মন পাড়ায় পর্ব ৫+৬

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“সবে এক হুরপরীর দর্শন করলাম। যদি হুরপরীটা স্বপ্নে এসে থাকে তাহলে আমি এই স্বপ্ন থেকে আর জাগতে চাই না। এত সুন্দর স্বপ্ন আর কখনো দেখা হবে কি’না কে জানে?”

“পাগল হয়ে গেলি না’কি কী আবল তাবল বকছিস?”

অর্ণব ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাবেক বিলিভ মি, শী লুকস লাইক আ এঞ্জেল।”

“এখন এঞ্জেল’স ওয়াল্ড থেকে বের হয়ে ক্যান্টিন ওয়াল্ডে চল। আমার খিদায় পেটে ইন্দুররা কুস্তি খেলতাসে।”
অর্ণব না নড়ায় সাবেক তার কলার ধরে টানতে টানতেই ভার্সিটির ভিতরে নিয়ে গেল।

ঝিনুক আশেপাশে অফিস খুঁজছিল আর বিড়বিড় করে কতগুলো গালি দিচ্ছিল সৈকতকে। তখনই আবার অর্ণবের কন্ঠ পেল ঝিনুক। ঝিনুক পিছনে ফিরে তাকালো। অপেক্ষা করল অর্ণব আসা পর্যন্ত। অর্ণব তার সামনে এসে বলল, “আপনি কী কিছু খুঁজছেন? সাহায্য করতে পারি?”

ঝিনুক একটু চিন্তা করে বলল, “অফিস খুঁজছি। আসলে আমার কিছু ফরমালিটি বাকি ছিলো। আর কিছু মানে অনেক। দেরিতে ভর্তি হচ্ছি তো তাই এইসব ঝামেলা।”

সাবেক অর্ণবের কানের কাছে যেয়ে বলল, “এই মেয়ের কথা তুই বাহিরে বলেছিলি? সুন্দর আছে কিন্তু আমার চিকেন পিজ্জা থেকে বেশি না। ইয়াম…ইয়াম।”

অর্ণব তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কনুই দিয়ে তার পেটে জোরে মারল। বলল, “নিজের গার্লফ্রেন্ডের কথা বললেও বুঝতাম। অবশেষে পিজ্জা! তোর মতো গাঁধার মাথায়তেই এইসব আসতে পারে। তোকে মাঠে ফালিয়ে উসঠানো উচিত।”

দুইজনের ফিসফিসানি দেখে ঝিনুক বলল, “আসলে আমার একটু তাড়া ছিলো।”

অর্ণব বলল, “সো সরি। সাবেক অঞ্জলিকে একটা কল দিয়ে বল যেন এইখানে আসে।” আবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “অঞ্জলিও প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আরও ভালোভাবে আপনার সাহায্য করতে পারবে। ততক্ষণে আমরা অফিসে যাই চলুন।”

সাবেক বলল, “আমার পেটের ইন্দুররা সে কুস্তি খেলতাছে তার কী?”

“তোর পেটে সারাক্ষণই এই কুস্তি খেলা চলে।” অর্ণব ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমার সাথে আসুন।”

সৈকত প্লে কোর্টের পাশের পার্কিং লটে তার বাইকের উপর বসে ছিল। তার পাশের বাইকে বসা একটি ছেলে বলল, “এই চাম্পুগুলা এতো একটা সুন্দর মেয়ের সাথে কী করে? হোয়াট দ্যা হেল ম্যান!”

সৈকত তার বন্ধু নিহানের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। সে দেখলো ঝিনুক অর্ণবের সাথে কোথাও যাচ্ছে। মুহূর্তে তার ভ্রু কুঁচকে গেল। সৈকতের আরেক বন্ধু ইকবাল বলল, “আরে এই মেয়েকে তো কোথাও দেখছি মনে হইতাছে। সৈকত, মেয়েটা তোর এক্স না?”

