#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৪,,
তিলো শাওয়ার সেরে মাত্র বেরিয়েছে। যদিও ওর শাওয়ার নিতেই ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে নিজের গালের দাগটা খেয়াল করতেই দেখতে পেলো। যদিও ওর গায়ের রঙের জন্য খুব বেশি স্পষ্ট না, তবুও গভীরভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাচ্ছে। তিলোর মনে মনে অভিমানের পাহাড় জমে যাচ্ছে ওর মায়ের বিরুদ্ধে। টাওয়েলটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই কলিং বেল বাজতে শুনলো। তিলো একপ্রকার নিশ্চিত এটা তুলি। কারণ এখন আনিস সাহেব আসবেন না আর তুষার কখনো একটা বাজিয়ে ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোক না। পরপর তিনটা কমপক্ষে বাজাবে। ওর নাকি শব্দটা শুনতে ভালো লাগে। নাসীরা পারভীন বকেও ঠিক করাতে পারেনি ওকে। প্রতিবেশীদের কেউ আসলে আলাদা কথা।
তবে তিলোর ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে দরজায় তুলিই ছিলো। নাসীরা পারভীন দরজাটা খুলতেই তুলি মিষ্টি একটা হাসি তাকে উপহার দিলো। ঘরে ঢুকে ওড়নার মাথা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সোফায় বসে পড়লো। হাতের ব্যাগগুলো সেন্টার টেবিলের উপর রেখে নাসীরা পারভীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-ইশান, কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? রাস্তায় এতো জ্যাম! দেরি হয়ে গেলো একদম। এই রোদে রাস্তায় থাকা যে কি!
নাসীরা পারভীন দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এসে ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে বরং গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-তুমি আজকে আবার ওই ছেলের সাথে দেখা করে এসেছো তুলি? আমার কোনো কথা তোমার গায়ে লাগে না? তোমার বাপের মুখে চুনকালি না মাখানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছো না?
তুলি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ওনার কথা শুনে। চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। তুলি শুকনো একটা ঢোক গিলে ওনার দিকে তাকিয়েই বললো,
-আ…আ…আমি তো শুধু মার্কেটে…
তুলির কথার মাঝেই নাসীরা পারভীন খানিকটা চিৎকার করে উঠলেন,
-চুপ কর অসভ্য মেয়ে কোথাকার! একদম মিথ্যা বলবি না। তোকে আমি নিষেধ করিনি ওর সাথে মিশতে? উত্তর দে। এরপরও কেন গেলি? তোর বাপ জানতে পারলে না, একেবারে খুন করে ফেলবে তোকে। নিজের সংসার ভেঙেছিস। এখন আমার সংসারে কোনো অশান্তি চাই না আমি।
তুলি ওনার কথাগুলো শুনে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা। ডুকরে কেঁদে উঠলো। এতে নাসীরা পারভীন আরো বিরক্ত হয়ে তুলির চুলের মুঠি ধরে বললেন,
-ছিঃ ছিঃ ছিঃ। নিজেকে ঘেন্না হচ্ছে আমার। এই মেয়ে আমি পেটে ধরেছি! বিয়ের পর পরকীয়া করে বেড়ায়। থুহ্। একদম ন্যাকা কান্না কাঁদবি না। এই খা** নাকি আমার পেটে হয়েছে। তুই জন্মানোর পর মরলি না কেন!
তুলির চুল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কোনোমতে সামলে বললেন,
-ইমনের বাড়ি ফিরে ওর পা ধরে মাফ চাবি। মাফ করলে ভালো। না হলে তোর কি হবে আল্লাহই ভালো জানেন। ওই নেশাখোর, মাতাল বদমাশের সাথে আর একবার কথা বললে মুখ ভেঙে ফেলে দেবো। ওইটুকু একটা ছেলে রেখে! ওই তোর কি একবিন্দু লজ্জা নেই?
তুলি কেঁদে চলেছে। আর নাসীরা পারভীন এদিকে যা মুখে আসছে তাই বলে চলেছেন। তিলো নিজের রুমে বসে সবই শুনছে। কিন্তু ও সেখানে যাওয়ার কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাচ্ছে না। তুলি অন্যায় করেছে আর নাসীরা পারভীন পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় সম্মান বাঁচাতে সেটা লুকিয়ে নিজে দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন মেয়েকে ঠিক করার। তুলি কথা শোনেনি৷ এটুকু তো অন্তত ওর প্রাপ্য। তাছাড়া নাসীরা পারভীন ওকে নিজে এসবের থেকে দূরে থাকতে বলেছে৷ তিলোর বিছানায় বসে বসে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো আর কিছু সময় পরপর একেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চললো। যদিও এভাবে আড়িপাতা ঠিক না। তবুও ওর আজকে কৌতুহল হচ্ছে তুলির বিষয়টা নিয়ে। তাই আর আজ ঠিক ভুলের বিচার করার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। তবে ওর খুব ক্ষুধা পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যে খাবার জোটার কোনো সম্ভাবনা নেই ও জানে। এখন শুধু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা তিলোর। মনে মনে দ্রুত সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনাও করে চলেছে।
পরিস্থিতি মোটামুটি ঠান্ডা হলো তুষারের বাজানো কলিং বেলের শব্দে। নাসীরা পারভীন কথা থামিয়ে তুলির দিক থেকে অগ্নিদৃষ্টি সরিয়ে গটগট করে হেঁটে গেলেন দরজার কাছে। রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা তার স্বাভাবিক রঙে তখনো ফেরেনি। দরজা খোলার পরও আগের রেশ ওনার কাটেনি৷ তুষার দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে বললো,
-রোদ থেকে ফিরলাম আমি আর তোমার মুখ টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে কেন? বাইরে বেরিয়েছিলে নাকি?
তুষারের ঠোঁটে সাধারণ দুষ্টুমির হাসি৷ নাসীরা পারভীনের এটা যেন সহ্য হলোনা। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
-তোকে এতোবার বেল চাপতে নিষেধ করা হয়েছে না? চাপিস কেন? এর পরদিন থেকে দরজা খোলা হবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। কিছু বলি না বলে যার যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছো! চড়িয়ে তোর গাল লাল করে দেবো।
তুষারের বুঝতে বাকি থাকলো না যে, নাসীরা পারভীন রেগে আছেন। কার উপর বুঝতে পারছে না। তবে ওনি রাগলে সবার উপরই তার প্রভাব পড়ে। আনিস সাহেবও বাদ পড়েননা কখনো। তুষার এনিয়ে কথা না বাড়িয়ে বললো,
-পরে রাগ ঝেড়ো তো আম্মা। এখন ক্ষুধা লেগেছে, খেতে দাও। বাইরে থেকে এসে ভালো লাগছে না।
-হ্যাঁ, তাই তো। কারোরই কিছু ভালো লাগে না। সব যেন আমারই দ্বায়। যা তোর ছোট বোনকে ডেকে আন গিয়ে।
কথাগুলো বলতে বলতে নাসীরা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকলেন। তুষার এখনো জানে না ওনার রেগে যাওয়ার কারণ কি। ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে ‘ওই হবে কিছু একটা’ ধরনের একটা ভাব নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তুলি আরো আগেই নিজের রুমে ফিরে এসেছে।
তুষার কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে তিলোকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একসাথে বসলো ডাইনিং টেবিলে। তুষার চোখের ইশারায় তিলোকে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার? বাড়ির পরিবেশ বাইরে থেকে গরম কেন?
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে মৃদুস্বরে বললো, ‘কি জানি?’
