মন পাড়ায় পর্ব ৭+৮

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “সুখের সময়সীমা এত কম আর দুঃখের এত বেশি কেন?”

“কারণ সুখ জীবনের মিথ্যে আশা ও দুঃখ কটু সত্য।”

ঝিনুকের উওর না পেয়ে প্রভা আবারও বলল, “ইনশাআল্লাহ তুই দুঃখগুলোকেও ও জয় করে নিবি একদিন। ”

ঝিনুক তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল, “আমার জীবনটাই কটু সত্য। জন্মের পর থেকেই এই কটু সত্য আমার পিছু ছাড়ে না। আর এইসব ওই লোক ও মহিলাটার জন্য। ওই অক্ষম লোকটার জন্য যে আমার জন্মের কথা শুনে পালিয়ে গেছে আর ওই দুর্বল মহিলা যে আমাকে জন্ম দেওয়ার পর আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমাকে যদি এইভাবে ফালিয়েই যেতে হতো তাহলে জন্ম দিলো কেন? আমাকে যদি কখনো প্রশ্ন করা হয় না পৃথিবীতে সবচেয়ে ভীরু মানুষ কে? আমি বলব, আমার সো কল্ড মা বাবা। যারা মা বাবা নামে কলঙ্ক। না তারা আমাকে এইভাবে ফেলে যেত আর না কেউ অনাথ ভেবে আমার জীবন নিয়ে খেলতে পারতো। আর না কথা শুনাতে পারতো। কারণ তারা জানে আমার মা বাবা নেই যে আমার জন্য লড়াই করবে। তাই যা ইচ্ছা তাই করুক সমস্যা কোথায়?”

প্রভা ঝিনুককে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “এইভাবে বলতেই নেই ময়না পাখি। যতই হোক তোর মা ও বাবা। আর খালামণি তো এখন এই পৃথিবীতে নেই, মৃত মানুষ সম্পর্কে বাজে বলতে নেই। আর প্রতিবার এই কথা তুলে লাভ কী বলত? আর কে বলল তোর কেউ নেই, আমরা আছি না?”

“থাকলেও কি হয় আপি। অনাথ সন্তান অনাথই থাকে আর অবৈধ অবৈধই।” ঝিনুক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রভা জিজ্ঞেস করল, “কেউ কিছু বলেছে ময়না পাখি?”

“আপু ক্লাসে স্যার এসেছে আমি রাখি।”

প্রভা কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল। ঝিনুক ফোন কেটে দিয়েছে। মেয়েটাও না, রাগ সবসময় নাকে বসে থাকে। যাক তার স্বপ্ন তো পূরণ হবে তো অবশেষে । প্রভা আশেপাশে তাকিয়ে আয়নার সামনে যেয়ে নিজেই বলল, “অর্ক আমার সাথে যাই করুক না কেন কিন্তু তার এই কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। যদিও অর্কের খারাপ ব্যবহারেরও কারণ রয়েছে। অর্ক ও বিনয় পনেরো বছর ধরে বন্ধু এবং আমার জানা মতে অর্ক প্রায় আট বছর ধরে নূহাকে ভালোবাসে। তাহলে কীভাবে অর্ক আমার কথা বিশ্বাস করবে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভা আয়নায় তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “মুখে হাসি নিয়ে আয় প্রভা। বাহিরে অনেক মেহমান। এই রুম থেকে বের হতেই মানুষের ভিড়ে কষ্টগুলো হাসির চাদরে ঢেকে রাখতে হবে। তাই মুখে হাসি বজায় রাখ।”
প্রভা মৃদু হেসে রুম থেকে বের হলো।

