ভয় আছে পথ হারাবার পর্ব -২২+২৩+২৪+২৫

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২২,,

তিলো কয়েক মূহুর্তের জন্য ঘোরের মাঝে চলে গেলো অরিকের কথায়। অরিক ওকে ডাকছে। তিলোর সেদিকে খেয়াল নেই। অরিক ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জোরে ডাকলো। তিলো হঠাৎই হুসে ফিরে কেবল বললো,
‘আমি…। আমি এখন ফোনটা রাখছি।’

বলেই অরিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। অরিক ওর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারলোনা। ওর ভেতর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।
তিলো ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। অরিকের ওর প্রতি আচরণগুলো ভিন্ন, এটা তিলো আন্দাজ করতে পারলেও ভাবতে পারেনি কখনো অরিক সরাসরি স্বীকার করে নেবে সেটা। তিলো তো নিজের পরিবার এবং বন্ধুদের বাইরে শুধু ফাহাদকেই ভালোবেসেছিলো। অরিক ওকে কেন ভালোবাসতে যাবে? ও তো তিলোকে সহ্যই করতে পারতো না একসময়। তিলোর ভাবনার মাঝেই ওর ফোনে টুন করে একটা একটা শব্দ হলো। তিলো ফোনটা তুলে দেখে অরিক ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ছোট্ট একটা লাইন কেবল,
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে?’

তিলোর অজান্তেই ওর ঠোঁটের কোণা সামান্য উঁচু হয়ে উঠলো। কেউ এর আগে ওকে কখনো এভাবে কথা বলেনি। হয়তো সে রবি ঠাকুরের এই লাইনটুকু দ্বারা অরিকের চাটুকারিতায় সামান্য গলে গেলো। অরিককে হারিয়ে ফেলাটা কি তার জীবনে ভুল বলে গণ্য হবে নাকি ওকে আঁকড়ে ধরাটা? তিলো নিজের উভয়সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। তিলোর নিজের কি কোনো অনুভূতি নেই অরিকের প্রতি? তিলো সেটা জানে না। ফাহাদকে হারিয়ে ফেলার পর ওর নিজেকে হৃদয়হীনা বলে মনে হয়। কারো সাথেই আর সে নিজের হৃদয়ের আদান-প্রদান ঘটাতে পারেনি। হয়তো অনুভব করতেই ভুলে গিয়েছে এধরনের অনুভূতি। রেজাকে ও পরিবারের থেকে ঠিক করা বিধায়ই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে মন থেকে। জীবন তো থেমে থাকে না। কারো না কারো সাথে ওকে মানিয়ে চলতেই হতো। সে রেজাকে একমুহূর্তের জন্যও অনুভব করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার অনুভূতি তো উন্মাত্ত উগ্র অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার মতো। যেখানে শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজটাও মনে হয় সুর তুলছে। অরিক সত্যি কিছু ওর প্রতি অনুভব না করলে কিভাবে এই বেপরোয়া শব্দটাকে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করলো একজন অপরিচিতের সামনে। অরিক নিশ্চিতভাবেই একজন দ্বায়িত্ববান ছেলে। সে কোনো কথার মানে না বুঝে বলবে না। অরিককে রেজার মতো একজন অপরিচিত ধরেই কি সব নতুন করে গুছিয়ে নেওয়া যায়না?

অরিক তিলোর থেকে ম্যাসেজটার উত্তর আশা করছে না ঠিকই। তবে ওর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে তিলো কিছু বলুক সে সম্পর্কে আর ও শুনুক। অরিকের তিলোর প্রতি অনুভূতিটা বুঝে উঠতে সময় লেগেছে। ভালোবাসা আর ভালো লাগার মধ্যে পার্থক্য হয়তো এটাই যে, অরিক কোনোভাবেই বলতে পারে না কোথা থেকে ঠিক ও তিলোকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। শুধু জানে ও বাসে। খুব বেশিই হয়তো। কেন বাসে কি কারণে বাসে ও ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। যদি হয়ে থাকে এটা হঠাৎ তবে হঠাৎই। যদি এর সূত্রপাত আরো অনেক আগে হয়ে থাকে তবে অনেক আগে থেকেই। আগে কোনোভাবে হয়তো না। অরিকের ক্ষেত্রে এটা হঠাৎ। ভার্সিটিতে দেখার পর থেকে। ধীরে ধীরে ওর আচরণ, অনুভূতি বদলেছে ওর অজান্তেই। তবে তিলোর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে আমূল পরিবর্তন এসে গিয়েছিলো রাতারাতি। সবটা বুঝতেও সময় লেগেছে ঠিকই। তবে কেবল এক সপ্তাহের মাঝেই ওর কাছে তিলো নামটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অরিকের তিলোকে ভালোবাসার কথা না। তবে হয়ে গিয়েছে এটা। কেবলই হয়ে গিয়েছে। তিলোর বিয়ে হয়ে যাবে শুনে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাটার নাম ও খুব তাড়াতাড়ি দিতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে, এটা একটা অনুভূতি যাকে সকলে বলে থাকে ভালোবাসা। একটা উশৃংখল শব্দ! যেরকমটা ও আগে কখনো কারো প্রতি অনুভব করেনি।

যখনই বুঝতে পেরেছে, আসলে কি রকম অনুভূত হয় একজন ভালোবাসার মানুষকে হারাতে, অরিক তিলোর ফাহাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার সময়কার অনুভূতিটাও অনুভব করলো যেটা ও সেই সময় একদম হেসে অতিরঞ্জিত একটা বিষয় মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলো। অরিক বুঝতে পারলো, তিলো ওর থেকে আরো কঠিন হৃদয়ের একজন মানুষ। কারণ সে সেই সময়টা কাটিয়ে উঠে এসেছে। অরিক বুঝতে পারলো তার দূর্বলতা। সে কখনো পারবেনা সেটা। বিষয়টা লজ্জাজনক হলেও অরিক সেই লজ্জায় লজ্জিত হতে রাজি। ও সরাসরি রেজা সাহেবকে গিয়ে বলে এসেছে। দ্বিধায় ছিলো লোকটা বিয়েটা ভাঙবে কিনা? কারণ ও বিয়ে ভাঙতে বলেনি। শুধু নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলো। ভেবেছিলো হয়তো এরপর ওর পালা তিলোর জায়গায় নিজেকে দেখার জন্য। কিন্তু সেটা হয়নি। রেজা সাহেব অরিকের অনুভূতিকে সম্মান করে। ভালোবাসলে আচরণগুলোও হয়ে ওঠে ঠিক সেই শব্দটার মতোই পরোয়াহীন এবং উন্মাদনায় পরিপূর্ণ। বেখেয়ালি।