নাসীরা পারভীন ওদের দুজনকে খেতে দিয়ে তুষারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তোমার বড় বোন কি খাবে না? নাকি? আমি কারো জন্য পরে করতে পারবোনা।
তুষার সরু চোখে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি তো শুধু তিলাপুকে ডাকতে বললে। তুলিপু খায়নি?
নাসীরা পারভীন কোনো একটা কারণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সে ভঙ্গিতেই বললেন,
-যার ইচ্ছা হবে সে খাবে। না হলে আমার কি? আমি আর কাউকে দিতে পারবোনা। নিজে নিয়ে খাবে।
কথাটুকু শেষ করে ওনি চলে গেলেন সেখান থেকে। তুলি সবকিছু শুনলেও আসলোনা। তিলো আর তুষারের কি? ওদের ক্ষুধা লেগেছে, তাই খেয়ে নিলো। তুষার বুঝতে পারলো, ওর মা আসলে তুলির উপর রেগে আছেন।
খাওয়া শেষে নাসীরা পারভীন একটা প্লেটে খাবার গুছিয়ে তুষারের হাতে দিয়ে বললেন তুলির রুমে রেখে আসতে। সাঁধতে নিষেধ করলেন। ইচ্ছা হলে খাবে না হলে নাই। তুষারের হাতে প্লেটটা দিতে দিতে স্বগতোক্তি করলেন,
-যাবি আর কই? সেই ডাবের চারির ধারে তো আসতেই হবে। বাপের তা ছাড়া খাবি কি?
তুষার মুখ টিপে হেসে দিলো। ওর মায়ের স্বভাব ও জানে। ছেলেমেয়ের উপর ভীষণ রেগে থাকলেও তারা সময়মতো না খাওয়া পর্যন্ত ওনি শান্তি পাননা৷
তুষার খাবারটা তুলির রুমে থাকা স্টাডি টেবিলটার উপর রেখে ওকে খেতে বলে চলে আসলো। ওকে আবারও বের হতে হবে টিউশনে।
সন্ধ্যায় আজকে আর প্রতিদিনের মতো হালকা নাস্তার সাথে আড্ডাটা হলোনা। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। তিলো বিকালে ছাদে গিয়েছিলো। তবে সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, ওর মা আগে থেকেই সেখানে আছে। ওনি সাধারণত ছাদে ওঠেন না৷ বিকালে বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখেন, নইলে পাড়া বেড়াতে বের হন৷ এই ভাবির বাড়ি, ওই ভাবির বাড়ি।
আজকে ছাদে দেখেও তিলো অবাক হয়নি। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেও হয়নি৷ ওনি কাঁদছিলেন। তিলো ওনাকে সামলাতে যায়নি৷ কেঁদে হালকা হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাছাড়া ও সামলাতে গেলে হয়তো হিতে বিপরীত হতো। ওনার সহানুভূতি পছন্দ না। আবার তিলো তো অভিমান করে আছে তাঁর উপর।
তিলো নিঃশব্দে নিচে চলে এসেছে।
সন্ধ্যার পর বইগুলো নিয়ে বসে ও পড়ায় মন বসাতে পারছে না। কারণ অনুধাবন করলো, আশেপাশের পরিবেশের অস্থিরতা আর ওর পেটের ক্ষুধা নামক ছোট্ট ইঁদুরটা। সন্ধ্যার নাস্তার অভাব ও অনুভব করতে পারছে। তিলো রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে সাথে কয়েকটা বিস্কুট এনে বারান্দায় বসলো।
খেতে খেতে চিন্তাগুলো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মা আর বোনের মধ্যেকার ঠান্ডা যুদ্ধটা এতোদিন সবার চোখের আড়ালেই ছিলো। আজ যেন তিলো আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জেগে উঠেছে ওর ইন্ধনে। আর ও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে আগেই এলাকা ত্যাগ করেছে। চুপচাপ গর্তে লুকিয়ে আছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লো হঠাৎ ওর৷
ছোট থাকতে তুলির কোনো লুকিয়ে রাখা অন্যায় মাকে জানিয়ে দিয়ে তিলো একদম চুপ হয়ে দেখতো ওর বোনের বকা খাওয়া। তখন সে হতো সবচেয়ে ভদ্র মেয়ে। আজ এতোগুলো বছর পর আবারও ছোটবেলার একটা স্বাদ পাচ্ছে ও৷ যদিও তুলির অন্যায়টা এবার খুবই গুরুতর।
ওর ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। তিলো ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকিয়ে স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে বিরক্ত হলেও ফোন রিসিভ করলো। ও হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে বাজখাঁই কন্ঠ শোনা গেলো।
-আমার নাম্বার তুই তোর বান্ধবীকে দিয়েছিস তিল?
কন্ঠটা শুনে তিলো কয়েক মূহুর্ত চিন্তা করলো এটা কে। মনে পড়তেই বললো,
-কে? অরিক ভাইয়া?
-রাখ তোর ভাই। তুই দিয়েছিস আমার নাম্বার?
-হুম।
-কেন তিল? আর দিলেও বলিসনি কেন আমাকে বিরক্ত না করতে? কি উশৃংখল মেয়ে রে বাবা!
তিলোর আজকের মন খারাপের মাঝেও বেশ মজা লাগছে। অনি কাজ সেরে ফেলেছে। তারপরও এখন ওর অরিকের বকা শোনার সাধ নেই। মনে মনে বললো, প্লিজ আল্লাহ, এই মিথ্যার জন্য মাফ করে দাও। আর বলবো না। প্রমিজ।
কথাটা মনে মনে আওড়ে তিলো ফিঙ্গার ক্রস করে নিয়ে বললো,
-সরি ভাইয়া, আসলে ওকে আরেকটা নাম্বার দিতে গিয়ে তোমারটা চলে গিয়েছে। আজকে ভার্সিটিতে গেলে তখন ও বললো। নিষেধ করার সময় পাইনি৷ ওকে বলে দেবো।
অরিক নিজের কন্ঠ শান্ত করে বললো,
-হ্যাঁ বলে দিস। আর আমার এই নাম্বারটা একদম দিবি না৷ বেহায়া মেয়ে! নিষেধ করা সত্ত্বেও ফোন করে যাচ্ছে।
তিলো ছোট করে ‘আচ্ছা’ বলে ফোন কেটে দিলো। অরিক চাইছিলো না তিলো এখনই কেটে দিক। একবার ওরও জিজ্ঞাসা করা হয়নি, যে তিলো কেমন আছে আর না তিলো করলো। এটা কি সম্পর্কের অবচেতন দূরত্ব নাকি জড়তা আর সংকোচবোধ এটা অরিকের বোধগম্য হলোনা।
#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৫,,
পরদিন ভোরে বাড়িতে নাসীরা পারভীনের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই, হালিম সাহেব এসে হাজির হয়েছেন। হঠাৎ তার আগমনে নাসীরা পারভীন ব্যতীত কেউই আসলে খুশি হয়নি। লোকটা এককালে সচিব ছিলেন। একমাত্র মেয়ের জামাই একজন জীববিজ্ঞানী, তারা থাকে আমেরিকা। লোকটার অহংকারী ভাবটা আনিস সাহেবেরও পছন্দ না। নিজেকে কি মনে করেন, সেটা কেউ চিন্তা করেও বের করতে পারে না।
একদিন ভোরে আনিস সাহেবকে কল করে খোশগল্প শুরু করে দিলেন। তখন একদম ভোর। ঘুম ঘুম চোখে আনিস সাহেব ফোনটা রিসিভ করে কথা বলেন। কথাগুলো নিতান্তই অমূলক গল্প ছিলো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, তার শরীর বেশ অসুস্থ হয়ে ছিলো কিছুদিন যাবৎ। ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে কোনো রোগ পায়নি। এমনকি এটাও বলেন, ল্যাব রিপোর্ট নিতে গিয়ে ওনি জিজ্ঞাসা করায় ওরা বলে, ওনার স্টুলে কোনো ওয়ার্ম নেই। ঘুম ভাঙিয়ে এমন কথায় আনিস সাহেবের মেজাজ তখন তিরিক্ষি হলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারেননি।
তিলো ঘুম থেকে উঠে ওনাকে দেখে চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই লোকের মতলব ওর ভালো লাগে না। এক কাজ পেয়েছে এখন, ঘটকালি করা। তুলির বিয়েটা ওনি দিয়েছিলেন। আজ ওনাকে দেখেই অজানা আশঙ্কায় তিলো মৃদু কেঁপে উঠলো। হঠাৎ খবর না দিয়ে একা এলেন কেন? ওনার স্ত্রী কোথায়? তিলো এসব চিন্তা করতে করতেই একেবারে রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো ভার্সিটিতে যাবে বিধায়। ওনার আগেরবার যাওয়ার সময় বলা শেষ কথাগুলো তিলোর কানে বাজছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, তিলো বড় হয়েছে। ওর তো এখন একটা সংসার হওয়া প্রয়োজন। তুলি তো পার হলো। সামনেরবার এসে ওর জন্য জামাই ঠিক করেই যাবে।
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে ওনার দিকে পিঠ দেখিয়ে বসে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করে নিলো। পানি পান করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছোট করে হালিম সাহেবকে একটা সালাম দিলো।
হালিম সাহেব মুখে হাসি নিয়ে মৃদুসুরে তার জবাব দিয়ে বললেন,
-তিল মা, আজ বাইরে যাসনা।
তিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,
-যাওয়া তো লাগবে মামা। ক্লাস মিস করা যাবে না।
নাসীরা পারভীন পাশ থেকে বলে উঠলেন,
-মামা যখন যেতে নিষেধ করছে, তো একদিন না গেলে কিছু হবে না।
তিলোর সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। হালিম সাহেব কমলা দাঁত বের করে হেসে বললেন,
-বয় বয়। সামনে বয় তো দেখি। কতকাল দেখি না তোদের।
তিলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওনার সামনের সোফাটায় বসলো। হালিম সাহেব আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললেন,
-তা পড়াশোনা কেমন চলছে?
