মধুবালা পর্ব ৭+৮

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

নীল শাড়ি পরে খুব সুন্দর করে সেজেছে নীলা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাঁকে! কিন্তু যার জন্য সাজলো তার তো দেখাই নেই! সাড়ে আটটা বেজে গেছে অথচ আশরাফি স্যার এখনো এলেন না! ফোনেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো নীলার। তবে কি তিনি সত্যিই আসবেন না? কিন্তু নীলা যে এত শখ করে সাজলো! সব কি তবে বৃথা? রাগে, অভিমানে সাজগোজ সব তুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে তাঁর। খুব কান্না পাচ্ছে!

বড় মুখ করে বন্ধুদের সবাইকে বলেছিলো আশরাফি আসবেন কিন্তু ফাঁকি দিয়েছেন তিনি। বন্ধুরা নিশ্চয়ই চুপিচুপি হাসাহাসি করবে নীলাকে নিয়ে? খুব রাগ হলো আশরাফি ওপর! আসতে যেহেতু পারবেন না তখন আশা দেওয়ার কি দরকার ছিলো? সরাসরি বারণ করে দিলেই তো পারতেন? ফোন করে একবার জানিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। নিষ্ঠুর লোক একটা! শাড়ি খুলে পুনরায় বাবার দেওয়া গাউনটা পরে নিলো সে। সবাই বারবার করে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো নীলা। কি বলবে সে? শুধুমাত্র আশরাফিকে দেখানোর জন্যই নীলা শাড়ি পরেছিলো? কিন্তু এই কথা কাউকে বলা যায়? না বলা যায় না। বিষণ্ণমুখে জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা সারলো সে।

ভেতরে ঢুকতেই সতেরো আঠারো বছর বয়সী একটা মেয়ে বিচ্ছিরি হাসি দিলো আশরাফির দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তি বোধ করলো আশরাফি। এমনিতেই এখানে আসতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে তাঁকে। তারওপর কেউ দেখে ফেললে মানইজ্জত সব শেষ। কিন্তু না এসেও থাকতে পারলো না। ঘুরেফিরে মধুর শাসনই চললো মনের ওপর। নীলাদের বাসায় উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু মাঝপথে গিয়ে সব ভুলে গেলো! সেখানে আর যাওয়া হলো না। এদিকে অনবরত তাঁর দিকে চেয় হেসেই যাচ্ছে মেয়েটা। আশরাফি খানিকটা বিব্রত কন্ঠে ইতস্তত করে বললো,’মেহের কোথায়?’

মেয়েটা হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’মেহের কে?’

এখানে মেহের বলে কেউ মধুকে চেনে না। সবার কাছে মধু/ মধুমা/ মধুবালা এসব নামেই পরিচিত সে। কথাটা মনে পড়তেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সংশোধন করে নিলো আশরাফি। গম্ভীর গলায় বললো,’মধু?’

-‘ও মধুমা? উনি তো নাচের প্র‍্যাকটিস করছেন।

-‘সে নাচ জানে?’, অবাক হলো আশরাফি।

-‘কে বলেছে জানে না? কত ভালো নাচেন আমাদের মধুমা। বিকেলে গুরুজী এসে নাচ তুলে দিয়ে গেছেন এখন সবাইকে নিয়ে প্র‍্যাকটিস করছেন তিনি। ডেকে দেবো?’

ওপরতলার একটা ঘর থেকে একসাথে অনেকগুলো ঘুঙ্গুরের সম্মিলিত আওয়াজ কানে আসছে আশরাফির। সেদিকে একবার তাকিয়ে মেয়েটার কথার জবাবে বললো,’হ্যাঁ। ডাকো তাঁকে।’

কিন্তু বলার পরেও গেলো না মেয়েটা। ফের মুচকি মুচকি হাসছে। অস্বস্তি বেড়ে গেলো আশরাফির। সেই সাথে রাগও হলো। এমনিতে মেজাজ যথেষ্ট চড়ে আছে তাঁর! তারওপর মেয়েটার অদ্ভুত চাহনী! এবার খানিকটা ধমকের সুরেই বললো সে,’এই মেয়ে? সমস্যা কি তোমার? বোকার মত হাসছো কেন?’