তিলো সেরাতে ঘুমাতে পারেনি। কেবলই বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে। কি বললো তখন অরিক! কথাটা বারবার মস্তিষ্কের মাঝে ছোটাছুটি করেই চলেছে। সত্যিই সে এটা বলেছে! ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। তিলো বুঝতে পারছে, ও ফেঁসে গিয়েছে। এখনো চলেছে। কিন্তু নিজেকে থামাতেও পারছে না। নিজেকে একবার হ্যাংলা মনে হচ্ছে তো একবার মনে হচ্ছে, এটা শুধু কারো প্রতি সম্মান বা নিজের প্রতি একটা সম্মান। যে তাকে সম্মান করবে, তাকে মেনে নেওয়াটাও তো পরোক্ষভাবে নিজেকে সম্মান করা।

আনিস সাহেব নাসীরা পারভীনের রাগ ভাঙাতে নানা উপায় বের করছেন। নিজে থেকে কথা বলছেন। তবুও তার রাগ যেন পড়ছেই না। এমন না যে তিনি অরিককে অপছন্দ করেন। ছেলে হিসাবে অরিক ভালোই। তার নামে কোনো বদনাম নেই। বরং ছোট থেকে পড়াশোনায় সে ভালো। বড় হয়ে আলাদা হোস্টেলে থেকেও কোনো বাজে অভ্যাস গড়েনি। চরিত্রের দিক থেকেও প্রশংসনীয়। দেখতেও খারাপ না। তিলোর তুলনায় একটু বেশিই। কেবল চোখজোড়া একটু ছোট। চশমা পড়ায় আরো মনে হয়। বিয়ের বাজারে পাত্রীপক্ষের প্রথমেই পছন্দ হয়ে যেতে পারে। নাসীরা পারভীনেরও তাকে খারাপ লাগে না। কিন্তু রেজার মতো অতো ভালো চাকরি সে করে না। ওই পেশার একটা ছেলেকে তার মেয়ে ইতিমধ্যে প্রত্যাশা করে। সেখানে কলেজের প্রফেসর অরিকের বিষয়ে নাসীরা পারভীনের মনটা খুঁতখুঁত করছে। সাথে ফাহমিদা বেগমের বিষয়টা তো আছেই।

পরদিন তিলো কিছু না ভেবেই সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। আজ ভার্সিটি যাবে না সে। সকালে ডাইনিং এ খাবার গোছানোই পেয়েছে। নাসীরা পারভীন রেগে আছেন বিধায় রান্না করে রেখে চলে গিয়েছেন নিজের রুমে। কাউকে গুছিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না।
তিলো একবার তুষারের রুমের দরজা ঠেলে উঁকি মেরে দেখলো আনিস সাহেব তুষারের সাথে ঘুমিয়েছেন রাতে। তিলো ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। ওর মা রাতে ওনাকে ঘরে ঢুকতে দেননি। তিলো নাসীরা পারভীনের এই কাজটায় বেশ মজা পায়। এবার দেখতে পায়নি ও কি হয়েছে। তবে প্রতিবার দেখে রুমের দরজার বাইরে আনিস সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন আর নাসীরা পারভীন ওনার বালিশ কম্বল ছুঁড়ে ওনার উপর ফেলছেন। ওনি সেগুলো হাতে ধরে সামলাতে ব্যস্ত আর এদিকে মুখ থেকে নাসীরা পারভীনকে নাসু নাসু ডেকে মাঝে মাঝে ক্ষমা চান তো মাঝে মাঝে তার ভুলটা বোঝাতে থাকেন। তিলোর অদ্ভুত লাগে এটা ভেবে যে, ওনারা এতোবছর পরও কম বয়সী নতুন দম্পতির মতো ঠোকাঠুকি ধরনের ঝগড়া বাঁধান। তবে নাসীরা পারভীন কোনোদিনও ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাননি। ওনার কথা হচ্ছে, এটা ওনার স্বামীর বাড়ি মানে ওনার বাড়ি। ঝগড়া করে চলে যাবেন কেন? চলে যাবেন, আবার ঝগড়া মিটে গেলে মাথা নিচু করে ঢুকতে বিব্রতবোধ হবে না? তাঁর কি আত্মসম্মান নেই? গেলে আনিস সাহেব যেতে পারেন। আনিস সাহেব যেতেনও। নিজের বাবার বাড়ি চলে যেতেন। ঝগড়া মিটে গেলে নিজেই আবার ফিরে আসতেন। নাসীরা পারভীন কখনো আসতে বলতেন না।

তিলো পুরান কথাগুলো চিন্তা করতে করতেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে এসে রিকশা থামালো। ও একদমই নিশ্চিত নয় যে অরিক আদৌও বাড়িতে আছে কিনা? খুব ভোরে ফিরোজকে বলে ও অরিকের ঠিকানা যোগাড় করেছে। ফিরোজ কলেজের পিয়নকে দুশো টাকা দিতেই সে অরিকের ঠিকানাটা ফাইল ঘেঁটে বের করে দিয়েছে। তিলো আর কাউকে জিজ্ঞাসা করতে সংকোচবোধে ভুগছিলো। ওরা কি ভাববে? তিলো সম্পূর্ণ আন্দাজের উপর এসেছে। ফাহমিদা বেগম গতকাল বলছিলেন অরিক আরো দুদিন বাড়িতে থাকবে। তাহলে ও নিশ্চয়ই ছুটি নিয়েছে ভার্সিটি থেকে। যদি ছুটি বাতিল না করে থাকে তাহলে এখন বাড়িতে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে।

তিলো ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানের থেকে জেনে নিলো অরিক তিনতলায় থাকে। তিলো একবার চিন্তা করলো সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। পরক্ষণে লিফট ফাঁকা দেখে উঠে পড়লো। তবে লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই একটা যুবক দৌড়ে এসে উঠলো লিফটে। পরনে ট্রাউজার আর একটা ধূসর বর্ণের হাফ হাতার গেঞ্জি। পায়ে সু। ঘেমে একাকার। হয়তো সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলো। এখন ফিরছে! তিলোর এখন মনে হচ্ছে, হয়তো সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। লিফটের দরজা বন্ধ হলো। তিলো স্থির হয়ে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ফোনে মুখ গুঁজে ফেলেছে। তিলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আগে কখনো এমন বদ্ধ পরিবেশে একা অপ্রস্তুত অবস্থায় সে পড়েনি। ছেলেটা মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে ওকে। তিলো সেদিকে খেয়াল না করার চেষ্টা করছে। অহেতুক হাত উঠিয়ে ঠিক হয়ে থাকা মাথার কাপড়টা আরো টেনে দিলো। পিনে আটকে আছে। তারপরও করলো। ছেলেটা হঠাৎ ফোন থেকে মুখ তুলে বলে উঠলো,
-এক্সকিউজ মি, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি নতুন এসেছেন? না মানে আগে আপনাকে দেখিনি?

তিলো উত্তর দেওয়ার আগেই লিফটের দরজা খুলে গেলো। ও আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। ও বেরিয়ে যেতেই ছেলেটা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-আসলে বাড়িটা আমাদের। তাই আপনার পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম।

আর কিছু বলার আগে আবারও দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়িটা ওদের তো কি হয়েছে? সেধে কথা বলা লাগবে তাই তে? নাকি ওকে চোর ছ্যাচড় কিছু মনে করে জানতে চাইলো?

