ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ২১

#ভ্রান্তির_অগোচরে
পর্ব ২১
লেখা আশিকা জামান

নায়রা মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছে শিউলির। কেমন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলেটাকে ঠিক বাড়ী নিয়েসেছে। স্বামীর কাছেও মেয়েটাকে নেহাৎ মন্দ লাগেনি এ তিনি বেশ বুঝেছেন। কেমন সুন্দর সাবলীলভাবে কথা বলছিলো। মেয়েটা প্রচন্ড মিশুক মুহুর্তেই কেমন আপন করে নিলো। সবুজের এইরকম মেন্টাল কন্ডিশনে সাপোর্ট দেয়ার জন্যে হলেও পাশে কাউকে প্রয়োজন। সেই যায়গায় যদি নায়রা হয় তাহলেতো কোন কথাই নেই। মেয়েটা বেশ সামলাতে পারবে অন্তত শিউলি চৌধুরীর বিশ্বাসতো সেটাই বলে।
সবুজকে বলে কয়ে দেখবো মেয়েটাকে যদি আজকে আরেকবার বাড়ীতে আনা যায়। মেয়েটা যদি রিগুলার পাশে থাকে তাহলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে ছেলেটার বেশিদিন লাগবেনা।
নিজের মনে নিজেই ভেবে নিয়ে শিউলি ছেলের ঘরে ঢুকেন। সবুজ তখন একমনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে সাঁত পাচ কি যেন ভাবছিল। অবশ্য শিউলির তাতে কোন মাথা ব্যাথা নেই। সবুজকে নায়রার কথা বলাতে কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজী হয় এই ভেবে যে, ও আসলে অন্তত আজকে আবার মিমকে খুঁজতে বের হবে। অনেক যায়গায় ছেলেদের ঢুকতে দেয়না সাথে একজন মেয়ে হলে সুবিধে হয়। সবুজ রেডি হয়ে গাড়িতে বসতে যাবে ঠিক তখনি হুট করে নাসির এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে।
সবুজ বিরক্তি নিয়ে নাসিরের দিকে তাকায়,
” তুই এখানে কি করছিস? আমি একা ড্রাইভ করবো তুই যা।”

” সরি স্যার, খালাম্মা এখন থেকে একা গাড়ি নিয়া বের হইতে নিষেধ করছে, যেইহানেই যান আমারে সাথে যাইতে কইছে।”