সৈকত উওর দিলো না ঝিনুকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না ঝিনুক অর্ণবকে কীভাবে চিনে? আর এইখানে এত হেসে হেসে কথা বলার কী আছে? সে সোজা উঠে সেদিকে গেল। ইকবাল বলল, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো ড্রামা হতে যাচ্ছে।”

নিহান বলল, “মনে পড়ে করিস আগে ক্যামারা বের করে ভিডিও শুরু কর। ধামাকাদার কিছু হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছাইড়া দিমু।”
.
.
প্রভা চিন্তায় ভুগছিল। তার নিজের বিয়ের প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। তার রঙ কালো বলে তাকে জলদি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মা ভাবে আর এত ভালো সম্পর্ক পাবে না তার জন্য। তাই বিয়ে করিয়ে দেয় এমন এক পরিবারে যে পরিবার কখনো তাকে মেনেই নেয় নি। তার তখন আঠারো বছর। বিয়ের পর পড়ানোর কথা ছিলো পড়ায় নি। মা’কে বলায় মা বলে, “সংসারই তো করবি পড়াশোনা লাগবে না। শশুড়বাড়ির লোকেরা বলছে তো ভেবেচিন্তেই বলছে গো মা।”
অথচ তার স্বপ্ন ছিলো শিক্ষিকা হবার। প্রথমে যৌতুকে অর্থ নেওয়ার পর আবারও তাকে চাপ দেওয়া হয়—- আবারও— আবারও— আবারও—-
স্বপ্নগুলো মিশে গেল দীর্ঘশ্বাসে…….

কিন্তু সে চায় না ঝিনুকের সাথে এমনটা হোক। সে চায় ঝিনুক নিজের স্বপ্নগুলো বাঁচুক। তাই অর্কের সাথে কথা বলতে যাচ্ছে সে। অর্ক তাকে আবার খোঁটা শুনাক বা মারুক কিছু আশে যায় না। অনেক বছরের অভ্যাস আছে। এখন আর এইসব কিছু মনে হয় না।

প্রভা রুমের ভেতর ঢুকে দেখে অর্ক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই চুল আঁচড়াচ্ছে। প্রভা ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। অর্ক আয়নার দিকে প্রভার প্রতিচ্ছবি দেখেই ভারী কন্ঠে বলল, “কী প্রয়োজন?”

প্রভা মাথা নিচু করে বলল, “ওই—ওই’যে ঝিনুকের পড়া—শোনার কথা বলার ছিলো। প্লিজ ওর পড়াশোনা বন্ধ করাবেন না।”

“পড়াশোনা বন্ধ করাব কেন? ওর সাথে সৈকতের বিয়ের কথা হওয়ার সাথে সাথেই আমি সৈকতের ভার্সিটির প্রিন্সিপালকে কল দিয়ে ওর এডমিশনের কথা বলেছিলাম।”

প্রভা মাথা উঁচু করে হাসিমাখা মুখে বলল, “সত্যি!”

অর্ক উওর দিলো না। সে আলমারির সামনে যেয়ে ড্রয়ের থেকে একটি ঘড়ি বের করে পরতে পরতে বলল, “আমারও কিছু কথা ছিলো।”

“জ্বি বলুন।”

“অদিন ও বিনুর থেকে দূরে থাকো।”

প্রভা ঠিক মতো কথাটা বুঝতে পারল না। সে ভাবল হয়তো ভুল শুনছে। বলল, “আমি হয়তো ভুল কিছু শুনেছি।”

“একদম ঠিক শুনেছ। আমি বলেছি বিনু ও অদিন থেকে দূরে থাকও।” [পর্ব-৪ এ আমি ভুলে প্রভা ও অদিনের কথোপকথনে বিনুর জায়গায় নূহা লিখে ফেলেছিলাম। ‘রাণী নূহা আপু’ শুধু এই অংশে। অর্ক ও প্রভার অংশে তা নূহাই হবে। ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন।]

প্রভার চোখে মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। সে বলল, “আমি আমার নিজের সন্তানদের থেকে দূরে থাকব?”

“তাহলে তোমার কী মনে হয় আমি তোমার সাথে বিয়ে করেছি কেন? তোমার শাস্তির পর যেন আমি অদিন ও বিনুর কাস্টাডি পেতে পারি। আর ওরা তোমার থেকে বেশি এই পরিবারকে আপন করতে পারে। যেন তুমি ওদের জীবন থেকে যাওয়ার পর ওরা নিজেকে সামলাতে পারে। ওরা আমার প্রিয় বন্ধু বিনয়ের শেষ স্মৃতি। তুমি আমার বন্ধু ও আমার নূহাকে আমার কাছ থেকে অলরেডি ছিনিয়ে নিয়েছ আমি তোমাকে বিনু ও অদিনের সাথে এমনটা করতে দিব না। ওদের আমি আমার সন্তানের মতো মানুষ করব।”