ধমক খেয়েও চেহারায় বিন্দুমাত্রেও পরিবর্তন হলো না মেয়েটার। পূর্বের ন্যায় হাসছে সে। অবিশ্বাস্য হলেও এই কথা সত্যি যে, স্যুট টাই পরা হ্যান্ডসাম সুদর্শনদের এখানে খুব কমই আসতে দেখেছে সে। এখানে যারা আসে তাদের অধিকাংশই মাঝবয়সী, চ্যাংড়া টাইপ ছেলেপুলে। মেয়ে দেখলেই হামলে পড়ে! কিন্তু আশরাফি তাদের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। আশ্চর্য সংযত দৃষ্টি মানুষটার! তাই নিতান্তই কৌতুহল বশতই আশরাফির তাকিয়ে ছিলো সে। আর হাসি? হাসিটা তাদের নিত্যদিনের অভ্যেসের সাথে মিশে গেছে। শত দুঃখের পরেও প্রতিরাতে হাসিমুখে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা একজন পুরুষের কাছে নিজেদের বিলিয়ে দিতে হয় তাদের। তাই হাসতে ওদের লজ্জা করে না! সব দুঃখের মাঝেই এই হাসিটাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে এখানকার সব অসহায় মেয়েগুলো! কিন্তু এসব আশরাফির বোঝার কথা নয়! কারণ এখানকার পরিবেশের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবগত সে। উপরন্তু মেয়েটার আচরণে বিরক্ত হয়ে, সে নিজেই উপরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে ওপর তলার সিঁড়ি বেয়ে অনুমান করে নিলো ঘুঙ্গুরের আওয়াজ কোন ঘর থেকে আসছে?

আশরাফি ভেতরে ঢোকার পূর্বেই নাচের প্র‍্যাকটিস থেমে গেলো। মেয়েগুলো সব একে একে নিচে নামতে শুরু করেছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো আশরাফি। কিন্তু মধু নামলো না। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে অবশেষে ভেতরে উঁকি দিলো সে। উল্টোদিকে ফিরে কিছু একটা করছে মধু। সদ্য প্র‍্যাকটিস শেষ করায় ঘামছিলো বোধহয়। তাই শাড়ির আচঁল কোমর থেকে খুলে কপালের ঘাম মুছলো। তারপর সেটাকে আলগাভাবে গায়ের ওপর মেলে দিলো।
ফলাফল স্বরূপ, খুব সহজেই তাঁর ফর্সা, মেদবিহীন ক্ষীন কটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে গেলো আশরাফি সামনে। সমস্ত শরীর ঝিঁঝিঁ করে উঠলো আশরাফির। তাঁর দীর্ঘ আটাশ বছরের তারুণ্যময় জীবিনের সংযম কেবল এই মুগ্ধনয়নবিহারিনীর প্রতীক্ষাতেই ! একে ভীন্ন অন্য কোন নারীকে একমুহূর্তের জন্যেও চায় নি সে! বুকের ভেতরে তীব্র হাহাকার রব উঠলো! চোখ ঝাপশা হয়ে এলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো সে। নিজে সংযত করে নিলো। কিন্তু হঠাৎ আবার কি বুঝে যেন,চুপিচুপি ভেতরে ঢুকলো। মধুর উন্মুক্ত কটিতে বেশ জোরেশোরেই একটা টোকা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তাঁর বিপরীতে মধু যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠে চেঁচামেচি শুরু করবে এই কথা স্বপ্নিউ ভাব নি আশরাফি। হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁকে দেখে আচমকাই আবার চিৎকার থেমে গেলো মধুর। লাফ দিয়ে দূরে সরে গেলো সে। বুকে থুথু দিয়ে,চোখ বড়বড় করে আতংকিত কন্ঠে বললো,’তুমি?’

আশরাফি অবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থেকে বললো,’হ্যাঁ আমি। কিন্তু তুমি এতজোরে চিৎকার দিলে কেন?’

-‘চোরের মত ঘরে ঢুকে গায়ে হাত দিচ্ছো আবার বলছো চিৎকার দিলাম কেন? এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?’, কণ্ঠস্বর ঝাঁঝালো শোনালো মধুর।

আশরাফি হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’বাহ! ভূতের মুখে রামনাম? আমি হাসবো না কাঁদবো সত্যিই বুঝতে পারছিনা।’

-‘মানে?’

-‘মানে আবার কি? তোমার রিয়েকশনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সামান্য একটা টোকা দিয়েছি বলে এত চিৎকার করার কি আছে? এমন তো নয় যে এই প্রথম কেউ তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? তুমি তো রোজই…!’

পরের কথাটা সম্পূর্ণ করলো না সে। চুপ করে মধুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। ভীত হরিণীর ন্যায় আদুরে মুখ! সীমাহীন মায়া আর অপূর্ব মুগ্ধতা! সম্মোহিতের মত চেয়ে রইলো আশরাফি! ততক্ষনে শাড়ি আঁচল পুরোপুরি গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে মধু। গম্ভীর গলায় বললো,’এসব কথা এখন থাক।’

-‘কেন থাকবে কেন? লজ্জা করছে? আফসোস হচ্ছে?’

