মধুবালা পর্ব ১৭+১৮

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৭

হতবিহ্বল, স্তম্ভিত আশিরাফির মুখের দিকে চেয়ে সুলেখা দ্বিধায় পড়ে গেলো। মানুষটা কি তাঁর কথা গুলো বিশ্বাস করেছে? নাকি সুলেখাকে পাগল ভাবছে। কিছুক্ষণ উশখুশ করে মৌনমুখে বললো,’কি হলো স্যার? আমার কথাগুলো আপনার বিশ্বাস হয় নি?’

উত্তরের আশায় উৎসুক চেহারা সুলেখার! নির্বাক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলো আশরাফি। সুলেখার কথায় সম্বিত ফিরলো। ধ্যান ভাঙ্গলো তাঁর। মিষ্টি করে হাসলো সে। সুলেখা ভীষণ অবাক হলো! মানুষটার মুখে হাসি কিন্তু চোখভর্তি পানি টলমল করছে! তাঁর বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে আশরাফি নরম, কোমল কন্ঠে ছোট্ট করে বললো,’আমি তোমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছি সুলেখা।’

হাসি ফুটে উঠলো সুলেখার ঠোঁটেও। যাক! এবার নিশ্চয়ই আশরাফির সঙ্গে তাঁর মধুমার ভাব হয়ে যাবে! কিন্তু পরোক্ষনেই আবার মুখটা করুণ করে বললো,’মধুমা আপনাকে জানাতে নিষেধ করেছিলো তাই বলতে পারি নি। নইলে আরো আগেই সব জানিয়ে দিতাম। আমি তো জানি, আপনি কেবল মধুমার জন্যই এখানে আসেন। কিন্তু আরমান লোকটা খুব খারাপ। মধুমাকে বিয়ে করতে চায় সে।’

সুলেখার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আশরাফি। মাথার ভেতর একগাদা প্রশ্ন কিলবিল করছে তাঁর। কিন্তু উত্তেজনার বশত কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না সে। সুলেখা আসল কথাটা এখনো জানায় নি। মেহের কেন তাঁর কাছে সত্যিটা গোপন করে গেলো? কিসের ভয়ে? কেন সে নিজেকে আশরাফির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে?’ আশরাফির চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে সুলেখা নিজে থেকেই বললো,’এখান সবাই আরমানকে খুব ভয় পায়। কেবল মধুমা ছাড়া। মধুমার কথা খুব শোনে সে। মধুমাকে পছন্দ করে তো তাই।’

নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে গেলো আশরাফির। অবচেতন মন খানিকটা ঈর্ষা বোধ করলো আরমানের প্রতি। গম্ভীর গলায় বললো,’ভালোই তো। তোমার মধুমাও নিশ্চয়ই তাঁকে খুব ভালোবাসেন।’

-‘ভালোবাসে না ছাই!’,বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে ফেললো সুলেখা। তারপরই আবার একটুখানি হেসে বললো,’মধুমা তো শুধু আপনাকে ভালোবাসে। আপনার জন্যই তো রোজ কান্নাকাটি করে। আপনার অসুখের খবর শুনে কি পাগলামিটাই না করেছিলো। নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে,দিনরাত শুধু চোখের পানি ফেলেছে। তারপর আপনি যখন সুস্থ হলেন মধুমার সেকি আনন্দ। কি যে খুশি।’

এতকাল যাবত মধুর একান্ত গোপন, পরম যত্নে লালিত ভালোবাসার দ্বার আজ উন্মুক্ত হয়ে গেলো আশরাফির সামনে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটস শীতল রক্তের একটা স্রোত বসে গেলো তাঁর। মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনে গেলো সে। আনন্দে, লজ্জায় তাঁর সুন্দর মুখটা আরক্তিম দেখালো। বিমুগ্ধ হয়ে যেন নিজেকেই শোনালো,’সে বুঝি আমাকে ভালোবাসে?’