প্রভা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি আজ শুধু জীবিত আছি আমার বাচ্চাদের জন্য আর আপনি বলছেন আপনি ওদের আমার থেকে দূরে করে দিবেন।”

“তুমিও তো আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার থেকে দূর করেছ।”

প্রভা এইবার উঁচু স্বরে বলল, “আপনি সে চরিত্রহীন মেয়ের সাথে আমার সন্তানদের মিলাতে যাবেন না।”

অর্ক থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার সাহস কী করে হয় তুমি আমার নূহাকে চরিত্রহীন বলেছ!”

অর্ক দ্রুত এসে প্রভার হাত মুচড়ে ধরলো। সে রাগে গর্জে উঠে বলল, “নূহার ব্যাপারে আরেকবার কিছু বললে আমি তোমাকে—–”

প্রভা তার কথা কেটে চোখে চোখ রেখে বলল, “কী মারবেন? আপনাদের মতো কাপুরুষরা আর পারেই বা কী? আপনি আপনার বন্ধুর থেকে কোনো অংশেই আলাদা না। আপনাদের মতো পুরুষ দেখলে আমার পুরুষ জাতিকেই ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।” প্রভা একটু থেকে গভীর নিশ্বাস ফেলল। তার বুক কাঁপছে। সে নিশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। তার কান্না আসছে খুব কিন্তু তা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তবুও যেন নোনপানি তার চোখের পাতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে আবারও বলল, “আর বলছেন আপনার নূহা চরিত্রহীন নয়? কোনো মেয়ে জেনে শুনে বিবাহিত পুরুষের সাথে প্রেমের বা শারীরিক সম্পর্ক রাখলে তাকে চরিত্রহীনই বলে। পরকীয়া কোনো চরিত্রবান মানুষ করে না।”

“তোমার এত সাহস তুমি আমার চোখে চোখ রেখে এ-সব বলছ!”

“বলছি। আরও একশো বার বলব। সত্যি বলতে আমার ভয় নেই। কী করবেন? বেশি হলে মেরে ফেলবেন তাই তো। আমার শুধু এই দেহটাই বাকি, নাহয় আত্নাটা তো শতবার মরে গেছে। আমি চুপ করে থাকি বলে এই নয় যে কেউ আমার থেকে যা চাইবে তা ছিনিয়ে নিবে।” প্রভার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তার কান্না এসেই পরল। গালে বয়ে যেতে শুরু করলো একধারা নোনাপানি। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠেই বলল, “যখন বিনয় আমাকে ছুঁতে আসতো আমি বুঝতাম ও আমার আগে অন্য কোনো মেয়েকে ছুঁয়ে এসেছে। আমি বুঝতাম যখন ও—ও মধ্যরাতে আমাদের রুমের বারান্দায় যেতে মুঠোফোনে গল্প করতো। ও তো এসে আরামে ঘুমিয়ে পড়তো আমার নির্ঘুম রাত কাটতো শুধু। যখন আমি ওকে ভালোবাসি বলতাম, আমি বুঝতাম ওকে অন্যকেউ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তুলেছে। আমি বুঝতাম। আমার আত্মা তখন আহত হয়েছে যখন আমার স্বপ্ন চুরমার হয়েছে, আমার আত্না তখন আহত হয়েছে যখন আমাকে অমানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, আমার আত্না তখনও নিহত হয়েছে যখন আমার বিশ্বাস ভেঙে গেছে। আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার দুইটা বাচ্চার জন্য। আর আপনি বলছেন আপনি তাদেরকেও নিয়ে নিতে চান আমার কাছ থেকে? আপনি জানেন আমি বিনয় থেকে কাউকে বেশি ভালোবাসি নি আর ওর থেকে বেশি ঘৃণাটাও কাউকে করি নি। দয়া করে আপনি এমন কিছু করবেন না যে আপনাকেও ঘৃণা করতে বাধ্য হই। মনে রাখবেন, মুখ থেকে অভিশাপ দিতে হয় না, কষ্ট পেতে পেতে একসময় মনটাই অভিশাপ দিয়ে দেয়। আর এক স্ত্রীর থেকে মায়ের অভিশাপ অনেক বেশি ক্ষতিকর।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অর্ক প্রভার হাত ছেড়ে বলল, “ধরে নিলাম তুমি সত্যি বলছ। মেনে নিলাম ওরা ভুল করেছে। মেনে নিলাম যে আমার ছোট বেলার বন্ধুর সাথে মিলে আমি যাকে ভালোবাসি সে আমাকে ধোঁকা দিয়েছে যাকে আমি ভালোবাসি। মানলাম। কিন্তু ওদের শাস্তির ব্যবস্থা করার মতো তুমি কে? যদি আমি মেনে নিই ওরা তোমার সাথে ভুল করেছে তাহলে তো ওরা আমার সাথেও ভুল করেছে। ওদের শাস্তি মৃত্যু হবে এইটা তুমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে?”