জবাব দিলো না মধু। অবনত মস্তকে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে! মনে মনে তাঁর এই রিয়েকশনটাই প্রত্যাশা করছিলো আশরাফি। কাছে এগিয়ে গেলো সে। আলতো করে মধুর দুইবাহু চেপে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বললো,’বলো না মেহের, কিসের দুঃখ তোমার। কেন তুমি এখানে পড়ে আছো?’

মধুর সমস্ত শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো আশরাফি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! এখনো তাঁকে এত ভালোবাসে মানুষটা? এত আদরমাখা আকুতি! মুচকি হাসলো সে। ঝাড়া মেরে আশরাফির হাতটা সরিয়ে দিলো।কিঞ্চিৎ অবজ্ঞামিশ্রিত সুরে বললো,’তোমার নাকি আমার সাথে কথা বলার কোন রুচি নেই, আমার গায়ে হাত দিতে নাকি তোমার রুচিতে বাধে? প্রমাণ হয়ে গেলো তো সব মিথ্যে? ভেতরে ভেতরে তুমি এখানকার আর দশজনের মতই। ‘

চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলো আশরাফি। বড় বড় দম নিলো সে।কিন্তু মধুর পরেও কথাটা শুনে আর শান্ত থাকতে পারলো। তাঁকে অবাক করে দিয়ে মধু বললো,’এখানে যারা আসে সবাই টাকা দিয়ে অধিকার প্রয়োগ করে। তোমার যদি খুব বেশি ইচ্ছে করে তবে তুমিও টাকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট করে নিতে পারো। তবে শুধু একরাতের জন্য!’

সেদিনের মত আজকেও যথারীতি ঠাস করে চড় পড়লো মধুর গালে। চোখেমুখে তারা দেখছে সে! দেখারই কথা! কারণ সেধে সেধে নিজেই আগুন জ্বালিয়েছে আশরাফি মাথায়। এখন সহ্য তো তাকেই করতে হবে। রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলো আশরাফি,’নির্লজ্জ, বেহায়া, চরিত্রহীন মেয়ে! তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে এসব বলার?’ মধু গালে হাত দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,’কথায় কথায় আমার গায়ে হাত দাও কেন তুমি?’

-‘দিয়েছি বেশ করেছি। ডেকেছো কেন আমাকে? আবার দেবো। তোমাকে আর তোমার ঐ হারামির বাচ্চা আরমানকে খুন করবো আমি। খুন করে তারপর জেলে যাবো।’

কথা শেষ করে দুম করে পাশের ফুলের টবটা লাথি মেরে ফেলে দিলো সে। তাঁর রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিউত্তরে আর কিছু বলার সাহস হলো না মধুর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিরবে কিছুক্ষণ আশরাফির মেজাজ শান্ত হওয়ার অপেক্ষা করলো। কিন্তু মেজাজ কি এত সহজে কমে আশরাফির? রাগে গরগর করছিলো সে। অত্যাধিক ক্রোধে দিশেহারা হয়ে শেষমেশ বেরিয়েই যাচ্ছিলো কিন্তু চট করে তাঁর পথ আগলে দাঁড়ালো মধু। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বললো,’কোথায় যাচ্ছো?’

-‘জাহান্নামে।’

-‘শান্ত হও। কথা আছে তোমার সাথে।’

-‘আমার নেই। তোমার মত নোংরা, জঘন্য নিচু মনমানসিকতার একটা মেয়ের সাথে কোন কথা থাকতে পারে না আমার। তোমার মুখ দেখতেও ঘৃণা লাগছে। গা গুলিয়ে আসছে, ঘিনঘিন করছে! নিজেকে অপবিত্র মনে হচ্ছে।’

-‘ঠিক আছে আমার মুখ দেখার দরকার নেই। শুধু কথাগুলো শুনলেই হবে।’

-‘বললাম তোমার কোন আমি শুনবো না।’

তথাপি দরজা থেকে নড়লো না মধু। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আশরাফির কথা গুলো যেন শুনতেই পায় নি এমন ভাব করে বললো,’তোমরা মেয়েগুলোকে ঠিক যেভাবে রেডি করতে বলেছো আমি ঠিক ঐভাবে তৈরী করেছি ওদের। কিন্তু সেই বিষয়ে আমার একটা প্রশ্ন আছে?’

