ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -১৮+১৯+২০+২১

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১৮,,

-দোস্ত সত্যিই তুই রাজি হয়ে গেলি?

ভার্সিটির মাঠে একটা বড় গাছের ছায়ায় সকলে বসে আড্ডা দিতে শুরু করেছে। আজকের সবচেয়ে বড় বিষয় তিলোর বিয়ে। কারো যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা। হঠাৎ করে এমনটা হবে ওরা কেউ ভাবতে পারেনি। মিরা অবিশ্বাসের কন্ঠে কথাটা বললো। সম্বন্ধ আসতে পারে, তাই বলে ও কাউকে একবারও না বলে একেবারে রাজি হয়ে কথাটা বললো! হজম হচ্ছে না কথাটা। বিশেষ করে অনির। অনি ছেলের বয়স শুনে নাক শিটকাচ্ছে। সাথে যখন শুনেছে টাক, অনির তো হার্টফেইল করার উপক্রম।
অবিশ্বাসের সুর গলায় স্পষ্ট রেখে অনিমা বললো,

-তিল, রাজি হয়ে গেলি? লোকটা আসলে লোকটাই। নাতি নাতনির মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা, কে জানে? লোকগুলো আসলে বিরক্তিকর।

তিলো ওর কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে বললো,
-তবে মানুষ ভালো।

-এক দেড় ঘন্টা কথা বলে কিভাবে বুঝলি? মানুষ কয়েক বছর সংসার করেও বুঝতে পারে না।

-কয়েক বছর সংসার করে তো আর বিয়ে করা সম্ভব নয়। আগের দিনগুলোতে তো কেউ কাউকে না দেখেই বিয়ে করতো। জানিস, অরিক ভাইয়ার নানা নানীর কিভাবে বিয়ে হয়েছে? অরিক ভাইয়ার নানার বাড়ির লোক একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিলো। তবে বিয়ের দিন তারা পাত্রী বদলে একটা কৃষ্ণ বর্ণের বোবা একই সাথে কানে কালা মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিচ্ছিলো। এদিকে পাশের গ্রামের অরিক ভাইয়ার নানীর বর ওই দিনই বিয়ে করতে আসার সময় নৌকা ডুবে মারা যায়। অরিক ভাইয়ার নানাকে ঠকানো হয়েছে বলে বিয়ে না করে চলে আসে। এদিকে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তার নানীকে কতো কথা শুনতে হচ্ছিলো! অরিক ভাইয়ার নানীর বাবার ক্ষমতা ছিলো অনেক। এখন মেয়ের বিয়ে দিতে পাত্র খোঁজ শুরু। যে করে হোক সেই রাতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন। এদিকে তাকে অলক্ষী বলে কেউ বিয়ে করতে রাজি হলোনা। অরিক ভাইয়ার নানা বরযাত্রী নিয়ে সেই গ্রাম ধরে যাওয়ার সময় একপ্রকার তুলে নিয়ে গিয়ে তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। তারা কি অসুখী হয়েছে? এখনো বেঁচে আছেন তারা। দুজন দুজনকে ছাড়া একপাও চলে না। কথা হলো, দেখা সাক্ষাৎ বিষয় না। সে যদি ইচ্ছা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তো তুমি হাজার খুঁজলেও পাবে কিভাবে তার আসল রূপের খোঁজ। গোয়েন্দা লাগাতে হবে তো তাহলে।

তিলোর গল্প শুনতে শুনতে আহান রিয়ার কোলে মাথা রেখে শুতে নিতেই রিয়া ওর চুল ধরে টেনে তুললো। আহান ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ওর সমস্যা জিজ্ঞাসা করলে রিয়া চোখ বড় করে তাকিয়ে ওকে সতর্ক করলো। বিষয়টা কেউ খেয়াল না করলেও তৌকির করেছে। আহানের কানে ফিসফিস করে বললো,
-বিয়ে হতে না হতে বউয়ের শাসনে বিড়াল হয়ে গেলি!

কথাটা বলে তৌকির দাঁত বের করে হাসছে। আহান মুখে রাগের ভঙ্গিমা করে চুপ করে বসে থাকলো।

অনি বিরক্ত তিলোর প্রতি। অমন বয়স্ক একএকটা লোককে ও বিয়ে করবে মানতেই পারছে না। ওদের তর্কবির্তকের মাঝখানে অরিক এসে উপস্থিত হলো। এখন ক্লাস টাইম নয় তাই ওদের ঘাবড়ে যাওয়ারও কোনো কারণ নেই। অরিক তিলোর পেছনে দাঁড়ানো বিধায় ও খেয়াল করেনি।অনি ওর মুখোমুখি বসেছে আর সে এখন অরিকের মুখোমুখি। অরিকের দিকে চোখ পড়তেই অনি নিজের ওড়না টেনে পুরো মুখ ঢেকে ফেললো। আগেরদিনের ঘটনার পর ও অরিকের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। নিজের ভুল এবং হ্যাংলামি বুঝতে পেরে লজ্জাও পাচ্ছে। পুরো ঘোমটা টেনে বিড়বিড় করলো, এই কাজী মারুফ এখানে কেন রে ভাই? গালির ভান্ডার কি ফাঁকা হয়নি?

তিলো ভ্রু কুঁচকে অনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোর আবার কি হলো? কোনো অপরাধ করে পুলিশের থেকে লুকাচ্ছিস নাকি?

অনি কিছু বলার আগেই অরিক তিলোর নাম ধরে ডাকলো। তিলো মাথা ঘুরিয়ে ওকে দেখে বললো, ‘জ্বি।’

অরিক বলতে চায় তবে পরিবেশটা ওর কাছে উপযুক্ত মনে হলোনা। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললো,
-ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করে যাবে।

তিলো নিজের ভেতরকার জড়তা নিয়েই বললো,
-ঠিক আছে।

অরিক আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে ফিরে আসলো। তিলোর বন্ধুরা নির্বাক ছিলো এতক্ষণ। অরিক ফিরে যাওয়ার পর ফিরোজ বললো,
-তোর ভাই ডাকলো কেন তোকে?

তিলো কাঁধ নাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-আমি কি জানি। কিছু বলবে হয়তো। যাই হোক,
তিলো অনিকেতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-তোর যাওয়ার কি খবর?