-‘বাসে না আবার? কত ভালোবাসে আপনাকে। আপনি এখানে আসার মধুমার মুখে আপনার কত গল্প শুনেছি আপনি ভাবতেই পারবেন না।’

অত্যাধিক খুশিতে বিনাকারণেই শব্দ করে হাসলো আশরাফি! আর বেশিকিছু শুনলে সে বোধহয় হার্টফেল করবে। স্নিগ্ধ হাসিতে তাঁর সারা মুখ ঝলমল করে উঠলো। হাসি থামিয়ে আন্তরিক গলায় বললো,’তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে সুলেখা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে তোমাকে। একদিন তোমার গল্পও শুনবো। কিন্তু আপাতত তোমার মধুমাকে দেখে আসা যাক।’

আশরাফির কথা শেষ হওয়ার আগেই কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসতে দেখা গেলো মধুকে। একদৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো আশরাফি। মধু কাছে এসে ক্লান্ত স্বরে বললো,’এখনো যাও নি যে?’, নির্জীব, নিঃস্পৃহ কণ্ঠস্বর! শুষ্ক, রোগা, বিবর্ণ চেহারা মধুর। শরীর ভেঙ্গে আধখানা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি দেখে মনে হচ্ছে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে। আকস্মিক চোখে পানি চলে এলো আশরাফির। অনুশোচনায় হাহাকারে করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মিনিট খানেকের জন্য কোন কথা বলতে পারলো না সে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মধুর কাছে। হাত দিয়ে একটু খানি স্পর্শ করতে চাইলো তাঁকে। সভয়ে পিছিয়ে গেলো মধু। অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আশরাফির মুখের দিকে। গম্ভীর গলায় বললো,’এসব ব্যথা সয়ে গেছে আমার। তুমি চলে যাও!’

সম্বিত ফিরে পেলো আশরাফি। চোখের পানি মুছে মলিনমুখে একটুখানি হাসলো সে। মধু অবাক হয়ে বললো,’কি হলো দাঁড়িয়ে আছো যে?’

জবাব দিলো না আশরাফি। চট করে একবার সুলেখাই মুখের দিকে চাইলো। মেয়েটা ইশারায় যেতে বারণ করছে তাঁকে। কিন্তু থাকার মতন কারণও খুঁজে পাচ্ছিলো না আশরাফি। মধুর কথাদ জবাবে ইতস্তত করলো। সুলেখাই বুদ্ধি খাটিয়ে বললো,’উনি যাবেন না মধুমা। দুহাজার টাকা দিয়েছেন। আজকে রাতে এখানেই থাকবেন। তোমার শরীর খারাপ তুমি গিয়ে বরং শুয়ে পড়ো।’

গোলগোল চোখে অবাক হয়ে সুলেখার মুখের দিকে চাইলো মধু। চেহারা ফুটে উঠলো কঠিন রাগ! আশরাফিও অবাক। মনে মনে সুলেখার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে। হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো,’হ্যাঁ। আমি আজকে রাতে এখানেই থাকবো।’

-‘না থাকবে না তুমি।’ ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর মধুর। সুলেখা আশরাফি মুখপানে চেয়ে হাসলো। এর মানে,’দেখেছেন কত ভালোবাসে আপনাকে?’

আশরাফি হাসলো না। মধুর যন্ত্রণা কাতর মুখের দিকে চেয়ে অনুশোচনায় ভরে উঠলো বুকটা। মধুর কাছে সরে গেলো সে। ছলছল চোখে, অবরুদ্ধ কন্ঠে বললো,’কেন মেহের? তোমার কি কষ্ট হবে?’