মেহেরের প্রশ্ন সম্পর্কে জানার বিন্দুমাত্রেও আগ্রহ প্রকাশ করলো না আশরাফি। নিজের মত গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে। বাধ্য হয়ে মধু নিজে থেকেই বললো,’তোমরা কি শুধু জলসার আয়োজনই করেছো নাকি অন্যকিছু…! অন্যকিছু মানে বুঝতে পারছো তো? একটু আগে যেইজন্য আমাকে কথা শুনিয়ে ছিলে সেটাই!’ এটুকু বলেসতর্ক দৃষ্টিতে একবার আশরাফি দিকে চাইলো সে। আশরাফি পূর্বের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিঞ্চিৎ ভরসা পেলো মধু। যাক! পাগল এখনো শান্ত আছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করে ফেলতে হবে। তড়িঘড়ি করে বললো,’যদি তেমন কিছু হয় তবে এখন যেই মেয়েগুলোকে সিলেক্ট করেছি তাদের পাঠানো যাবে না। ওদের বয়স কম। তাছাড়া শরীরও খারাপ। অন্যদের পাঠাতে হবে।’

মধুর অন্য কিছুর ইঙ্গিতটা ঠিক ধরতে পারলো আশরাফি। সুন্দর মুখটা ক্রমশ ধারালো হয়ে এলো তাঁর! ঘৃণাভরা কন্ঠে বললো,’তোমার চিন্তাধারা কেবল টাকা আর শারীরিক সম্পর্কতেই আটকে আছে, তাই না? মানে, এর বাইরে আর কিচ্ছু বুঝতে বোঝার দরকার নেই তোমার ?’ জবাব দিলো না মধু। আশরাফি থেমে রইলো না। তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে মধুর ভেতরটাকে জর্জরিত করে দিয়ে বললো,’এতটা নির্লজ্জ তুমি কবে থেকে হলে মেহের? তোমার নির্লজ্জতা দেখে লজ্জায় আমার মরে যেতে মন চাইছে!’

এবারেও আশ্চর্যজনক ভাবে হাসলো মধু। ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা দিতে দিতে পাকা ছাত্রী হয়ে গেছে বটে। আশরাফির কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললো,’কিন্তু আমার যে মরতে ইচ্ছে করে না। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে আমার। খুব ইচ্ছে করে। আরমান কত ভালোবাসে আমাকে। মরে গেলে কি লাভ?’

আরমান! আরমান! আরমান! গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে আশরাফির। আর সহ্য করতে পারলো না সে। পুনরায় বহির্গমনে উদ্যত হলো। মধু ফের বাধা দিয়ে বললো,’আমার প্রশ্নের উত্তর?’

-‘তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করি না।’

-‘কিন্তু তবুও দিতে হবে। কারণ আমাদের সাথে ব্যবসা করছো তুমি।’

-‘ব্যবসা করছি মানে?’

-‘আলবৎ ব্যবসা করছো। তোমরা টাকা দিয়েছো আমরা সার্ভিস দিচ্ছি। এটাকে ব্যবসা বলবো না তো কি বলবো?’

-‘কিন্তু তারসাথে ঐ মেয়েগুলোর সুস্থতার কি সম্পর্ক? তুমি আর তোমার ঐ সো কল্ড স্বামী মিলে যখন মেয়েগুলোকে দিয়ে এসব নোংরা কাজই করাচ্ছো তখন ওদের শারীরিক সুস্থতা দিয়ে এসব মিথ্যে কনসার্ন দেখানোর মানে টা কি?’

-‘মানে জেনে তোমার দরকার নেই। তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি তুমি শুধু তাঁর উত্তর দাও।’

-‘সেটাই তো! মানে জানলে তো বলবে। কিন্তু আমি জানি। আমি শতভাগ নিশ্চিত এরসঙ্গেও কোন স্বার্থ জড়িয়ে আছে তোমাদের? নতুবা তোমার মত নীচ, জঘন্য মনমানসিকতার মেয়ের কাছ থেকে তো এমন ভালো কিছু আশা করা যায় না।’

-‘একদম ঠিক ধরেছো তুমি। আমার মনমানসিকতা, চিন্তাধারা সত্যিই খুব নিম্নমানের। সেইজন্যেই মেয়েগুলোর শারীরিক সুস্থতা নিয়ে ভাবতে হয় আমাকে। কারণ ওরা অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার টাকা আসবে কোথা থেকে? কিন্তু, এবার তুমি আমার চিন্তাধারাকে নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিয়ে কাজের কথায় এসো। সত্যিই মেয়েগুলোকে দিয়ে অন্যকিছু করানোর প্ল্যান নেই তো তোমাদের?’