যাই ভাবুক তাতে ওর কি? তিলো তিনটা দরজার মধ্যে কোনটায় কলিং বেল বাজাবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। এখানে যে তিনটা ফ্ল্যাট হবে সেটা ওর মাথায়ও আসেনি। এ বি সি, কোন দরজায় বেল বাজাবে ও। দারোয়ানটাও আধা কথা বলে। তিলো আবার নিচে নেমে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো। এবার সিঁড়ি বেয়েই নামলো এবং উঠলো। ওর মনে হচ্ছে, তখন লিফট ব্যবহার করে লাভটা কি হলো ওর? হাঁপিয়ে গিয়েছে উঠে এসে। সি ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
দরজা খুললো না। তিলোর রাগ হলো। ও এবার পরপর কয়েকটা বাজালো তুষারের মতো অভদ্রতার সাথে। ভেতর থেকে কারো গলা শোনা গেলো। অরিক বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দরজার সামনে তিলোকে দাঁড়িয়ে থাকাতে দেখে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। চোখের ঘুম নিমেষে উধাও৷
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৩,,

তিলোর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অরিক যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। সে কখনোই ওকে প্রত্যাশা করেনি এই অবস্থায় কোনো খবর না দিয়ে ও আসবে। যেভাবে অরিকের ভেতর অনুভূতিটা এসেছিলো কোনোপ্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। কোনো সতর্ক সংকেতের বালাই নেই। একেবারে হঠাৎ আক্রমণ রূপে। অরিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তার চোখজোড়া বেইমানি করছে৷

তিলো ওকে একদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কি করবে ভাবতে ভাবতেই বললো,
-আমি কি ভেতরে আসতে পারি?

অরিক হুসে ফিরলো। বুঝতে পারলো, তিলো আসলে ওর ভ্রম না। ও নিজেও ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বললো,
-হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।

তিলো এই প্রথমবার অরিকের ফ্ল্যাটে পা রেখে খানিকটা অবাক হলো। ব্যাচেলর কেউ এতো বড় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে! তার উপর বেশ পরিপাটি। তিলো তো বোধহয় নিজের রুমও ঠিকমতো গুছিয়ে রাখে না।
তিলো এগিয়ে গিয়ে কর্ণার সোফাটায় বসলো। অরিকের যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও এসেছে! অরিক দরজাটা চেপে দিয়ে ওর দিকে ফিরে বললো,
-একটু বোস। আমি আসছি।

বলেই অরিক আর দাঁড়ালো না। তিলো ওকে নিজের বেডরুমে ঢুকতে দেখলো। তিলো চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে। ও বুঝতে পেরেছিলো, গতকালকের ঘটনার পর অরিক নিজের বাড়ি আর থাকবে না। ওই সময়ই ফিরে আসবে৷ অরিকের এটা অভ্যাস। কারো সাথে মনোমালিন্য হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
সামনের সেন্টার টেবিলের উপর কিছু ম্যাগাজিন রাখা। তিলো সেখান থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে পাতা উল্টে দেখছে।
অরিক ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করায়নি। দ্রুতই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে ওর পাশের সোফাটায় বসতে বসতে বললো,
-হঠাৎ না বলে আসলি যে? ফোন করতে পারতিস।

তিলো ম্যাগাজিনেই চোখ নিবদ্ধ রেখে বললো,
-ফোন করবো না বলেই এতবার ওঠা নামা করে গাঁধার খাটুনি খাটা লেগেছে।

অরিক বিষয়টা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-মানে?

-মানে কিছু না।
তিলো ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-একা থাকো, এতো বড় ফ্ল্যাট দিয়ে করো কি?

-মাঝে মাঝেই আম্মা এসে থাকেন। তাছাড়া ছোট জায়গায় দমবন্ধ লাগে।

তিলো ওর কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না। আবারও ম্যাগাজিনে চোখ রাখলো। অরিকও কিছু বলছে না। আসলে কি বলবে ও ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না শব্দ। দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। অরিক অবশেষে বললো,
-আজকে ভার্সিটি যাসনি?

-দেখতেই তো পাচ্ছো।

তিলোর জবাব দেওয়ার ধরণটা অরিকের পছন্দ হলোনা। অরিকও শক্ত গলায় বললো,
-তা তো পাচ্ছি। কেন যাসনি সেটা বল।

-ইচ্ছা হয়নি তাই।

-ব্রেকফাস্ট করেছিস?

-হুম।

আবারও সবকিছু চুপচাপ। বড় ড্রইং রুমটায় সুনশান নিরবতা। হঠাৎই তিলো হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটা রেখে অরিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-গতকাল রাতে তুমি যা বলেছো, তা কি সত্যিই সত্যি অরিক ভাই?

-কোন কথা?

অরিক মনে করার নূন্যতম চেষ্টা না করেই বললো। তিলো চুপ করেই অরিকের দিকে তাকিয়ে আছে। ও মূলত কথাগুলো বলার সময় অরিকের ফিনোটাইপ পর্যবেক্ষণ করতে চায়। তবে অরিকের প্রথমেই ভুলে যাওয়ার বিষয়টায় তিলোর মনোবাসনা খানিকটা নড়ে উঠলো।
অরিক ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝতে পারলো, ও হয়তো আঘাত পেয়েছে এই সংবেদনশীল বিষয়টায়। অরিক নিজের মস্তিষ্কের নির্দেশে কথাগুলো মনে করে বললো,
-হ্যাঁ সত্যি। সবটা সত্যি।

তিলো ভগ্ন কন্ঠে বললো,
-আমিই কেন?

অরিক আগের মতোই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এর উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো জানা নেই বিধায়ই। আমি ব্যাখ্যা করতে পারিনা বিধায়ই।

অরিকের কন্ঠে আবেগ মিশে আছে। কন্ঠটা তিলোর কর্ণকুহর হতে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক হয়তো তার প্রতিধ্বনি হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছে। আজ যেন অন্যরকম স্বরে কথা বলছে অরিক। তিলোর হৃদয় শীতল করে দেওয়া একটা সুর! তিলো চোখ বুজে সুরটুকু অনুভব করে আবারও চোখ মেলে বললো,
-আমি আর কাউকে ভালোবাসি জানার পরও?

অরিক সোফার ব্যাকরেস্টে শরীরটা ঠেকিয়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো,
-এটা একটা অনুভূতি। যে কারো উপর যখন তখন আসতে পারে। তোর আগে কারো উপর এমন অনুভূতি এসেছে। এটা নিয়ন্ত্রণহীন। আমি আমার দিক থেকে তোকে ভালোবেসেছি। আর তুই আর কাউকে। এতে কার দোষ আছে? তুই আমার থেকে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য বিধায় আমি ভালোবেসেছি। আর কেউ তোর চোখে মনে হয়েছে তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, যদিও সে নয়।

-যদি বলি তোমাকে আর কেউ ভালোবাসে?

-সেটাও তার বিষয়। আমি তার থেকে পাওয়ার যোগ্য বিধায়।

তিলো আরও কিছু সময় চুপ করে থেকে তারপর বললো,
-আমি যদি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি?