প্রশ্নটার জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারলো না মধু। চোখের পানি আড়াল করতে মাথা নিচু করে ফেললো সে। ঠোঁটদুটো ঝিম মেরে প্রাণপণ চেষ্টা করলো কান্না চাপানোর।

সবই দেখলো আশরাফি। অনুভবও করলো! তাঁর ভেতরের আশরাফিটা করুণমুখে অনুনয় করে বললো,’বলো মেহের। প্লিজ বলো। আমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে কষ্ট হয় তোমার!’ কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলো না। গিলে নিলো!

মধু আবারো তাঁকে হতাশ করে দিয়ে শান্ত গলায় জবাব দিলো,’না। আমার কোন কষ্ট হয় না। বারবার এককথা কেন জিজ্ঞেস করো তুমি? একই উত্তর বারবার দিতে দিতে আমি হাঁপিয়ে গেছি। কতবার বলেছি তোমার লাইফ নিয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই তারপরেও ঘুরেফিরে আবার একই প্রশ্ন!’
ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। তবে আজ আর রাগলো না সে। মলিনমুখে বললো,’তবে কেন আমাকে চলে যেতে বলছো মেহের?’

মধু তার কথার জবাব না দিয়ে সুলেখাকে সজোরে ধমক দিয়ে বললো,’এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস তুই? উপরে যেতে বলেছিনা তোকে? যা উপরে যা।’

সুলেখা ভয়ে মিনমিন করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো মধু পুনরায় ধমক দিয়ে ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিলো তাঁকে। উপায়ান্তর না পেয়ে সুলেখার হাত চেপে ধরলো আশরাফি। মধু সীমাহীন বিস্ময়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে। ব্যপারটা সহ্য হলো না তাঁর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশরাফির দিকে চেয়ে রইলো সে। আশরাফির দেখেও না দেখার ভান করে গম্ভীর গলায় বললো,’ও কোথাও যাবে না। আজকে রাতের জন্য ওর সঙ্গে কন্ট্রাক্ট হয়েছে আমার।’

ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড খেপে গেলো মধু। কিন্তু ভাবখানা এমন যেন আশরাফির কথাগুলো শুনতেই পায় নি সে। আবারো কষে ধমক লাগালো সুলেখাকে। এবার ভয়ে আশরাফি সুদ্ধ কেঁপে উঠলো। সুলেখা মাথা নিচু করে বললো,’যাবো কি করে উনি আমার হাত ধরে আছেন যে।’

আশরাফি ধরে রাখা হাতটার দিকে আরেক ঝলক চাইলো মধু। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’ওর হাত ছাড়ো।’

মুহূর্তকালের জন্য থমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো আশরাফি। সমান তেজে সেও জবাব দিলো,’ছাড়বো না। ওর সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট হয়েছে। পেমেন্টও করেছি। তুমি কেন বাধা দিচ্ছো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।’

জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মধু। মনে মনে নিজেকে বোঝালো সে। তাঁর বাধা দেওয়ার কারণটা কেবল ঈর্ষা নয়। এর সঙ্গে আশফির মানসম্মানও জড়িয়ে আছে। আশরাফি নেহায়েত পাগল বলেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের মানসম্মানের কথা না ভেবে এখানে থাকার জেদ করেছে। কিন্তু মধু তো আর পাগল নয়? সব কিছুর জানার পরেও সে নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকতে পারে না? তাছাড়া আরমান যদি কোনভাবে জানতে পারে আশরাফি এখানে আছে তখন কি হবে? তাই বাধ্য হয়ে বাধা দিতে হচ্ছে মধুকে। নতুবা শুধুশুধু ঈর্ষা হতে যাবে কেন তাঁর? সে-তো ভালো করেই জানে মানুষটা কেমন! মধু ছাড়া অন্যকারো প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই তাঁর!

