মধুবালা পর্ব ২৩+শেষ

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩

স্টেজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বসে আছে মধু।সামনে বিভিন্ন নারীবাদী সংঘটনের বেশ কিছু নেতাকর্মী, মিডিয়ার লোকজনও আছে। মিডিয়ার লোকজন বলতে জার্নালিস্ট শ্রেণীর লোকজন। তাদের পাশে সম্মুখের সারিতে একেবারে মধ্যমনি হয়ে বসে আছে আশরাফি। হাতের রাখা ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ! তাঁর চিন্তা অন্যদিকে!

আর কিছুদিনের মধ্যেই ব্রোথেলটা সরকার দখলে নিয়ে নেবে। তাই সরকারি আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত মেয়েদের কাউকে স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। যদিও ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগে নি আশরাফির। আরমান পালানোর পর আর একটা মুহূর্তও মধুকে ঐ নোংরা জায়গায় রাখতে রাজি ছিলো না সে। কিন্তু উপায় নেই। সরকারি আদেশ!

আজকের ব্রিফিংয়ে মধু এবং মধুর মত মেয়েদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত যেমন, কিভাবে তারা এখানে এসেছে, কার মাধ্যমে এসেছে, তাদের ওপর কি ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো, এখানে কোন শ্রেণির লোকজন বেশি আসতো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। সবাই নিজনিজ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছে।

মেয়েদের জীবন কাহিনী বর্ণনা ছাড়াও এখানকার মোট তেইশজন মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে নতুন একটা সমিতি গঠনের যে প্রস্তাবনা আশরাফির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর নাম এবং তালিকাভুক্ত মেয়েদের লিস্ট জমা নেওয়া হয়েছে মধুর কাছ থেকে। মেয়েদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সমিতির প্রধান হিসেবে মধুকেই নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নিজের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা দেওয়ার পর সমিতির ব্যপারে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য স্টেজে উঠলো মধু। মেয়েরা সবাই দারুণ খুশি! নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে সবাই। একটা সুস্থ জীবন কে না চায়? সবাই তো চায় একটু সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে!

নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বারবার আত্মবিস্মৃত হলো মধু! সে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি তাঁর মত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের জীবনে এমন দিন আসবে। তাঁর আপনজনেরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! কিন্তু এমনটাই হয়েছে! স্বার্থের লোভে প্রিয়জনরা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে আপন জন্মদাতা পিতাও বাদ যান নি! এরজন্যেও হয়ত অনেকাংশে আমাদের সমাজই দায়ী! এই সমাজ পতিতাদের ভালো চোখে দেখে না! এই কলুষিত সমাজ মেহেরদের মধুবালা হয়ে উঠার জন্য হাজার পথ সৃষ্টি করলেও মধুবালাদের মেহের হয়ে উঠাতেই তাদের যত আপত্তি। তাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নির্মম নিয়তির স্বীকার হতে হতে ভাগ্যদোষে ভুক্তভোগী অসহায় মধুবালাদের!

বক্তৃতার একেবারে শেষ পর্যায়ে মধু আশরাফির দিকে এক ঝলক চাইলো। গম্ভীরমুখে বসে আছে মানুষটা। কি যেন ভাবছে! কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটিয়ে অবশেষে বলেই ফেললো মধু,’আমার জীবনের এই কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে সমস্ত অবদান আমার স্বামীর! জনাব আশরাফি বিন আবদুল্লাহ! তিনি না থাকলে আমার,আমার মত মেয়েদের, এই সমতির সমস্ত দুঃখি মেয়েদের এই দুর্বিষহ জীবন থেকে পরিত্রাণের কোন উপায়ই ছিলো না। সারাজীবন একটা নষ্ট জায়গায় পঁচে মরতাম আমরা! তাই আমি আন্তরিক ভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ!’
সাথে সাথেই করতালিমুখর হয়ে উঠলো বিশাল অডিটোরিয়াম। সবগুলো ক্যামেরা আশরাফির দিকে ঘুরে গেলো। আশরাফি হাতের মুঠোয় থুতনি চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলো। মধু হাসলো! সাহস করে কথাটা বলতে পারবে সে নিজেও ভাবতে পারে নি। কিন্তু বলার পর ভীষণ আত্মতৃপ্তি লাগছে!

বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে এলো সে। আশরাফি হাতের ফোন পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মধুর দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ হেসে বললো,’একি করলে মেহের? সবার সামনে আমাকে স্বামী বলে পরিচয় দিলে? এবার যে বিয়ে না করে উপায় নেই? সবাই শুনেছে তুমি আমার বউ! চাইলেও আর না করতে পারবে না।’

মধু হাসলো। বললো,’সারাক্ষণ জোঁকের মত পিছনে লেগে থাকলে না করে উপায় আছে?’

আশরাফির সঙ্গে অলিখিত চুক্তি হয়েছিলো মধুর। আশরাফি বিয়ে করুক বা না করুক মধুকে মধুর মত থাকতে দিতে হবে। আশরাফির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তাঁকে কোনরকম জোর করার যাবে না। নতুবা সে ব্রোথেল থেকে বেরিয়েই যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে, আশরাফির সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না। তাঁর হুমকিতে বাধ্য হয়ে, অগত্যা আশরাফিকে সব শর্ত মেনে নিতে হয়েছিলো। কিন্তু মধুর মুখ থেকে ‘স্বামী’ শব্দটা শুনে বেশ অবাক হলো সে। সুযোগটা কাজে লাগালো। এই সুযোগ! প্রিয়তমার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা আদায় করে নেওয়া যাবে! একমুহূর্তও দেরী না করে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,’বুঝি! বুঝি আমি সবই বুঝি! ভাবটা তুমি শুধুশুধুই নাও।

-‘কচু বুঝেছো তুমি।’

মাছ জালে আটকা পড়েছে ভেবে আশরাফি ভ্রজোড়া দুষ্টুভবে নাচিয়ে বললো,’ঠিক আছে তাহলে তুমিই বলো, আমাকে স্বামী বলে পরিচয় দিলে কেন? কেন আমি কি তোমার স্বামী?’

জবাবে মধু তাঁকে হতাশ করে দিয়ে বললো,’আমার মর্জি!’

-‘কেন? তোমার মর্জি মতন আমাকে কেন চলতে হবে? কে হই আমি তোমার?’

মধু হাসলো। বললো,’চলতে হবে কেন? হুহ! চলতে হবে, মানে হবে। কেন হবে? সেই প্রশ্ন করার অধিকার আমি কাউকে দেই নি! মনে রাখবে আমার সেবাই তোমার কর্তব্য!’

হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি।
এতকিছুর পরেও মধুর মুখ দিয়ে ভালোবাসি শব্দটা বের করতে পারলো না সে। মধু যে সবার চাইতে আলাদা। সর্ব সমুখে আশরাফিকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিতে পারবে কিন্তু একা আশরাফিকে ভালোবাসি বলতেই তাঁর যত কষ্ট! তাঁকে ছটফট করাতে পারলেই যেন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়।
কিন্তু এতকিছুর পরেও আশরাফির ক্লান্তি আসে না। এমনি করে আরো হাজারবছর মধুকে ভালোবেসে যেতে পারবে সে। মুচকি হেসে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বললো,’যথা আজ্ঞা!’

