মন ময়ূরী পর্ব -১২

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

১২.

অবশেষে, আমার বিদায়ীক্ষণ চলে এলো।মা,দাদি, বাবাকে ছেড়ে যাবো, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার তেমন কোনো কষ্ট নেই। কারণ, মাত্র দু’দিনের জন্যই তো যাচ্ছি ওই বাড়িতে।

কিন্তু, মা আর দাদির কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম।বাবা এসে আমার হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো বাইরের দিকে। যেতেই যেতেই বাবা নীচুস্বরে আমাকে বলতে থাকে ,

-খেয়া,তুই আমার সবচেয়ে আদরের মেয়ে।ছোটবেলা থেকে তোর যেটা পছন্দ হয়েছে আমি সেটা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি তোকে দেয়ার। কিন্তু, তোর জীবনের সবচেয়ে দামী মানুষ পছন্দ করার সময় আমি ব্যর্থ শুধুমাত্র তোর পছন্দ হয়নি বলে।কিন্তু, আমার মান বাঁচাতে গিয়ে তুই তোর সবচেয়ে অপছন্দের মানুষকে নিয়ে আজীবন একসাথে থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। মা’রে মাঝে মাঝে আমাদের শত অপছন্দ থাকা সত্বেও আমরা অপছন্দের জিনিসগুলোকে যত্ন করি,কারণ দায়বদ্ধতা। দায়বদ্ধতা পালন করতে গিয়ে হয় আমাদের সেই জিনিসটা হয়ে ওঠে অনেক পছন্দের আর যদি পছন্দ না হয় তো সেই অপছন্দের জিনিসকে আমরা ছুড়ে ফেলে দেই আমাদের জীবন থেকে বহু ক্রোশ দূরে।
তুই বুঝতে পেরেছিস আমি কি বলতে চাইছি?

আমি বাবার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি আর বুঝতে পেরেছি বাবা আমাকে কি বলতে চাইছে।

বাবা,আমাকে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে বসিয়ে দিলেন, আমি গাড়িতে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, বাবা আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে উপুড় হয়ে কপালে চুমু দিয়ে গাড়ির পাশ থেকে সরে গেলেন।আমি জানি বাবা কারো সামনে কাঁদবে না, কেউ না থাকলে বাবা খুব কাঁদবে।

অবশেষে,গাড়ি রওনা হলো চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য। পাশে আমার চুপচাপ বসে আছে ফায়েজ আর সামনে ফাহিম, ড্রাইভিং সিটে জব্বার।

এতক্ষণ জমিয়ে রাখা চোখের পানি গুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো আমার চোখজোড়া দিয়ে।

রাতের আঁধারে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঠিকরে খেয়ার মুখশ্রীতে পড়ছে। ওর গালে চিকচিক করা পানিগুলো দেখে ফায়েজ বুঝতে পারছে, “পরিবারকে পিছনে ফেলে এসে নতুন সংসারে ধাবিত হওয়া মেয়েরা বড্ড সাহসী হয়,ছেলেদের থেকেও বেশি। কারণ, পুরোনো সম্পর্ক ফেলে নতুন সম্পর্ককে তারা সাদরে গ্রহণ করতে পারে খুব সহজে। যা কখনোই ছেলেরা পারবে না “।

চৌধুরী বাড়িতে একে একে প্রবেশ করছে বরযাত্রী বাহী কারগুলো।গাড়ি থামতেই খেয়া ট্যিসু দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিকভাবে বসে থাকে।

বর কনের গাড়ির সামনে ভীর জমিয়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা। ফায়েজ ধীরপায়ে কার থেকে নেমে উল্টো পাশে ঘুরে গিয়ে কারের ডোর খুলে খেয়ার সামনে হাত বাড়িয়ে দিলো।খেয়া ফায়েজের হাতের দিকে তাকিয়ে ডানহাত বাড়িয়ে ফায়েজের হাতের উপর হাত রাখলো।খেয়া ফায়েজের হাতের উপর হাত রেখে কার থেকে নেমে দাঁড়ালো।মূহুর্তে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ক্লিক ক্লিক শব্দে মুখরিত চারপাশ।