সবুজ নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে বসে। যাবেতো ওই নায়রার বাসা পর্যন্তই থাক এখন আর নাসিরকে কিছু বলার দরকার নেই। বিষয়টা পরে দেখে নিবে ও।
কিন্তু কথা হলো ওতো এক্সাটলি নায়রা ঠিক কোন বাসায় থাকে সেটাতো জানে না? অবশ্য এটা এমন কোন সমস্যা না ফোন করলেই নায়রা পাগলী ঠিক এসে নিয়ে যাবে। আচ্ছা ওরতো ওদের বাসায় যাওয়ার প্রয়োজন নাই ও বরং বাসার নিচে থেকেই ফোন দিবে তারপর নায়রাকে নিয়ে চলে আসবে। ব্যাস কেল্লাফতে।
নিজের মনে নিজেই কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে দুচোখ বুজলো। চোখে রাজ্যের ঘুম তবে ও ঘুমোতে পারছে ন। কয়েকদিনে চেহারাও উশকুখুশকু মলিন হয়ে গেছে। সবুজ চোখ খুলে জানালার দিকে তাকায়। নায়রাদের এলাকায় এসে পড়েছে। সবুজ নাসিরকে গাড়ি থামাতে বলে নিজে নেমে পড়ে। চারপাশে একি রকম অনেকগুলো বিল্ডিং দেখে মনে হচ্ছে ও যেন গোলকধাঁধায় এসে পড়েছে। ও ড্যাম শিউর নতুন কেউ এই এলাকায় আসলে নির্ঘাত হার্টফেইল করবে। হঠাৎ রিক্সায় একটি মেয়েকে এদিকেই আসতে দেখা যায়। মেয়েটার শাড়ীর আচল রিক্সার চাকায় আটকে আছে আর মেয়েটি অন্যমুখ হয়ে উদাস বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেকোন সময় বিপদ ঘটতে পারে। সবুজ দৌড়ে রিক্সায় সামনে এসে পড়ে। রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামাতেই মিম চমকে উঠে সবুজের দিকে তাকায়। সবুজ বিস্ময়ের চুড়ান্ত সীমায় পৌছে মিমের অগুছালো এলোমেলো চেহারার দিকে তাকায়। মিম রিক্সাওয়ালার ভাড়া দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে সোজা বাসার দিকে যেতে থাকে। সবুজ যেন ঘোরের মাঝে আছে, মিম যে চলে যাচ্ছে এটা ওর মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে। নির্বাক দৃষ্টিতে মিমের পথের পানে তাকানো ছাড়া যেন এই মুহুর্তে ওর আর কোন কাজ নেই। হুশ আসার সাথে সাথে সবুজ চিৎকার করে মিমকে ডাকতে থাকে।
মিম কোন শারা না দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়িঘরে চলে যায়। এভাবে হঠাৎ দেখা পেয়ে তাকে আবার হঠাৎই হারিয়ে ফেলবে! অসম্ভব সবুজ এ হতেই দিবে না। ও মিমের পিছে ছুটতে লাগলো সন্তর্পনে।
সবুজকে আসতে দেখে মিম আরো দ্রুত পা চালাতে থাকে। ও কিছুতেই চায়না সবুজের সাথে ওর আবার দেখা হোক। মিম তিনতলায় উঠে দেখে ওর ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। তারমানে নুরী কোথাও বেরিয়েছে। মিম হাপাতে হাপাতে ভেতরে ঢুকে। ইতিমধ্যে সবুজকে তিনতলায় আসতে দেখে মিম সজোরে দরজা লাগিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি গিলে ফ্লোরে বসে পড়ে ।
সবুজ বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজালেও মিম দরজা খুলে না। মিমের এমন অসংলগ্ন আচরণে সবুজের খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে দরজা ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু এখানে ওর জোড়াজোড়িতে কিছু হবেনা। ঠান্ডা মাথায় অন্যকোন উপায় ভাবতে লাগলো সবুজ। এর মাঝে বারবার ফোনটা বাজতে লাগলো। নাসিরের কল দেখে কলটা কেটে দিলো । কিন্তু অসভ্য নাসিরটা বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে। এই বদটাকে কিছু না বললেই নয়।
যেখানে নিজের বউ জামাইরে চিনে না সেখানে নাসিরের আর কি দোষ। রাগে দুঃখে নিজের মাথার চুল নিজেরি ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
সবুজ নাসিরের ফোনটা ধরলো,
” স্যার আপনি কাউয়ার মতো কোন মেয়ের পিছুপিছু এইভাবে দৌড়াইলেন? মাথায়তো কিছু ঢুকে না।”

নাসিরের প্রথম কথাটা শুনেই ওরে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ও কিছুই করলো না।যথাসম্ভব শান্ত হয়ে বললো,
” এই তোর বিকাশ একাউন্ট আছে না? ২০০০ টাকা পাঠাচ্ছি নিয়া বিদেয় হ। আর বাসায় গিয়ে বলবি আমি একটা রেস্টুরেন্টএর সামনে নেমে গেছি। তারপর আর তুই আমারে খুঁজে পাস নাই। ভুলেও হাচা কথা যেন মুখ দিয়ে না বাইরই।”

” হায় আল্লাহ। আমি পারমুনা। সরি স্যার।”

বেয়াদবটা পারবি পারবি ঠিকি পারবি।
” আরো ২০০০ দিচ্ছি এইবারো পারবি না? ”

নাসির মুচকি হেসে বললো,
” জি স্যার। আপনার কথাই আমার কথা।”
নাসির গদগদ হয়ে আরো কিছু বলতে চাইছিলো সবুজ কথার মাঝখানে ফোন কেটে দেয়।
নাসিরের ফোনে মেসেজ আসতেই মহাআনন্দে নাচতে নাচতে ওখান থেকে কেটে পড়ে। আজকে রুমানার সাথে ডেটিং টা ভালোই জমবে।