অরিক চকিতে ওর দিকে ফিরে তাকালো। ওর চোখে মুখে একরাশ হতাশা গ্রাস করে ফেললো মূহুর্তেই। কোনোমতে বললো,
-তুই সেটাই করবি?

-যদি করি? হ্যাঁ করবো।

-এটা তোর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তোর জীবন, তোরও মতামত রয়েছে। পরিশেষে সংসারটা তুই করবি। জোর করে আর কাউকে খুশি করতে নিজেকে বলি দেওয়াটা বোকামি। জীবন একটাই। আর এর দৈর্ঘ্যটাও বেশি না। নিজের জীবনকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হয়।

-তোমার মায়ের কথা কি তুমি একবারও ভাববে না? কোন বুদ্ধিতে তুমি তার সামনে গতকাল অতোগুলো কথা বললে?

-তিল, আমি এইমাত্র কি বললাম? নিজের জীবনে গুরুত্ব দিতে শিখতে হয়। একটা জীবনে তার মুখ চেয়ে আমি আমার নিজের কথা একবারও ভাববো না? এখন সবকিছু যে আমার ভাগ্যে থাকবে তার তো নয়। তবে তার দাবি করতে দোষ কোথায়? সংসার আমি করবো। সে তো নয়।

-তুমি সত্যিই বলেছিলে কালকে?

তিলো অবিশ্বাসের সুরে কথাটা আবারও জিজ্ঞাসা করলো। অরিক একই প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে বরং মুখে প্রশান্তি মূলক একটা হাসি ফুটিয়ে বললো,
-একদম সত্যি।

তিলো যেন স্বস্তি পেলো। ও আর বসলো না সেখানে। তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। অরিক ওর আকস্মাৎ আচরণে হকচকিয়ে গিয়েছে। বুঝে উঠতেই তিলোর নাম ধরে ডাকলো কয়েকবার। তিলো যেতে যেতেই বললো,
-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি।

অরিক নিশ্চিত ও এখন পরিস্থিতি থেকে পালাতেই কথাটা বললো। তিলো চলে গেলো। অরিক জানতেও পারলোনা আসলে তিলো কি সিদ্ধান্ত দেবে।

তিলো অরিকের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। গতকালকের পর থেকেই অরিকের সামনে দাঁড়াতে ওর কেমন অস্বস্তিবোধ হয়। এটা কি অরিকের গতকালকের কথাগুলোর জন্যই? তিলোর সেটাই মনে হয়। ও দ্রুত একটা রিকশা ঠিক করে বাড়ি ফিরে এলো। দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন ওর কাছে অনন্তকালের অপেক্ষা মনে হচ্ছে। তুলি দরজা খুলে দিলে তিলো খুব দ্রুতই ঘরে ঢুকলো। আনিস সাহেব অফিসে মনে পড়তেই তিলোর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও নাসীরা পারভীনের কাছে গিয়েই জানালো যে ও অরিককে বিয়ে করতে রাজি। নাসীরা পারভীন তিলোর এই হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টা সম্পর্কে অবগত হলেও আজ বেশ বিরক্ত এতে তিনি। তিলো বরাবরই হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া মেয়ে। সকলে তাই মনে করে। তবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিলো কতোটা চিন্তা করে নেয় সেটা কেবল ওই জানে। সিদ্ধান্ত ভুল হলেও এরপর আর ও বদলাতে চায়না।

#চলবে#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৪,,

তিলোর ঘোষণার পর খুব বেশি সময় লাগেনি ওদের বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে যেতে। ফাহমিদা বেগমের আপত্তি সত্ত্বেও সেটা এগিয়ে চলেছে। তিলোর বন্ধুদের খবরটা জানানোয় সকলেই খুশি হলেও মনে হলো না অনি খুব বেশি খুশি হয়েছে বলে। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে নারাজ।

ইতিমধ্যে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা মর্যাদাপূর্ণ গতিতে তিলো এবং অরিকের সম্পর্কটারও উন্নতি ঘটছে। তুলির সাথে সম্পর্কটাও কিছুটা সহজ হয়ে উঠেছে তিলোর।

তুলি ফোনে একটা নাম্বার ডায়াল করে হাতে নিয়ে বসে আছে। কলটা করবে কি করবে না ভেবে উভয়সংকটে পড়েছে। খুব ইচ্ছা করছে মানুষটার সাথে কথা বলতে। আবার দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে বিষয়টা আদৌও ঠিক হবে কিনা ভেবে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ইশানের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে খুব তাড়াতাড়িই নিজের দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে উঠলো সে। কল করলো নাম্বারটায়। কানে ধরে ‘টুউউ’ ‘টুউউ’ শব্দটা যতোবারই ওর কানে যাচ্ছে ততবারই শরীরের ভেতর একটা শিহরণ খেলে চলেছে। একটা আতঙ্ক। এই বুঝি ফোনটা তুলে সেই চিরচেনা কন্ঠটা ‘হ্যালো’ বলে উঠবে। তখন সে কিভাবে কথা বলবে? আনিস সাহেব বলেছিলেন, তিনি কথা বলে তিলোর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করবেন। তুলিই আগ বাড়িয়ে সেই দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এছাড়া কি করতো সে? খুব বেশিই ইচ্ছা করছিলো একটা অযুহাত পেতে তার সাথে কথা বলার। তাকে কি সবকিছু বলে দেওয়া উচিত নয়? যে কারণে সব গোপন করেছিলো, একটা ভুল করে হাজারবার মিথ্যা বলে সেটা ঢাকতে চেয়েছিলো, সেই কারণটাই তো নেই। সংসারটা তো টিকলো না। অন্যায় করেছে সে। ঘোরতর পাপ। একবার করেছিলো। এরপর বারবার। সইতে না পারলেও সইতে হচ্ছে তাকে।

তুলির ভাবনার মাঝেই ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত কন্ঠটা বলে উঠলো,

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

তুলির কন্ঠ আটকে গিয়েছে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। এটা কি সম্ভব ভাষার বাইরে বসবাস করা? ও হয়তো করছে। ওর গবেট মাথা (তুষারের দেওয়া উপমা) পুরোপুরি শূন্য হয়ে গিয়েছে, ও অনুভব করলো। যেন সে ইশানের মতোই কথা বলতে জানে না।
তিলোর তুলির সাথে কথা বলতে ওর রুমেই তখন আসছিলো। এটা অনেকটাই কাকতালীয় একটা ঘটনা, যেমনটা প্রায়শই হয়ে থাকে। তুলিকে ফোনটা কানে ধরে বসে থাকতে দেখে তিলো নিজেও ওর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে গেলো। আড়িপাতা খারাপ অভ্যাস ও জানে। তারপরও মাঝে মাঝে ও নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

তুলিকে কিছু বলতে না দেখে অপর পাশ থেকে আবারও বলে উঠলো,
-হ্যালো! কে বলছেন? কথা বলুন।