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি আবারও বলছি, আমি ওদের খুন করি নি।”

অর্ক উঁচু স্বরে বলল, “তাহলে কে করেছে? উওর দেও। নূহার মৃত্যুর সময় তুমি সেখানে কী করছিলে?”

“আমি বলেছি ও আমায় ডেকেছিল।”

“কেন ডাকবে? ও তোমায় কেন ডাকবে? তোমার কথানুযায়ী যদি তুমি ওদের জীবন থেকে চলেই যাও তাহলে ও তোমায় কেন ডাকবে?”

প্রভা মাথা নিচু করে বলল, “এর উওর ও ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। আর ও এখন এই পৃথিবীতে নেই।”

অর্ক কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আর কারণটা তুমি।”

অর্ক প্রভার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। প্রভা চোখ বন্ধ করলো আর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
সিঁড়িতে দেখা হলো অঞ্জলির সাথে। সে নিচে নামছিল। সাবেক অঞ্জলিকে দেখে বলল, “আসতে এতক্ষণ লাগে?”

“তুমি ফোন দিয়েছ এক মিনিটও হয় নি। এখন আমি তো আর জাদুকর না যে মুহূর্ত না গড়াতে তোমার সামনে এসে হাজির হয়ে যাব।”

সাবেক নিরাশায় মাথা দুলাতে দুলাতে বলল, “জাদুকর হলে কী ভালোই না হতো। তুমি জাদু করে আমার জন্য কত টেস্টি টেস্টি খাবার আনতে পারতে।”

অঞ্জলি রেগেমেগে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্ণব ভাইয়া ওকে বলে দিন আমার সামনে যেন আর খাবারের কথা না বলে। মাথা খেয়ে ফেলছে ছেলেটা। আমি কেন যে আজও ওর সাথে রিলেশন রেখেছি বুঝি না।”

“দোষ তো তোমারই। লাত্থি মেরে নিজের জীবন থেকে বের করে দেও। পরে বুঝবে।”

সাবেক অর্ণবের পিঠে এক ঘুষি মেরে বলল, “শালা মীরজাফর, তুই আমার বন্ধু না ওর?”

অঞ্জলি মাত্র দেখল ঝিনুককে। দেখতেই তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে তার চেঁচামেচি বন্ধ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলল, “আসসালামু আলাইকুম মেডাম।”

ঝিনুক থতমত খেয়ে গেল তাকে মেডাম ডাক শুনে।বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিন্তু আমাকে মেডাম কেন ডাকছ?”

“আমার বাবা মাহমুদ আংকেলের অধীনে কাজ করে। সেদিন বিয়েতেও ছিলাম। আমার আব্বু আম্মুর সাথে দেখা হতে পারে, আমি দেখা করতে পারি নি। অভিনন্দন মেডাম।”

অর্ণব কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কীসের অভিনন্দন?”

অঞ্জলি যখন বলতেই নিলো, “ওই’যে সৈকত স্যারের —-” তখনই ঝিনুক তার তার হাত খপ করে ধরে নিলো। আর বলল, “সৈকতের বড় ভাই অর্ক ও আমার আপুর বিয়ের। তাই না?”

অঞ্জলি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
ঝিনুক বারবার চোখের ইশারায় তাকে কিছু বলতে মানা করছে তা সে বুঝতে পারছে। সে বলল, “ওই অর্ক স্যারের বিয়ের।”

সৈকত হঠাৎ করে তাদের সামনে হাজির হলো। জিজ্ঞেস করল, “অর্ক স্যারের বিয়ের কী?”
অর্ণবের মুখের ভঙ্গি মুহূর্তে পরিবর্তন হয়ে গেল সৈকতকে দেখে। অর্ণব রুক্ষ গলায় তাকে জিজ্ঞেস করল, “কি চাই?”

