ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ২০

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পর্ব ২০

” মা, এই বাচ্চাটাকে নিয়ে ভাইয়ার এতো আদিখ্যেতা করার কি আছে আমি বুঝতেছিনা।” নায়রা কিছুটা বিরক্ত হয়েই মায়ের দিকে তাকায়।
” ছিঃ নায়রা ওসব কি কথা। তুই খেতে বোস। তোর প্রছন্দের সব আজ রান্না করেছি। ”
নায়রা টেবিলের দিকে ভ্রুকুচকে তাকায় সমস্ত রিচ আর মশলাদার খাবার দেখে ওর গা গুলুচ্ছে।
” মা, আমি ডিনারে এত ভারী খাবার খাইনা। তুমি অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করে নিবেতো?”

” আচ্ছা এখনকার মতো খা। কালকে থেকে সব ঠিক হবে কেমন।”
নীলিমা প্লেটে বিরিয়ানি তুলে দিতে যায়।
কিন্তু নায়রা বাধা দিয়ে বলে উঠে,
” হুয়াট? কালকে থেকে মানে কি? আমার ডায়েটের কি হবে? তোমাদের মত যা পাই তাই গরুর মত গিলার অভ্যেস আমার নেই। প্লিজ আমি এগুলো খাবোনা। পারলে যেকোন একটা স্যুপ আর স্যালাড নিয়ে এসো। নাহলে আমি গেলাম।”
নীলিমা বিস্মিত হয়ে মেয়ের পথের পানে তাকিয়ে থাকে। নাহ্ মেয়েটা আর জীবনে মানুষ হলোনা।
নিয়াজ অনেকক্ষণ ধরে নায়রার কাণ্ডকারখানা দেখছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি ওকে আটকে রাখলো।

” মা প্লেটে খাবার তুলে আমার হাতে দাও আর তুমি ইবতিহাজকে নিয়াসো। যে তোমার ভালোবাসার মুল্য দিবে তাকেই ভালোবাসতে হয়। ”
নীলিমা ছেলের পিছুপিছু মিমের ফ্ল্যাটের ঢুকেন।

____________________________________

সবুজ মেঘের মুখের উপর চিঠিটা ছুড়ে মারে। মেঘ চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়।
” কিরে ভুত দেখার মতো চমকাচ্ছিস কেন? আমার লাইফটাকে হেল করে তুই কি শান্তি পাচ্ছিস? বল?”
সবুজ বেশ উচ্চ্বস্বরে চেঁচিয়ে উঠে।

” আসলে আমি মিমকে ভালোবাসতাম। ”
মেঘ আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সবুজের হাতের থাপ্পড় খেয়ে ও স্তব্ধ হয়ে যায়।
” সেট আপ, কিসের ভালোবাসা। তুই ভালোবাসা নাম উচ্চারণ ও করবিনা।তুই কোন ভালোবাসার জোড়ে আমার ওয়াইফের বেড়রুমে ঢুকেছিস বল? স্কাউন্ডেল তোকে আমি পুলিশে দেব।”
সবুজ মেঘের কলার ধরে নাক বরাবর এলোপাথাড়ি ঘুষি বসিয়ে দেয়।
শিউলি বসা থেকে উঠে এসে মেঘকে সবুজের থেকে ছাড়িয়ে আনতে যায়।
সবুজ আরো শক্ত করে মেঘের কলার উঁচিয়ে ধরে।
” মা, তুমি সরো বলছি। তুমি বাসায় থাকতে এই বদমাইশ আমার ওয়াইফের বেডরুমে ঢুকে কি করে? ওকে আজকে আমি মেরেই ফেলবো।”
সবুজ এক নাগাড়ে কতক্ষণ চড় থাপ্পড় দিয়ে মেঘের নাকে রক্ত বের করে দেয়।
মেঘ এইমুহুর্তে সবুজের পা ধরে বসে পড়ে,
” ভাই আমাকে মাফ করে দে। আমি খুব ভুল করেছি। আমাকে এবারের মত মাফ করে দে না ভাই।
বিশ্বাস করো মিমকে পাওয়ার জন্য আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোরা যদি নিজেদের নিয়ে হ্যাপি থাকতি তাহলে বিশ্বাস কর আমি তোদের মধ্যে ঢুকার চেষ্টাও করতাম না।
তাছাড়া তোদের দুজনের কি কোন দোষ ছিলোনা?
তোদের মধ্যেতো সেরকম কোন বন্ডিংই ছিলো না। থাকলেতো আমি সুযোগই পেতাম না ”