তুলির চোখজোড়া ইতিমধ্যে ওর হৃদয় গভীরের আবেগ প্রকাশ করতে যথেষ্ট ছিলো। ভরে উঠেছে নোনাপানিতে। সে পলক ফেলতেই পানির রেখা তার সরু নাকটার দুপাশের হালকা ফোলা ফর্সা গাল দুটোয় গড়িয়ে গেলো। তুলি বহু চেষ্টার পর শব্দ সাজিয়ে মুখ ফুটে বলতে সক্ষম হলো। সালামের উত্তরটা আর ও দিলো না।
-আমি তুলি, ইমন।

তুলি নামটা শুনে ইমনের মেজাজটা ঠিক থাকলো না। তবে এখন সে অফিসে আছে বিধায় ফোনেই চিৎকার করে কিছু বললো না। চোয়াল শক্ত করে ফোনটা কেটে দিতে নিতেই হয়তো তুলি ওর প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলো। আসলে এখন এটাই ও প্রত্যাশা করে। তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-ফোনটা কেটো না। প্লিজ। একটু কথা বলতে দাও আমায়।

ইমন গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-তোমার মতো নোংরা মেয়ের সাথে আমার কোনো কথা নেই। তোমার কন্ঠ শুনতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। দ্বিতীয়বার আমাকে ফোন করার স্পর্ধা দেখাবে না। ভুলে যেও না আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমি আবারও বিয়ে করছি।

ইমন আবারও বিয়ে করবে শুনে তুলির ভেতরটা একেবারে ভেঙে গেলো। যেন চামড়াটা ঠিক রেখে, তার নিচে ওর শরীরটা কেউ ভেজা কাপড়ের মতো নিঙড়ে দিলো। তুলি নিজেকে সামলে বললো,
-আমি আমার স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে তোমাকে ফোন করিনি ইমন। সামনের মাসে তিলের বিয়ে। তুমি পরিবার নিয়ে এসো। আব্বু যাবে তোমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে। প্লিজ তাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে অপমান করো না।

ইমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। এরপর বললো,
-কেন? তোমার বাবাকে এখনো তোমার সুকীর্তির কথা বলোনি? আমাদের চেনো না তুমি? আমরা আমাদের চিরশত্রুকেও বাড়িতে আসলে অপমান করি না। কথাটা কি হবে, আমি যা করেছি সেটা বলো না?

তুলি নাক টেনে বললো,
-হ্যাঁ সেটাই।

-নিজের কথা লুকিয়ে তাহলে বোনকে বিয়ে দিয়েই দিচ্ছো! তোমার কথা সবাই জানলে ওর বিয়ে হতো না।

-অতীত চর্চা বন্ধ করো।

-অতীতকে তুমি ডেকে এনেছো। ফোন করলে কেন? আমি রাখছি। আর দয়া করে বিরক্ত করো না।

কথাটা বলেই ইমন ফোন কেটে দিলো। তুলি ফোনটা কানে তারপর বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরে ছিলো। এরপর সেটা কান থেকে নামিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তবে সাথে সাথেই কান্নার শব্দ থামিয়ে দিতে হলো ইশানের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে সেটা চিন্তা করে।
তিলো কখনোই কাউকে সান্ত্বনা দিতে জানে না। সবচেয়ে বেশি যেটা পারে তা হলো কারো দুঃখে সমব্যথী হয়ে তার সাথে কান্না করা। ওর এখনো মনে পড়ে, ও যখন পঞ্চম শ্রেণিতে ছিলো তখন অনির দাদী মারা যায়। অনিমা ওর দাদী বলতে অজ্ঞান। খুব বেশি ভালোবাসতো তাঁকে। দাদীর হাতেই মানুষ বলতে গেলে। রাতে ঘুমাতোও দাদীর সাথে। যেদিন ওনি মারা গেলেন সেদিন অনির সে কি কান্না! দুবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। তিলো কেবল তার পাশে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছিলো কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।
তুলিকে কাঁদতে দেখে ও আসলে কি বলতে এসেছে সেটাই ভুলে গিয়েছে। আর কিছু না বলেই ও সেখান থেকে চলে গেলো। তুলি দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখার কারণে সেটা দেখলোও না।

তিলো নিজের রুমে ফিরে এসেও শান্তি পাচ্ছে না। তুলি কেন একাধারে তার ভুলটা এখনো জিইয়ে রেখেছে তার কোনো যুক্তি তিলোর মাথায় আসছে না। ইশানের কথা ভেবে অন্তত সংসার টিকিয়ে রাখতে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারতো ইমনকে! তবে ওর অন্যায়টা চাপা পড়ে আছে কিভাবে এতোদিন সেটা তিলো বুঝতে পারছে। নাসীরা পারভীন এখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। তুলির অন্যায়টা তিনিই ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন নিজের স্বামীর থেকে পর্যন্ত। আনিস সাহেব তুলির কথা জানতে পারলে নিশ্চিতভাবেই তুলির এবাড়ির ভাত কপাল থেকে উঠে যাবে। ওনি এসমস্ত অন্যায় একদমই বরদাস্ত করেন না।
তিলোর চিন্তার মাঝেই ওকে অনিমা ফোন করলো। তিলো ফোনের স্ক্রিনে মিস পাটোয়ারী নামটা দেখে মৃদু হেসে রিসিভ করলো। এই মেয়েটার সাথে তিলোর বন্ধুত্ব কোন কালের থেকে!! প্রথম প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ওর প্রথম বান্ধবীই এই অনিমা পাটোয়ারী। সেই সময় থেকে এখনও ওদের বন্ধুত্ব টিকে আছে। মাঝখানে যে ভেঙে যায়নি তা নয়। মাঝখানে কয়েকবছর ওর সাথে যোগাযোগটাই ছিলো হালকা পাতলা ধরনের। কোনো ঝগড়া নয়। তবে অনির আরো কিছু বন্ধুবান্ধব জোটায় ও তিলোর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। তিলো ওর তুলনায় পড়াশোনায় ভালো। তিলো একটা গতানুগতিক ছাত্রী। আর অনি টিটিপি। মানে টেনেটুনে পাশ করে আরকি। ফলে তিলো একটা ভালো হাইস্কুলে এডমিশন পেয়ে যায়, যেখানে অনিমাকে পড়তে হয় একটা লোকাল স্কুলে। ফোনে যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এরপর কলেজে উঠে অনির সাথে আবার দেখা। আবার একসাথে ব্যাচ টিউশন। তবে ওদের কলেজও আলাদা ছিলো। এখন আবার ভার্সিটিতে এক হয়েছে।

অনির ফোনটা ধরার পরই অনি সাধারণ কুশল বিনিময় বাদ দিয়ে বললো,
-তোর কি আজকে বিকালে সময় হবে?

তিলো একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে আছরের আযানের সময় হয়ে গিয়েছে।
-হ্যাঁ হবে।

-হাঁটতে যাবি?