-আরো কিছুদিন লাগবে।
অনিকেত মলিন কন্ঠে বললো।

তৌকির বললো,
-তা ভাই চলেই যখন যাবি আর নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবি তো এখানে পড়ছিস কেন? একবারে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে পড়াশোনা শুরু কর। আমি হলে তো এই কয়দিন শুধু চিল করতাম।

অনিকেত মন খারাপ করে বললো,
-যেতে কি আর ইচ্ছা করছে। দিই ডাকছে। বাবাও যেতে জোর করছে।

ওদের আড্ডার পরিবেশটা মূহুর্তে গম্ভীর হয়ে উঠলো। কিছু সময় পর অনি আবারও অধৈর্য্য ভঙ্গিতে ডেকে উঠলো, ‘তিইইল।’

-হ্যাঁ বল।

-তুই সত্যি রাজি হয়ে গেলি?

-আরে জ্বালা। এই মেয়ে তো সব কথার এক কথা বারবার বলে যাচ্ছে।

অনি কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বললো,
-এভাবে বললি তুই!! আর তুই কেবল চাকরি দেখে বিয়ে করছিস না?

-নাহ্। আমি বলেছি, তিনি লোক ভালো। এখন চাকরিটা একটা এডভান্টেজ। ‘এ’ ক্যাটাগরির অ্যাম্বাসেডর হবেন একজন যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে।

অনি বিরক্ত ভঙ্গিমায় বললো,
-‘এ’ ক্যাটাগরি না ‘জি’ ক্যাটাগরি, কোনো বিষয় না৷ বিষয় হলো লোকটা বুড়ো এবং টাক৷ আর সে খাটো।

তৌকির ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
-অ্যাম্বাসেডর তো তিন ক্যাটাগরি জানি আমি। এ, বি আর সি। এখন জেড ক্যাটাগরি কবে আবিষ্কার হলো। নিশ্চয়ই এটা অনির বরের পদ। এলিয়েন বিয়ে করবে তো সে আবার।

অনি খানিকটা রেগে তৌকিরের পিঠে নিজের ব্যাগটা দিয়ে বারি মারলো। তৌকির খুব বেশি ব্যথা না পেলেও সেখানে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো,
-সত্যি কথা তো! সবার গায়ে লাগে।

অরিক টিচার্স ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব ভালো করে নিজের চেহারা পরখ করছে। চাপ দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখছে। ছোটবেলায় ওকে একটা সাদা বড় বল মনে হতো। এখন একদমই মেদহীন বলিষ্ঠ একটা শরীরের অধিকারী সে। সেই শ্বেত ভাল্লুকের গায়ের রং খানিকটা চেপে গিয়েছে এখন, আরো ভালো লাগে। ছোট থাকতে রোদে দৌড়াদৌড়ি করলেই ওর গাল নাক পুরো লাল হয়ে যেতো। ওকে কিছু বিচ্ছু ছেলে ইঁদুরের লাল শিশু বলেও ডাকতো। এখন অতোটা হয়না। সময়ের সাথে কাজের ব্যস্ততায় গায়ের রং একটু চেপে গিয়েছে।
অরিক নিজের চেহারার পরিবর্তন খুঁজছে। যা আসলে ও খুঁজছে, তা পেলোনা। আজকে কি তিলোকে অন্য দিনের তুলনায় বেশি ভালো লাগছিলো? অরিক চিন্তা করছে। গ্রামের বাড়িতে খালার বিয়ের সময় গিয়ে অনেক কথা শুনেছে ও। দূর বনে নাকি একটা ফুল ফোটে। যার উদ্দেশ্যে ফোটে তার নাকি বিয়ে হয়। একে নাকি বিয়ের ফুল বলে। অরিক কখনোই সেগুলো বিশ্বাস করে না। ও আরো শুনেছে, বিয়ের সময় নাকি চেহারা খোলে। তিলো কি সুন্দর ছিলো আজকে দেখতে? আদৌও চেহারা সুন্দর হয় নাকি মানুষ এটা বিশ্বাস করে বিধায় চোখে ভ্রমের সৃষ্টি হয়? অরিক দেখছে নিজের চেহারা আরো ভালো হয়েছে নাকি। ওর কি এখনো বিয়ের সময় হয়নি?
নিজের পাগলামিতে নিজেই লজ্জা পেলো অরিক। ভাগ্য ভালো যে ওর এটুকু অন্তত বোধ ছিলো যে কারো সামনে এই কাজ ও করেনি।

ক্লাস শেষে তিলো অরিকের সাথে দেখা করতে আসলো। অরিককে খুঁজতে খুঁজতে একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে পেলো। তিলো অনুমতি নিয়ে ঢুকে দেখলো অরিক একা একা বসে স্টুডেন্টদের থিসিস দেখছে। তিলো আশেপাশে তাকিয়ে ফাঁকা দেখে কিছুটা সংকোচ নিয়েই ওর সামনে দাঁড়ালো। অরিক বেশ কিছু সময় ওকে পাত্তা দিলো না। তিলোর বিরক্ত লাগছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। অবশেষে না পেরে বললো,
-প্রফেসর, কিছু বলবেন বলেছিলেন।

অরিক চশমার ফাঁকা থেকে ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-হুম বলবো। তাড়া আছে তোমার?

-হুম। না মানে আসলে হ্যাঁ। কিছুটা।

-বুড়োর সাথে ডেটে যাবে?

অরিকের কথাটায় তিলোর বেশ রাগ হলো। কিছু বলতে গিয়েও বললো না। এই প্রতিষ্ঠানে তাদের সম্পর্ক চাচাতো ভাই বোনের নয়৷ বরং শিক্ষক ছাত্রীর। তিলো নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো,
-নাহ্। বাড়ি ফিরতে হবে।

-কাল রাতে ফোন ধরোনি কেন?

-ওহ! তখন আসলে ব্যস্ত ছিলাম। আর তারপর …

-তারপর?

তিলো ডান হাতটা তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিমা করে চোখ বুজে আবার খুলে বললো,
-আসলে এরপর অলসতায় আর কথা বলতে ইচ্ছা করেনি।

তিলোর উত্তরটায় অরিক কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই ভুলে গিয়েছে। অলসতায় তার ফোন ব্যাক করতে ইচ্ছা হয়নি। অরিক সেদিকে আর না গিয়ে বললো,
-শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?

-এই কথাগুলো বলতে আমাকে দেখা করতে বলেছেন? সত্যি? আমি তো কতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভেবে বসে আছি।

অরিক কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললো,
-ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছো কেন? বিয়ের সময় বিয়ে হবে। তাই বলে মাঝে মাঝেই ভার্সিটি থেকে উধাও হয়ে যাও কেন?