কিন্তু এতকিছুর পরেও বেশিক্ষণ নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে টিকতে পারলো না মধু। সুলেখা মেয়েটা দেখতে বেশ বেশ ভালোই সুন্দরী। কথাবার্তাও মায়া আছে। আশরাফির সঙ্গে তাঁর কিসের এতকথা? আশরাফিই বা হঠাৎ করে তাঁর সঙ্গে একঘরে থাকতে রাজি হয়ে গেলো কেন? একটু আগে তো সে নিজেই এখানে থাকতে বলার অনুরোধে অনেকগুলো খারাপ কথা শুনিয়েছিলো মধুকে। তবে এখন কি হলো? এত জলদি মত পরিবর্তন কেন করলো সে?

পরোক্ষনেই আবার নিজেকে তীব্র ধিক্কার জানালো। তাঁর মনটা সত্যিই নোংরা হয়ে গেছে। নতুবা আশরাফি সম্পর্কে এমন জঘন্য চিন্তাভাবনা সে করলো কি করে? যেই মানুষটা এতগুলো বছর যাবত পাগলের মত তাঁকে ভালোবেসে এসেছে, একমুহূর্তের জন্যেও তাঁকে ভুলতে পারে নি সেই মানুষটার সম্পর্কে এসব নোংরা চিন্তাভাবনা এলো কি করে তাঁর মাথায়? বাস্তবিকই মন নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। মস্তিষ্কে পঁচন ধরেছে!
কিন্তু আফসোস! এতকিছুর পরে সত্যিটা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারলো না। হ্যাঁ! ঈর্ষা হচ্ছে তাঁর! খুব ঈর্ষা হচ্ছে। আশরাফি সুলেখার হাত ধরাতে খুব খারাপ লাগছে। কেন লাগছে মধু নিজেও জানে না। কিন্তু লাগছে! আশরাফির প্রশ্নের জবাব পাশ কাটিয়ে গেলো সে। থমথমে গলায় বললো,’আমি তোমাকে ওর হাত ছাড়তে বলেছি?’
তার কণ্ঠে অনেকটা নির্দেশের সুর।

আশরাফিও পালটা জবাব দিয়ে বললো,’বললাম তো ছাড়বো না।’

রাগে দাঁতেদাঁত চেপে ধরলো মধু। ক্রুদ্ধ কন্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো সমস্ত শরীর। দাঁড়ানো থেকে টলে পড়ে যাচ্ছিলো সে, চট করে ধরে ফেললো আশরাফি। তাঁর হাতের ওপরেই জ্ঞান হারালো মধু।
মধুর গায়ে হাত রাখতেই শরীরের উত্তাপ টের পেলো আশরাফি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলো তাঁকে। সুলেখা কাঁদোকাঁদো মুখে বললো,’কি হলো মধুমার?’

-‘জানি না।’, অসহায়, উদ্বিগ্ন শোনালো আশরাফির কন্ঠস্বর। তাড়া দিয়ে বললো,’চলো আমার সঙ্গে চলো, তোমার মধুমার ঘরটা দেখিয়ে দেবে।’
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৮

রাগে মুখ লাল হয়ে আছে মধুর। এই নিয়ে তিনবার আশিরাফিকে ডেকে পাঠিয়েছে সে। কিন্তু আসে নি আশরাফি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার খবর পাঠালো। চতুর্থবারেও এলো না আশরাফি। নিচের ঘরের সুলেখার সাথে গল্প করছে সে। গল্প বলতে, আসলে মধুর জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী সমূহের বর্ণনাই করছিলো সুলেখা।

এদিকে মধু নিজের ঘরে বসে ছটফট করছে। জ্ঞান ফিরতেই সে সর্বপ্রথম যেই প্রশ্নটা করেছে সেটা হলো আশরাফি বাড়ি ফিরেছে কি না। ফেরে নি শোনার পর থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। অত্যাধিক রাগে প্রথমে সুলেখাকে ডেকে আনার জন্য খবর পাঠালো। কিন্তু সংবাদবহনকারী ফিরে এসে জানালো সুলেখা ব্যস্ত আছে। এখন আসতে পারবে না।
ধক করে জ্বলে উঠলো মধুর চোখজোড়া। দাঁতমুখ খিঁচে ফেললো সে। বুকের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করছে তাঁর! মুখে স্বীকার না করলেও আশরাফি সঙ্গে সুলেখার অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠাতা সহ্য করতে পারছিলো না সে। আর যাইহোক অন্তত চোখের সামনে এসব সহ্য করা যায় না। এরপর আশরাফিকে ডেকে আনার জন্য খবর পাঠালো। সে-ও যখন এলো না তখন অভিমানে, অবহেলায় চোখে পানি চলে এলো মধুর। বিছানার বালিশ আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো সে।