তিলোর একবার ইচ্ছা হলো বলবে, নিজেই তো যেতে দিলেন না ভার্সিটিতে। এখন এই প্রশ্ন অমূলক। কিন্তু বললো না। ভদ্র কন্ঠে বললো,
-এই চলছে। ভালোই। আলহামদুলিল্লাহ।
-তা ভালো।
কথাটুকু বলে ওনি চুপ করে আছেন। তিলোর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে যেন পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। এরপর নাসীরা পারভীনের দিকে ফিরে তাকাতেই। নাসীরা পারভীন তিলোকে নিজের রুমে যেতে বললো। তিলো বিরক্তির একটা মুখভঙ্গি করে নাসীরা পারভীনকে একনজর দেখে নিজের রুমে চলে এলো।
নিজের রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। নাসীরা পারভীন চিৎকার করে উঠলেন। তিলোও গলার স্বর চড়িয়ে বললো,
-সরি আম্মা। জোরে লেগে গিয়েছে।
এরপরই ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। এর কোনো মানে হয়? যেতে দেবে না আগে বললেই হলো। এতো কষ্ট করে তিলো রেডি হতোনা। তিলো কয়েক পদক্ষেপ হেঁটে নিজের শরীরটাকেও ঠাস করেই বিছানার উপর ফেলে দুইহাত দুদিকে প্রসারিত করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তিলো ভাবছে, ওর ভাবনা সত্যি হলে, তুলির বরটা তো খারাপ হয়নি৷ তুলি নিজের দোষে সংসার হারিয়েছে। তিলোর জন্যও এমন কাউকে? নাকি ওর গায়ের রঙের জন্য ওকে ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না?
তিলোর ভাবনার মাঝেই তুষার নক করলো। তিলো মুখ থেকে ‘চঁ’ জাতীয় একটা শব্দ করে উঠে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই তুষার হেলেদুলে রুমে ঢুকলো। তিলো দরজা চেপে দিয়ে তুষারের দিকে সন্দেহাতীত চোখে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। তুষার ওর বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বললো,
-তিলাপু তোর বিয়ে।
তিলো এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওর কথায়। যদিও আগেই আন্দাজ করেছিলো। তুষারের হাত টেনে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে বললো,
-বললেই হলো নাকি? বিয়ে এতো সহজ!! আমি করবো না।
-সেটা তোর ব্যাপার। আজকে যে তোকে পাকা দেখতে আসবে নিশ্চিত থাক।
তিলো কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
-তুই জানলি কেমন করে?
-মামাকে দেখলি না? আমি আম্মাকে আব্বুকে বলতে শুনেছি।
-আমার পছন্দের একটা বিষয় আছে।
-আগে তো দেখুক। বাদ দে। বলতো কালকে আম্মা তুলি আপুর উপর রেগে ছিলো কেন?
-আমি কি করে জানবো? তুই আম্মাকে জিজ্ঞাসা কর।
-সেটা পারিনা বলেই তো আমার আশেপাশে এতো রহস্য। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে বকা খাওয়ার সাধ নেই।
-জানা লাগবে না৷ তোর জানার বিষয়ও না।
-বল না। আমি জানি, তুই জানিস।
-না বললাম তো। বিরক্ত করিস না। এমনিতে মেজাজটা গরম হয়ে গেলো।
তুষার আরো কিছু সময় ওকে জোরাজোরি করা সত্ত্বেও ও বললো না। তুষার হতাশ হয়েই নিজের রুমে ফিরলো।
তুষার চলে যেতেই তিলো অনিকে ফোন করলো। ও সরাসরি আজকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলো অনিকে যে ও অরিকের সাথে আসলে কি করেছে। কিন্তু যেতে পারলোনা ভার্সিটিতে। আর ওর কৌতুহলও দমিয়ে রাখা সম্ভব না। তিলো কল করতেই অনি রিসিভ করলো। তিলো সাধারণ ফর্মালিটি বাদ দিয়ে সরাসরি ওকে বললো,
-কি করেছিস রে তুই অরিক ভাইয়ের সাথে?
অনিমা একমুহূর্ত চুপ থেকে ওর কথাটা বোঝার পর বললো,
-কি করবো? তোর ওই আনরোম্যান্টিক গম্ভীর ভাই তো শুরুতেই সব পন্ড করে দেয়। সকালের নাম্বার বাদ দিয়ে আরেক নাম্বারে ফোন করলাম। সে ধরেই আমি কথা বলছি না বলে কেটে দিলো। আমি আবার দিলাম। এবার রেগে ঝেড়ে দিলো। আমি আবার দিয়ে বুঝতে পারলাম, নাম্বার ব্লক করেছে। আমি আয়াশের ঘর থেকে ওর সীমের বক্সটা এনে আর আমার গুলো মিলিয়ে মোট তেরোটা সীম নিয়ে বসলাম, তাকে একে একে ফোন করবো বলে। সময় নিয়ে নিয়ে ফোন করলাম। আরো দুটো ব্লক করার পর আর ফোন ধরে না। এরপর সন্ধ্যায় কল করে বললাম, প্রফেসর আমি অনি। ওনি চিনলেনই না৷ তোর বান্ধবী পরিচয় দিলে বললো, কলেজে কোনো সমস্যা হলে অফিসে ফোন করতে। আবার দিলো কেটে। আমি আবার ফোন করে বুঝলাম সেটাও ব্লক করেছে। আরেকটা দিয়ে ফোন দিতেই, তিল, এই তিল…….।
অনিমা ওদিক থেকে তিলোর কোনো আওয়াজ না পেয়ে ওর নাম ধরে ডাকলো। তিলো ওর কথা শুনে ঝিমাচ্ছে। মেয়েটা এতো কথা বলে! একসাথে বলে যায়, ওদিকে কে শুনলো না শুনলো সেদিকে খেয়াল খুব কম। অনির মুখে নিজের নাম শুনে তিলোর হুস ফিরলো। আধো আধো গলায় বললো,
-হু বল।
-তুই কি আদৌও শুনছিস?