প্রভা তার প্রথম বিয়ের সাত মাস পর থেকে আয়নায় নিজের সাথে কথা বলে। যখন নিজের কষ্টগুলো ভাগ করার জন্য কোনো বন্ধু থাকে না তখন নিজেকেই বন্ধু বানাতে হয়। নিজেকে দেখে হাসতে হয়, কাঁদতে হয়, উপদেশ দিতে হয়। প্রভারও তো কেউ নেই। প্রথম বিয়ের পর শশুড়বাড়ির লোকেরা তার সাথে ঠিক মতো কথা বলত না। এমনকি তার স্বামীও রাগ করতো ভীষণ। কেন রাগ করতো ঠিক সে জানত না। পরে জানতে পারে বিনয় তাকে কখনোই পছন্দ করে বিয়ে করে নি। তার বাবার কয়েকটা টেন্ডারে অংশীদারি লাগতো তাদের। একটা নিজের গাড়ি লাগতো তাই বিয়ে করেছে। কিন্তু পরে আস্তে-ধীরে তার ব্যবহার পরিবর্তন হয়। তবুও তার পরিবারের নির্যাতন কমে নি। তার এখনো মনে আছে যে মেয়ে তার বাবার বাসায় একবার চাও বানায় নি সে মেয়ে সারাদিন ঘরের পরিষ্কার করতো, কুটা বাছা থেকে শুরু করে সব রান্না করতো, ঘরের সবার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিত। আর দিনশেষে সবার খাওয়া শেষে কিছু থাকলে তা খেতে দিত। আর না থাকলে,সেদিন বাদ যেত। এমনকি বিনু হওয়ার সময়ও তার শাশুড়ী তাকে ঠিক মতো খাবার দেয় নি। ভালো কিছু রান্না করার পর তা ছুঁতেও দিত না। এমনও হয়েছে সে একদিনে শুধু মরিচ ও লবণ দিতে ভাত একবেলা খেয়েছে। বিনয় সব জেনেও তার মা’কে কিছু বলতে পারে নি। সে চাইত প্রভার বাবার বাসায় বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত প্রভা থাকুক। কিন্তু তার বাবার বাসাতেও আট মাস না হওয়া পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয় নি। এমনকি মেয়ে হওয়ায় বিনয়ের মা হাস্পাতাল থেকেই বের হয়ে যায় রাগে। কিন্তু বিনয় সেদিন খুব খুশি হয়। সেদিন প্রথম তাকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলেছিল। প্রভার জন্য পৃথিবীর অনেক মূল্যবান কিছু ছিলো। অথচ তাদের আবার অদিন হওয়ার পর সব আগের মতো হয়ে যায়। অথবা বলা যায় আরও খারাপ হয়ে যায়।

প্রভা বাহিরে বের হওয়ার আগেই মাথায় ঘোমটা দেয়। সোজা রান্নাঘরে যায়। যেয়ে দেখে তার শাশুড়ী চা বানাচ্ছে। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “মা আমি আপনার সাহায্য করব?”

উনিও হেসে উওর দিলেন, “না মামনী তুমি এখন ক্লান্ত যেয়ে আরাম কর। গতকাল কত দখল গেল তোমার উপর।”

“একা তো ভালো লাগছিলো না। মা ভাদ্র ভাইয়া কোথায়?”

“ও নিজের মামার বাসায় আছে আপাতত। বেশি মানুষ দেখলে সমস্যা হয়। তোমাদের ফেরার পর একেবারে আসবে।”

প্রভা অনুরোধের সুরে বলল, “মা আপনি আমি আপেলটা কেটে দিই দিন। আমার ভালো লাগছিলো না তাই।”

“আচ্ছা নেও। আমি ততক্ষণে চা তোমার শশুরকে দিয়ে আসি।”

প্রভার শাশুড়ী যাওয়ার প্রভা আপেল কাটতে শুরু করলো। তখন দুইজন মহিলা পাকঘরে প্রবেশ করল। তারা দুইজনের প্লেট রাখলো। প্রভা মৃদু হেসে সালামও দিলো তাদেরকে। সম্ভবত এরা দাদিমার বাড়ির কেউ। তারা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই একে অপরকে বলল, “আমি বুঝতে পারলাম ছোট বউয়ের বিয়ে ভাঙা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করিয়ে আনল কারণ মেয়েটা অনেক সুন্দর। কিন্তু অর্ক বাবা এই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হইসে কেন? একতো কয়লার মতো কালো রঙ, এর উপর দুই বাচ্চার মা। আরও বিধবা। জামাই মরার দুইবছর হয় নি লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে বিয়ে করতে।”

প্রভা আপেল কাটছিলো। কথাগুলো কানে আসতেই থেমে গেল। সে জানে কথাগুলো তাকে শুনিয়েই বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন তা আজও বুঝতে পারে না সে। অন্যের জীবন নিয়ে তাদের এত চিন্তা কেন? কারও মুখে হাসি না আনতে পারলে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার?