সৈকত এক পলক অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আবার বিরক্তি নিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকালো। বলল, “তোমার দুলাভাই ফোন করে বলেছে তোমার কাজগুলো যেন দেখি, নাহয় কী আকাম করে ফেলো কে জানে?”

ঝিনুক ভেংচি কেটে বলল, “নো থ্যাংকস। আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমার। চলুন অর্ণব।”

ঝিনুক এগোতে নিলেই সৈকত বলল, “এজ ইউর উইশ। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে তো আমার কথা বলতে হতো। নাই হোক তাতে কী এক বছরই নষ্ট হবে।”

সৈকতের কথা শুনে ঝিনুক দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, “আগে বলবে না? চলো।”

সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কোথায় চলো? তোমার তো আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

“কিন্তু জিজু না তোমাকে বলছে আমার হেল্প করতে?”

“সো হোয়াট? তুমি বলেছে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি তো অফার করেছিলাম।”

ঝিনুকের প্রচন্ড রাগ উঠলো সৈকতের উপর। তবুও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “তাইলে কী এখন তোমাকে অনুরোধ করতে হবে যেন আমাকে নিয়ে যাও।”

“ওয়াও তোমার মাথার উপরের তালায় এতটুকু বুদ্ধি আছে? তো থাকলে কর না কেন? আর না করলে সময় নষ্ট কর না আর।”

সৈকত ঝিনুকের পাশ যেতে নিলেই সে সামনে এসে মুখ বাচ্চাদের মতো করে অনুরোধের সুরে বলল, “আমি অনুরোধ করছি প্লিজ আমার সাথে চলুন।”

সৈকত ফিক করে হেসে তার দুই পকেটে দুই হাত দিয়ে একটু ঝুঁকে ঝিনুকের কানের কাছে এসে বলল, “এত কিউট দেখালে তো অনেক বেশি করে আদর করতে মন চায়। আফসোস এটা পাবলিক প্লেস।”

সৈকত উঠে দাঁড়াতেই ঝিনুক অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সৈকত নিজের হাসি চাপানোর চেষ্টা করে বলল, “আমার সাথে আসো।”
অর্ণবকে সাথে আসতে দেখে সৈকত বলল, “আমরা বিয়ে বাড়িতে খেতে যাচ্ছি না যে দল সহ আসতে হবে। ঝিনুক তুমি আসো। আর অঞ্জলি —”

অঞ্জলি সামনে এসে আমতা-আমতা করে বলল, “জ্বি—জ্বি— ছোট স্যার।”

“আমাদের সাথে আসো।”

অঞ্জলি একপলক সাবেক আর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সৈকতের পিছনে চললো। অর্ণব রাগান্বিত স্বরে বলল, “আমার ওকে দেখলে মন চায় একদম খুন করে ফেলি। বুঝেটা কি নিজেকে?”

সাবেক অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আগে আমার পেটের ইন্দুরগোরে খুন হতে দেয় ভাই। এইবার তো ক্যান্টিনে চল।”
সাবেক শেষমেশ টেনেই অর্ণবকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল।

রুম নং ৩০২ এর সামনে এসে দাঁড়ালো সৈকত। ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, “এইটা তো ক্লাস। প্রিন্সিপাল স্যারের রুম মনে হচ্ছে না।”

“হ্যাঁ, যেয়ে ক্লাসে বসো। ক্লাস কর।”

“কিন্তু তুমি বলেছিলে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবে।”

সৈকত একটু চিন্তা করে বলল, “তাই আমার তো মনে নেই।”

ঝিনুক বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার কী আমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে না’কি? সময়ে কাজ না হলে আমার এডমিশন হবে না। মানে একবছর লস যাবে। ধ্যুর ভালো লাগে না।”

ঝিনুক যেতে নিলেই সৈকত তার হাত ধরে ফেলল। ঝিনুক পিছনে তাকাতেই সৈকত বলল, “সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। একটা ছেলে আসবে তুমি শুধু সেইখানে নিজের স্বাক্ষর দিবে।”
ঝিনুক তাকালো তার হাতের দিকে। আরেক পলক সৈকতের দিকে। মুহূর্তে তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল। তার হাত সৈকতের হাত থেকে ছাড়িয়ে নামা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বছর আগে এইভাবেই হাতটা ধরেছিল সে। কিছু বছর আগে—-