তিলো অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় বললো,
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। বল।
-বল আমি কি বলেছি এতোক্ষণ?
তিলো এবার বিপদে পড়েছে। তিলোর কৌতুহল হলেও অনির বর্ণনায় ওর ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো। তিলো আমতাআমতা করে বললো,
-ওই, ওই তো। কয়েকটা নাম্বার ব্লক খেলি। আবার দিলি। আবার ব্লক খেলি। আবার দিলি৷ আবার ব্লক খেলি। আবা……।
-থাম। তোকে আর বলবোই না। কিচ্ছু শুনিস না তুই।
-আরে আরে না। আমি শুনছি। বল।
অনি আবার শুরু করলো,
-ওনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন সকাল থেকে আমি বিরক্ত করছি। এবার ফোন দিতেই…
অনির কথা শেষ হওয়ার আগেই তিলো কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
-এবার ফোন দিতেই …।
অনির কথার মাঝে থামিয়ে দেওয়ায় ওর একদমই ভালো লাগেনি। কর্কশ গলায় বললো,
-তোর ওই মারুফ ভাই আমার সাথে প্রেমালাপ করেনি। কি উগ্র মেজাজ! যা নয় তাই বললো!
-মারুফ! হেইয়া কেডায়?
-ওই মারুফের মতো গালিগালাজ চালিয়েছে।
তিলো বুঝতে পারলো, অনি প্রতিকী অর্থে তার নাম নিচ্ছে। তিলো নাক ফুলিয়ে নিজের সামান্য রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বললো,
-আমার ভাই ওরকম ভাষা ব্যবহারই করে না। বাজে কথা বলবি না ওর নামে।
-এঁহে। এসেছে আমার ভাই ভক্ত বুন্ডি। শোন, আমি না হয় একটু বাড়িয়েই বলেছি। অতো খারাপ কথা সে বলেনি। কিন্তু খুব ভালো কথাও বলেনি। এই তুই না বলেছিলি, তুষার জন্মানোর পর ওকে কেবিনে নিয়ে আসতেই তোর দাদী তখন র’চা খাচ্ছিলেন, তাই মধুর অপেক্ষা না করে ওর মুখে র’চা দিয়েছিলেন আঙুলের মাথায় লাগিয়ে? তিল, আই স্যোয়্যার তোর অরিক ভাইকে এভাবে নীম পাতার রস খাওয়ানো হয়েছে জন্মের পর।
-তুষারেরটা সত্যি। ভাইয়েরটা তো জানি না।
-জেনে নিস। এই অনির ধারণা ভুল হতে পারে না।
বাই দ্য ওয়ে, ভার্সিটি আসবি না?
-না। ভালো লাগছে না।
অনি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। তিলোর খুব ঘুম আসছে। ভার্সিটি গেলে চা-কফি খেয়ে ক্লাস করা লাগতো। এখন উঠে গিয়ে চা বানাতে ইচ্ছা করছে না। তিলো আগে পিছে বেশি না ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো।
ওর ঘুম ভাঙলো নাসীরা পারভীনের ডাকে। ওনি বিরক্ত ভঙ্গিতে তিলোকে ডেকে চলেছেন। তিলো ঘুম থেকে উঠতেই, তিনি ওকে ফ্রেশ হয়ে এসে হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে পড়ে নিতে বললেন। তিলো পুরোটা বুঝতে পেরে বললো,
-আম্মা, আমি এখনি বিয়ে করবো না।
নাসীরা পারভীন ব্যস্ত ভঙ্গিমায় রুম থেকে বের হতে হতে বললেন,
-দেখাদেখি হলেই বিয়ে হয়ে যায়না মা। বিয়ে জীবনের খুব বড় একটা বিষয়। তোর মামার পরিচিত একটা ছেলে। দেখ তুই। পছন্দ না হলে তো আমরা আছি৷ মামা খুব আশা করে এনেছেন। তার সম্মান নষ্ট করিস না।
-আম্মা, তবুও।
তিলো ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটা বললো। যেন এখুনি কেঁদে দেবে। নাসীরা পারভীন চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-কথা শোনো আমার। দুপুরে খাবে ওরা। মাংসটা আমি রান্না করছি। কিন্তু যখন আমি বলবো, তুমি করেছো। তুমি সম্মতি দেবে। আমি তোমাকে রেসিপি শিখিয়ে দিচ্ছি। আর একটু এসে খুন্তি নেড়ে দিয়ে যাও। দ্রুত।
নাসীরা পারভীন রুম ত্যাগ করতে নিতেই তিলো বললো,
-আমি কালো বলে, মিথ্যা যোগ্যতা দেখাতে হবে?
নাসীরা পারভীনের কানে কথাটা গেলেও তিনি কিছু না বলেই রুম ত্যাগ করলেন।
#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৬,,
হালকা গোলাপি রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পরিহিত এবং চোখে মুখে হালকা সাজে মাথায় ঘোমটা টেনে দুজন অপরিচিত মহিলা এবং দুজন অপরিচিত পুরুষের সামনে পরিবার সহিত তিলো বসে আছে। তিলো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে একবার মুখ তুলে প্রত্যেককে দেখে নিলো। শুনেছে পাত্র এসেছে। কিন্তু পুরুষ দুজনের কাউকে দেখে ওর একজনকেও পাত্র বলে মনে হচ্ছে না। হালিম সাহেব এদিকে তিলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিলো নিজের সম্পর্কে এতো প্রশংসা শুনে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে যে ও নিজেও জানে না ওর এসকল গুণ রয়েছে!! তবে কিছু কিছু অবশ্য সত্যি।
আনিস সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাদের সামনে চা নাস্তা রাখা হয়েছে। কক্ষে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানে যে, কেউই এই দুপুরে সেগুলো ছুঁয়েও দেখবে না কারণ তাদের দুপুরের দাওয়াত এখানে, বিকালের চা নাস্তার নয়৷ এরপরও আনুষ্ঠানিকতা একটা বিষয়। ওদের কথাবার্তার একপর্যায়ে তিলো বুঝতে পারলো পাত্র আসলে কে? আর সেটা বুঝতে পেরেই তিলোর মনটা ভেঙে গেলো। দুজন অপরিচিত পুরুষের মধ্যে তুলনামূলক কম বয়স্ক, তারপরও বয়স নিতান্ত কম নয়, লোকটিই পাত্র। তিনি চমকে দেওয়ার মতো খাটো। গতানুগতিক কর্মঠ পুরুষের গায়ের রং। মাথায় খরা প্রবনিত এলাকার মাঠের রঙ, তবে তার উপর যেন তেল মালিশ করা। জানালা থেকে আসা দিনের আলো যেন সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। ছোট ছোট চোখ। তবে নাক টানা। ক্লিন শেভ করা মুখটাও তেলতেলে। বলিষ্ঠ গোটা গোটা আঙুল বিশিষ্ট হাতে নীল সবুজ শিরাগুলো ফুলে উঠেছে যেন। তিলো একবার চিন্তা করলো, লোকটা কি খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করেন। তবে কথাগুলোর একপর্যায়ে লোকটার পেশা জানতে পেরে তিলো হতাশ হলো। কারণ এমন একটা ছেলেকে কেউই হাতছাড়া করতে চাইবে না যদিনা এমন পরিবার মেয়েকে ছেলের পেশার সাথে বিয়ে দিতে চায়। লোকটা উচ্চ পর্যায়ের একজন ফরেন অফিসার। যোগ্যতা এবং আশেপাশের ছাউনি খুবই মজবুত যে, নিশ্চিতভাবেই একপ্রকার বলা যায়, তিনি তাড়াতাড়িই একজন ‘এ’ ক্যাটাগরির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন। জি-সেভেনের যেকোনো দেশে। তার রাজনৈতিক আশ্রয়ও রয়েছে। লোকটার বয়স সাইত্রিশ।
তিলোকে খুব ছোট ছোট কিছু জিজ্ঞাসা করায়, সে সঠিক উত্তরই দিলো। হালিম সাহেব একপর্যায়ে নাসীরা পারভীনকে ইশারায় তিলোকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন। তিলো কারো ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারলো না, আসলেই ওদের মনে কি চলছে। কারণ শেষের দিকে ওদের আলোচনা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হয়েছে, যেটা চালিয়ে নিয়ে চলেছেন হালিম সাহেব।
তিলো রুমে আসতেই নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে মাথার ঘোমটা ফেলে বললো,
-ওই লোকটা পাত্র?