মধুও হুকুম করার ভঙ্গিতে বললো,’হ্যাঁ! এবার আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো।’

বোকা ধরণের মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো আশরাফি! ভাবখানা এমন যেন, সে অনেক আশা করে ছিলো শেষমেশ মধু তাঁকে ভালোবাসি বলবে! কিন্তু সেটা হলো না দেখে মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছে সে! কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই চুপচাপ গাড়ির পেছনে দরজা খুলে হাত ইশারায় ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিলো মধুকে।

তাঁর কাঁচুমাচু চেহারা দেখে হাসলো মধু। মনে মনে হাজারবার বললো,’ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি! আমি তোমাকে ভালোবাসি! ভীষণ ভালোবাসি!’
কিন্তু মুখে বললো না। কারণ সে চায় আশরাফি এমনি করে সারাজীবন তাঁর মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করুক। এমনি করে সারাজীবন তাঁর পেছনে লেগে থাকুক, তাঁকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উতলা হোক! এসব দেখে আনন্দ পায় মধু। ভীষণ আনন্দ পায়! কেউ একজন নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাঁকে চাইছে ভাবতেই আত্মতৃপ্তিতে বুকটা ভরে যায়। অথচ সে জানে না তাকে খুশি করার জন্যই আশরাফির সব জেনেবুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে! তাঁর মুখের হাসি দেখার জন্যই নিজের মনের কথাগুলো সব লুকিয়ে রাখে!


দুদিন ধরে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে নীলা। রায়হান সাহেব মেয়ের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তার মেয়েটা কি শেষমেশ পাগল হয়ে যাবে? সারাদিন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে, রাত হলে কি যেন বিড়বিড় করে। গতকাল রাতে অস্ফুট গোঙ্গানির আওয়াজও পেয়েছেন মেয়ের ঘর দেখে । অথচ এসব দেখেও চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না তিনি। নীলা নিজ দায়িত্বে আশরাফিকে সেদিন পালাতে সহযোগিতা করেছিলো। অথচ আশরাফি! নিষ্ঠুর পাষন্ডটা একবারও বুঝলো না কতটা, যন্ত্রণা, কতটা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে কাজটা করেছে নীলা। শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সে আশা করে বসেছিলো আশরাফির হয়ত যাবে না। হয়ত তাকে বিয়ের পোশাকে দেখে মায়ায় পড়ে যাবে! একটা মেয়ে সাধ করে তাঁর জন্য বউ সেজেছে, তাঁকে ছেড়ে যেতে একটু হলেও কষ্ট হবে আশরাফির! কিন্তু না সেসব কিছুই হলো না। আশরাফির তাঁর দুহাতভর্তি ভালোবাসাকে নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করে বেরিয়ে গেলো। একবার পিছু ফিরে চাইলো না পর্যন্ত! কি নির্মম! কি পাষন্ড!
সে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মূর্ছা গেলো নীলা। তারপর থেকেই টাকা দুদিন ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে। কারোসঙ্গে কথাবার্তা বলছে না। সারাক্ষণ একা একা। রায়হান সাহেব ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। মেয়েটা অত্যাধিক শোকে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে। এই ভয়ে রাত জেগে মেয়ের ঘরের সামনে বসে থাকেন তিনি। তার এই একটিমাত্র মেয়ে। এর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারেন তিনি। নীলা যদি সেদিন নিজে আশরাফির পক্ষ না নিতো তবে কারো ক্ষমতা ছিলো রায়হান সাহেবের হাত থেকে আশরাফিকে রক্ষা করে। যে করেই হোক নীলার সঙ্গেই আশরাফির বিয়েটা দিতেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা জেনেশুনে, নিজের সর্বনাশ করেছে! এখন আর চাইলেও কিছু করা সম্ভব না।
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
#অন্তিম_পর্ব

রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে মধু। পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি। উঠে বসার শক্তিটুকু নেই। সারাগায়ে আঁচড়ের দাগ। আশরাফি সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। থরথর করে হাঁটু কাঁপছে তাঁর। কপাল ঘামছে। নাঈমের বিয়ে উপলক্ষ্যে তাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়েছিলো তাঁকে। ফিরে এসেই মধুকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। যদিও বাড়ি খালি করার জন্য সরকারিভাবে কোন আদেশ দেওয়া হয় নি তথাপি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলো আশরাফি। কিন্তু হঠাৎ করেই এই সর্বনাশটা ঘটবে সে স্বপ্নেও ভাবে নি। আরমান পলাতক অবস্থায়ও এতবড় সাহস করবে একথা কারোর মাথাতেই আসে নি।