-সরি। আসলে কালকে মামা আসতে দেননি।

-অযুহাত বন্ধ করো। এখন যাও৷ আর ক্লাস ফাঁকি দিও না।

তিলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বের হয়ে আসার সময় অরিক হঠাৎই কোমল কন্ঠে ওকে ডেকে ওঠে,
-তিল…

অরিকের কন্ঠের এই কমনীয়তার সাথে তিলো একদমই পরিচিত না৷ হঠাৎ এমন ডাকটা ওর কান থেকে মস্তিষ্কে ঢুকে এক অন্য ধরনের অনুভূতির সন্ধান দিলো ওকে। তিলো না চাইতেও মৃদু কেঁপে উঠলো। নিজের অজান্তেই তেমনি মৃদু কোমল সুরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘জ্বি, বলুন।’

অরিক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি কি রাজি এই বিয়েতে?

অরিকের চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত। তিলো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তর দিলে যেন সে চোখে অসহায়ত্ব এবং মনকষ্ট ভেসে উঠবে। অরিকের দৃষ্টি ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। তিলো যান্ত্রিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
-হ্যাঁ। আমি নিজেই রাজি।

অরিক কয়েক মূহুর্ত নির্জীব চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ‘ওহ’ বলে আবার নিজের কাজে মন দিলো। তিলো এবার অনুমতির অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো ক্লাসরুম থেকে। বেরিয়ে এসে তিলো নিজেই এক গোলকধাঁধায় যেন আটকে গিয়েছে। তিলো অবুঝ নয়। তবে অবিশ্বাসী। অরিকের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া আচরণ ওর অজানা নয়। অরিকের বর্তমানে ওর সাথে কথা বলার ধরণ। সবকিছুই ওকে ভাবতে বাধ্য করায়, ওর প্রতি অরিকের বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। তিলো এটা আজ থেকে নয় বরং ভার্সিটিতে অরিকের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই অনুভব করে। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না। অরিককে এড়িয়ে চলে ও। ও বিশ্বাস করতে পারে না, যে ছেলে ছোট থেকেই নিজের মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওকে অপছন্দ করতো সে ওর প্রতি কিছু অনুভব করে। তিলো নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পেলোনা।

শুক্রবারে অরিকদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা প্রায় সকলেই ভিড় করেছে। সকল আতিথেয়তা শেষে হঠাৎ অরিক সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ……

#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১৯,,

নাসীরা পারভীনের জন্মদিনে পারিবারিকভাবে ছোটখাটো সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করেছে তিলো আর তুষার। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে তিলো নিজে হাতে রান্না করেছে। নাসীরা পারভীন ওর অতি আগ্রহে ভেবেছিলেন মেয়ের সংসার হবে তাই নিজে থেকে ঘরকন্না শুরু করেছে। তিলো তার কোনো সাহায্য ছাড়াই সব করেছে। এদিকে তুষারের মাথায় হাত। ও নিশ্চিত তিলোর রান্না খাওয়া যাবে না।

দুপুরে তিলোর অনুরোধে আনিস সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। যদিও ওনি নিজেও নাসীরা পারভীনের জন্য সন্ধ্যায় কিছু পরিকল্পনা করেছেন। তবে ছেলেমেয়ের সামনে ভাব ধরেছিলেন যেন জানেনই না। তিলো ওনাকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে বললে ওনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন। তিলো তার উত্তর না দিয়ে বরং অধিকার নিয়ে বলেছে, আসতে বলেছে তাই আসতে হবে তাকে।

সবাই টেবিলে বসলে তিলো একে একে সব পরিবেশন করে। খাবারগুলো দেখতে অত্যন্ত লোভনীয় হয়েছে। তিলো নিজেও খেতে বসতে বসতে বললো,
-ভাবতে পারছো? আমি নিজে সবকিছু রান্না করেছি!

নাক টেনে ঘ্রাণ নিয়ে বললো,
-কি দারুণ ঘ্রাণ আসছে! নাও সবাই শুরু করো।

সকলের মনেই একপ্রকার ভয় কাজ করছে, তিলোর রান্না! তবে ধীরে সুস্থে গালে নিয়ে দেখলো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। আনিস সাহেব তিলোকে উৎসাহ প্রদানের সুরে বললেন,
-বাহ ছোট মা! খুবই সুন্দর হয়েছে।

তিলো হেসে দিয়ে বললো,
-আমি রেঁধেছি। বুঝতে হবে।

তুষার তো খাচ্ছে না বরং গালে নিয়ে কি কি দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটাই বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। খেতে খেতে বললো,
-ভালো হয়নি। তোর হাতে রান্না তো। এ কোনোদিন ভালো হবে না।

তুলি ফোঁড়ন কেটে বললো,
-তাহলে খাস না তুই। জোর করছে না তো কেউ তোকে।

-তবুও আমি খাবো। বোন বলে কথা। না খেলে কষ্ট পাবে তো।

নাসীরা পারভীন ওদের খুঁনসুটির মাঝেই বলে উঠলেন,
-এখন তো শিখতে হবে ওকে ধীরে ধীরে সব। কয়দিন পর চলে যাবে নিজের সংসারে।

বলতে বলতে ওনি কেঁদে দিলেন। মেয়ে বিদায় করতে যে ওনার ভীষণভাবে কষ্ট হচ্ছে সেটা সকলে বুঝতে পেরেই কেউ সান্ত্বনা দিলো না। তুষার ভেংচি কেটে বললো,
-বিদায় হবে তো! চুন্নি বিদায় হলে বাঁচা যাবে।

তুলি মৃদু ধমকে উঠলো তুষারকে। তিলোর চোখেও এদিকে পানি ভরে উঠেছে। ওকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে! ছোট থেকে আজ পর্যন্ত এবাড়ির বাইরে গেলে ওর ঘুম আসতো না। আর কোথাও থাকার কল্পনাও করতো না পরিবার ছেড়ে। তুলির বিয়ের আগের রাতে সারারাত তুলির পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। তুলি অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, ও বিয়েই করছে, মরছে না। এবার অন্তত থেমে যাক। তিলো তাই শুনে ওর পিঠে কিল বসিয়ে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে।
আর আজ কয়েকদিন পর ওকেই ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মনটা বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তো তুলি গেলেও বাবা মা তুষার ছিলো। এবার তো ও একা হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ একা!
তিলো খেতে পারছে না। নিজে এতো কষ্ট করে নিজেই খেতে পারছে না। হাত দুই জায়গায় পুড়ে গিয়েছে। কিছু জায়গায় কেটেও গিয়েছে। সেটা বড় ব্যাপার নয়। আসল কথা হলো খাবার ভালো হয়েছে। সকলের সামনে কোনোমতে খেয়ে নিলো। আনিস সাহেব সবটা খেয়াল করেও তখনই কিছু বললেন না। সবাই খেয়ে উঠে গেলে নাসীরা পারভীন সবকিছু পরিষ্কার করেন।
আনিস সাহেব লিভিং রুমে সোফায় বসে পেপারটা খুলে সামনে ধরেন। তিলো ওনার পাশে বসে কোক খাচ্ছে। তুলি ইশানকে সামলাতে ব্যস্ত। তুষার বন্ধুদের ডাকে বাইরে গিয়েছে।
আনিস সাহেব পেপার থেকে চোখ তুলে তিলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন ও ফোন স্ক্রোল করছে। ওনি দুবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার পেপারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তিল একটা সত্যি কথা বলবি?