নাসীরা পারভীন কেবল ছোট করে হুম বললেন। তিলো দুইহাত দুদিকে প্রসারিত করে ঠোঁট জোড়া সামান্য ফাঁকা করে হতাশার ইঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-আম্মা। শোনো, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। আমি কি বললাম? তিনি একজন লোক আসলে। তার উচিত একজন মহিলাকে বিয়ে করা। আমি ছোট, একটা মেয়ে। মহিলা নই। আমার সবে একুশ বছর।
নাসীরা পারভীন শান্ত দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোর কি কোনো পছন্দ আছে?
তিলো ঠোঁটের কোণা উঁচু করে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বললো,
-প্রশ্নটা তুমি করছো?
নাসীরা পারভীন আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। বিশাল এক আলোচনা সভার পর দুপুরে খেতে বসতে বসতেই প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছে। তিলোর আবারও ডাক পড়লো তাদের খাবার পরিবেশন করতে। তিলো যতটুকু পারে, ততটুকুই করলো। যাওয়ার আগে ওদের ভেতর একজন মহিলা সামান্য আনুষ্ঠানিকতার সহিত তিলোর অনামিকায় একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। এমন ঘটনায় তিলো হতভম্ব হয়ে গেলো ঠিকই। তবে চমকে উঠলো হঠাৎই হালিম সাহেব আর নাসীরা পারভীনের উচ্চস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ওঠায়। তিলো আনিস সাহেবের কন্ঠ শুনতে পেলোনা। ওর চোখ পানিতে ভরে উঠেছে, ওর মতামত নেওয়ার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই?
ওরা চলে যাওয়ার পর পর হালিম সাহেবও চলে গেলেন। তিলো লিভিং এ সবার উদ্দেশ্যে বললো, এই বিয়ে ও করবে না। ওর ছেলেকে পছন্দ হয়নি। নাসীরা পারভীন ওকে কিছু বলার আগে আনিস সাহেব বলেন,
-ঠিক আছে। তোমার পছন্দ না হলে এই বিয়ে হবে না।
নাসীরা পারভীন বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কি বলছো কি তুমি? এমন একটা ছেলেকে হাতছাড়া করা যায়? নেহাত ভাইয়া ওমন একটা পর্যায়ে ছিলো বিধায়! না হলে, তুমি পারতে আমাদের তিলের জন্য এমন ছেলে এনে দিতে?
আনিস সাহেব হাত উঁচু করে ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-শুধু তার সামাজিক অবস্থান দেখছো? আমার মেয়ের ভালো না লাগলে, সে কিভাবে সুখী হবে? তাছাড়া ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতেও চাই না। লেখাপড়া করছে করুক।
-আরে বাবা, ওরা তো পড়াবে ওকে। অ্যাম্বাসেডর সাহেবের বউ অশিক্ষিত থাকবে নাকি? বললো তো পড়াবে। একবার ভাবো, তুষারের ভবিষ্যতও একেবারে সাজিয়ে দেওয়া যাবে। তুলি যা ঘটিয়েছে, তাতে তিলোর সমন্ধটা কতো ভালো!
নাসীরা পারভীন আর আনিস সাহেব কথা কাটাকাটি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিলো বুঝতে পারলো, ওর বাবারও আসলে ছেলে পছন্দ হয়নি। তিলো ওনাদের ঝগড়ার মাঝে থাকতে চায়না। ওর বাবা একদমই একজন ফ্যামিলি ম্যান। ওনাদের ঝগড়া খুব কমই হয়। যতক্ষণ হয়, ছেলেমেয়ে কেউই ওনাদের ভেতরে ঢোকে না।
তিলো রুমে এসে আঙুলের আংটিটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনলাইনে ঢুকে স্ক্রোল করতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের ভেতরই ওর এলোমেলো মেজাজটা ভালো হতে শুরু করলো।
কিছু সময় পর নাসীরা পারভীন তিলোর রুমে এসে ওকে বললেন,
-তুই ভেবে দেখিস মা। সময় নে। মাথা ঠান্ডা করে সবটা ভাব। তারপর সিদ্ধান্ত জানা। চেহারাই তো সব না। লোকটা ভালো। তোকে সুখে রাখবে। সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখ। হুট করে একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিস না।
নাসীরা পারভীনের কন্ঠ ভেজা ভেজা। ওনি যে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। তিলো চিন্তা করলো, ওনাদের মাঝে গুরুতর কিছু হয়েছে কি? তিলো এরপরও কঠিন কন্ঠে বললো,
-হুট করে তো তোমরাও একটা সিদ্ধান্ত নিলে!
