এসে দরজায় নক করে। ও চেয়েছিলো সবুজ আসার আগেই দেশ ত্যাগ করার কিন্তু জাস্ট দুইদিনের ব্যাবধানে প্ল্যানটা সাকসেস হলোনা। কে জানতো সবুজ এইভাবে হুট করে চলে আসবে। আর এসেই ওর খুজ করবে।
সোহেল চৌধুরী দরজা খুলে দিতেই মেঘ রুমে ঢুকে।
শিউলির মাথায় কিছুই ঢুকেনা সবুজ কি সব জেনে গেছে? কিন্তু কি করে? ওতো সব হাইড করে গেছে।
চলবে..