-হুম বলো।

-তুই কি সত্যিই মন থেকে রাজি? দেখ মা, তুই যা চাইবি তাই হবে। তোর বিয়েতে অমত থাকলে এই বিয়ে হবে না।

তিলো অবাক চোখে আনিস সাহেবের দিকে তাকালো। ওনি কি এখনো রাজি নন। তিলো অবাক কন্ঠেই বললো,
-তোমার কি রেজা সাহেবকে পছন্দ হয়নি আব্বু?

আনিস সাহেব পেপার থেকে চোখ তুলে বললেন,
-বিষয়টা আসলে তা নয়। তুই ওনার তুলনায় আসলে অনেক ছোট।

-তুমিও?

-এটাই আসলে কথা। তাছাড়া আমি চাই না আমাদের মতো পরিবার থেকে গিয়ে তুমি অতো বড় বাড়িতে অবহেলিত হও।

-ওনি ভালো মানুষ আব্বু। আমাকে সম্মান করেন। অবহেলা করবেন না।

আনিস সাহেব দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন। ওনার আসলে রেজাকে খুব বেশি পছন্দ হয়নি নিজের মেয়ের জন্য। রেজা মানুষ হিসাবে ভালো। তবে এতোটুকু মেয়ের জামাই হিসাবে মানতে ওনার কষ্ট হচ্ছে।

আজ শুক্রবারে অরিকদের বাড়িতে ওর ফুফু এবং চাচার পরিবারের সকলের দাওয়াত। সাথে নানা বাড়ির দিক থেকে মামা খালারাও আসবে। সকাল থেকেই ফাহমিদা বেগমের মাঝে বিরাট ব্যস্ততা। কোনদিক রেখে কোনদিক সামলাবেন সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। বাবুর্চি রান্না করছে একদিকে। আরেকদিকে বাড়ির সামনের বাগানে টেবিল পাতা হচ্ছে। ওদের বাড়িতে লোক বেশি আসবে। অরিকের নানাবাড়ির দিক থেকেও লোক আসছে।
সকাল থেকে তিনি অরিকের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। বুধবার রাতে অরিক এসেছে এবাড়িতে। গতকাল রাতেও বেশ চিন্তিত ছিলো ও। জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর পাননি ফাহমিদা বেগম। আজকে সকাল থেকে অরিক নিখোঁজ। ওকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না৷ ফাহমিদা বেগম একদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে আজকের পুরো অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে আকবর সাহেব সেটা হতে দেননি৷ ফাহমিদা বেগমের ধারণা তিনি জানেন অরিক কোথায় গিয়েছে। তবে তার মুখ থেকে সেটা বের করা সম্ভব না যদিনা তিনি নিজে থেকে জানাতে চান।

এই অবস্থায় ফাহমিদা বেগমের সবটা তদারকি করতে হচ্ছে। অভ্র সবে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা নিয়ে বসলো।

তিলোর বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছে। যখন সবাই রাজি তখন আর ওনারা কেউ দেরি করতে চাননি। আজকে তিলো অরিকদের বাড়িতে যেতে চাচ্ছে না। এরপরও নাসীরা পারভীন খানিকটা জোর করলেন। লোকে কি বলবে? তিলো নিজের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও ফাহাদের শোক ভুলতে পারেনি! তিলোও ভেলা দেখেছে সেটা। আসলেই আজকে ফাহাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে।
খুব সকালেই ওরা বেরিয়ে পড়লো অরিকদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

প্রায় সবাই এসেছে এখানে। নাসীরা পারভীন তো গর্ব করে সকলের মাঝে নতুন জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আনিস সাহেব সেবিষয়ে একটা কথাও বলছেন না। সামনের মাসেই ওনার অপছন্দের পাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দেবেন, এটা মানতে পারছেন না ওনি এখনো।

আজকেও কলি আর ফাহাদের জুটিটা নজরকাড়া। তিলো না চাইতেও কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে। ফাহাদ ওকে দেখতে পেয়েই হাসি মুখে বলেছে,
-কি রে ছোট! তোরও বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে! ভাবা যায়! কতো বড় হয়ে গেলি!

তিলো কেবল মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করলো। ফাহাদ আজও ছোটই ভাবে ওকে। এরপরও সেদিন অপমানটা কিভাবে করলো ও!

অরিক ফিরলো দুপুরে খাওয়ার ঠিক আগে আগে। ফাহমিদা বেগম ছুটে এসে ওকে কোথায় গিয়েছিলো, কি করছিলো বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করলেও অরিক কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের অবতারণা হতে দেয়নি।

খাওয়া দাওয়া শেষে যেন দুটো দল আপনাআপনি জেনারেশন অনুযায়ী ভাগ হয়ে গেলো। বড়রা সবাই ভেতরের ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর এদিকে ছোটরা বাগানের মাঝে গোল ছাউনিযুক্ত বসার জায়গাটায় মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের কথাগুলো ঘুরে ফিরে সেই তিলোর বিয়েতেই আটকে যাচ্ছে। তিলোর বর্তমানে এবিষয়ে এতো আলোচনা, এতো লাফালাফি ভালো লাগে না। তবে প্রত্যেকেই কৌতুহলী। বড়রা তো ছেলের পেশার নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ছেলের পেশা থেকে ধীরে ধীরে সেটা রাজনীতির আলোচনায় রূপ নিয়ে কয়েক পর্বের কথার ব্যবধানে ছোটখাটো সংসদ বানিয়ে ফেলে। দেশের হালচাল। সরকারের অক্ষমতা, তার সফলতা সামান্য পরিমাণে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিও বিষয়।
আর এদিকে ছোটরা! ওদের কৌতুহল ছেলের বয়স আর রূপ। অভ্র আলোচনার মাঝখানে বললো,
-তিল যতোই বল, ছেলে কিন্তু টাক।

তিলো স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-তো কি! বড় বড় মানুষেরা টাকই হয়। আমার প্রিয় একশান হিরো ডোয়াইন জনসনও টাক।

তুষার ঘোৎ করে বলে উঠলো,
-কি মিথ্যা! কি মিথ্যা! তোর না টম ক্রুজ পছন্দ। এখন জনসন আসলো কোথা থেকে?