জবাবে ভয়াবহভাবে চোখপাকালো আশরাফি। মধু ভয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,’ঠিক আছে,ঠিক আছে আমি বুঝতে পেরেছি তোমাদের সেরকম কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু সবসময় এত মেজাজ দেখানোর কি আছে? ভালো করেও তো বলা যায়। এত রাগ স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো নয়। তুমি জানো,শরীরের কত ক্ষতি হচ্ছে তোমার। রাগটা একটু কমাও।’

-‘তুমি ভাবলে কি করে তুমি উপদেশ দিলেই আমি শুনবো? তোমার কথা শোনার চাইতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা কুকুরের কথা শোনাও আমার কাছে ঢের আনন্দের।’

-‘সেই জন্যই বুঝি কুকুরের মত ঘেউঘেউ করতে শিখে গেছো?’ মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেলো মধুর। সঙ্গে সঙ্গেই জিভ কাটলো সে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। আগুনে ঘি ঢালা হয়ে গেছে! মানে, এতক্ষণ বোম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আশরাফি, এবার ফেটে পড়লো। সজোরে মধুর দুবাহু ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’এতবড় সাহস তোমার? তুমি আমাকে কুকুর বলেছো?’ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি আটকালো মধু। আশরাফি যতই তাঁকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে ততই হাসে সে। হাসির বহর যেন থামেই না। থমকে গেলো আশরাফি। নির্বাক চোখে মধুর দিকে চেয়ে থেকে নিজের ভেতরটাকে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে। হ্যাঁ! এই হাসি দুর্বল করে দিচ্ছে তাঁকে! মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে!
আকস্মিক মধুকে ছেড়ে দিলো ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো সে। একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।

আশরাফি চলে যাওয়ার পরেও অবাক, বিস্ময়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো মধু। নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে গেলো তাঁর। মুহূর্তেই যেন সবকিছু অন্তঃসারশূন্য করে দিয়ে গেছে মানুষটা। ফাঁকা, জনমানবহীন লাগছে সবকিছু! চাপা কান্নায় বুকের ভেতরটা গুমরে উঠলো মধুর। পূর্বের ন্যায় নিজেকে সংযত করতে গিয়ে থমকে গেলো। আশরাফি চলে গেছে। এবার নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারে সে!

ভাগ্যিস আশরাফি অন্তর্যামী নয়! নতুবা কোন কিছু দিয়েই আটকানো যেতো না তাঁকে। পাগলাটে, মতিচ্ছন্ন, খ্যাপাটে প্রেমিক সে। কোন কিছুর পরোয়া নেই! কিন্তু মধু তো জানে, সমাজ একজন পতিতা নারীকে কতটা খারাপ, কতটা ঘৃণার চোখে দেখে। মধুর জন্য আশরাফি হয়ত সমাজের পরোয়া করবে না কিন্তু আশরাফির জন্য মধুকে সমাজে পরোয়া করতে হবে। মধু চায় না আশরাফি এমন কোন ভুল করুক যেই ভুলের জন্য হয় সারাজীবন সমাজের প্রতিটা স্তরে, প্রতিটা পর্যায়ে, প্রতিটা ক্ষেত্রে হেনস্তা হতে হয় তাঁকে।

মধুর জীবন পঁচে, গলে নষ্ট হয়ে গেছে! অবশিষ্ট বলে যেটুকু আছে সেটুকু কেবল আশরাফির স্মৃতি! কিন্তু আশরাফি? সে তো কোন দোষ করে নি। তবে বিনাদোষে কেন তাঁকে সারাজীবন সবার কাছে মাথা নিচু করে থাকতে হবে? কেন মধুর নষ্ট, নির্মম পরিনতির দায়ভার সারাজীবন মাথায় নিয়ে বেড়াবে সে? ভালোবাসার দায় কি কেবল একার তাঁর? মধুর নেই?
না মধুরও আছে। আশরাফিকে কোন ভুল করতে দেবে না। তারজন্য যা করতে হয় মধু করবে! একসময় ঠিক মধুকে ভুলতে বাধ্য হবে আশরাফি! হতেই হবে।