হাটুমুড়ে মধুর সামনে বসলো সে। আধোবোঝা চোখ মেলে চাইলো মধু। ক্ষীণস্বরে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আরমান আমাকে শেষ করে দিয়েছে।’

তাঁর ক্রন্দনরত অসহায় মুখখানা দেখে শরীরের সমস্ত রক্ত টগবগ করে উঠলো আশরাফির। টলমল করতে থাকা চোখের পানি সমতে মধুকে বুকে টেনে নিলো সে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার! দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। মধু আহত,ভাঙাস্বরে আবারো ফুঁপিয়ে উঠলো,’আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে! আমি অপবিত্র হয়ে গেছি। শয়তানটা আমাকে অশুচি করে দিয়েছে। তোমার মেহের আর তোমার রইলো না।’

ভোররাতের দিকে ঘটনাটা ঘটিয়েছে আরমান। বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকে মধুর ঘরে ঢুকেছে সে। ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে থাকার কারণে বাড়ির কলকব্জা সব চেনা আছে তাঁর। তাই অন্ধকারেও মধুর ঘর খুঁজে বের করতে খুব বেশি অসুবিধে হয় নি। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মুখ বেধে ফেললো মধুর। রাগটা মূলত আশরাফির ওপরে থাকলেও সেটা মেটায় মধুর ওপর। এতদিনের সব সংকোচে, ভয় কাটিয়ে চড়াও হয় মধুর ওপর। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় অসহায় মধুর অস্পষ্ট আর্তনাদ কেউ শুনতে পায় নি। নিজের কামনা,বাসনা মিটিয়ে মধুকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে রাতের আঁধারেই আবার পালিয়ে যায় শয়তানটা! সুলেখার কাছ থেকে খবর পেয়ে নাঈমের বিয়ে ফেলে রেখে রাতদুপুরেই ছুটে এসেছে আশরাফি।

মধুর কথার জবাবে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলো তাঁকে। চোখভর্তি পানি নিয়ে সান্ত্বনার সুরে বললো,’কিচ্ছু শেষ হয় নি! তুমি আমার ছিলে আমারই আছো। আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি!’ কথা শেষ করে মধুর তপ্ত ওষ্ঠাধরে স্নেহের চুমু খেলো সে। মধুর তাঁর বাহু চেপে ধরে হু!হু! করে কেঁদে উঠে বললো,’কেন তুমি আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে? কেন গিয়েছিলে? কেন আমার এতবড় সর্বনাশ করলে?’

ডুঁকরে কেঁদে উঠলো মধু! তাঁর বাঁধভাঙ্গা অসহায় আর্তনাদ আশরাফির সমস্ত শরীরকে বিবস করে দিলো। নিস্তব্ধ, শূন্য দৃষ্টিতে মধুর চেয়ে রইলো সে। সব দোষ তাঁর! তাঁর দোষেই মধুকে এতটা সাজা ভোগ করতে হয়েছে! কেন সে মধুকে একা রেখে গেলো? কেন একবারও তাঁর নিরাপত্তার কথাটুকু ভাবলো না? বাঁ হাতটা মধুর মাথায় রেখে আর্দ্র কণ্ঠে বললো,’ঠিকই বলেছো তুমি! সব দোষ আমার! আমি তোমার সব দুঃখের কারণ! আমার জন্যই তোমার এতবড় সর্বনাশ হলো।’

হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো মধু। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মিথ্যে দোষের বোঝা মাথায় নিচ্ছে মানুষটা। কেন মধুর ভাগ্যটা এমন হলো? কেন এতদিন বাদে সে আশরাফির কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই এতবড় সর্বনাশটা হলো?
তাঁর চোখের পানিতে আশরাফির বুক ভিজে একাকার হয়ে গেলো। তবুও কান্না থামলো না। আশরাফির শার্ট খামছে ধরে আর্তনাদ করে বললো,’আমার সাথেই কেন এমন হলো? কেন আমি তোমার হতে পারলাম না? কেন’
জ্বরে শরীরটা থরথর কাঁপছিলো মধুর। আহত পক্ষীশাবকের ন্যায় তাঁকে বুকের মাঝে আড়াল করে নিলো আশরাফি। শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’বললো কিচ্ছু হয় নি! কেন তুমি নিজেকে দোষ দিচ্ছো? ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই। কে বলেছে তুমি আমার হউ নি? তুমি তো আমারই!’

-‘আমার যে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। এই অপবিত্রতা নিয়ে আমি কখনো তোমার কাছে যেতে পারবো না!’

আশরাফি পুনরায় তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’তবে আমি যাবো তোমার কাছে। তোমাকে নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই! তুমি আমার ভিতর, বাহির, অন্তর সব জায়গায় আছো। বাহিরের রূপটা তো কেবল বাহিরকেই ভোলায়। অন্তরকে তো অন্তর দিয়ে বশ করতে হয়! তুমি আমার অন্তর জুড়ে বিরাজ করছো মেহের! পৃথিবীতে আমি সবথেকে বেশি ভালো তোমাকে বেসেছি। তুমি ভিন্ন অন্য কাউকে আমি কখনো, কোনদিন, কোন একমুহূর্তের জন্যেও চাই নি! তুমি যদি মেহের হও তবে আমি তোমাকে মেহেররূপে ভালোবেসেছি। আর তুমি যদি মধুবালা হও তবে আমি তোমাকে মধুবালা রূপেই ভালোবেসেছি! তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্রেও কমে নি!’


তার দুদিন বাদের ঘটনা,
রাত দেড়টা! খাটের ওপর মধুর পাশে শুয়ে আছে সুলেখা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। কিন্তু মধুর চোখে ঘুম নেই। সে ভাবছে আশরাফির কথা। মানুষটা ঘুমিয়েছে কি না কে জানে? গতদুদিন পাগলের মত ছুটেছে আরমানকে খোঁজার জন্য।
আজকেও মধুকে একা রেখে যেতে কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিলো না। অনেক কষ্টে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িয়ে পাঠিয়েছে মধু। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে, এখানে আর একমুহূর্তও থাকতে মন চাইছে না। কিন্তু উপায় নেই! সরকারি নির্দেশ, মানতে হবে। যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে বাড়ি ততদিন সরকারি দখলে থাকবে। মেয়েদের স্থানান্তরও নিষিদ্ধ! অথচ তাদের নিরাপত্তার জন্যেও জোরালো কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। ভাবখানা এমন যে, পতিতাদের সম্মান থাকলেই কি বা না থাকলেই কি! সবকিছুতেই গাছাড়া ভাব! তবে আশরাফি আসার পর থেকে আদাজল খেয়ে লেগেছে। আশা করার যায় এবার খুব শীঘ্রই মামলার নিষ্পত্তি হবে! আরমানের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমান আদালতে পেশ করা হয়েছে। মেয়েরা সবাই বাদী হয়ে সাক্ষী দিয়েছে। অতএব তাঁর কারাদণ্ড ঠেকানো অসম্ভব যদি না পালিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকে।