-পছন্দ পাল্টায়।

অরিক তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
-এখন তো তোর সব পাল্টাবে। লোকটা খাটো। একদম বাটকুলি।

তিলো চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-বুদ্ধিমান মানুষেরা খাটোই হয়।

-তোকে বলেছে?

-ওই হলো।

-সে বু্ড়ো।

-তাহলে জ্ঞানী। পিচ্চি পোলাপাইনের মতো বউ সামলাতে মারামারি চুলোচুলি করবে না।

অরিক বিরক্ত হয়ে মুখ শিটকে জোরালো কন্ঠে ‘রিডিকিউলাস’ বলে উঠে গেলো সেখান থেকে।
তিলো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওদের সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিলো।

বিদায়ের আগে সকলে ওদের গার্ডেনে এসে জড়ো হয়ে একে একে কথা শেষ করছে। মহিলাদের কথাই আসলে শেষ হচ্ছে না। একজনের কথা একটা শেষ হয় তো আরেকজন আরেকটা বলে। এদিকে পুরুষেরা বিরক্ত হয়ে তাগাদা দিচ্ছে যাওয়ার।
অরিক হঠাৎ খুব ভেবেচিন্তে মনস্থির করলো কাজটা এখনি করবে। ও এই কয়েকদিন অনেক ভেবে দেখেছে শেষ পর্যন্ত এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ও সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে জোরে বলে উঠলো ‘এটেনশান’। সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে প্রথমবারেই সফল হলোনা। কয়েকজন ওর দিকে তাকালো। অরিক এবার আরো জোরে বললো। প্রায় সকলেই ওর দিকে তাকিয়েছে। তিলোর মুখোমুখি তুষার দাঁড়ানো। তিলো নিজের ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করতে শুরু করেছে কেবল।
অরিক চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে একনিশ্বাসে বললো,
-আমি তিলোকে বিয়ে করতে চাই।

কথাটা সকলের কানে পৌঁছাতেই মৃদু গুঞ্জনটাও থেমে গেলো। ছোটখাটো একটা নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো সেখানে। তিলো নিজের নাম শুনে বিষম খেয়ে তুষারের মুখ ভিজিয়ে দিলো মুখের পানিতে। ফাহমিদা বেগমের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম। অভ্র ভাইয়ের সাহসের নমুনা পেয়ে মনে মনে বাহবা দিলো। আকবর সাহেব আর আনিস সাহেবের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এদিকে নাসীরা পারভীনের চোখে মুখে কেবলই অবিশ্বাস।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২০,,

অরিকের কথাটা পুরো লিভিং রুমে একটা বজ্রপাত ঘটালো। কেবল তাতে কেউ নিহত হলোনা। নাসীরা পারভীন খানিকটা চিৎকার করে বললেন,
-অসম্ভব! তিলের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।

অরিক চোখজোড়া মেঝেতে আবদ্ধ রেখে বললো,
-আমি জানি। আসলে এটা আমার আরো আগে বলা উচিত ছিলো। কিন্তু …।
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে,
-কিন্তু আসলে আমার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি সবটা সামলে নেবো। আমাকে একটা সুযোগ …

অরিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই অকস্মাৎ ওর মুখে একটা থাপ্পড় পড়লো। অরিকের মুখটা একদিকে ঘুরে গিয়েছে। অরিক চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে ফাহমিদা বেগমকে আবিষ্কার করলো ওর চড়দাতা হিসাবে। ফাহমিদা বেগমের অগ্নিদৃষ্টি আজ ওকে ভীত করে তুললো না। বরং ও যেন এর জন্য প্রস্তুতই ছিলো। অরিক কিছু না বলেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহমিদা বেগম চিৎকার করে বললেন,
-এই তুই আমার ছেলে! আমি তোকে জন্ম দিয়েছি! আমার ভাবতেও অবাক লাগছে।

ফাহমিদা বেগম কেঁদে দিলেন শেষের দিকে। আকবর সাহেব এসে ওনাকে আটকাতে গেলে ওনি আকবর সাহেবের উপরও চড়াও হলেন। এদিকে নাসীরা পারভীন অরিকের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয় যে যখন ইচ্ছা হবে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে। আমরা অনেক ভেবেচিন্তে তিলের বিয়ে ঠিক করেছি। এটা নিয়ে মজা করোনা। দিনতারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া তোমার মায়েরা দিকটা তো দেখবে? আমি জানি না হঠাৎ তোমার এমন অদ্ভুত কথার মানে কি। তবে বলবো, এমন আর করোনা।

অরিক নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমি সত্যিই চাই ওকে বিয়ে করতে। আমি কোনো মজা করছি না।

-এখন তা সম্ভব নয়।

আচমকা ও নাসীরা পারভীনের একটা হাত নিজের দুই হাতের মাঝে স্যান্ডউইচের মতো করে ধরে বললো,
-ছোট আম্মু, ওর যদি বিয়েটা ভেঙে যায়, তবে আমার সাথে ওর বিয়ে দেবে?

এতক্ষণে সারা ঘরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। অরিকের ফুফু মরিয়ম রহমান বলে উঠলেন,
-কি আবোলতাবোল বলছিস তুই অরিক! মাথা ঠিক আছে? ওই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি!

অরিক তার কথায় পাত্তা দিলো না। ও তো নাসীরা পারভীনের উত্তরের অপেক্ষায় আছে। নাসীরা পারভীন বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
-ওর বিয়ে ভেঙে যাবে মানে? অরিক তুমি কিছু করেছো?

অরিক ওনার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। নাসীরা পারভীন এবার চিৎকার করে বললেন,
-আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছি অরিক। কি করেছো তুমি যে ওর বিয়েটা ভেঙে যাবে?

অরিক এবারও কিছু বললো না। নাসীরা পারভীন আবারও কিছু বলার আগে আনিস সাহেব বলে উঠলেন,
-আমি দেবো তোমার সাথে তিলের বিয়ে।

নাসীরা পারভীন এবার আনিস সাহেবের উপর তেতে উঠলেন।
-তুমি দেবে! তোমারও কি ওর সাথে সাথে মাথাটা পুরোপুরি গেলো নাকি? কিভাবে সম্ভব!

ওনাদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা হলো। সারা ঘরেই এখন একটা মাছের বাজার ধরনের অবস্থা। এতোকিছুর সূচনা যে মানুষটাকে নিয়ে তার দিকেই কেউ এতক্ষণ খেয়াল করেনি।
নাসীরা পারভীনের মনোযোগ অরিকের উপর থেকে আনিস সাহেবের উপর যেতেই অরিক তিলোকে খুঁজে চলেছে। তুষারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। আর এখন নেই। ফাহমিদা বেগম ওদিকে অরিককে কিছু বলে চলেছে। কিন্তু সেদিকে অরিকের খেয়াল নেই।
অরিক তুষারের কাছে গিয়ে তিলোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই তুষার নিজেও অবাক হলো ওর পাশে তিলোকে দেখতে না পেয়ে। তুষার ওদের কথার দিকে খেয়াল করছিলো। সামনে এতোটা নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছে যে প্রত্যেকেই সেদিকে খেয়াল করছে। আর চেষ্টা করছে সেই নাটকে একটা ভূমিকা পালন করতে। তবে যাকে নিয়ে এতোকিছু তার দিকে খেয়াল করার কারোরই সময় নেই।

অরিক ব্যস্ত হয়ে পড়লো তিলোকে কোথাও দেখতে না পেয়ে। এদিকে ওনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেই চলেছে।
অরিক আনিস সাহেবের কাছে গিয়ে ওনার হাত টেনে নাসীরা পারভীনের সামনে থেকে সরিয়ে এনে বললো,
-ছোট আব্বু, তিল নেই এখানে।

আনিস সাহেব কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হলেও বললেন,
-আমি দেখছি।
বলেই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। অরিক আর তুষারও ওনার পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেলো। নাসীরা পারভীন এদিকে আনিস সাহেবকে ডেকেও থামাতে পারলেননা।

রাস্তায় এসে অরিক আনিস সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-আমি সত্যিই দুঃখিত। বুঝতে পারিনি, সবাই এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আমার আসলে ব্যক্তিগতভাবে বলা উচিত ছিলো বা হয়তো কখনোই না বলা উচিত ছিলো।

অরিকের কন্ঠে অনুতাপবোধ স্পষ্ট। আনিস সাহেব ওর পিঠ চাপড়ে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললেন,
-তাতে কি হয়েছে? সব গোলমাল ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া কি বলছো? কখনোই বলা উচিত নয়? কেন? তোমার মনে হয়েছে তুমি বলেছো। এখন না বললে সারাজীবন আফসোস করতে। সেটা ভালো হতো কি?

অরিক ওনার কথার প্রত্যুত্তর না করে কেবল হাসলো।
তবে সারা রাস্তায় কোথাও তারা তিলোকে পেলোনা। তাদের এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তিলোর ফোনও বন্ধ। আনিস সাহেব হতাশ হয়ে ফিরলেন। সাথে ভীষণ দুশ্চিন্তা।
এসে দেখলেন পরিস্থিতি আগের তুলনায় বেশ শান্ত। তবে তার মাঝেও কলহ আছে।
ইতিমধ্যে অনেকেই চলে গিয়েছে শো’টা উপভোগ করে। আনিস সাহেবও দাঁড়ালেন না৷ পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

নাসীরা পারভীন তিলোকে খুঁজেছে। তবে পাননি। এতে ওনি রাস্তাতেই কেঁদে দিলেন। আনিস সাহেব একদিকে ওনাকে সামলালেও আরেকদিকে বিরক্ত ওনার প্রতি।

অরিক বুঝতে পেরেছে, আজকে বাড়িতে থাকা ওর জন্য অসহনীয় একটা বিষয়। ও নিজেও রওনা দিলো নিজের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। বারবার তিলোর ফোনে কল করে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা বন্ধ।

তিলো একাই বাড়ি ফিরে এসেছে। যদিও অনেক দূর আর দু-তিনবার যানবাহনও পরিবর্তন করতে হয়, যা ওর জন্য বিরক্তির একটা কারণ সাথে সাথে জড়তাও। এরপরও ও কেবল ঝোঁকের বশেই কাজটা করে ফেলেছে। অরিকের কথাগুলো শোনার পর থেকেই তিলো যেন একটা ঘোরের মাঝে আছে। ও তো এতোদিন আন্দাজ করতো। আর আজকে যে অরিক সত্যিই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে ও ভাবেনি। আবার আনিস সাহেবও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। ওকে নিয়ে সব হচ্ছে, আর কেউ ওকে একবার জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজনবোধ করলোনা? ওর মতামতের মূল্য নেই? ও কি হাতের পুতুল যে যার হাতে সুতা থাকবে আর ওকে যেমনভাবে চালাবে ও তেমনভাবে চলবে।

তিলোর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার চিন্তিত হয়ে পড়লো এটা ভেবে যে চাবি কোথায়? পরমুহূর্তেই মনে পড়লো চাবির দ্বায়িত্ব তুষারের ছিলো, তবে ও পাঞ্জাবির পকেটটাকে বিশ্বাস করতে না পেরে তিলোর ব্যাগেই রাখতে বলেছিলো।

তিলো ব্যাগ হাতড়ে চাবিটা পেয়ে মনে মনে ধন্যবাদও জানালো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আর দরজা বন্ধ করলোনা। বাড়ির আলোও জ্বালালো না। নিজের রুমে অন্ধকারে চুপচাপ মূর্তির ন্যায় বসে থাকলো। কি ঘটে গেলো এতক্ষণ ওর সাথে!

নিজেদের এলাকায় ঢুকতেই নাসীরা পারভীনের ফোনে হালিম সাহেব কল করে জানালেন যে, রেজার বাড়ির থেকে তিলোর সাথে রেজার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। কারণটা ওনারা স্পষ্ট করে বলেননি। তবে এটুকু বলা হয়েছে যে, সম্পর্কটা ওনারা আর এগোতে চান না। কথাটা শুনে নাসীরা পারভীন হয়তো এখন চিৎকার করে উঠতেন। তবে ওনি এখন তিলোকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কথাটা মস্তিষ্কে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারলোনা।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২১,,

অটোটা এসে বাড়ির গেটের সামনে থামতেই নাসীরা পারভীন খুব দ্রুত নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। পারলে হয়তো চলন্ত অটো থেকে লাফ দিতেন। তুলি ঘুমন্ত ইশানকে তুষারের কোলে তুলে দিয়ে নিজেও নাসীরা পারভীনের পেছনে পেছনে ঢুকলো। নাসীরা পারভীন তিলোর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজা খোলা পেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নিশ্চিত হলেন তিলো বাড়ি ফিরেছে। তিনি তিলোর রুমে ঢুকে দেখেন, ও অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে। খানিকটা রাগ হলো ওনার এটা ভেবে যে, এই সন্ধ্যায় বাড়ির দরজা হাট করে খোলা রেখে অরক্ষিত অবস্থায় বসে আছে ও!