মেঝেতে বসে আরমানের কুকীর্তির বর্ণণা করছিলো সুলেখা। খাটের ওপর বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আশরাফি। একপর্যায় সুলেখা দাঁতকিড়মিড় করে বললো,’আমার তো মাঝে মাঝে মন চায় হারামজাদাটাকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে চামড়া তুলে নেই। কিন্তু সাহসে কুলায় না। ব্যাটার গায়ে মহিষের মত জোর!’

তাঁর বলার ঢং দেখে হেসে ফেললো আশরাফি। সুলেখাও হাসলো। ঠিক সেইসময়ে দরজায় এসে হানা দিলো মধু। বাইরে থেকে হাসির শব্দ শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেলো তাঁর। দরজায় পাট্টায় সজোরে বাড়ি মেরে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’এতবার খবর পাঠালাম! ফিরিয়ে দিচ্ছিলে কেন?’
নিঃসন্দেহে প্রশ্নটা আশরাফিকে উদ্দেশ্য করেই করা হয়েছে। কিন্তু সুলেখা সেটা বুঝতে পারলো না। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে তার আগেই আশরাফি জবাব দিয়ে বসলো। গম্ভীর গলায় বললো,’ব্যস্ত ছিলাম! কিন্তু তুমি এখানে কি করছো? আমি তো পুরো টাকা পেমেন্ট করেছি।’

রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো মধুর। তাঁর শরীর খারাপের কথাটা পর্যন্ত একবার জিজ্ঞেস করলো না। তীব্র অভিমানে আশরাফির দিকে চাইলো না সে। একদিকে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে আবার মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। সেই সুযোগে আশরাফি যা খুশি তাই করছে। আর সুলেখা! যেই আশরাফির কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে সে তো মাথায় চড়ে বসেছে। রাগত মুখে সুলেখাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তোর শরীর খারাপ তাই খোঁজ নিতে এসেছিলাম।’

সুলেখা তখন গল্প বলার মুডে। আশরাফির মত মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে গল্প বলার আগ্রহটাও তুঙ্গে! মধুর কথা শুনে অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চাইলো। তাঁর শরীর খারাপের কথাটা তো মিথ্যে! বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মধুর মিথ্যে বলার কারণটা বুঝতে পারলো সে। চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। দুষ্টু হেসে চোখ বড় বড় করে বললো,’কই না তো মধু মা। আমি তো ঠিকই আছি! ‘

মধু থতমত খেয়ে গেলো। পাছে তাঁর রাগটুকু আশরাফির কাছে ধরা পড়ে যায় তাই বিব্রত মুখে দ্রুত নিজের কথা সংশোধন করে বললো,’না মানে। শরীর খারাপ কি না সেটাই জিজ্ঞেস করতে এসেছি। তোর তো প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে তাই।’

-‘আমি একদম ঠিক আছি মধুমা। তুমি আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না। তোমার শরীর খারাপ তুমি গিয়ে বরং রেস্ট নাও।’

সুলেখার ঢং দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো মধুর। তথাপি নিজেকে সংযত করে নিলো সে। শান্ত গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ভেতর থেকে আশরাফি পুনরায় সাড়া দিয়ে বললো,’জিজ্ঞেস করা শেষ? ও ভালো আছে। শুনেছো? এবার তুমি আসতে পারো। শুধুশুধু আমার সময় নষ্ট করো না।’

আগুনে ঘি ঢেলে দিলো আশরাফি কথাটা। জ্বলজ্বল করে উঠলো মধুর চোখজোড়া। সুশ্রী শান্ত মুখখানা ধারালো,কঠিন হয়ে উঠলো। তিরস্কারের সুরে বললো,’তর দেখছি আর সইছে না!’