” বাহ্ বেশ সুযোগ পেয়ে তুই স্বদব্যাবহার করবি তাইতো?”
সবুজ মেঘকে মারার জন্য আবার হাত উঠালে সোহেল এসে ছেলের হাত ধরে ফেলে।
” বাবা , ছাড় আমি ওকে পুলিশে দেব।”

” ওকে আর মেরে কি হবে? আর পুলিশে দিয়েই কি হবে? ওতো পরশুদিন চলেই যাচ্ছে। প্লিজ বাবা শান্ত হ, ওতো ওর ভুল স্বীকার করেছেই। তাছাড়া যে যাবার সেতো ঠিকি চলে গেছে । ওকে তো আর খুঁজে পাইনি পাবো কিনা সেটাও জানিনা।”

সবুজ বাবাকে দুহাত দিয়ে ঝাপ্টে ধরে কাঁদতে লাগলো বাচ্চাদের মত। ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগলো,
” বাবা, ও আমার সাথে এমনটা করতে পারলো? আমি কি চিরদিনের জন্য চলে গিয়েছিলাম। আর কয়েকটা দিন কি কষ্ট করে থাকতে পারলোনা। ওকে এখন আমি কোথায় খুঁজব? বলোনা বাবা। আমি এখন কিভাবে থাকব?”

সোহেল জানেনা ছেলেকে কিভাবে শ্বান্তনা দেয়া উচিৎ। নিজেও নির্বাক।কিছু অনুভুতির কখনো কোন প্রকাশভঙ্গী হয়না।
মুহুর্তের মাঝেই সবুজ চোখ মুছে বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
শিউলি বিস্মিত হয়ে ছেলের দিকে তাকায়,
” কোথায় যাচ্ছো?”

” মিমকে খুঁজতে। যদি না খুঁজে পাই তাহলে আর কোনদিন বাসায় ফিরবো না। এই বলে গেলাম।”
শিউলি অসহায়ের মত ছেলের পথের পানে তাকিয়ে থাকে। গতকালই ফিরেছে ছেলেটা আর এখনি এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। কিচ্ছুটি করার নাই। আগে থেকেই যদি মেয়েটির দিকে একটু নজর দিত তবে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরিই হতো না। না জানি মেয়েটা কত কষ্টে আছে।

দুইদিন পার হয়ে যায় সবুজ এর খবর নেই। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার অবসান আর ঘটেনা। শিউলি আত্নীয় স্বজন বন্ধুদের বাসায় খোজ নিয়েও ওর কোন খুজ পায়না। এর মাঝে সে নায়রাকেও ফোন করে সবুজের কথা জিজ্ঞেস করে কিন্তু কোন হদীস পায়না। নায়রা মেয়েটার সাথে শিউলির দুই/ একবার কথা হয়েছে। মেয়েটা বেশ স্মার্টলী কথা বলে। খারাপ না ভালোই।

————————————
গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছিলো, খুঁজতে খুঁজতে যেখানে রাত সেখানে কাত অবস্থাটা অনেকটা এই টাইপের হয়ে গেছে। দুই দিন ধরে কারো ফোন ও ধরেনি সবাই নিশ্চিত চিন্তা করছে। এইভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে কাউকে কি খুঁজা যায়? কারো হেল্প নেয়া দরকার। বিষয়টা ওয়েল প্ল্যানড হওয়া উচিৎ।
এলোপাথাড়ি ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে উঠে। নায়রা ফোন করেছে।
স্তিমিত গলায় সবুজ বলে,
” বলো?”
” সবুজ আর ইউ ওকে? ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া, আংকল আন্টি কিভাবে তোমাকে খুঁজছে? ”
নায়রার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা, উৎকন্ঠতা স্পষ্ট ঝড়ে পড়ছে।
” হুম জানি?”
” তুমি জানো! অদ্ভুত তবুও এই বাচ্চামিগুলা করছো? এইভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেই কি বউকে খুঁজে পাবা।
তোমার কি মনে হয় তোমার বউ এর মতো একটা এডুকেটেড মেয়ে এখনো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে?
প্লিজ পারলে আমার সাথে একবার দেখা করো। আমি দায়িত্ব নিয়ে তোমার পাশে থাকবো কথা দিচ্ছি। প্লিজ না করোনা।”