-যাওয়া যায়।

-তাহলে নামায আদায় করে তৈরি হয়ে থাকিস। আমি তোর বাড়ির সামনে দাঁড়াবো। আর হ্যাঁ, মোড়ের মাথার দোকানটায় চা খাবো।

তিলোর উত্তরের অপেক্ষা না করে অনি ফোন কেটে দিলো। তিলো বোকার মতো ফোনটা হাতে ধরে বসে থাকলো কিছু সময়। এরপর দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো বসা থেকে।

নামায আদায় করে তিলো তৈরি হয়ে নিয়েছে অনির দেখা নেই। হঠাৎই আবার ফোন করে বললো,
-শোন না, সরি। আব্বু ফিরেছে আজকে। এখনই৷ যাওয়া হবে না। তবে কাল যাবো। অবশ্যই, অবশ্যই। তোকে কিছু বলার আছে আমার।

-আঙ্কেল কেমন আছেন?

-ভালো। রাখছি আমি।

এবারও অনি হুট করে কেটে দিলো ফোনটা। তিলো বর্তমানে খেয়াল করেছে, অনির ওর প্রতি আচরণ বদলে যাচ্ছে। আগের মতো আর খোলামেলা আচরণ সে করে না। ফোন কম দেয়। কথা কম বলে। হুটহাট সিদ্ধান্ত জানিয়ে আবার নিজেই পরিবর্তন করে। নাসীরা পারভীনের সাথে ওর সম্পর্কটাও তিলোর ভালো লাগছে না। ওর মা’ও ওর থেকে যেন দূরে চলে গিয়েছে। আগের মতো আর নেই।
তিলোর এসব ভাবতেই খুব খারাপ লাগে।

মাঝরাতে তিলোর ঘুম ভাঙলো ফোনের আওয়াজে। বিরক্ত মুখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-বাড়ি থেকে বের হও।

কথাটা কানে যেতেই তিলোর ঘুম ছুটে পালিয়েছে। তিলো কান থেকে ফোনটা সামনে ধরে দেখলো এটা অরিকের কল। তিলো পুনরায় কানে ধরে বললো,
-এতোরাতে বাড়ি থেকে বের হবো মানে কি?

-ঘুরতে যাবো।

-মাথা খারাপ নাকি? আমার ঘুম আসছে। বিরক্ত করো না। রাখছি।

-তিল, আমি ‘আশাকুঞ্জের’ বাইরে দাঁড়িয়ে আছি৷ অপেক্ষা করছি। প্লিজ এসো।

অরিকের মুখে নিজের বাড়ির নাম শুনে তিলো উঠে বসলো। খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, সত্যি বলছে কিনা অরিক। প্রাচীরের জন্য সরাসরি দেখা না গেলেও গেটের বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে বোঝা যাচ্ছে।
-না বলে কয়ে আসতে কে বলেছে?

-ইচ্ছা হয়েছে এসেছি। তুমি কি আসবে? প্লিজ এসো।

তিলো হঠাৎ ফোন কেটে দিলো। না বলে হঠাৎই এসে বলে ঘুরতে যাবো। এটা যে পরোক্ষভাবে জোর করা সেটা তিলো বুঝতে পারছে। তিলো মানবতার খাতিরে না গিয়েও পারবে না। এতোরাতে কষ্ট করে এসেছে। ও দ্রুত নিজের পোশাক বদলে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই ভেঙচি কাটলো। একটু সাজতেও পারলোনা এখন। ওকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবে? বলে আসলে না হয় এতোক্ষণে সেজে ফেলতো।
তিলো রুম থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ভেবেছিলো কাউকে জানাবে না। তবে ও জানতো না তুষার আগে থেকে সবটা জানে। তিলো বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখে তুষার সোফায় বসে ঢুলছে। তিলো ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এতো রাতে এখানে কি তোর? নিজের ঘর কি ভাড়া দিয়েছিস?

তুষার তেতে উঠলো ওর কথায়। চিৎকার করে বলে উঠলো,
-এতো রাতে!

সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরলো ও। ওর চিৎকার না সবাই জেগে যায়! তিলোও হাতের ইশারায় বোঝাচ্ছে আস্তে কথা বলতে। তুষার এবার ফিসফিসিয়ে বললো,
-রাত কয়টা বাজে তা তোদের খেয়াল আছে? প্রেমে পড়লে যে মানুষের মতিভ্রম হয় তা তোদের দেখে বোঝা যায়। এতো কষ্ট করি সারাদিন আমি। আর সেই আমাকেই ঘুম থেকে তুলে দরজা বন্ধ করে দিতে বলা হচ্ছে! তাড়াতাড়ি বিদায় হ। আমি দরজা আটকে শুতে যাবো।

তিলো কিছু বললো না ওকে। এখন কিছু বললেই ও ঝগড়া বাঁধাবে। তিলো চুপচাপ দরজা খুলে বের হয়ে গেলে তুষার দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৫,,

ধীর গতিতে গাড়িটা চলছে ভেজা রাস্তার বুক চিড়ে। মৃদু বিদেশি গানের সুর ভেসে আসছে যা পরিবেশের আবহটায় খানিকটুকু গাম্ভীর্যতা বজিয়ে রেখেছে।
‘Wise men say
Only fools rush in
But I can’t help falling in love with you.’

ডার্ক ভার্সনটায় কেবল এটুকুই বারবার আবৃত্তি করে চলেছে অদ্ভুত একটা মিউজিকের সাথে। তিলো অরিকের পাশের সীটে বসে বাইরে তাকিয়ে বললো,
-রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো! আমি টেরই পাইনি!

অরিক ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-মরার মতো ঘুমালে টের পাবে কিভাবে?

-তাও ঠিক।

আবার দুজনের মাঝে নিরবতা। গানটা শেষ হতেই তিলো আবারও বললো,
-আমি ভেবেছিলাম তুমি এখন রবীন্দ্র সংগীত ছাড়বে।

ভ্রু কুঁচকে অরিক বললো,
-কেন?

-আসলে সেদিনের টেক্সটার কারণে।

অরিক হেসে ফেললো, যাতে ছিলো ও বোকা সেটা বোঝানোর ইঙ্গিত।

-হাসছো কেন? পছন্দ করো না তাঁকে?

-আসলে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে অবশ্যই পছন্দও করি এবং সাথে সাথে শ্রদ্ধাও করি। কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে বলতে গেলে করি না। একজন গুণী মানুষের কর্মকে ভালোবাসলেই যে তাঁকে বাসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাঁর সৃষ্টির প্রতি অগাধ সম্মান আমার আছে। তবে তাঁর প্রতি সম্মানের ঘাটতি তুমি আমার ভেতর পাবে। তিনি বাংলাদেশে তাঁর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে একটা পাগলী মহিলার সাথেও প্রেম করে গিয়েছেন।

তিলো সীটের ব্যাকরেস্টে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে কেবল হাসলো। সেভাবেই বললো,
-তুমি কখনো প্রেম করোনি?

-সে সুযোগ আগে আসেনি৷ এখন তো করছি।

তিলো প্রত্যুত্তর করলোনা। কিছু সময় চুপ থেকে আবারও বললো,
-আমাদের প্রণয় ঘটিত সম্পর্কটা গভীর হচ্ছে। তাই না? শেষ পরিণতিটা কেমন? একটা মানানসই ঠিকঠাক পরিণতি নাকি হতাশাপূর্ণ গন্তব্য?