সেখানে আরেকটি মহিলা বলল, “আমার তো মনে হয় জাদু টোনা করছে। নাইলে অর্কের জন্য তো কত সুন্দর স্মার্ট মেয়ে আনলাম এই মেয়েকে কেন পছন্দ করবে?”

প্রভা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একসময় এইসব শুনে কষ্ট লাগতো। এখন লাগে না। বড় বড় কষ্ট ভোগ করা শেষে এত তুচ্ছ কষ্টে আর কাঁদা আসে না। এতগুলো ঠোকর খাওয়ার পর কান্নাও শুকিয়ে যায়।

চোখ খুলতেই দেখে তার শাশুড়ী মা এসে পড়েছে। সে বলল, “প্রভা মামনী এই চা নিজের দাদিমায়ের জন্য নিয়ে যাবে একটু?”

“জ্বি মা দিন।”

মহিলা দুটো যাওয়ার পর। মা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা সামাজিক প্রাণী মামনী। এইখানে একেকজন একেক কথা বলে। আর বেশিরভাগই খারাপ হয়। ভালো বলার মানুষ এই সমাজে অনেক কম। কারণ মানুষ খোঁট ধরতে ভালোবাসে গুণ ধরতে নয়। আর মেয়ে মানুষ হলে তো আর রেহাই নেই। আমি যখন এই বাসায় নতুন বিয়ে করে এসেছি আমাকেও অনেক কিছু শুনতে হয়েছিলো যেখানে কেউ আমাকে চিনতোই না। সব কথায় কান দিলে জীবনটা শোকেই কেটে যাবে তাই এইসব কথায় কান দিও না। নেও এই ট্রে টা নিয়ে তোমার দাদিমার কাছে নিয়ে যাও।”
.
.
ছেলেটাকে ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, “এই ফ্রম ফিলাপ কে করেছে?”

“সৈকত ভাইয়ে করছে। আর কইসে যেন আমনে সই নিয়া আহি। আর আমনেরে ডাকছে।”

ঝিনুক ফর্মটার দিকে তাকালো। তার নাম, রোল, জিপিএ থেকে শুরু করে সব ঠিক। সৈকত এইসব জানল কীভাবে? তাদের তো দুইবছর কোনো যোগাযোগই হয় নি। তাহলে কীভাবে? প্রশ্নের একটা উওর যখন পেল বুকের ভিতরটা যেন মুচড়ে উঠলো। না, সৈকত কেন এই দুইবছর তার খোঁজ রাখবে? সে তো মেয়েদের থেকে সময়ই পাবে না আবার তার খোঁজ!

ঝিনুক ছেলেটার সাথে লাইব্রেরি গেল। আরও কিছু কাজ শেষ করতে হবে তাই। আশেপাশে মানুষ আছে কয়েকজন। কিন্তু সে পেল না সৈকতকে। ছেলেটাও চলে গেছে। ধ্যুর। সে খুঁজতে খুঁজতে একদম ভিতরের দিকে চলে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজছিল শুধু। এক শেল্ফের সামনে যেয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে সৈকত। ঝিনুক বিরক্ত নিয়ে বলল, “দেখা দিতে এত সময় লাগে? আর লাইব্রেরিতে কেন ডেকেছ?”