সবুজ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তারপর বলে,
” ঠিক আছে? আমি কুঞ্জ নিকেতনের সেভেন ইলেভেন রেস্টুরেন্ট এর সামনে আছি। যদি আসো হাফ এন আওয়ারের মাঝে আসবা নইলে আসার দরকার নাই।”

নায়রা জিন্সের উপড় রেড ফ্লোরাল টপসটা চড়িয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে চলে। সবুজ যে টাইপের বদমেজাজি মানুষ তাছাড়া এখন যে মেন্টাল কন্ডিশন এখন লেট করে যাওয়া মানে একগাদা ঝাড়ি খাওয়া।

————————————

প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছে। যেকোন মুহুর্তে জ্বর আসতে পারে। মিম আকাশের দিকে তাকায়। নীলচে আকাশ মুহুর্তেই কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। যেকোন মুহুর্তেই বৃষ্টি নামতে পারে। অবশ্য এই অসহ্যরকমের গরমে এক পশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয়না। আহ্ এমন বৃষ্টির দিনে পাতলা খিচুড়ি মাংস জমবে ভালো। নুরীরে কি ফোন করবে মাংস কষিয়ে রাখতে? না থাক এমনিতেই বেচারি ইবতিহাজকে রাখতে গিয়ে নির্ঘাত হিমশিম খাচ্ছে । ইবতিহাজটা যা দুষ্টু হয়েছে। মিম নিজের মনে নিজেই হেসে উঠলো। সুপার শপের সামনে আসতেই মিমের মনে পড়ে গেলো। ইবতিহাজের জন্যেতো দুধ কিনতে হবে। আসার সময়ই দেখে আসছে অল্প পরিমাণই আছে দুই কি একদিন যাবে।
মিম রিক্সাটাকে সাইড করতে বলে সুপার শপে ঢুকে যায়।
দুধের কৌটো হাতে নিয়ে, টাকা পেমেন্ট করে মিম উল্টোদিকে হাটা দেয়।
এদিক সেদিক তাকিয়ে রিক্সায় উঠার সময় রাস্তার অপোজিটে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দু চোখ আটকে যায়।
গাড়ীর সাথে একটি ছেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা ঠিক সামনে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। পেছনের চুলগুলোক দেখে সবুজের মত মনে হচ্ছিলো। পরক্ষণেই নিজেকে শোধরে নেয় ও কি করে হবে? ওতো কানাডায়।
মিম রিক্সায় উঠার জন্য পা বাড়াতেই সবুজ চুল হাতড়াতে হাতড়াতে উল্টোদিকে ঘুরে। মিমের দুচোখ ঝাপসা হয়ে যায়। এতোদিন পর এত চেঞ্জড হওয়া সত্বেও সবুজকে চিনতে একবিন্দুও ভুল হয়না মিমের। যতোক্ষণ পেরেছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে।
” আফা রাস্তায় এইভাবে হা কইরা চাইয়া থাকবাইন না যাবাইন।”
রিক্সাওলার কথায় মিমের সম্ভতি ফিরে। রিক্সার উঠার পর আবার ঐদিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটি সবুজের হাত ধরে গাড়িতে উঠাচ্ছে। বুকের ভেতরকার জমাট বাধা কষ্টটা অগ্নিসম দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। মেয়েটাকে সবুজের সাথে দেখেই কি ওর এতোটা খারাপ লাগছে?
কিন্তু ওতো স্বেচ্ছায় ওর সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিয়ে এসেছে? তবে কিসের এতো কষ্ট? থাকুক না সবুজ অন্যকাউকে নিয়ে হ্যাপি। অনেকতো কষ্ট দিয়েছে ছেলেটাকে এবার না হয় একটু সুখে থাকুক। বোধটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। জীবন্ত সবুজ বুকের ভেতর ঢুকে আছে। খুব করে ছুটে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বুকেই থাকুক সযত্নে..

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here