কিন্তু এখন এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন হৃদযন্ত্রে হুল ফুটছে তাঁর! কেন আশরাফির শূন্যতা মধুর সমস্ত হৃদয়ে কালবৈশাখীর ঝড় তুলছে? মেঝেতে আছড়ে পড়লো সে। তাঁর মর্মভেদী চিৎকার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সমস্ত বাড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করলো। তথাপি চিৎকার থামলো না। উন্মাদের মত বাঁধভাঙা ক্রন্দনে বুক ভাসিয়ে ফেললো সে! এইজন্যেই বোধহয় রবীঠাকুর বলেছিলেন,’ভালোবাসাকে বর্ণনা করা অসম্ভব, ইহা একটু অফুরন্ত রহস্য!’
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে বসে ডিপার্টমেন্টের অফিসিয়াল কিছু কাজ করছিলো আশরাফি। এই আওয়ারে তাঁর ক্লাস নেই। সেই ফাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো সে। দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে জামা, ওড়না ঠিক করে নিলো নীলা। থাই গ্লাসের আয়নায় চুলটা একবার দেখে নিয়ে রুমের দরজায় উঁকি দিলো সে। সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’স্যার আসবো?’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা ছিলো আশরাফি। দরজার কাছে আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসলো। সামনে খুলে রাখা ল্যাপটপে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে হাত দিয়ে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলো নীলাকে। গতকালকের কথা মনে পড়তেই অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,’আমি খুবই দুঃখিত নীলা, কালকে তোমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে পারি নি। আসলে হঠাৎ করেই একটা জরুরী কাজ পড়ে গিয়েছিলো। ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিলো তাই কল রিসিভ করতে পারি নি। তুমি কিছু মনে করো নি তো?’ নীলা জোরপূর্বক হাসলো। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে বললো,’ ইটস ওকে স্যার।’

-‘বসো।’

মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো নীলা। তাঁর চোখমুখে উদ্বিগ্নতা, ভয়। ম্লান কন্ঠে বললো,’একটা কথা বলার ছিলো স্যার।’

পুনরায় হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলো আশরাফি। হাতের কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে নীলার মুখের দিকে একপলক চাইলো সে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনকিছু নিয়ে ভীষণ মন খারাপ মেয়েটার! সচরাচর নীলাকে হাসিমুখেই কথা বলতে দেখেছে সে। তাই আজকে হঠাৎ ওকে আপসেট দেখে একটু অবাকই হলো। তথাপি নীলার কথার জবাবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো সে,’বলো, কি বলবে।’

নীলার বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে! কথাটা আশরাফিকে জিজ্ঞেস করা ঠিক কতটুকু শোভন হবে বুঝতে পারছে না সে। কিন্তু জিজ্ঞেস না করেও উপায় নেই। নিজের সহপাঠীর কাছ থেকে স্যারের সম্পর্কে এমন জঘন্য একটা কথা শোনার পর চুপ করে বসে থাকাটা মোটেও সমীচীন মনে করলো না সে। বিষয়টা আশরাফির সম্মানের ব্যপার। তাই চুপ থাকতে পারলো না সে। একরকম বাধ্য হয়েই আশরাফির কাছে এসেছে।

ঘটনাটা হচ্ছে ইউনিভার্সিটি আসার পর থেকেই নীলা আশরাফিকে নিয়ে কানাঘুষা শুনছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সবাই চুপ হয়ে যায়। শেষমেশ খুব কাছের এক বান্ধবীর কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে পারে সে।

গতকাল রাতে আশরাফি যখন মধুদের ওখানে গিয়েছিলো ঘটনাচক্রে সেখানকার একটা কাছাকাছি এলাকাতেই বেড়াতে গিয়েছিলো নীলাদের এক সহপাঠী ছেলেবন্ধু। এলাকাটা তাঁর নানার বাড়ি। রাতের বেলা তাঁর মামার সাথে হাঁটতে বেরিয়েছিলো সে। এদিকে ব্রোথেলের চিপা গলিতে গাড়ি না ঢোকায় বেশ খানিকটা পথ হেঁটেই যেতে হয়েছিলো আশরাফিকে। যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দেয় সে। এবং তখনই দূর থেকে তাঁকে দেখতে পায় ছেলেটা। কিন্তু মিনিটখানেক জন্য সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না লোকটা আশরাফি। ভালোভাবে সিউর হওয়ার জন্য আশরাফির পিছু নিলো সে। তারপর যখন দেখলো মানুষটা সত্যিই আশরাফি ছবি তোলার জন্য ফোনও বের করেছিলো। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো আশরাফি।