নাসীরা পারভীন তিলোর ছেড়ে রাখা চুলগুলোতে হাত দিয়ে আঙুলের ফাঁকা থেকে টেনে দিতে দিতে বললেন,
-তুই সময় নে। ভাব। ভেবে জানা।
নাসীরা পারভীন আর কিছু বললেন না৷ তিলোর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিলো চোখের মণি ঘুরিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে আবারও নিজের ফোনে মনোযোগ দিলো।
অরিক নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে জানতে পারে, ওর বাবা মা কালই চলে যাবেন নিজেদের বাড়িতে। শুক্রবার সবার দাওয়াত, তাই বাড়ি গোছানো প্রয়োজন। অরিক ভার্সিটিতে চাকরির সুবিধার্থে এই শহরে একটা বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ওর বাবা মা আর ভাইও এসে থাকে। যেমন, গত শুক্রবার থেকে আজ পর্যম্ত রয়েছে। অরিক আজ বেশ বিরক্ত। তিলো আজও ভার্সিটিতে আসেনি। ও নিজেও বুঝতে পারছে না, ওর আসলে হয়েছে কি? তিলোকে নিয়ে ও কেন ভাবছে? যে মেয়েটাকে ছোট থেকে দুচোখে দেখতে পারতোনা, এখন ভার্সিটিতে ওকে না দেখতে পেলে ভালো লাগে না। আজকে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বেশ অনেকগুলো কাজ ছিলো ওর। সব সেরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছে।
অরিক বাড়ি ফিরে একবার তিলোকে ফোন করবে ভাবলো। এরপরই ফাহমিদা বেগমের ডাক পড়ে খেতে যেতে।
রাতে খাবার টেবিলে সকলে একসাথে বসে খাওয়ার সময় বিভিন্ন কথার মাঝে হঠাৎই আকবর সাহেব বললেন,
-মৃদু(ফাহমিদা বেগমকে উদ্দেশ্য করে) আমাদের তিলের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।
কথাটা অরিকের কানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে তবে ওর চমকে উঠে একটা হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি। অরিক কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালো। ওনি সে দৃষ্টির দিকে চেয়েও দেখলেন না। ফাহমিদা বেগমের দিকে তাকিয়েই বললেন,
-ছেলে সে ফরেন অফিসার। হাই কোয়ালিফিকেশন। অ্যাম্বাসেডর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। একটাই সমস্যা। বয়স একটু বেশি। তাতে কি? এদিক ছাড় দিলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।
ফাহমিদা বেগমের মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গিয়ে আবারও নিজেকে সামলে বললেন,
-বলো কি? তিলোর জন্য এমন সম্বন্ধ? কপাল করে জন্মেছিলো বলতে হবে। ওই গায়ের রঙে…
কথাটা ওনি শেষ করতে পারলেন না তার আগেই আকবর সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওনার নাম ধরে ডাকলেন। এটা ছিলো আসলে সতর্কতা। তিলোর রঙ নিয়ে সমালোচনা করা একজন ব্যক্তি ওনি। আর এটা আকবর সাহেব পছন্দ করেন না। ফাহমিদা বেগম চুপ করে সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে মনোযোগী হলেন।
এদিকে অরিকের গলা থেকে খাবার নামছে না৷ আজানা কষ্টে বুক ভার হয়ে আসছে। অরিক জানে না, কেন ও কষ্ট পাচ্ছে? তবে পাচ্ছে।
ও কিছু না বলে হঠাৎই উঠে গেলো খাবার ছেড়ে। ফাহমিদা বেগম ওকে ডেকেও থামাতে পারলেননা। অরিকের আজকের আচরণ ওনার বোধগম্য হলোনা। পুরোটা অভ্রের চোখে পড়লেও ও কেবল নির্বাক দর্শক ছিলো পুরো ঘটনার৷ অরিকের মাথায় কি চলছে, ও আন্দাজ করতে পারলেও অরিককে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ ও করছে না। অরিক নিজেই খুঁজে নিক নিজের অনুভূতির উৎস।
অরিক তিলোর ফোনে কল করে ব্যস্ত পেলো। স্বগতোক্তি করে উঠলো,
-বিয়ে ঠিক হয়ে পারেনি আর বুড়োর সাথে গল্প শুরু করে দিয়েছে!
অরিক পরপর কয়েকবার দিয়ে ব্যস্তই পেলো।
তিলো সারারাত জেগে আছে। ও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ নয়। খুব ভেবেচিন্তে। ও জানাতে চায় ওর মাকে। কিন্তু এখন ওনি ঘুমাচ্ছেন।
তিলো ফজরের আযান পর্যন্ত জেগে, ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। এরপর অপেক্ষা করলো নাসীরা পারভীনের জেগে ওঠার।
নাসীরা পারভীন ওয়াক্ত মতোই উঠে ওজু করে নামাজ আদায় করতে দাঁড়ানোর আগেই তিলো ওনার ঘরের দরজায় নক করলো। আনিস সাহেব মনে একটা খটকা নিয়ে দরজা খুলতেই তিলো ভেতরে ঢুকে দুজনের উদ্দেশ্যেই বললো,
-আমি বিয়েতে রাজি আম্মা।
ওর এই ছোট একটা বাক্যে নাসীরা পারভীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আনিস সাহেব কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ করলেন না।
#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৭,,
নাসীরা পারভীন তিলোর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিলো ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে আবারও নিজের ফোনে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ পর মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো ঠিকই। তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। ফাহাদের স্ত্রী কলি ওর অনলাইন ফ্রেন্ড। তার কিছু পোস্ট নিজের চোখের সামনে পড়তেই তিলোর মনে বিষাদের কালো মেঘ ছেঁয়ে গেলো। ফাহাদকে নিয়ে তার সুখী দাম্পত্যের বর্ণনায় বিভিন্ন পোস্ট। তিলো ফাহাদকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। ওর মনেও পড়েনা সবসময়। তবে প্রথম ভালোবাসা সবসময়ই মনে আলাদা স্থান দখল করে থাকে, এটা ও অস্বীকার করতে পারে না। এখনো ফাহাদের সাথে কলিকে দেখলে ওর ভেতরটা বারবার মুচড়ে ওঠে। সে হয়তো আবারও কাউকে নিজের জীবনে, নিজের মনে জায়গা দিতে পারবে, কিন্তু তাকে ভোলা অসম্ভব ওর পক্ষে।
তিলো না চাইতেও ওর চোখ ভরে উঠছে পানিতে। ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে পাশে রেখে দিলো। আর ভালো লাগছে না ওর ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে। বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে চলে গেলো। ইতিমধ্যে ও শাড়ী পাল্টে সালোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। ছাদের কিনারে রেলিঙের উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকাল শেষ হতে যাওয়া আকাশটার দিকে চেয়ে আছে। পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরছে। কাকগুলো কাঁ কাঁ করে ডাকছে। দূরে কোথাও ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে। এক কথায় আকাশটা ফাঁকা নেই। ভালোই লাগছে এখন। মৃদু বাতাস ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। শিরশির অনুভূতি হচ্ছে শরীরে। তিলো চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো।
কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাড়ির গেট থেকে শাহানা আন্টিকে ঢুকতে দেখলো ও। তিলো সেদিকে কোনো কৌতুহল দেখালো না। নাসীরা পারভীনের সাথে গল্প করে চলে যাবেন৷ এতে ওর ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আজ আবার ওকে নিয়ে যে বিশাল আলোচনা হবে সেটাও ও বুঝতে পারছে। তিলো স্থির দৃষ্টিতে ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ অস্তমিত সূর্যের হালকা আলোয় আলোকিত আকাশটার দিকে তাকালো। আকাশটাও রঙিন৷ কেবল ওর গায়ের রঙের সাথে সাথে জীবনে কালো রঙ ছেঁয়ে আছে। কিছু সময় পর টের পেলো ছাদে কেউ আসছে। তিলো ঘাড় না ঘুরিয়েও বুঝতে পারলো এটা তুলি।
তুলি এগিয়ে এসে ওর পাশেই দাঁড়ালো। আজকে সারাদিনের ঘটনায় তুলির কথাটা ওর মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। তিলো চোখ ফিরিয়ে তুলির দিকে তাকালো। একদিনেই চেহারায় বিষন্নতার ছাপ পড়ে গিয়েছে। চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। তিলো কোনো কথা খুঁজে পেলোনা বলার জন্য। হয়তো এমন পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই বলা যায় একটা মানুষকে। তবে তিলো সেই ভাষা খুঁজে পেতে ব্যর্থ। মস্তিষ্ককে চাপ দিলো না ভাষা খোঁজার দ্বায়িত্বে লেগে পড়ার জন্য।
দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। কেবল কাকগুলোর ডাক শোনা যাচ্ছে। অপূর্ব সুন্দর গোধূলিতে কেবল দুজনের মনের ভেতরকার সৌন্দর্যটুকু নেই। দুজনেই আলাদা আলাদা মনতাপে দগ্ধ হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। দুজনের যন্ত্রণার কারণ এবং ধরণ ভিন্ন প্রকারের হলেও তারা একই বিষন্নতার শিকার। পাশাপাশি দাঁড়িয়েও কেউ কাউকে সেটা না বলে কোনো সেতু তৈরি করছে না নিজেদের ভেতর বিধায় তারা আসলে মানসিকভাবে একে অপরের থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে।
তিলো মাগরিবের আযান পড়তেই নেমে আসতে নিলো। তুলি ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীরটা টপকে তিলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-গতকাল তুই আমাকে বাইরে দেখেছিস। তাই না?