একটা ঝামেলাতো মিটলো কিন্তু বউ এর কাছে এখন যাবে কি করে? উফ্ মাথায় কিচ্ছু নাই। নাই কোন গিলুই নাই।
সবুজ বাসার সামনে অনবরত পায়চারী করতে থাকে।
একবার এদিক যাচ্ছেতো আরেকবার ওদিক। এইভাবে ঘন্টাখানিক যাওয়ার পর কারো পায়ের শব্দ শুনে ও নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
একটা১৫/১৬ বছরের মেয়ে কোলে একটা বাচ্চা । মেয়েটি চোখ বড় বড় করে একবার সবুজের দিকে তাকায় আরেকবার বাচ্চার দিকে তাকায়। এতো মিল কারো হতে পারে? এ কি করে সম্ভব? তাছাড়া এই লোকটাই বা কে? আগেতো কোনদিন দেখেনি।
” এই মেয়ে এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?”
সবুজ বেশ জোড়েসোড়েই ধমক দেয়।
” নাহ্ মানে আমাদের বাবু আর আপনার চেহারায় এত মিল কেন? আপনি কি ওর কিছু হোন।”
মেয়েটা আমতাআমতা করে সবুজের দিকে তাকায়।
সবুজ চমকে উঠে বাচ্চাটির দিকে তাকায়। অনেক সুক্ষ্মভাবে বাচ্চাটার সাথে ওর গভীর মিল। এত মিল যে ওর ডান ভ্রুতে একটা তিল আছে বাচ্চাটার ও সেইম যায়গায় তিল। সবুজ বিস্মিত সাথে পুলকিত।
” আচ্ছা এই বাচ্চাটা কার?”

” মিম আপামনির। আমি এইবাসায় বাচ্চা রাখি।”

সবুজ মুহুর্তেই ছোঁ মেরে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটাও চোখ মেলে ওর চোখের দিকে তাকায়। হাত-পা নাড়াতে থাকে দ্রুতগতিতে। বাচ্চাটার হাতের ছোঁয়া বারবার সবুজের গালে লাগছে । প্রতিবারই এক অদ্ভুত ভালোলাগায় অন্যরকম বোধ এর জন্ম হতে লাগলো। এ আমার রক্ত, আমার বাচ্চা! আমার সন্তান। আমার উত্তরাধিকারী। কারো অধিকার নেই আমার থেকে ওকে দূরে সরানোর। মুহুর্তেই চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো।
” কি হলো আপনি কানতাছেন ক্যা?”

এই প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলোনা সবুজ।
কিছুক্ষন নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর বললো,
” তুমি এতোক্ষণ জিজ্ঞেস করছিলে না বাচ্চাটা আমার কে হয়? আমি ওর বাবা। তুমি আমাকে একটা উপকার করবা? বিনিময়ে যা চাবে তাই দিব।”
মেয়েটা সবুজের কথা শুনে বিস্ময়ে মুখে রা কাটতে ভুলে গেল। আচ্ছা আগেতো কোনদিন ইবতিহাজের বাপকে দেখেনি? আর আপাওতো কোনদিন স্বামীর কথা কিছু বলেনি? এই লোকের কথা কি বিশ্বাস করা ঠিক হবে? তাছাড়া লোকটাকে বিশ্বাস না করার কিছু নাই। প্রথম দেখাতেই বিশ্বাসী মানুষের কাতারে পড়ার মত।

” জি বলুন কি উপকার?”

” মিম আমাকে বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না। তুমি আমাকে একটু বাসায় নিয়া যাইতে পারবা। এতে তোমার কোন ক্ষতি হতে দিবনা। বাকীসব আমি দেখব। শুধু বাসায় নিয়ে যাও। প্লিজ না করোনা।”

” কিন্তু আপনি যদি দুলাভাই হোন তবে বাসায় কেন ঢুকতে দিবোনা।” নুরী কিছুক্ষন চিন্তা করে সবুজের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলো।

” তোমার আপা আমার সাথে অভিমান করে বাড়ী ছেড়ে চলে আসছে। এখনো নিজের জেদ নিয়েই বসে আছে। প্লিজ না করোনা।”

সবুজ নুরীকে ওয়ালেট বের করে টাকা দিতে যায়, কিন্তু নুরী নিতে অস্বিকৃতি জানায়।
” দেখুন আমরা কাজ কইরা খাই কিন্তু কোন ঘুষ টোষ নিতে পারুম না। আপনাকে আমি বিশ্বাস করলাম আমার বিশ্বাদের মর্যাদাটুকু রাইখেন। আপনি দূরে গিয়ে ওই পাশের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়া খাড়ান। আর বাবুকে আমার কোলে দেন। আপা দরজা খুললেই আপনি ঢুকবেন। ”
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here