ঘড়িতে রাত তিনটা! মুখের ওপর কারো গরম নিশ্বাস পড়তেই চোখ খুলে গেলো মধুর। মুখ বেধে রাখা মানুষটার দেহবয়ব দেখে বুঝতে বাকি রইলো শয়তানটা কে! ভয়ে আতংকে শিউরে উঠলো মধু। চিৎকার দেওয়ার আগেই তাঁর মুখ চেপে ধরলো আরমান। ফটাফট কাপড় দিয়ে মুখ বেধে ফেললো। তারপর হাত বাঁধলো। পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো তাঁকে। খাট থেকে নামার আগে পা দিয়ে সুলেখার হাতে সজোরে চিমটি কাঁটলো মধু। ঘুমের ঘোরে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সুলেখা। অন্ধকারে মধুর গোঙানি শুনে লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে গেলো! জানালা দিয়ে মধুকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে আরমান। খাট থেকে নেমে ক্ষিপ্রগতিতে তাঁর পা চেপে ধরলো সুলেখা। বাধা পেয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পা ঝাড়া দিলো আরমান। ছিটকে পড়ে গেলো সুলেখা। কিন্তু পুনরায় চেপে ধরলো। শক্তিতে আরমানের সঙ্গে না পেরে তাঁর ডানহাতের কব্জিতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো সুলেখা। কামড়ে রক্ত বের করে ফেললো। কামড়ের চোটে চোখেমুখে তারা দেখলো আরমান। সবেগে মধুকে নিচে ফেলে দিয়ে সুলখার চুলের মুঠি চেপে ধরলো জঘন্য ধরনের গালি দিলো তাঁকে উদ্দেশ্য করে। তারপর ঠাস করে চড় মারলো তাঁর গালে। সঙ্গে সঙ্গেই ঠোঁট কেঁটে গলগলিয়ে রক্ত পড়া শুরু করলো। চড় খেয়ে বেহুঁশ হয়ে গেলো সুলেখা। ফের নোংরা জঘন্য গালি দিয়ে ঘুমন্ত মেয়েটার ওপর চড়াও হওয়ার প্রস্তুতি নিলো আরমান। বজ্জাত মেয়েটা কামড়ে হাতের মাংস তুলে নিয়েছে আজকে ওকে মেরেই ফেলবে আরমান।

ধ্বস্তাধস্তিতে হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে গেলো মধুর। হাত খুলে কোনরকম কালবিলম্ব না রাগে ক্ষোভে চৌকির নিচ থেকে বটিটা বের করে নিয়ে সে। তারপরই দিশেহারা হয়ে কোপানো শুরু করলো আরমানকে। চেপে রাখা ক্রোধ, ক্ষোভ ঝেড়ে ফেললো। দশমিনিট পর যখন হুঁশে ফিরলো আরমানের রক্তাক্ত ঝাঁজরা দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। হাত থেকে বটি পড়ে মধুর। অত্যাধিক মানসিক চাপে জ্ঞান হারালো সে।


সকাল বেলা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে আশরাফি। নিচতলায় মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে সুলেখা। মধুর হাতে হাতকড়া। বোবা দৃষ্টিতে সম্মুখপানে চেয়ে আছে সে। আরমানের ডেডবডি পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পা-টা টলছিলো আশরাফির। বারবার মনে হচ্ছিলো, সব মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে! মধুর কিচ্ছু হয় নি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই সব ওলটপালট হয়ে গেলো। হাঁটুতে ভর দিয়ে মধুর পায়ের কাছে বসে পড়লো সে। অশ্রুসজল চোখে মূর্তির মতন চেয়ে থেকে বললো,’কেন তুমি আমার কথাটা একবারও ভাবলে না মেহের? কেন? কোন অপরাধে আমাকে তুমি এতবড় শাস্তি দিলে ? আমি যে শুধুমাত্র তোমার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করে ছিলাম! তুমি কেন আমাকে এভাবে শেষ করে দিলে? ঐ শয়তানটার সাথে সাথে তো তুমি আমাকেও খুন করে দিয়ে গেলে মেহের!’

অত্যাধিক শোকে পাথর হয়ে রইলো মধু। আরমানের মত নরকের কীটকে খুন করার জন্য কোন কষ্ট হচ্ছে না তাঁর। এরা সমাজের জন্য হুমকি! যত তাড়াতাড়ি এদের নির্মূল করা যায় ততই মঙ্গল! কিন্তু আশরাফি? সে কি নিয়ে বাঁচবে? তাঁর তো মধু ছাড়া আর কেউ নেই? টুপটুপ করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো মধুর! কোন রকম জবাব দিতে পারলো না সে! মহিলা একজন পুলিশ এসে নিয়ে গেলো তাঁকে! বোবা, শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলো আশরাফি!