অতঃপর আজকে ক্লাসে এসে সত্যমিথ্যে মিলিয়ে সে-ই নানারকম গুজব ছড়াচ্ছে আশরাফি নামে। আশরাফি স্যারের মতন মানুষও ব্রোথেলে যায়। বন্ধুদের সাথে আলোচনার জন্য এই চাইতে রোমাঞ্চকর বিষয়বস্তু আর কি হতে পারে না? অতএব যতরকম মশলাপাতি আছে সব মিক্স করে বিষয়টাকে আরো ইন্টারেস্টিং, আরো থ্রিলিং করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু সমস্যা হলো ক্লাসের কেউই বিশ্বাস করলো না তাঁর কথাটা। নীলা তো না-ই, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস আর যাই হোক, আশরাফি স্যার এমন খারাপ জায়গায় যেতেই পারেন না। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের অন্য মেয়েরাও খেপে গেলো। তাঁদের প্রিয় আশরাফি স্যারকে নিয়ে এসব বাজে কথা ছড়ানো হচ্ছে সহ্য করতে পারছিলো না কেউ। উল্টো ছেলেটাকেই কথা শুনিয়ে দিলো তাঁরা। আর শুধু মেয়েরা কেন? ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেই বর্ননাকারীর সমস্ত কথা নিতান্তই না শোনার ভান করে অবজ্ঞাভরে ঝেড়ে ফেলে দিলো। সবার এক কথা, তাঁর হয়ত দেখার ভুল হয়েছে কিংবা এর মাঝে অন্য কোন ঘটনা আছে। কিন্তু আশরাফি স্যার যাবেন ব্রোথেলে? এমনটা হতেই পারে না! যদিও বর্ণনাকারী গ্যারান্টি দিয়ে বলছে সে শতভাগ নিশ্চিত লোকটা আশরাফিই ছিলো। তথাপি কেউ বিশ্বাস করলো না তাঁর কথা। নীলার তো চড়িয়ে গাল লাল করে দিতে মন চাইছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। তাই ক্লাসের ফাঁকে, আসলে কি ঘটেছিলো সেটা জানার জন্যই আশরাফির কাছে এসেছে সে। কিন্তু এখন লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছে না। এমন একটা কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা তো সহজ নয়! যে কারোরই লজ্জা, হওয়ার কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ বসে থাকার পর অনুভব করলো সে, লজ্জার চেয়ে বেশি যেটা হচ্ছে সেটা হলো ভয়। অত্যাধিক ভয়ে হলা শুকিয়ে আছে তাঁর। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো।

আশরাফি স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে বললো,’এনিথিং রং?’

জবাবে অসহায় দৃষ্টিতে চাইলো নীলা। নিজের অজান্তেই এতক্ষণ বাম হাত দিয়ে টেবিল খুঁটছিল সে। আশরাফির শান্ত চাহনীতে সচেতন হয়ে হাত গুটিয়ে নিলো। সেদিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো আশরাফি,’কোন সমস্যা?’

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো স্যার।’, অবশেষে মুখ খুললো নীলা।

-‘বলো না।’

এবারে শুকনো ঢোক গিললো নীলা। হার্টবিট অসম্ভব দ্রুত উঠানামা করছে তাঁর। আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’আপনি মাইন্ড করবেন না তো স্যার?

প্রশ্নটার জবাব সাথে সাথেই দিলো না আশরাফি। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলো সে। ভাবা শেষ হলে বললো,’কথাটা কি মাইন্ড করার মতন?’

এমনিতেই ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে নীলার। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে অত্যাধিক আতংকে আছে সে। তারওপর আশরাফি গম্ভীর চেহারা দেখে আরো বেশি করে ঘাবড়ে গেলো। যদিও আশরাফিকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একইভাবে নীলার দিকে চেয়ে আছে সে। বাস্তবিকই তাঁর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই নীলার কথাগুলো শুনে সম্ভাব্য ঠিক কি ধরনের রিয়েকশন হতে পারে তাঁর। নীলা কাচুমাচু করে বললো,’জি স্যার।’

আশরাফি সপ্রতিভ হাসলো। অবাক হলো নীলা। আশরাফি এবারে টেবিলে আলতো করে একটা চাপড় দিয়ে বললো,’ঠিক আছে করলাম নাহয় একটু মাইন্ড। ক্ষতি কি? তুমি বরং বলেই ফেলো।’

আশরাফির হাসিতে নীলার ভয় পুরোপুরি না গেলেও কিছু কমলো। বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলো সে। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,’কথাটা কার কাছ থেকে শুনেছি আমি নাম বলবো না স্যার। কিন্তু যার কাছ থেকেই শুনি না কেন সে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলছে তাঁর কোন ভুল হয় নি।’

-‘একটু ক্লিয়ার করে বলো নীলা। আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলে কোন লাভ নেই। বলতে যখন হবে তখন সরাসরি জিজ্ঞেস করাই ভালো। এবার সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করলো নীলা,’আমার পরিচিত একজন বন্ধু বলছিলো সে নাকি গতকাল রাতে আপনাকে ঢাকার বাইরে খুব একটা খারাপ জায়গায় দেখেছে। আনুমানিক আটটা কিংবা নয়টা বাজে তখন। জায়গাটার নাম আমি উল্লেখ করতে চাইছি না স্যার। কিন্তু কথাটা কি সত্যি?’