-‘সইবে কেন? সয় না বলেই তো এখানে এসেছি।’

এবার আর আত্মসংবরণ করতে পারলো না মধু। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো সুলেখাকে। আশরাফির দেখেও না দেখার ভান করে মুখ টিপে হাসলো। সুলেখা বেরিয়ে গেলে খপ করে তাঁর একটা হাত ধরে নির্দেশের সুরে বললো,’চলো আমার ঘরে চলো!’

আশরাফি কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’কেন তোমার ঘরে কেন? আমার কাছে এখন টাকা নেই।’

এইকথাটা তীব্রভাবে আঘাত করলো মধুকে। ইতোপূর্বে তাঁর বলা কথাগুলোরই শোধ নিচ্ছে আশরাফি। তথাপি নিরবে একঝলক আশরাফির মুখের দিকে চেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো সে। কিন্তু হাত ছাড়লো না। টেনে বের করে নিয়ে গেলো আশরাফিকে। আশরাফিও বাধ্য ছেলের মতন পেছন পেছন বেরোলো।

দোতলা উঠে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো মধু। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে তাঁর খাটের ওপর বসলো আশরাফি। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। ইচ্ছে করেই শার্টের প্রথম তিনটে বোতাম খুলে দিলো সে। সেদিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো মধু। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো সে। ধমক দিয়ে বললো,’এসব কি? শার্ট খুলছো কেন?’

-‘আমি ভাবলাম তুমি আমাকে ভালোবাসবে বলে তোমার ঘরে নিয়ে এসেছো। কেন আনোনি বুঝি?’

লজ্জায় মধুর গালদুটো পাকা টমেটোর মত লাল হয়ে গেলো। অস্বস্তি ঠেকাতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। বিড়বিড় করে বললো,’অসভ্য!’

হাসলো আশরাফি। শাটের বোতাম পুনরায় লাগাতে লাগাতে বললো,’লজ্জা লাগছে?’
জবাব দিলো না মধু। আশরাফির এমন উদ্ভট আচরণ করবে ভাবতেই পারে নি সে। অসভ্যটা মধুর জালে মধুকেজ ফাঁসিয়েছে। আশরাফির তাঁর লাজুক, ভীরু মুখ পানে চেয়ে ফের হাসলো। গলাটা সামান্য গম্ভীর করে নরম গলায় বললো,’কেন আমাকে মিথ্যে বলেছিলে মেহের? নিজের সম্পর্কে এমন জঘন্য কথা বলতে একটুও বুক কাঁপে নি তোমার? আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তুমি জানো?’ আর্দ্র হয়ে এলো আশরাফির কন্ঠস্বর।

নিরুত্তর রইলো মধু। সে মরেও গেলে সত্যিটা বলতে পারবে না আশরাফিকে। এখান থেকে ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর। আর যদি ভুল করেও সেই বন্ধ পথ কোনদিন খুলে যায় তথাপি আশরাফির সঙ্গে কখনো মিলবে না। নীলার সঙ্গে এ্যাংগেইজমেন্ট হয়ে গেছে তাঁর। বিয়েটা হয়ে গেলেও সে মধুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আশরাফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি কেন আমাকে কষ্টটা বুঝতে চাও না মেহের? কেন তুমি আমাকে এত দুঃখ দাও? তুমি তো ভালো করেই জানতে,যে যাই বলুক না কেন আমার কাছে সবার আগে তুমি! তোমার সম্মান। তবে কেন তুমি আমাকে সত্যিটা বললে না? কি অসহ্য যন্ত্রণায় আমার এতগুলো দিন কেটেছে তুমি জানো? মনে হচ্ছিলো মরে যাই। তোমাকে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে দেখলেও আমার এতটা কষ্ট হতো না যতটা কষ্ট তোমাকে এখানে দেখে হয়েছে। আর চুপ করে থেকো না মেহের, দোহাই তোমার! তুমি শুধু একবার বলো তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও আমি তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। কেউ কিচ্ছু জানবে না।’