“পড়ছিলাম তাই উঠে যেতে মন চাইল না। এইজন্য তোমাকেই ডাক দিলাম।”

ঝিনুক তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “পড়া আর তুমি! প্লিজ, এই শব্দ তোমার পারসোনালিটির সাথে একদম যায় না।”

সৈকত ঝিনুকের দুইপাশে দুই হাত রেখে তার সামনে ঝুঁকে বলল, “মনে আছে চ্যালেঞ্জ করেছিলে যদি আমি ভার্সিটিতে ফার্স্ট হই আমাকে কিছু দিবে।”

ঝিনুক চিন্তা করতে শুরু করল। কিন্তু মনে পড়লো না। সে জিজ্ঞাসুক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। সৈকত বলল, “তোমার রিভোর্ডের আশায় দুই বছর নিজের ডিপার্টমেন্টে প্রথম হয়েছি। আমি আমার উপহার নিয়ে নিলাম।”

ঝিনুক তবুও কিছু বুঝলো না। তার মনেই পড়ছে না কিছু। সৈকত চোখ বন্ধ করে একটু ঝুঁকে তার ঠোঁটে আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তে কেঁপে উঠলো ঝিনুক। এটা তার আশার বাহিরে ছিলো।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

ঝিনুক তবুও কিছু বুঝলো না। তার মনেই পড়ছে না কিছু। সৈকত চোখ বন্ধ করে একটু ঝুঁকে তার ঠোঁটে আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তে কেঁপে উঠলো ঝিনুক। এটা তার আশার বাহিরে ছিলো।

সৈকত মাথা তুলে চোখ টিপ মেরে বলল, “আমার রিভোর্ডটা আমার পছন্দ হয়েছে। এইটা দ্বিতীয় বর্ষে আর তৃতীয় বর্ষেরটা—-”

কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ঝিনুক সৈকতের বুকে ঘুষি মারতে শুরু করল। আর বলতে শুরু করল, “শয়তান, গরু, ছাগল, ভেড়া, জিরাজ, ভুরুম তুরুম তোর সাহস কত তুই আমাকে কিস করসোস তাও না জিজ্ঞেস করে।”

সৈকত খপ করে তার এক হাত দিয়ে ঝিনুকের দুইহাত ধরে ফেলল আর বলল, “জিজ্ঞেস করলে কী কিস করতে দিতে না’কি?”

ঝিনুক সৈকতের পায়ে মারতে শুরু করল। বলল, “তোকে আমি আজকে খুন করে ফেলবো লুইচ্চা ব্যাটা। সাহস কত বড় হয় আমার পারমিশন ছাড়া কিস করার?”

“আজব তো পাবলিক প্লেসে এভাবে কেউ মারে না’কি?”

কথাটা শুনেই ঝিনুক থেকে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকালো সৈকতের দিকে। নাক ফুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ তো পাবলিক প্লেসে তো কিস করার পোস্টার লাগিয়ে রাখসে।”

“ইশশ রাগ করলে তোমাকে কত কিউট লাগে! পুরো মুখ লাল।হয়ে যায়। একদম টমেটোর মতো লাগে।”

“তোকে আমি টমেটো খাওয়াচ্ছি।”

সৈকত ঝিনুকের হাত ছেড়ে ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “তুমি চাও আমি তোমাকে খেয়ে ফেলি।”

“একদম খুন করে ফেলবো।”

“তুমিই তো বলেছে খাওয়াচ্ছি। নিজে ডাবল মিনিংয়ের কথা বলে আমাকে বকে যাচ্ছ। বেচারা মাসুম আমি।”

ঝিনুক আবারও সৈকতকে মারতে নিলে সৈকত এক দৌড় দেয়। ঝিনুক তার পিছনে দৌঁড়ে গেল। ঝিনুক দেখল সৈকত এক চেয়ার টান দিয়ে বসে গেছে। তখনই একটা লোক তাকে ধমকের সুরে বলল, “এটা লাইব্রেরি না’কি অন্যকিছু? তোমার কন্ঠ সে কখন থেকে শুনছিলাম। লাইব্রেরিতে কীভাবে থাকতে হয় জানো না?” আবার সৈকতকে দেখিয়ে বলল, “ওর থেকে শিখা উচিত। ওদের ডিপার্টমেন্টে ফাস্ট হয় সবসময়ই। সবসময় কত শান্ত হয়ে থাকে ছেলেটা। আর তোমাদের মতো পোলাপান আমাদের ভার্সিটির সম্মান নষ্ট করে। হয়তো চুপচাপ কোথাও বসো, নাহয় এখনই বের হয়ে যাও।”