লাল গালিচার উপর দিয়ে ফায়েজ খেয়ার হাত ধরে ধীরপায়ে হেটে যাচ্ছে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক-যুবতীরা ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে নব বর কনেকে বরণ করার জন্য ।

দরজার সামনে এলেই ফায়েজের মা বরণ করে নেয় নিজের ছেলে এবং পুত্রবধুকে।

-ভাই, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এবার ভাবিকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করো।

ফাহিমের কথায় ফায়েজের সকল কাজিনরা হৈ হৈ করে উঠলো।খেয়া ফাহিমের কথা শুনে আড়চোখে ফায়েজের দিকে তাকালো, দেখলো ফায়েজ ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাহিমের দিকে।

খেয়া কি মনে করে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু মূহুর্তের মধ্যে ও শূন্য ভেসে উঠলো। ভয় পেয়ে মুখ দিয়ে আর্তনাদ বের করার আগে সকলের উচ্ছাসিত কন্ঠ পেয়ে খেয়ার গলার ভিতর আওয়াজ রয়ে গেলো।

খেয়া মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখতে পায়, ফায়েজের মুখ। ফায়েজের মুখের দিকে তাকিয়ে খেয়া কি যেন ভাবছে!ঠিক তখনি ফায়েজ মুখ ঘুরিয়ে খেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে নিচুকন্ঠে বলে,

-নববধূকে তার স্বামী কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করবে এটাই আমাদের বাড়ির রীতি বলতে পারো। আমাদের মাঝে যা কিছু থাকুক অন্তত বাড়ির লোকদের বুঝতে না দেয়াই ভালো, তাই এরকমটা করতে বাধ্য হয়েছি। তুমি বুঝতে পারছো?

খেয়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।ফায়েজ ড্রইংরুমে এসে ধীরে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।খেয়া দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে।

কোত্থেকে, একটি নারী এসে ফায়েজ আর খেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তের মাঝে আনন্দিত খুশি গলায় বলে,

-মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ।ফায়েজের মা তুমি দেখি পরির মতো বৌ এনেছো আমাদের ফায়েজের জন্য।সেই জন্যই তো বলি, ছেলে আমাদের নায়িকা বিয়ে না করে সাধারণ মেয়ে বিয়ে করার জন্য রাজি হলো কি করে!

ফায়েজের মা হেঁসে নিজের জা’য়ের উদ্দেশ্য বলেন,

-হ্যা, ভাবি আপনাদের দোয়ায় খেয়ার মতো মেয়েকে আমার ছেলের বৌ হিসেবে পেয়েছি।

-থাক এই ব্যাপারে পরে কথা বলবো রেহনুমা। এখন ছেলে আর বৌকে কিছু খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দাও। বাবা’রে যে পরিমাণ ক্যামেরার সামনে আজ ওরা দুজন দাঁড়িয়ে ছিল তাতে যে কোনো মানুষ হাঁপিয়ে উঠবে।

-জি, ভাবি। ব্যবস্থা করছি আমি।

আকাশে ঘনঘটা কালো রাত্রীতে পুরো পৃথিবী আঁধার হয়ে আছে। রাতের পৃথিবীর কালো রঙের মতো আজ রওশানের জীবনও কালো হয়ে গিয়েছে খেয়াকে অন্যকারো সাথে হাসিমুখে দেখে।রওশান খুব করে চাচ্ছে,স্বাভাবিক থাকতে কিন্তু পারছে না, ইচ্ছা থাকলেই কি সব হয়!

এই যে সোশাল মিডিয়ার একের পর এক ছবি আপলোড হচ্ছে ফায়েজ আর খেয়ার বিয়ের । সাদা আর সোনালী সুতার কারুকাজ মন্ডিত শেরওয়ানী, পাগড়ি মাথায় দেয়া ফায়েজের হাসিমুখ বলে দিচ্ছে সে আজ কত সুখী!পাশাপাশি দাঁড়ানো খেয়াকে কি কম সুন্দর লাগছে! আজ গোলাপী শাড়ি আর মাথায় সাদা ভারি কারুকাজের ওড়নায়।
দুজনের সাদা আর গোলাপী ড্রেস কম্বিনেশন বলে দিচ্ছে তারা একে অপরের রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে নিজেদের।