-‘আমি এখানে স্বামীর সংসারই করছি।’

-‘আবার মিথ্যে কথা?’, রাগে অসহ্য হয়ে ধমক দিলো আশরাফি।

-‘আমি কোন মিথ্যে বলি নি।’

-‘তাহলে এত লজ্জা পাচ্ছিলে কেন তুমি? কেন আমার কাছে আসতে পারছিলে না? এসব তো তোমার অভ্যেস হয়ে যাওয়ার কথা। নিজের ইচ্ছেতেই তো এই ব্যবসায় নেমেছিলে?’

-‘তো? তাই বলে লজ্জা পাওয়া যাবে না? মেয়েরা স্বামী ছাড়া অন্য সকল পুরুষের সামনে লজ্জা পাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাছাড়া তোমাকে তো আগেই বলেছি আরমানের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আমি কারো সাথে কন্ট্রাক্ট করি না!

-‘এতই যখন পতিভক্তি তখন স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য একটা লোককে নিজের ঘরে ডেকে আনলে কেন?’

-‘এনেছি তার কারণ আছে। তোমাকে আমি শেষবারের মতন নিষেধ করে দিচ্ছি এসব বাজে জায়গায় আর আসবে না তুমি। লোকে শুনলে কি বলবে? তোমার না বিয়ে ঠিক হয়েছে?’

-‘সেটা আমি বুঝবো। তোমার তাতে কি?’

-‘অতো কিছু আমি জানি না। তুমি আর আসবে না ব্যস। যদি আসো তবে আমি দারোয়ানকে নিষেধ করে দেবো সে যেন তোমাকে ঢুকতে না দেয়।’

-‘তা এই জোরটা কি কেবল আমার ওপরেই চলে? নাকি এখানে যারা আসে সবাইকে এই কথা বলো তুমি! ‘

-‘সবাইকে বলবো কেন? সবাইতো আর আমার চেনাজানা নয়!’

-‘ও তারমানে আমি কেবল তোমার চেনাজানা বলেই তুমি আমাকে এসব কথা বলছো?’

-‘হ্যাঁ। কারণ আমি চাই তুমি ভালো থাকো।’

স্থিরভাবে কিছুক্ষণ মূর্তির মত চেয়ে সজোরে তাঁর কোমরে একটা চিমটি কাটলো আশরাফি। ‘ও মাগো!’ বলেই লাফ দিয়ে সরে গেলো মধু। রাগে মুখ বিকৃত করে বললো,’অসভ্য! বখাটে। মেয়েদের কোমরে হাত দিতে লজ্জা করে না তোমার।’

-‘না করে না। আমি তো তোমার স্বামীর মতন সাধুও নই, ধোয়া তুলসী পাতাও নই। তাই আমার লজ্জা করে না।’

এই কথার জবাবে চুপ করে গেলো মধু। মনে মনে হাসলো সে। পাগলটা নিজের সঙ্গে আরমানের তুলনা করছে! মাথায় একফোঁটাও বুদ্ধি নেই। নইলে এই ভিত্তিহীন কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করার আগে কমপক্ষে হাজারবার ভাবতো। কিন্তু এসব কথা বললে সুযোগ পেয়ে যাবে। আশরাফিকে রাগানোর চেষ্টা করে একটুখানি হাসলো সে। সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে বললো,’ঠিকই বলেছে। আরমান সত্যিই খুব ভালো। সাধু কিনা জানি না কিন্তু তোমার চেয়ে তো আরমান হাজার গুনে ভালো। এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোন সন্দেহ নেই।’

ইতোপূর্বেও সুলেখার মুখে আরমানের কথা শুনেছে আশরাফি। মধুর প্রতি দুর্বলতা আছে শয়তানটার। তাই সেই সুযোগে মধুকে একটু খেপাতে চাইলো সে। মুখটা বিচ্ছিরিভাবে বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যসের সুরে বলল,’ও হো,হো! আরমান আমার চাইতে হাজার গুন ভালো? খুব ভালো না?’