‘রুহানির বিয়েতে ভালোই মজা করছিলো সব বান্ধবীরা মিলে। ঝিনুক সহ তার বান্ধবীরা মিলে প্রথমে ‘ডোলারে’ গালে নাচ প্রদর্শন করেছিলো এরপর ঝিনুক একা ‘মান মোহিনি’ গানে নাচ প্রদর্শন করছিল। নাচ শেষে স্টেজ থেকে নামার পর ভারী তৃষ্ণা লাগে তার। কোল্ড ড্রিংক নিতে যাওয়ার সময় কেউ তার হাত ধরে ফেলল। পিছনে তাকিয়েই দেখে সৈকত। সে বলল, “অনেক ভালো নাচতে পার।”

“এই কথাটা আপনি হাত না ধরেও বলরে পারতেন। কোনো অচেনা মেয়ের হাত ধরাটা ভদ্রতা নয়।”

“আমি তো বলি নি আমি ভদ্র।”

“রাইট। ছ্যাঁচড়ামি করলে ভদ্র বলাও যায় না।”

সৈকত বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল, “ইশশ তোমার কথাটা ছুড়ির মতো বুকে গেঁথে গেল।”

ঝিনুক কথার উওর না দিয়েই এগোতে শুরু করল। সৈকত আবারও বলল, “তুমি কিন্তু আমার কাছে অচেনা না।”

ঝিনুক থামলো। প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো সৈকতের দিকে। সৈকত বলল, “আমি তোমার প্রভা আপুর স্বামীর ছোট ভাইয়ের মতো। প্রভা আপুর বিয়ে থেকে শুরু করে তিন বছর আগ পর্যন্ত প্রতি বছর ঈদে তোমাদের বাসায় যেতাম।”

ঝিনুক বলল, “প্রভা আপুকে চিনেন আপনি?”

“অফকোর্স। বিনু তোমাকে অনেক মিস করে সেটাও বলতে পারি।”

ঝিনুক একটু অস্বস্তি নিয়ে হাসলো। তারপর বলল, “মাফ করবেন আমি চিনতে পারি নি আগে।”

“ইট’স ওকে। তোমার নাম্বার পেতে পারি?”

“কেন?”

“এমনি তোমার সমস্যা না হলে কথা বলতাম।”

ঝিনুক ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “প্রয়োজন ছাড়া কথা বলার প্রয়োজন কী? আমার এমনিতেও ফোন নেই।”

“বাসার কোনো নাম্বার নেই?”

“আছে তবে আমি দিতে পারব না। খালু জানলে আমাকে মেরে ফেলবে।”

সৈকত হেসে বলল, “এত ভীতু তুমি!”

ঝিনুক চোখ দুটো ছোট করে বলল, “আপনার এতোই সাহস থাকলে বাসায় এসে আমার খালুর থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে যেয়েন।”

“চ্যালেঞ্জ করছ?”

“ধরে নিতে সমস্যা কোথায়?”

“চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড।”

ঝিনুক মুচকি হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।’

ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে দেখে সৈকত অঞ্জলিকে বলছে, “তুমি একটু কষ্ট করে ওর খেয়াল রেখ। ওর উপরের তালায় কিছু নেই তো। একা কী না কী করে বেড়ায় কে জানে।”

অঞ্জলি মাথা নামিয়ে বলল, “জ্বি স্যার।”

“আমি তোমার কোনো স্যার না। রহমতুল্লাহ আংকেল কাজ করে আমাদের কারখানায়। তুমি না। আর করলেও আমার জন্য কাজ কর না। ভাইয়া ডাকবে আর মাথা ঝুঁকিয়ে রাখার কিছু নেই।”

অঞ্জলি মাথা উঠিয়ে একটি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। তারপর মৃদু হেসে বলল, “ঠিকাছে ভাইয়া।”

“আর হ্যাঁ, ও একটু সরি অনেকটা বিরক্তিকর প্লাস আজব এক এলিয়েন, মাঝে মধ্যে ভূত পেত্নীর মতোও কাজ করে নিও। তাই একটু সহ্য কর।”
অঞ্জলি শব্দ করে হেসে দিলো সৈকতের কথা শুনে।

ঝিনুক বলল, “তুমি এলিয়েন। ভূত, পেত্না। সরি সরি তারাও এই কথা শুনলে কষ্ট পাবে। যাচ্ছ কই শুনে যাও—এই—-”
সৈকত ঝিনুকের কথায় পাত্তা না দিয়েই চলে গেল। ঝিনুক রাগে ফোঁপাতে লাগলো। অঞ্জলি বলল, “আমি যেমন শুনেছিলাম আমার কাছে উনাকে তেমন মনে হলো না।”

ঝিনুক অঞ্জলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন শুনেছিলে?”