ঝিনুক ভীষণ লজ্জিত হলো। তার লজ্জায় কোথাও ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে। বিনা কারণে এতটা লজ্জিত হতে হলো তাকে। তবুও এই টেবিলের সারিতে কেউ বসে নেই দেখে অন্যকেউ দেখে নি, নাহয় প্রথম দিনেই তার সম্মান ধুঁয়ে যেত। সৈকতের উপর ভীষণ পরিমাণে রাগ উঠছে তার। সে সৈকতের সামনে যেয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল, “বাসায় আসো খবর করছি তোমার।”

সৈকত চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “উফফ মাই ডিয়ার ওয়াইফ, তুমি এতটা দুষ্টু আমি জানতাম না। এইসব চলে তোমার মাথায়।”

“তোমাকে আমি—-” কিছু বলার আগেই সৈকত ফট করে উঠে ঝিনুকের নাকে একটা চুমু খেয়ে আবার বসে পরলো। ঝিনুক থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কী হলো তা বুঝলোই না। সৈকত গালে হাত দিয়ে বলল, “কন্টিনিউ কিটি ক্যাট।”

ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমাকে আমি একদম খুন করে ফেলব।”

সৈকত বুকের বা’পাশে হাত রেখে বলল, “উফফ জান তোমার হাতে আমি একশোবার খুন হতে রাজি আছি।”

ঝিনুক শেষ না পেয়ে অসহায় গলায় বলল, “তুমি এত বেহায়া কেন?”

“তোমার এক্স ছিলাম না? তোমার সাথে থাকতে থাকতে প্রভাব পড়েছে মনে হয়।”

আবারও লাইব্রেরিয়ান ডাক দিলো ঝিনুককে। ঝিনুক তার কথা শুনে আবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে রেগেমেগে বলল, “আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ সো মাচ।”

“মি টু মাই ডিয়ার ওয়াইফ।” বলেই চোখ টিপ মারলো।

ঝিনুক কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু সৈকতকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে মেঝেতে লাথি মেরেই চলে গেল।

ক্লাসে ফেরত যাওয়ার সময় অর্কের মেসেজ পেল, “প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে বোধহয় সৈকতই কথা বলে নিয়েছে। তোমার এডমিশন হয়ে গেছে। আমি মাঝ রাস্তায় ছিলাম ফিরত যাচ্ছি। তুমিও জলদি চলে এসো। যেহেতু রাতে বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হতে হবে।”

ঝিনুক ক্লাসে না যেয়ে একদম নিচে গেল। নিচে যেতেই অর্ণবের সাথে দেখা হয়। সে ও সাবেক এক জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। অর্ণব তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কাজ শেষ?”

“কাজ না ক্লাস। ওই ফাজিলটা ইচ্ছা করে জ্বালাচ্ছিল। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথাই বলতে হয় নি। একটু আগে জিজুর মেসেজ আসলো যে ভর্তি হয় গেছে। সবই আমাকে জ্বালানোর জন্য।”

“এইজন্যই তো বলেছিলাম ওর থেকে দূরে থাক। শুধু শুধু ঝামেলা বাঁধানোর প্রয়োজন নেই।”

ঝিনুক জোরপূর্বক হাসলো। মনে মনে বলল, “একই রুমে থেকে দূরে থাকব কী করে ভাই?”

তাদের কথোপকথন চলাকালীন একটি ছেলে তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। বলল “এক্সকিউজ মি।”

ঝিনুক তাকালো তার দিকে। সম্ভবত তাকে আগেও দেখেছে। সৈকতের বন্ধুই। নামটা ঠিক মনে আসছে না। ছেলেটা হেসে বলল, “চিনেছ? আমি ইকবাল রুহানি ভাবি ও রাশেদ ভাইয়ের বিয়েতে দেখা হয়েছিলো। আর এরপরও সৈকতের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”

ঝিনুক আড়চোখে তাকালো অর্ণবের দিকে। তারপর বিচলিত না হয়ে ইকবালকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন ইকবাল ভাই?”