-‘ভালোই তো।’

-‘হ্যাঁ আমিও তো বলি ভালো। একেবারে দেবতা!আমি তো রাবণ!’

মধু হাসিচেপে বললো,’সে কখনো আমার গায়ে হাত দেয় নি!’

-‘সেই অধিকার আছে নাকি তাঁর?’

-‘এখানে অধিকারের পরোয়া কেউ করে না।’

কথায় মধুর সঙ্গে পেরে উঠা যাবে না। হাল ছেড়ে দিলো আশরাফি। হাই তুলে বললো,’খাবার দাবার কিছু থাকলে দাও। খেয়ে একটা ঘুম দেই!’

আতংকে চোখ বড়বড় করে তাঁর দিকে চাইলো মধু। বিস্মিত কন্ঠে বললো,’ঘুম দেই মানে? তুমি কি এখানে থাকবে?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘তারমানে আমার কথাগুলো কানে যায় নি তোমার?’

-‘গিয়েছে কিন্তু সেগুলো মানার কোন প্রয়োজন মনে করছি না। হয় তুমি আমার সঙ্গে এখান থেকে যাবে নতুবা আমিও এখন থেকে এখানে থাকবো। এককাজ করো হাউজের বাইরে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দাও। মেয়ে কাস্টোমারদের নাহয় আমি সেবা দেবো।’

এবারে গলার স্বরটা নরম হয়ে এলো মধুর। আপাতত এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আশরাফির মাথার কাছে মেঝেতে উপুড় বসে নরম গলায় বললো,’দেখো, তুমি কার কাছ থেকে কি শুনেছো আমি কিছুই জানি না। কিন্তু সত্যি বলছি আরমানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

এতক্ষণ ‘আরমান,আরমান’ করে খুব জ্বালিয়েছে তাঁকে। এবার আশরাফির পালা। মধুর অনুনয়ে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিলো না সে। ভ্রু জোড়া দুষ্টুভাবে নাড়িয়ে বললো,’সেজন্যই বুঝি স্বামী স্ত্রী আলাদা ঘরে থাকো?’

ধরা খেয়ে ফের রাগ উঠে গেলো মধুর। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’থেকেছি বেশ করেছি। তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? তুমি ওঠো আমার বিছানা থেকে!’

-‘আমার পয়সা না উশুল করে আমি এক পাও নড়বো না।’

-‘ঠিক আছে তোমার টাকা আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।’

-‘ফেরত দিলেই বা আমি নিবো কেন? আমার সাথে একরাতের কন্ট্রাক্ট হয়েছে। সেটা মিটিও দাও!’

ঠোঁট চেপে কিছুক্ষন নিরবে আশরাফির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বিরক্ত উঠে গেলো মধু। আশরাফি মুখটিপে হাসলো। বললো,’ঠান্ডা লাগছে মেহের। একটা চাদর হলে ভালো হতো!’

-‘নির্লজ্জ! বেহায়া!’ মুখ ঝামটা মেরে বেরিয়ে গেলো মধু। আশরাফি চোখবন্ধ করে হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে বুকের ওপর রেখে খুশি খুশি গলায় বললো,’ইশ! মেহের! রাগলেও তোমাকে যে কি অপূর্ব দেখায় ! আমার তো খালি জড়িয়ে ধরে ভালোবাসতে মন চাইছে! ‘
.
.
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here