-সন্দেহ আছে? বলো না তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না। কথাটা বললে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটা কথা হবে। কারণ বিশ্বাস না করলে কখনোই তুমি এই সময়ে আমার সাথে বের হতে না। তাহলে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখো, সবটা ঠিক হবে।

তিলো চোখ মেলে অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তাহলে আর কখনোই ভাইয়া ডাকা হচ্ছে না। আমি কি তোমার নাম ধরে ডাকবো? কোনো সম্বোধন ছাড়া কথা বলা কষ্টকর। তুমি আমার থেকে বড়।

তিলো অরিকের উত্তরের অপেক্ষায় আছে। অরিক কিছু সময় ভেবে বললো,
-নাম ধরেই ডাকো। তবে আম্মুর সামনে সামলে থেকো।

-তুমি সম্বোধন করছো! আসলেই অদ্ভুতভাবে নিজেদের বেখেয়ালেই আমাদের ভেতরকার কথাগুলো পাল্টে যাচ্ছে। আমরা কিন্তু গভীর আলোচনাও করি। কথার ধরণ পাল্টাচ্ছে, প্রকাশভঙ্গিমা পাল্টাচ্ছে, প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে, হয়তো কন্ঠটাও।

অরিক তিলোর কথা শুনে ব্রেক কষলো। যদিও অন্ধকারে তিলোকে সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট দেখা গেলো না তবুও অরিক হয়তো দেখতে পেলো তিলোর নাকের রন্ধ্রগুলো ফুঁসে উঠেছে, ঘোষণা করে দিচ্ছে ওর অসন্তোষ বা হয়তো ওর নিজের ভেতরকার অস্থিরতা, অবশ্যম্ভাবী সেটা তার উত্তেজনা, তার চোখগুলোর আগেই।
অরিক জড়তার সাথেই বললো,
-তাতে কি বিষয়টা জটিল হয়ে যাচ্ছে।

তিলো হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে বললো,
-আরেহ্ না। এমনিই বলছি। আগে কেবল তুমি সাধারণ কুশলাদিই বিনিময় করতে। এটা গত দুমাস আগের ঘটনাও বলতে পারো। তবে এখন তুমি খেয়াল রাখো আমার। আর দেখো আবদারও করো। যেটা কিছুদিন আগে কল্পনাও করোনি।

অরিক আবারও গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিলোর আচরণ অদ্ভুত লাগছে ওর। আসলে মানুষের মাঝে এমন একটা অনুভূতি মাঝে মাঝেই আসে। সে তখন অবচেতন একটা উত্তেজনায় উত্তেজিত থাকে। কারো সাথে মিশতে মিশতে সব কথা বলার জন্যই তাকে ভরসাযোগ্য মনে হয়। সে নিজেকে নিজের অজান্তেই সামলাতে পারে না এবং কথাগুলো বলতেই থাকে৷ পরবর্তীতে আবার সেই কথাগুলো চিন্তা করে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়।

তিলো নিজের অবস্থানে ফিরে চোখ বুজে বললো,
-কেন আমাকেই বেছে নিলে?

-অনুভূতিটা সম্পূর্ণ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই যেকারো প্রতি যখন তখন তৈরি হতে পারে। নিয়ন্ত্রণের লাগামটা মালিকপক্ষ পরবর্তীতে পেলেও শুরুটা তার হাতে থাকে না। তোমার গোলগাল মুখ আর চোখের তির্যকতা হয়তো আমার আসক্তির পঙ্কতিমালা।

অরিকের কথাগুলো শুনে তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। তিলোত্তমার পিছে পিছে ঘোরাটা অরিকের জন্য পরিকল্পনা মাফিক যায়নি। তার জন্য তিলোর হওয়া উচিত ছিলো একটা সহজ বিজয়মাত্র। আরেকজন নারী যে তার বুদ্ধিমত্তায় আর ব্যক্তিত্বে বশীভূত হয়ে যাবে এবং নিজের হৃদয় ভঙ্গ হতে দেখবে। তিলো সেটা ছিলোনা বলেই হয়তো অরিক নিজের অজান্তে নিজের হৃদয় পেতে দিয়েছিলো, যাকে তিলো চাইলে ভাঙতে পারবে বা চাইলে গ্রহণ করে নিজের হৃদয়ের পাশে আশ্রয় দেবে। তিলো লতার মতো জড়িয়ে জড়িয়ে ওকে বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, পরিণত হয়েছে একপ্রকার বাধ্যবাধকতায়, প্রায় একটা আসক্তি। আসক্তিরও নিজস্ব পঙক্তিমালা রয়েছে – ত্বক, ঘ্রাণ, চুল, মুখের গঠন, দাঁত, ভালোবাসার মানুষটার আঙুলের দৈর্ঘ্য, তার স্বভাব, তার চরিত্র, তার ব্যক্তিত্ব, তার হাঁটার ভঙ্গিমা, তার কথা বলার ভঙ্গিমা সহ অনেক কিছু। যেকোনো কিছু ভালো লেগেই আসক্তিতে পরিণত হতে পারে। হয়তো রোজ সকালে প্রিয়তমার হাতে তৈরি এককাপ চা। বা তার শব্দসহিত হাসি বা সকালে ঘুম ভাঙাতে তার চুলের পানি। হতে পারে রাতে তাকে বুকে আশ্রয় দেওয়া, হতে পারে তার চুলের ঘ্রাণ নেওয়া, হতে পারে কাজে যাওয়ার আগে তার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে সে না বলা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন না করা।

-তোমাকে আমি কিছু বাজে কথা বলি?
তিলো নিজের স্বকীয়তা বজিয়ে রেখে বললো। অরিক একটু থমকে বললো,
-পরে আফসোস না হলে বা ভেবে লজ্জা না পেলে বলো।

-আহ্ আমি আসলে বাজে হয়ে যাচ্ছি। সবকিছুর একটা শুরু থাকে। সেটা কখনো প্রত্যক্ষ করা যায় তো কখনো যায়না। আমি বিশ্বাস করলাম, তুমি আমার কিছু বৈশিষ্ট্যে নিজেকে হারিয়েছো। এখন পঁচা কথা বলি। আমি একজনকে চিনি, তার ছেলেবন্ধু তার একটা বৈশিষ্ট্য শুনে তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলো। জানো সেটা কি? সে আসলে দিনের একটা সময় পটিতে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে বসে বিড়ি টানতো। মেয়েটা বিড়ি টানতো হাই কমোডের উপর বসে।

বলেই তিলো হেসে দিলো। অরিক বুঝতে পারছে, তিলো আসলে ঘোরের মাঝে আছে। ওর ঘুম পাচ্ছে। তিলো হয়তো ওর মনের কথা বুঝতে পারলো। আবারও বললো,
-ভুল ভাবছো। আমি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে কথাটা বলছি। আসলে সেই প্রণয় সম্পর্কটি টেকেনি। Wolf wore the sheep as a perfect disguise. সে ধীরে ধীরে বখে গিয়েছিলো। কারো চোখের মায়ায় পড়েছিলো। কিন্তু মূল্যটা একদমই জানতো না। Teen mistake.