আশরাফির কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছে নীলা। আগামী শুক্রবার তাঁর ফ্লাইট। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে সে। সেখানকার একজন বাঙ্গালি প্রফেসরের সাথেই বিয়ের কথাবার্তা চলছে তাঁর। যাওয়ার আগে আশরাফির সাথে দেখা করতে এসেছে। আশরাফিকে বিদায় জানাতেই তাঁর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলো আশরাফি,’ভালো থেকো নীলা, খুব ভালো থেকো।’

নীলা মলিন হাসলো। মধু জেলে যাবার পর বিগত চারবছর যাবত আশরাফির জন্য অপেক্ষা করে এসেছে সে। কিন্তু মানুষটার মায়া হলো না! মধুকে না পেয়ে মধুর স্বপ্নের সমিতিকে আপন করে নিলো মানুষটা। অথচ চাইলেই সে জলজ্যান্ত নীলাকে আপন করে নিতে পারতো। কিন্তু নীলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ কোথায় তাঁর? সে তো ব্যস্ত মধুবালা ফাউন্ডেশন নিয়ে! সেখানকার মেয়েদের যাবতীয় ভালোমন্দ দেখাশোনা করাটাই যেন তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য!

মধুবালা নামটা এখন আর দুঃখ দেয় না আশরাফিকে। সমিতি সব মেয়েগুলোর কাছে মধুবালা একটা শ্রদ্ধার নাম! মধুবালা! যে নিজে ডুবে এখানকার সমতির সব মেয়েগুলোকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। অথচ সে চাইলেই পারতো আশরাফির সাথে একা চলে যেতে! কিন্তু যায় নি! সবার আগে এখানকার মেয়েদের কথা ভেবেছে। মায়ের মতনই তাদের বুকের আগলে রেখেছে! তাই এখনো আগের মতনই মধুমার নামটা শুনলে শ্রদ্ধায় মধুবালা ফাউন্ডেশনের সবকটা চোখ অবনত হয়ে যায়! কষ্টে চোখ ভিজে যায় তাঁদের! মধুর প্রতি তাদের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখলে নিজের দুঃখের কথা ভুলে যায় আশরাফি! ভালোবাসার অন্যরকম মানে খুঁজে পায় সে!

নীলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষন্ন গলায় বললো,’পৃথিবীটা সত্যিই বড় অদ্ভুত স্যার। সবাই ভালো থাকতে বলে কিন্তু ভালো রাখার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না। নিজের ঘাড়ে কেউ বোঝা চাপাতে চায় না।’ আশরাফি জবাব দিলো না। বিষন্ন দৃষ্টিতে নীলার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। নীলা ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’যাইহোক, আমি আসি। আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন।’
কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় ছলছল চোখে শেষবারের মতন আরেকবার পেছন ফিরে চাইলো আশরাফির দিকে। আশরাফি দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। বিদায় বেলায় মেয়েটার মায়া বাড়াতে চাইলো না। মেয়েটা কাঁদছে! মনে মনে হয়ত ঘৃণা করছে আশরাফিকে। কিন্তু তবুও আশরাফি চায় নীলা ভালো থাকুক। খুব ভালো থাকুক! আশরাফিকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যেন খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাক!
আশরাফি নিজের মত করে ভালো থাকতে শিখে গেছে। মধুবালা ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি মধুকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশাই তাঁর ভালো থাকার মূল মন্ত্র! তাঁর বিশ্বাস একদিন মধু ঠিক ফিরবে। ফিরতেই হবে মধুকে! সেদিন আর আশরাফির কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না সে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে আরো একবার সেই দিনটার প্রত্যাশা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশরাফি!
.
.
.
সমাপ্ত
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here