নাসীরা পারভীন ওর দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-কাউকে কিছু না বলে এভাবে চলে আসো কোন আক্কেলে। ফোন বন্ধ করে রেখেছো কেন? বাড়ির বাকি মানুষগুলোর কথা চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করো না?

তিলো ওনার এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে বললো,
-আমাকে একা ছেড়ে দাও মা।

নাসীরা পারভীন ওর কথায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে চিৎকার করে বললেন,
-একেক জন একেক ঢং শুরু করেছে। বাড়িতে হচ্ছেটা কি? একজন হুট করে বিয়ে ভেঙে দেবে। একজন হুট করেই সবার সামনে মান সম্মানের কিছুই বাকি রাখবে না। একজন তাতে আবার সায় দেবে। বলি এতোই যখন বিয়ে করার ইচ্ছা তো তার পরিবারকে বলুক। আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে ন্যাকামি করার কি…

নাসীরা পারভীন কথাটা শেষ করার আগেই তিলো হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-আমাকে একা থাকতে দিতে বলেছি তোমাদের। কেন বিরক্ত করছো? আমার মতামতের কোনো মূল্য আছে তোমাদের কাছে? বলো আমাকে। আছে কোনো দাম? এই কয়েকদিন ধরে সব কথা আমাকে নিয়ে হচ্ছে। কিন্তু কেউ একবারও আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করো না তোমরা। মামা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে কাউকে দেখানোর আগে? মেনে নিয়েছি। তবুও মেনে নিয়েছি। হুট করে ওরা আংটি পড়িয়ে গেলো। তাও মেনে নিয়েছি। অবশেষে রেজা সাহেবকে বিয়ে করতে মতও দিয়েছি। এখন আবার এই নাটক কেন?

তিলো প্রথম কথাগুলো চিৎকার করে বললেও, কথা বলতে বলতে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে ফেললো। একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এটা ওর বোধগম্য হলো। নাসীরা পারভীন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তুলি দরজার সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তিলোর অগ্নিমূর্তিটা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছে। তিলো কখনো এতোটা জোরে কথা বলে না। নরম মেয়ে বলে এলাকায় একটা সুনামও আছে। কোনোদিন কেউ ওকে ওর বাবা মায়ের সাথে জোর গলায় কথা বলতে শোনেনি। শুধু বাবা-মা কেন? ও তো তুলি তুষারের সাথেও খুব একটা ঝগড়া বাঁধায় না। কখনো বাঁধলেও প্রথমেই নিজের হার মেনে নেয় ঝামেলা এড়িয়ে যেতে।
আজকে ওকে এরূপে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছেন না নাসীরা পারভীন।
তিলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে চোখ বন্ধ করে থেকে নিজেকে সামলে নিলো। গলা চিড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমিও মানুষ আম্মা। আর জীবনটা আমার। দেখতে খারাপ বলে যার যা খুশি তাই করতে পারে না আমার সাথে।

নাসীরা পারভীনের গলা ধরে এসেছে। মেয়ের থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণটা ওনাকে আঘাত করেছে। ওনি নাক টেনে বললেন,
-তোমার রেজার সাথে বিয়েটা ভেঙে গিয়েছে তিল। তাই তোমার বাবা অরিকের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তিলো শান্ত কন্ঠে বললো,
-এবার আমার সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে দাও। প্লিজ।

নাসীরা পারভীন আরো কিছু বললেন। তবে তিলো সেদিকে কর্ণপাত না করে বারান্দায় গিয়ে বসলো। নাসীরা পারভীন বুঝতে পারলেন এখন আর কোনো কথায় কাজ হবে না। ওনি বেরিয়ে গেলেন তিলোর রুম থেকে।

আনিস সাহেব ভাড়া মিটিয়ে লিভিং এ সোফায় বসে তিলোর চিৎকার শুনতে পেলেন। কিন্তু তিনি আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলেন না৷ এখন কথায় কথা বাড়তেই থাকবে। কখনোই তিনি তিলোর সাথে ঝামেলা করেননি৷ আর কখনো করতেও চাননা।
ক্লান্তিতে ওনার চোখ বুজে আসছে। আজকে কম ধকল যায়নি সকলের উপর থেকে। সোফার ব্যাকরেস্টে শরীরটা ঠেকিয়ে মাথা পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেললেন। কয়েক মূহুর্ত পরই ওনার ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হলেন ওনি এতে। ফোনটা বের করে স্ক্রিনে অরিক নামটা দেখে ওনি নিজের বিরক্তি ধামাচাপা দিয়ে মনটা হালকা করে রিসিভ করলেন। কানে ধরতেই অরিকের উত্তেজিত কন্ঠস্বর কানে এলো ওনার।

-ছোট বাবা, তিল বাড়িতেই ফিরেছে তো?

আনিস সাহেব অরিকের ব্যস্ততার ইঙ্গিত পেয়ে মৃদু হাসলেন। তারা ছাড়াও কেউ এখন আছে তাঁর মেয়ের জন্য চিন্তা করার। অরিক কি সময় ধরে মেপে ফোন করেছে? বুঝতে পারলো কিভাবে এখনি তারা বাড়ি ফিরেছে? রাস্তায় কি আরো দেরি হতে পারতোনা? আনিস সাহেব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-হ্যাঁ, ও বাড়িতেই ফিরেছে।

অরিক যেন এতোক্ষণের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পেয়ে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো।
-ও কি ঠিক আছে? মানে, তখন ওভাবে না বলে বেরিয়ে আসলো তো…।

-আমরা আছি তো। তুমি দুশ্চিন্তা করো না।

-ওহ! ঠিক আছে।

-রাখছি তাহলে।

অরিক এবার নিজের সংকোচ ভেঙে বললো,
-আহ, ছোট বাবা!

-হুম বলো।

-তিলকে ফোনটা ধরতে বলো আমার। কিছু কথা বলার ছিলো আরকি।

আনিস সাহেব আবারও একটু হাসলেন। এখন হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অট্টহাসি দিতেন। কিন্তু তা করলেন না। মৃদুস্বরে বললেন,
-ঠিক আছে, আমি বলছি।

-ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ।

আনিস সাহেব ফোন কেটে দিয়ে তিলোর ঘরের দিকে গেলেন। দরজায় নক করলে তিলো ভগ্নকণ্ঠে অনুমতি দিলো। আনিস সাহেব ওকে ঘরে কোথাও দেখলেন না। ওনি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তিলো নিচে থাকা তোশকটার উপর বসে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। আনিস সাহেব কোনোকিছু না ভেবেই ওর পাশে মেঝেতে আসন দিয়ে বসে পড়লেন। তিল চমকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সরে বসে বললো,
-ময়লায় বসছো কেন? এখানে বসো।

আনিস সাহেব হাতের ইশারায় বোঝালেন যে ওনি ওখানেই ঠিক আছেন। তিলো আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করলো। নিরবতা ভেঙে আনিস সাহেবই বললেন,
-তোর কি অরিককে পছন্দ না?