সাহস করে প্রশ্নটা করে ফেললেও আতংকে অসাঢ় হয়ে গেলো নীলা। এই বুঝি আশরাফি স্যার সজোরে তাঁকে ধমক দিয়ে উঠবেন, এই বুঝি অপমান করে রুম থেকে বের করে দেবেন তাঁকে। অবশ্যম্ভাবী ঝড় থেকে বাঁচার জন্য মনে মনে আল্লাহ,আল্লাহ করছিলো সে।

কিন্তু না! তেমন কিছুই হলো না। আশরাফি যেমনি বসে ছিলো ঠায় বসে রইলো। তবে মুখখানা আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর হয়ে গেলো তাঁর। হাস্যজ্জ্বল মুখে নেমে এলো গাঢ় অমাবস্যার ন্যায় অন্ধকার। ডান হাত মুঠো পাকিয়ে থুতনিতে চেপে ধরলো সে। নীলা সরু চোখে চেয়ে রইলো। স্যার কি এবার কিছু বলবেন? আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অধৈর্য হয়ে উঠলো সে। স্যার কেন চুপ করে আছেন না? কেন তিনি প্রতিবাদ করছেন না? বলাবাহুল্য, এতক্ষণ আশরাফি কাছে থেকে যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করছিলো সে এবার মনে মনে সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করলো! সোজাসুজি বলতে গেলে, আশরাফি তাঁকে ধমক না দেওয়ায় বেশ হতাশ হয়েছে সে। কোনভাবেই আশরাফি নিরবতা মেনে নিতে পারছিলো না। কারণ এই নিরবতার প্রকৃত অর্থ ছেলেটার কথাই সত্যি! মনে প্রাণে প্রার্থণা করলো সে,’ইয়া আল্লাহ, না বলুক স্যার। প্লিজ! না বলুক। ঝাড়ি দিক, অপমান করুক তাঁকে।’

কিন্তু না! আশরাফি তাঁকে অবাক করে দিয়ে বলল,’হ্যা সত্যি। গতকাল ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম আমি।’

বিস্ফোরিত নয়নে, চোখ বড়বফ করে আশরাফি মুখের দিকে চেয়ে রইলো নীলা। এই উত্তরটা আশরাফি কাছ থেকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো তাঁর। তীরের ফলার মতন একেবারে তীক্ষ্ণভাবে বুকে গিয়ে বিঁধলো। ফলাফলস্বরূপ, আচম্বিতে সমগ্র পুরুষজাতির ওপর তীব্র ক্ষোভ গিয়ে পড়লো তাঁর। ঘৃণায় সারাশরীর ছেয়ে এলো। ছিহঃ পুরুষ মানুষ এত খারাপ? এই তাদের আসল চেহারা? মানব চরিত্রের গূঢ় দিকটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না সে। এইমুহূর্তে ইংরেজি একটা কথা খুব মনে পড়ছে তাঁর,’অল ম্যান আর অ্যালাইক। দ্যা অ্যাপ্রোচ ইজ ডিফারেন্ট;বাট দ্যা রেজাল্ট ইজ অলওয়েজ দ্যা সেইম।’ এর বাংলা ভাবার্থ হলো, ‘সকল পুরুষ একই রকম। তাদের পন্থা হয়ত ভিন্ন কিন্তু তাদের কাছ থেকে ফলাফল সবসময় একইরকম পাবে তুমি।’ নিদারুণ যন্ত্রনায়, রাগে, ক্ষোভে উঠে দাঁড়ালো নীল। অনেক কষ্টে অবরুদ্ধ কান্নাটাকে ঠেকিয়ে নিস্তেজ গলায় বললো,’আমি আসি স্যার!’

-‘এসো।’

ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো নীলা। আশরাফি কেন গিয়েছিলো, কি কারণে গিয়েছিলো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলো না। আশরাফিও আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না। তবে ব্যপারটা কিঞ্চিৎ আহত করলো তাঁকে। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে উঠলো মধুর পরিহাসরত মুখখানা! গতকাল আশরাফিকে বাগে আনতে পেরে খুব হাসছিলো সে। তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে ফেললো আশরাফি। আর এইমুখ মনে করতে চায় না সে। যত নষ্টের গোড়া এইমুখ! মায়াভরা, বিষাক্ত, জ্বালাময়ী মুখ! যতবার মনে পড়ে, কিছুতেই স্থির থাকতে দেয় না আশরাফিকে। বুকের ভেতর দমকা হাওয়ার মত তান্ডব শুরু করে দেয়!
.
.
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here