ফায়েজ আর খেয়ার আগামী জীবনকে ঘিরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের অজস্র শুভেচ্ছা বার্তা। এসব দেখে রওশানের দুচোখ ভিজে উঠছে বারবার।

কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই চোখ মুছে পিছু ফিরে তাকালো, রওশানের মা এসেছে।রওশান তার মা’কে দেখে ছোট্ট শিশুর মতো জরিয়ে ধরে বড়ো গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-“মা,কাউকে না একতরফা ভালোবাসতে নেই। একতরফা ভালোবাসার বোধহয় নিজস্ব একটি নিয়ম আছে।যাকে একবার এই একতরফা ভালোবাসা আঁকড়ে ধরবে তাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই যন্ত্রণার ভারে নুইয়ে পড়তে হবে।

রওশানের মা ছেলের যন্ত্রণার ক্ষতে কি বলে প্রলেপ লাগাবেন তিনি জানেন না। শুধু মনে মনে বিধিতার কাছে একটাই আর্জি করছে,

-মাবুদ গো, আমার ছেলের হৃদয় থেকে তুমি খেয়ার প্রতি জন্মানো ভালোবাসা বিলিন করে দাও।এমন কাউকে এনে দাও যার ভালোবাসার পরশে আমার ছেলেটা ঠিক আগের মতো প্রাণবন্ত হয় যাবে।

একতরফা ভালোবাসা এমন কেন? এইজন্যই বুঝি গুনীজনরা বলে গেছেন,

“একতরফা ভালোবাসাগুলো যাকে ছোঁবে তাকে এমনভাবে ভিখিরি করে দিয়ে যাবে,যার অভাব একজন্মে কেন সাতজন্মেও ঘুচবে না।”

খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই খেয়াকে নিয়ে আসা হয়েছে ফায়েজের ঘরে।খেয়া অবশ্য কিছুই খায়নি একগ্লাস জুস ছাড়া।

খেয়াকে ফায়েজের ঘরে নিয়ে এসেছে ফায়েজের চাচাতো বোন নিশিতা আর নিশিতার ভাবি অনামিকা নিয়ে এসেছে।খেয়াকে বসিয়ে দিলো গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সাজানো পালঙ্কে।

এমনসময় ফায়েজের মা এসে অনামিকার হাতে একটি শাড়ির প্যাকেট দিয়ে বলে যায় ওরা যেন খেয়ার পোশাক আর সাজ বদলে দিয়ে এই শাড়িটি পরিয়ে দেয়।

অনামিকা আর নিশিতা সায় জানিয়ে দেয়। ফায়েজের মা চলে যেতেই অনামিকা খেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-খেয়া,এই যে ওয়াশরুম দেখছো?ওখানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে, শাড়িটা চেঞ্জ করে এসো।তুমি জানো তো কীভাবে শাড়ি পড়তে হয় ?

-হু জানি।

খেয়া খুবই ধীর কন্ঠে অনামিকার প্রশ্নের জবাব দিলো। অনামিকা নিশিতাকে চলে যেতে বললো। নিশিতা চলে যেতেই অনামিকা এসে খেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-ভয় পাবার কিছু নেই। ফায়েজ অনেক ভালো একটা ছেলে। তোমাদের একে-অপরের সম্পর্কে জেনে-বুঝে নেয়ার দিন আজ থেকে শুরু। আজ জানতে শুরু করবে, জানতে জানতে একদিন দেখবে তার চেয়ে তুমি ওকে বেশি চিনতে পারবে।চলি আমি, বেস্ট অফ লাক।

অনামিকা চলে যেতেই খেয়া উঠে দরজা লাগিয়ে দিলো।এরপর,শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শাড়ি পড়ে নিলো খেয়া।লাল রঙের সুতির শাড়ি, বেশ সুন্দর বিশেষ করে আঁচলের অংশটা।

ভেজা চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো খেয়া।নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখে,ঘরে দরজা খুলে দিয়ে পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়লো।খেয়ার এখন ঘুমের প্রয়োজন নায়ক সাহেব আরও পরে আসুক, তারজন্য বসে বসে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না! তাদের তো আর ভালোবাসা -পছন্দের বিয়ে নয় যে, ও তেরো হাত ঘোমটা দিয়ে ফায়েজের জন্য এক বালতি লজ্জা নিয়ে বসতে থাকবে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here