তিলো ওর দিকে না তাকিয়েই কেবল ছোট করে ‘হুম’ বললো।
তুলি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-আম্মাকে বলার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করলি না?
তিলো এবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে কঠোর ভঙ্গিমায় বললো,
-কাজটা খুব মহান কোনো কাজ ছিলোনা যে আলোচনা করে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-একবার আমাকে কারণটা জিজ্ঞাসাও করলি না? কৌতুহল হয়নি?
-তোর নোংরামিতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
তুলি কেবল একটু হাসলো। হাসিতে তার স্পষ্ট উপহাস। তিলো আবারও ফিরলো যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
-লোকটা আসলে ভালো তিল। ওনার ব্যক্তিগতভাবে তোকে পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে অসুখী হবি বলে মনে হয়না। জানিস তো, এই ধরনের মানুষেরা কম বয়সী বউ পেলে তাদের যত্ন করে।
-আমি সম্মান প্রত্যাশী। যত্ন,,, খুব প্রয়োজন নেই।
তিলো আর দাঁড়ালো না। নিচে নেমে এলো নিজের ঘরে। মাগরিবের নামাজ আদায় করে মীরার কাছে থেকে আজকের নোটগুলো সংগ্রহ করে নিজের খাতায় তুলতে শুরু করলো। আজও সন্ধ্যাকালীন নাস্তা ওর নাগালে আপনাআপনি আসছে না দেখে তিলো রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। ও দেখলো এখনো শাহানা আন্টি বসে গল্প করে যাচ্ছেন। মাঝখানে বোধহয় নামাজের জন্য বিরতি নিয়েছিলেন। তিলো নিজের মনেই বিরবির করে উঠলো, ফের মিলেঙ্গে ব্রেক কি বাদ।
কথাটা মনে পড়তেই ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়লো। ওর বাবা মায়ের ঝগড়া খুব কমই হয়। তবে একবার বেশ বড়সড় ঝগড়া বেঁধেছিলো। তিলো তখন জি টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল আর রান্নার অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক ছিলো। রান্নার অনুষ্ঠানে কথাটা বলা হতো ব্রেক নেওয়ার আগে। ওনাদের ঝগড়া চলতে চলতে আছরের আযান পড়ে যায়৷ তাও থামে না। এবার ওয়াক্ত শেষ হতে নিতেই তুলি মাঝখান থেকে চিৎকার করে ওনাদের সতর্ক করে। নাসিরা পারভীন রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,
-দাঁড়াও নামাজের পর তোমার ব্যবস্থা নিচ্ছি।
আনিস সাহেবও তাল মিলিয়ে বলেন,
-আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছো? আজ একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বো।
বলে দুজন দুদিকে নামাজের উদ্দেশ্যে লিভিং ত্যাগ করতেই তিলো বলে ওঠে, ফের মিলেঙ্গে ব্রেক কি বাদ।
কথাটা বলে ওর মুখে চন্দ্র জয় করা হাসি ফুটে ওঠে, যেন কথাটা বলার পরিস্থিতি সে আজ অর্জন করেছে। নাসীরা পারভীন এবং আনিস সাহেবের কানে বাক্যটা প্রবেশ করতেই ওনারা নিজেদের ঝগড়া ভুলে তিলোর ওপর চড়াও হলেন। তিলোর হাসি মুখটা নিমেষে কালো মেঘে ছেঁয়ে গেলো।
কথাগুলো মনে পড়ায় তিলোর মনটা আরেক দফা খারাপ হলো। দিনগুলো কতো দ্রুত চলে যায়!
আজকে অতিথিদের আগমনের উদ্দেশ্যে অনেক প্রকার খাবারই আনা হয়েছে বাড়িতে। তিলো একটা গালে দিয়ে আরেকটা খুঁজছে। মন খারাপ হলে ওর বেশি ক্ষুধা পায় যেন। এখন কোনটা রেখে কোনটা খাবে এটার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ওর জন্য দুষ্কর।
বিড়ালের ন্যায় রান্নাঘর থেকে পেট পুড়ে খেয়ে তিলো ডাইনিং এর ফ্রিজ থেকে চকলেট বের করে নিয়ে নিজের রুমে ফিরলো। মন ভালো করতে এটা বেশ কার্যকর। নিজেকে ওর গোপন এজেন্ট মনে হচ্ছে। সে শাহানা আন্টির চোখ ফাঁকি দিতে পেরেছে!! ওনি তিলোকে একবারও ডাকলেন না! নিশ্চয়ই খেয়াল করেননি। আরে বাহ্!
তিলো নিজেকেই নিজে বাহবা দিলো।
ডিনার শেষে কেবল ঘুমানোর উদ্দেশ্যে বিছানায় উঠতেই ওর ফোনে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। তিলো ভ্রু কুঁচকে একবার সেটা দেখে রিসিভ করে নিলো। কানে ধরতেই ভদ্র তবে সামান্য গম্ভীর একটা কন্ঠ ওকে সালাম দিলো। তিলো তার উত্তর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কে।
-আমি শামীম রেজা বলছি।
তিলো এই নামের কাউকে চেনে না। কন্ঠে ভদ্রতা ধরে রেখে বললো,
-দুঃখিত, আমি ঠিক চিনতে পারছি না আপনাকে।
লোকটা বোধহয় ব্যথিত হলেন। বললেন,
-আপনি আমার নাম জানেন না? আজ আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছে।
তিলোর মুখটা আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেলো। এখন গলা থেকে নূন্যতম স্বর বের করতেও তিলোর সংকোচবোধ হচ্ছে। অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে ও। লোকটা হয়তো বুঝতে পারলো ওর পরিস্থিতিটা। ওকে অভয় দেওয়ার সুরে বললেন,
-আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন?
কথাটা বলেই রেজা বুঝতে পারলো আসলে সে কতোটা নির্বোধের মতো একটা প্রশ্ন করেছে। ইচ্ছা করছে নিজের গলা টিপে ধরতে৷ একটা সদ্য পরিচিত মেয়েকে সরাসরি এভাবে জিজ্ঞাসা করা! রেজা চোখ বুজে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে চোখ মেললো। হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো একটা মেয়ের সংস্পর্শে এসে সে একটু বেশিই ব্যস্ত এবং উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। প্রথমে তো সে কাউকে ভালোবাসতো। সেই কলেজ জীবনে। বেকার ছিলো বিধায় প্রথম ভালোবাসাটা তার পরিপূর্ণতা পায়নি। এরপর তো কোনোদিনই বিয়ে করবে না ভেবেছিলো। পরিবারের চাপে এই বয়সে এসে বাধ্য হয়েছে।
রেজার কথায় তিলো আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়েছে। তিলোকে চুপ করে থাকতে দেখে রেজা বললো,
-আসলে দুঃখিত।
এরপরও দুজনের মাঝে দীর্ঘ সময়ের নিরবতা। রেজা তারপর আবারও বললো,
-আপনার কি বিয়েতে মত আছে। না থাকলে নির্দ্বিধায় বলুন। আর এগোনো হবে না।
তিলো বলতে চাইলো ওর আসলে মত নেই। তবে লোকটার ভদ্রতা ওকে বাঁধা দিচ্ছে কোথাও। তিলো আমতাআমতা করে বললো,
-না আসলে… আসলে আমি ঠিক যাই না আপনার সাথে। আমার মতো একটা মেয়ে কোথায় আর কোথায় আপনি?