“অহংকারী ধরনের, অনেক গুন্ডামী করে আর—” কথার মাঝেই চুপ হয়ে গেল সে। আড়চোখে ঝিনুকের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকাল। ঝিনুক তার কথা সম্পূর্ণ করল, “আর প্লে বয়।”

অঞ্জলি মাথা নাড়ালো। সাবেক বলেছিল অনার্স ফাস্ট ইয়ারে উনি একই সাথে চারটা মেয়ের সাথে রিলেশন করেন। আর চারজনই বান্ধবী ছিলো। আর সেকেন্ড ইয়ারে একটা মেয়ের সাথে করে যাকে অর্ণব ভাইয়া পছন্দ করতেন কিন্তু রিলেশনের এক বছর পর হঠাৎ করে মেয়েটা বিদেশে চলে যায়। এমন শোনা গেছিল মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিলো, এবরশন করিয়েছে না’কি কে জানে? এছাড়াও অনেক কথা শুনা গেছে৷ ভার্সিটির বাহিরে না’কি কয়েকজন ছিলো।”

কথাগুলো অনেকটা ঝিনুকের জানা ছিলো কিন্তু কেন যেন তার মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড কেউ জোরে চেপে ধরেছে। এত জোরে যে ব্যাথায় তার কান্না আসছে। কাঁদবে না কাঁদবে না বলে তার পলক জলে ভিজে গেল। অঞ্জলি তার হাত ধরে বলল, “সরি আমার এইসব বলাটা ঠিক হয় নি।”

ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “না বলে ভালো করেছ। আমি গলে পড়ার আগেই আমাকে নিজেকে শক্ত রাখার আরেক কারণ দিয়ে দিয়েছ।”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

ঝিনুক অঞ্জলির হাতের উপর হাত রেখে বলল, “কিছু না। একটা প্রমিজ কর, কাউকে আমার ও সৈকতের বিয়ের কথা কিছু বলো না। কারণটা আমি তোমাকে পরে বলব।”

অঞ্জলি হেসে বলল, “ঠিকাছে।”

ঝিনুকের ফোন বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে প্রভার ফোন। ঝিনুক বলল, “একটু দাঁড়াও আমি আপির সাথে কথা বলে আসি।”

ঝিনুক একপাশে যেয়ে ফোনটা ধরলো। বলল, “আপি বলো।”

“দাদিমা বলল তুই না’কি ভার্সিটিতে গিয়েছিস।”

“হ্যাঁ আপি।”

“তোর কন্ঠ এমন লাগছে কেন? তুই ঠিকাছিস তো?”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ আপি, ঠিকাছি। শুধু কলেজের সব বান্ধবীর কথা মনে পড়ছিল। এত বছর সাথে থেকে আজ হঠাৎ আলাদা হয়ে গেলাম।”

“এটাই জীবন ময়না। কোনো কিছুই সারা জীবনের জন্য থাকে না।”

“মানুষ জীবন থেকে চলে যায়। সাথে তাদের দেওয়া সুখও কুড়িয়ে নিয়ে যায়।”

ঝিনুক মনে মনে বলল, “আমার জীবনের একমাত্র সুখের অধ্যায় তো তুমি ছিলে সৈকত। এত জলদি আমি সে অধ্যায়টা শেষ করে দিয়ে চলে যাবে আমি কখনো বুঝতে পারি নি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঝিনুক। প্রভা জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর বন্ধু-বান্ধব বানাতে সময় লাগে না’কি?”

“আপু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“অনুমতি লাগে না’কি কর।”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “সুখের সময়সীমা এত কম আর দুঃখের এত বেশি কেন?”

“কারণ সুখ জীবনের মিথ্যে আশা ও দুঃখ কটু সত্য।”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here