“এইতো ভালো। সৈকত বলেছে তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে। যেতে যেতে কথা বলি আসো।”

অর্ণব সাথে সাথে দাঁড়িয়ে রুক্ষ গলায় বলল, “ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে হলে আমি দিয়ে আসছি।”

ইকবাল হেসে অর্ণবের দিকে তাকালো। কাঁধে হাত রেখে বলল, “ধন্যবাদ ভাই কিন্তু সৈকত বলেছে অচেনা কারও সাথে যেন না পাঠাই। ওর ভাবির বোন তো তাই।”

অর্ণব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে ইকবালের হাত নিজের কাঁধের থেকে সরিয়ে দিলো। ইকবাল ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আসো।” ঝিনুক বিদায় নিয়ে ইকবালের সাথে চলল।

সৈকত চারতলা থেকে নিচে তাকিয়ে ছিলো। ঝিনুকের যাওয়া পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। অবশেষে যখন ঝিনুক চলে গেল। সে নিচে নামলো। গেইটের বাহিরে বাইক নিয়ে বের হয়ে দেখে ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। ইকবাল বলল, “মাত্র রিকশা নিয়ে দিয়েছি। তুই তো এখন বাসাতেই যাবি, ওকে সাথে করে নিলেই পারতি।”

সৈকত বলল, “ভার্সিটিতে আমার শত্রু কম না। কেউ যদি জানে ও আমার ওয়াইফ তাইলে ওর ক্ষতি করতে পারে।”

“ওহ আচ্ছা।” পরবর্তী মুহূর্তে ইকবালের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। অচমকায় সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়েট, হোয়ার! ওয়াইফ?”

সৈকত তার বাইক চালু করে বলল, “একটু পর পাঞ্জাবি পরে নিহানকে নিয়ে বাসায় এসে পরিস আজই বৌভাত। আর কাউকে ভুলেই এই কথা বলবি না।”
.
.
অর্ক বাসায় ঢুকতেই বিনু বলে, “আংকেল আংকেল আপনার মা ডেকেছে।”

অর্ক বিনুকে কোলে তুলে বলল, “আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? তার রাতে ঘুম হয়েছে ঠিক মতো?”

বিনু মলিন মুখেই বলল, “হয়েছে আংকেল।”

“আংকেল না। অদিনের মতো তুমিও বাবা ডাক দিও।”

বিনু মুখ মলিন করে তাকাল অর্কের দিকে। বলল, “কিন্তু আপনি আমার বাবা না তো ডাকবো কেন? আমার বাবাকেই শুধু আমি বাবা ডাকব। আর আপনি আমার বাবা না। কখনো হবেন না, কখনো না।”

বলেই বিনু অর্কের কোল থেকে নেমে চলে গেল। আর দৌড়ে তার রুমের ভিতরে ঢুকে পরল। আর অর্ক গেল দাদিমার রুমে যেয়ে দেখে সৈকতের মা ও দাদিমা প্রভার সাথে বিছানায় বসে আছে। দাদিমা তাকে দেখে বলল, “আয় আয় ভিতরে আয়।”

প্রভা পিছনে ফিরে অর্ককে দেখতেই উঠে একপাশে যেয়ে দাঁড়ালো। অর্ক এসে সেই জায়গাতেই বসল। জিজ্ঞেস করল, “ডেকেছিলেন দাদিমা?”

“হ্যাঁ, দাদুভাই ডেকেছিলাম। এই’যে দেখ গয়না। তোর দাদাভাই আমাকে এই গয়নাগুলো উপহার দিয়েছিল। তোমার দাদাভাই মারা যাওয়ার পর আমি ভেবে রেখেছিলাম এগুলো আমার তিন নাতির বউদের দিব বিয়ের পরেরদিনই দিব। এই সেট তোমার বউয়ের জন্য। ওর এইসবের মধ্যে এই রূপার গয়নাই পছন্দ হলো। নেও পরায় দেয়।”

“দাদিমা ওকে দিন ও নিজেই পরে নিতে পারবে।”

“ওইটা তো আমিও জানি পরতে পারব কিন্তু আমি চাই তুমি পরাও, নাহলে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতাম তোমার? আর তোমার কী সমস্যা পছন্দ করোই তো বিয়ে করলে। যে পাগল হয়ে গেছিয়ে বিয়েটা করার জন্য আর এখন লজ্জা পাচ্ছ?”