ওদিক থেকে অট্টহাসির আওয়াজে তিলো নিজের কথা থামিয়ে দিলো। তিলোর অবাক লাগছে। ওর কাছে এমন পেশার মানুষকে সবসময়ই গম্ভীর, একটুখানি রাগী, একদম আনরোম্যান্টিক, ফর্মাল হাসি ছাড়া কোনো হাসি থাকে না মুখে এমন মনে হতো। আজ ওনার হাসি আর কথা শুনে ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তিলোর অদ্ভুত লাগছে। তাছাড়া বয়স্ক মানুষটাকে কখনোই মনে হলোনা যে ওনি হাসতে জানেন। রেজা হয়তো ওর মন পড়তে পারলো। হাসি থামিয়ে বললো,
-আমি আমার পেশাগত জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন এক করে ফেলি না কখনো। বাড়িতে রসিক মানুষ বলেই আমাকে সকলে জানে। দেখুন, আজ কথা হয়ে পারেনি নির্লজ্জের মতো আমি ফোন করলাম।
ওদিকে অরিক রাতের খাবার টেবিলে বসে তিলোর বিয়ের কথা শোনার পর থেকে অস্থির হয়ে ওকে একের পর এক ফোন করে ফোন ব্যস্ত পাচ্ছে। তিলো যে ওর হবু বরের সাথে কথা বলছে, অরিক আন্দাজ করতে পারলো। কোথাও যেন নিজের ভেতর হিংসা ধরনের একটা ভাব ফুটে উঠেছে।
তিলো ধীরে ধীরে রেজার সাথে কথা বলে চলেছে। তিলো নিজেকে ছোট কেন মনে করে, এটা নিয়ে রেজা বেশ গম্ভীর গলায় কিছু বললো ওকে। তিলো যখন নিজের গায়ের রং নিয়ে বললো, রেজা হেসে উড়িয়ে দিলো বিষয়টা৷ ওর গায়ের রঙে রেজার কিছুই যায় আসে না। তিলো বললো সে কোনো কাজ পারে না। আজ ওর নামে বলা সব কথা সত্যি না৷ রেজা এবারও বললো, সে জানে সবকিছু। তিলোকে সে বাড়ির বউ করে আনছে, কোনো কাজের মানুষ না৷ বাড়িতে ওর মাও রান্না করে না। সবকিছুই কাজের লোক করে। সে তাকে বউ হিসাবে সম্মান দিতে চায়। যদি তিলোর মনে হয়, নিজে কিছু করে স্বামীকে খাওয়াবে৷ সেটা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছাধীন। রেজার কথাগুলো তিলোর ভালো লাগছে। লোকটার মানসিকতা খারাপ না৷ তিলোর চিন্তার একদমই বাইরে। লোকটা খুব দ্রুত নিঃসঙ্কোচে তাকে আপনি থেকে তুমি সম্বোধনে নেমে এসে নিজেকে হ্যাংলা নয় বরং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রমাণ করলো। তিলোর প্রধানতম ভয় ছিলো, বু্ড়ো স্বামী কেবল স্বামী হবে কোনো বন্ধু নয়। তিলোর ধারণা দেড় ঘন্টার আলাপ চারিতায় রেজা ভেঙে দিলো। তিলো নিজের অজান্তেই তার সাথে সহজ হয়ে এসেছে। ও কথা বলছে সাবলীলভাবে এখন। কথা শেষে যখন সেদিনের মতো বলার কিছু ছিলোনা তাদের উভয়েরই, ফোন কেটে দেওয়ার আগে রেজা হঠাৎই বললো,
-তিল, তোমার ভাঙা দাঁতটা কিন্তু তোমার গোলগাল মায়াবী মুখটায় একদম মানানসই। আরো ভালো লাগে।
তিলো চমকে উঠলো ওর কথায়। দুটো কারণ ছিলো তার। মাত্র কিছুক্ষণের কথায় এভাবে তিলো সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করলেন! আরেকটা কারণ, ওর ভাঙা দাঁতটা কিভাবে রেজার চোখে ধরা পড়লো। ওর মা’ই তো দেখেছে দুদিন পর যখন ওর দাঁতটা ভেঙেছে। আসলে এতো ছোট এবং সূক্ষ্ম ভাঙা যে খুব গভীরভাবে খেয়াল না করলে একদমই বোঝার কথা নয়। কিশোরী বয়সে একটা ক্লিপ থেকে পাথর তুলতে গিয়ে সামনের দাঁতের একটা একটুখানি, অতি সামান্য পরিমাণ ভেঙে গিয়েছে মাঝখান থেকে। সামান্য ঢেউ তুলে থাকে যা কেউ বুঝতে পারে না। নাসীরা পারভীন দুদিন দেখেননি৷ দুদিন পর ওর সাথে গল্প করতে করতে যখন তিলো প্রাণ খুলে হাসছিলো তখন তিনি বিষয়টা আবিষ্কার করেন। তিলো আগে বলেনি, বকা খাওয়ার ভয়তে। আর রেজা খেয়াল করেছে! তিলো তো ওদের সামনে অনেক অল্প কথা বলেছে। হাসেনি। এতটুকুতেই খেয়াল করেছে। রেজা ওর এই কৌতুহল না মিটিয়েই ফোন কেটে দিলো। তিলোর ইচ্ছা করছে জানতে যে, রেজা এতোটাই সূক্ষ্মভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু লজ্জায় পড়ে নিজে থেকে ফোন করলোনা।
রেজার সাথে কথা শেষ করে তিলোর বেশ ভালোই লাগছে। সারাদিনের মন খারাপটা নেই। নাহ্। লোকটা ভালোই। তিলোকে তার প্রথম প্রেমের গল্পও সংক্ষেপে শুনিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিলোকে সে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই কথা বলেছে। লোকটা দেখতেও খুব একটা খারাপ না৷ খাটো এবং টাক। এটুকুই। চেহারা দিয়ে কি হবে? মানুষের মানসিকতাই তো আসল। বয়স একটু বেশিই বেশি। মানিয়ে নেওয়া যায় কি?
তিলো আরও ভাবছে, এই বিয়েটা করলে ফাহাদকেও দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে, সেও তাকে ছাড়া নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে জানে। নাসীরা পারভীনকে কিভাবে দোষ দেবে ও? প্রতিটা বাবা মাই চায় তাদের সন্তান ভালো থাকুক। আর সমাজের প্রেক্ষাপটে, টাকা ছাড়া জীবন অচল৷ সমাজের পরিবারগুলোও জামাইয়ের পেশার সাথেই মেয়ে বিয়ে দেয়। কোন বাবা তার মেয়েকে একটা বেকারের হাতে তুলে দেন? একটা সন্তান যখন পৃথিবীতে আসে, তখন তাদের মৌলিক চাহিদাটুকু মেটানোর জন্য হলেও তো বাবা মা আয় রোজগার করেন। টাকা ছাড়া ভালো স্কুলে পড়াতে পারবে না। ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে পারবে না। ভালো চিকিৎসা দিতে পারবে না। সবকিছুই অর্থ কেন্দ্রীক বানিয়ে ফেলেছে মানুষ।
তিলো এতোটাও না ভেবে, কিছুটা ভাবলো সারারাত বসে। সিদ্ধান্ত নিলো, সে রেজাকে বিয়ে করবে। রেজা এখনো ওকে সময় দিয়েছে ভাবতে৷ বলেছে অমত থাকলে বলতে। যদি বাড়িতে ও না বলতে পারে তবে রেজাকে বললে রেজা নিজেই বিয়ে ভেঙে দেবে। তবে তিলো ফজরের সময় ওর মাকে নিজের মতামত জানিয়েই দিলো।
#চলবে