অরিক গাড়িটা থামিয়ে একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়ালো। বের হয়ে এসে তিলোর দিকে আসার আগেই তিলো নিজেও দরজা খুলে বের হলো। অরিক ঠিক নদীটার উপর দাঁড় করিয়েছে। ব্রিজের ওয়াকওয়ের রেলিঙের উপর হাত রেখে নিচে থাকা ঘোলা পানির দিকে তাকালো। আলোগুলো পড়ছে পানিতে মৃদুভাবে। হলদেটে আলোয় তিলোর মুখের দিকে তাকিয়ে অরিক নতুন কিছু আবিষ্কার করলো। আজ আরেক রকম লাগছে ওকে দেখতে। তিলো ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে বললো,
-আজকের জন্য মূল্য কি?

অরিক বুঝতে না পেরে মাথা নাড়িয়ে ওর দিকে তাকালো। তিলো পানির দিকে তাকিয়েই বললো,
-সবকিছুরই একটা মূল্য আছে। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম আরকি।

অরিক দুষ্টুমি করে বললো,
-আপাতত ধার নাও। সবকিছু বাকির খাতায় লিখে রাখছি। বিয়ের পর সুদে আসলে উসুল করে নেবো।

-ছিঃ। সুদের ব্যবসা করবে?

-ঠিক আছে। তবে আসলটুকুই।

ওদের মাঝে অনেকটা সময়ের নিরবতার পর অরিক বললো,
-মেয়েটা অনিমা ছিলো। তাই না?

তিলো চমকে তাকালো অরিকের দিকে। অরিক মৃদু হেসে বললো,
-তোমার সাথে এতো খোলামেলা আলাপ ও ছাড়া আর কেউ করার নেই।

তিলোও হেসে দিলো। ওর ইচ্ছা করছে অরিকের প্রশস্ত কাঁধটায় মাথা রাখতে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-ও হাইস্কুলে ওঠার পর ধীরে ধীরে বখে যাচ্ছিলো। আমি এসব পছন্দ করিনা বলে ও আমার থেকে দূরে থাকতো। আসলে ও সেটাই বলেছিলো আমাকে যখন কলেজে উঠে আমি আমার থেকে ওর দূরত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলি। অনিমাকে আদ্রিয়ান আঙ্কেল বেশি টাকা দিতো না৷ ও অন্তর নামের ছেলেটার সাথে প্রণয় সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো। ছেলেটা ভালো ছিলোনা। অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন এটা ঘটেছিলো। অনিমা একরাতে অন্তরের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো। তাহরিমা আন্টির সমস্ত গহনা আর আদ্রিয়ান আঙ্কেলের টাকাগুলো নিয়ে ও বেরিয়ে পড়েছিলো। রাত আড়াইটার দিকে থানা থেকে ফোন করে আদ্রিয়ান আঙ্কেলকে বলা হয়েছিলো, ওনার মেয়ে থানায় আছে। ওনি বিশ্বাস করতে পারেননি সেটা। সারাবাড়ি খুঁজে ওকে না পেয়ে, বিশ্বাস করলেন। অনিকে আনতে থানায় গেলেন। অনি তখন পাথরের ন্যায় ছিলো। অন্তর ওর থেকে সমস্ত টাকা আর গহনা নিয়ে ওকে রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিলো। সময় থাকলে হয়তো আরও কিছু নিতো। অনি থানায় ছুটে এসে ওকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে বলে। অনিমার বাবা, আদ্রিয়ান আঙ্কেল ওকে থানা থেকে নিয়ে আসার পর ধকলটা নিতে পারেননি। ওনি হার্ট অ্যাটাক করেন। সেবার বেঁচে ফিরলেও ওনার অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। ওনাকে প্রতিবছরই চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যেতে হয়। দেশে চিকিৎসা করিয়ে শান্তি পাচ্ছিলেন না বলে। আসলে এখনকার মানুষের ধারণাই এমন হয়ে গিয়েছে।

তিলো কথাগুলো বলে থামলো। অরিক মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিলো যদিও ও একদমই আগ্রহী ছিলোনা। অরিক একজন মনোযোগী শ্রোতার দ্বায়িত্ব পালন করলো কেবল। তিলোর কথা শেষ হতেই ও প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,
-কিছু খাবে?

-এইরাতে তুমি কি পাবে? ফার্মেসির দোকান আর হসপিটাল ছাড়া কনস্ট্রাকশন সাইটে কিছু চায়ের দোকান খোলা পেতে পারো, এখন মালামাল আসে বিধায়। আর হাইওয়ের পাশে ভাত রুটির হোটেল দূরপাল্লার যাত্রীদের জন্য। তাছাড়া আর কি আছে?

-চা খাবে?

-জানো, আজকে অনি বলছিলো বাইরে বেরিয়ে চা খাওয়ার কথা। আমারও ইচ্ছা করছিলো। কি কাকতালীয় ঘটনা!

-আসলেই। কাকতালীয় ঘটনা ঘটেই থাকে। অনেকে এটাকে টেলিপ্যাথির সাথেও তুলনা করে থাকে। মনে করো, তোমার ইচ্ছা করছে কিছু খেতে। তোমার বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় সেটাই নিয়ে আসলেন কাকতালীয়ভাবে। তুমি বললে, এটা আমার ইচ্ছা করছিলো। আর তোমার বাবা বললো, আমার হঠাৎই ইচ্ছা হলো। এমনই।

তিলো ওর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে ওরা ফিরে আসার সময় একটা চায়ের দোকান খোলা পেয়ে চা খেলো। তিলোর ব্যস্ততা ছিলো বাড়ি ফেরার। কারণ ফজরের আযান দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিলো। ওর বাবা মা নিশ্চিতভাবেই এখন জেগে উঠবে। অরিক তিলোকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আবারও তুষারকে ফোন করলো। তুষার দরজা খুলে দিলো চুপিচুপি এসে।
সময়টা অরিকের ভালো কেটেছে। নতুনভাবে সে তিলোকে আবিষ্কার করেছে। কথা বলার মতো লোক পেলে তিলোও খুব কথা বলতে পারে।

তিলো নিজের রুমে ঢোকার আগে তুলির রুম পার হয়ে যাওয়ার সময় তুলির রুম থেকে ওর কন্ঠ শুনতে পেলো ক্ষীণভাবে। তুলি কারল সাথে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। অপর কোনো কন্ঠ শুনতে না পেয়ে বুঝতে পারলো, ও ফোনে কথা বলছে। তিলো না চাইতেও আড়ি পাতলো। দরজায় কান ঠেকিয়ে দিলো। তবে কোনো কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো না। কিন্তু তুলির ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ কথায় বুঝতে পারলো, তুলি রেগে আছে। তিলো আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে ফিরে আসলো। সরাসরি ওকে জিজ্ঞাসা করার সিদ্ধান্ত নিলো।

#চলবে
#চলবে

সুস্থ থাকলে রাতে ইনশাআল্লাহ আরেকটা পর্ব দিবো।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here