সৈকতের মাও বলল, “হ্যাঁ, অর্ক পরিয়ে দেও। মা অনেক খুশি হবে।”

অর্ক তবুও দ্বিধাবোধ করল। দাদিমা সৈকতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলে মা রেনু, তোমার ছেলে লজ্জায় এখন ডুইবা যাবে। প্রভা নেও এইটা নিয়ে তোমাদের রুমেই যাও। পরিয়ে দেওয়ার পর আমাকে এসে দেখিয়ে যাবে”

কথাটা শুনতেই অর্ক উঠে রওনা দিলো। দরজায় দাদিমা আবার ডাক দিলে সে দাঁড়ায়। দাদিমা বললেন, “আমার কথার মান রাখবা কিন্তু দাদুভাই।”

“জ্বি দাদিমা।” অর্ক মাথা নামিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

সৈকতের মা প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও মামনী।”

প্রভাও যাওয়ার পর দাদিমা সৈকতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “রেনু মা এই চারটা সেট নিয়ে যাও যেটা ঝিনুকের পছন্দ সেটা ওকে দিবে।”

“জ্বি মা ঠিকাছে।”

প্রভা রুমে ঢুকেই একবার অর্কের দিকে তাকালো। তারপর সামনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে বক্সটা খুলতেই অর্ক তার পিছনে দাঁড়িয়ে গলার মালাটা বাক্স থেকে উঠিয়ে নিলো।
প্রভা জিজ্ঞেস করল, “কি করছেন?”

“দাদিমার আদেশ পালন। দাদিমা বলেছে যেন তোমাকে আমি নিজে পরিয়ে দেই।”

“প্রয়োজন নেই। আমি নিজে পরতে পারব।”

অর্ক আয়নাতেই কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। বলল, “তুমি চাও আমি কথা দিয়ে ফিরে যাই?”

অর্ক গলার মালাটা নিয়ে প্রভার গলায় পরাল। ঘাড়ে আঙুল ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলো প্রভা। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিলো। মাথা নিচু করে নিলো।
অর্ক একপলক তাকালো আয়নার দিকে। তার নিজেরও অস্বস্তি লাগছিলো কিন্তু প্রভার বিচলিত মুখ দেখে তার অস্বস্তি বেড়ে গেল। কানের দুল পরানো হলো। চুড়ি পরানোর জন্য হাত ছুঁতেই প্রভা নিজের চোখ দুটো চেপে ধরল। তার কেমন যেন লাগছে। এক ধরনের অস্বস্তি। কিন্তু সেই অস্বস্তির সাথে স্বস্তিও লাগছে যে এই লোকটা তার স্বামী, অন্যকেউ নয়। কিন্তু এই বিয়েটা তো শুধু একটা ছলনা, তাই না? তাহলে এমনটা লাগছে কেন?

অর্ক হাঁটু গেড়ে নিচে বসল। টুল এগিয়ে দিয়ে বলল, ” এইখানে বসে পা উঁচু কর।”

প্রভা তাই করল। পায়েল পরানোর সময় প্রভা জিজ্ঞেস করল, “আপনি বললেন আপনি কথা দিয়ে ফিরে যান না অথচ আপনি আমার মা’কেও কথা দিয়েছেন যে আমাকে কখনো কষ্ট দিবেন না।”

অর্ক চমকে উঠে তাকাল প্রভার দিকে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিলো। কিছু বলল না। অর্ক অন্যপায়ে পায়েল পরাতে যাবে তখন দেখে সেখানে আগের থেকেই একটা সোনালী রঙের নুপুর পরা। অর্ক তা খুলতে নিলেই প্রভা বলল, “এইটা খুলবেন না। আমার বিয়ের উপহার ছিলো।”

অর্কের কথাটা কেমন যেন বিশ্রী লাগলো। বিয়ের উপহার বলতে তার দেওয়া উপহার নয়, বিনয়ের দেওয়া উপহারের কথা বলছে প্রভা। তার নিজের স্বামীর সামনে আগের স্বামীর উপহারের কথা বলাটা কী মানানসই?

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here