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-এই বিষয়টা বাদ দেওয়া যায়না?

-ছোট মা, এমন তো না যে তুমি রেজা সাহেবকে ভালোবেসে বিয়ে করছিলে। বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। সংসারটা মানিয়ে চলতে চলতেই একসময় মায়া থেকে ভালোবাসা জন্ম নিতো। অরিককেও ধরে নাও পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছে তোমার জন্য।

তিলো দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বললো,
-আম্মার সাথে তোমার শুরুটা অন্যরকম ছিলো। তাই না? তুলি আপু বা আমার হতে যাওয়ার মতো না।

-সেটা বলতে পারো। বিয়ে পরবর্তী শুরুটা অন্যরকম হলেও। একদম শুরুটা খুব সহজ ছিলোনা। তোমার দাদীকে তো চেনোই। তোমার মায়ের নাকটা বোঁচা বলে বেশ কথা শুনিয়েছেন।

তিলো হুট করে হেসে দিলো। ওর দাদীর আচরণগুলো ওর কাছে অদ্ভুত লাগে। মহিলা নিজে সুন্দরী বলে বাকিদের খুঁত নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যান। এই কুঁচকে যাওয়া চামড়াও তার সৌন্দর্য সেই চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। দেখলেই বোঝা যায়, যৌবনে আগুণ ছড়ানো রূপ ছিলো তাঁর। সেই রূপের আগুনে চোখ ঝলসে অন্ধ হয়ে তিলোর দাদু তাকে বিয়ে করেন। মহিলার অহংকারী ভাবটা তাঁর চোখে তখন বাঁধেনি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হাসি অত্যন্ত কার্যকর একটা পদ্ধতি। তিলোকে হাসতে দেখে আনিস সাহেব মনে পুনরায় জোর ফিরে পেয়ে বললেন,
-ফোনটা অন করো। আর অরিকের সাথে একটু কথা বলো।

-আমার সময় প্রয়োজন আব্বু।

-সময় পাবে তুমি। অনেক সময় পাবে ভাবার। এখন ছেলেটা দুশ্চিন্তায় আছে। ওর সাথে একটু কথা বলো।

-দুশ্চিন্তা করার কি আছে? এতোদিন তো আমি একজন অপরিচিত ছিলাম। আজ এতো চিন্তা করছে কেন?

-তোমাদের ব্যাপার। তোমরা সামলে নাও। ভেবে দেখো, তোমার বিয়েটা কিন্তু পারিবারিকভাবে হচ্ছে। সুতরাং, পাত্র বদলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

কথাটা বলে আনিস সাহেব উঠে চলে যাওয়ার সময় তিলো ওনার হাত ধরে আটকে দিলো। আনিস সাহেব ওর দিকে তাকাতেই, ও নিজের হাতের অনামিকা থেকে রেজাদের বাড়ি থেকে পড়িয়ে দেওয়া আংটিটা খুলে ওনার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
-ওনাদের ফিরিয়ে দিও এটা। এখন এটা আমাদের মাঝে মূল্যহীন।

আনিস সাহেব একবার আংটিটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না এ বিষয়ে। হুট করে বললেন,
-চা খাবে?

তিলো ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি বানাবে?

-হুম। মাথা যন্ত্রণা করছে। তোমার আম্মা ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। পরিবেশ গরম৷ তুমি খাবে?

তিলো মৃদু হেসে শরীরটা একদিকে হেলে আয়েশি ভঙ্গিতে বললো,
– তাহলে এই যে টি বয়, একটা চা।

আনিস সাহেব মজারচ্ছলে হেসে বললেন,
-আমি তোর বাপ হই ফাজিল মেয়ে। আব্বু বলে ডাক।

-এখন তুমি ওয়েটার। গো গো। ওয়ান টি প্লিজ টি বয়।

আনিস সাহেব এবারও মজারচ্ছলে ওকে মারার ভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
তিলো নিজের আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়লো।

অনেক ভেবেচিন্তে তিলো রাতে ফোন করলো অরিককে। অরিক যেন ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিলো। কলটা বাজতে না বাজতেই রিসিভ করলো। রিসিভ করেই বললো,
-এতক্ষণে ফোন করলি তুই? আর কি করলি আজকে? টেনশানে আমার কি অবস্থা হয়েছিলো তোর কোনো ধারণা আছে?

তিলো অরিকের ধীর পরিবর্তনের সাথে পরিচিত। তবে হঠাৎ এতো বড় পরিবর্তন ওকে অস্বস্তিতে ফলে দিলো। তিলো ওর কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
-কেন করলে এমন অরিক ভাই? কি বলেছো তাদের আমার বিয়েটা ভাঙতে?

তিলোর কথাটা অরিকের বুকে বিঁধলো যেন। তিলো শুধু পরিবারের কথাতে নয় বরং মন থেকে মেনে নিয়েছিলো রেজাকে! ভাবতেই অরিকের মন ভেঙে গেলো। অরিকের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। সে অবস্থাতেই বললো,
-তুই রাগ করেছিস আমার উপর?

তিলো এবার যেন রেগে গেলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না ভাইয়া। কি বলেছো তুমি তাদের? আমার নামে কি বদনাম রটিয়েছো?

-আমি তোর নামে কিছুই বলিনি।

-তাহলে কি বলেছো ঢ়ে ওনারা এভাবে না করে দিলো?

-আমি শুধু …
কথাটা বলতে অরিকের সংকোচবোধ হচ্ছে। এক মূহুর্ত থেমে গিয়ে বললো,
-আমি শুধু শামীম রেজা নামের লোকটাকে বলেছি, তোকে কেউ ভালোবাসে। মানে আমি তোকে ভালোবাসি। ওনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি কিনা? আমি শুধু বলেছি, আমি কেবল আমারটা জানি।

-বাহ্! এভাবে মিথ্যা বলে আমার বিয়েটা ভেঙে তোমার কি লাভ হলো?

অরিক ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-তিল আমি মিথ্যা বলিনি। যা বলেছি সত্যি বলেছি।

তিলো থমকে গেলো অরিকের মুখে বাক্যজোড়া শুনে। অরিক সত্যি বলেছে!!

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here