#মম_চিত্তে
#পর্ব_২+৩
#সাহেদা_আক্তার
রাতের খাবারটা শেষ করে মাত্র আপেলের জুসটা নিয়ে বসেছে রুমে, সাথে সাথে কাজিনগুলো এসে জেঁকে বসেছে। সবগুলো চোখ গোল গোল করে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বেফাঁস কথা সাথে সাথে পৌঁছে গেছে রিয়ানের তথাকথিত বান্দরগুলোর কাছে। ছোট থেকে বুড়ো কাউকে বাদ দেয়নি। সবাইকে রিয়ানের রুমে জড়ো করেছে। মেয়েটা দেখতে কেমন, নাম কি, কোথায় থাকে প্রশ্নগুলো একেকজন এক এক দিকে ছুড়ে দিচ্ছে আর আরেকজন ক্যাচ ধরছে। রিয়ান শান্তি মতো জুসটাও খেতে পারছে না। মেজাজ খারাপ করে বার বার মিনহাজের দিকে তাকাচ্ছে আর বেক্কলটা এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলাচ্ছে। রিয়ানের দাদু এসে বললেন, দাদুভাই মেয়েটাকে বাড়ি আনিস তো। দেখবো কেমন।
– অচেনা একটা মেয়েকে নিয়ে কি শুরু করলে তোমরা?
ওর বোন রিতু কোমড়ে দুই হাত রেখে বলল, কে অচেনা শুনি? মিনু ভাই যে বলল। রিয়ান আরেকবার মিনহাজের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি বলেছে? কোটটা তো? বেশি দয়া দেখাতে গিয়ে এক অসহায়কে দান করে এসেছি। এবার যাও সবাই। অনিমা হেসে বলল, আগে বলো কে অনি আর কে নীলি তাহলে সবাই চলে যাবো। এবার রিয়ানের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
অনিমা আর নীলিমা দুইজনে ওর জমজ চাচাতো বোন। আইডেন্টিক্যাল টুইনস। হঠাৎ করে দেখলে কেউ চিনতে পারে না। আর এই ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করে দুইজনেই। সব সময় একই রকমে সেজে থাকে আর সবাইকে ভড়কে দেওয়ার জন্য এই প্রশ্নটা সব সময় ঠোঁটের আগায় থাকে। রিয়ান কখনো সঠিকভাবে ওদের চিনতে পেরেছে বলে মনে পড়ে না। তাই এখনো যে পারবে না তা বেশ ভালো করেই জানে৷ রিয়ান অসহায় ভঙ্গিতে ছোট চাচি কনকের দিকে তাকালো। কনক চাচিও ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কিছু করার নেই। উত্তর না দেয়া পর্যন্ত দুই বোন এক চুলও নড়বে না রুম থেকে। ও অসহায়ের মতো ওর বাবাকে খুঁজতে লাগল। এই বাড়িতে রিয়ানের বাবা রাকিব হাসানকেই সবাই একটু ভয় করে চলে। আর বাকি সবাই এক একজন রসিক প্রাণী।
বড় চাচা রাশেদ হাসান এখন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত খিলাচ্ছেন আর ওর উত্তরের অপেক্ষায় আছেন। ছোট চাচা রবিন হাসান চশমার ফাঁকে ওর দিকে গোয়েন্দা দৃষ্টি দিচ্ছে পাছে ওর কোন মুখোভঙ্গী মিস করে যান! বড় চাচি নাহার দাদি রওশন আরার পাশে ওর বিছানার উপর বসে আছেন। দাদির পানের কৌটা সাথে করে নিয়ে এসেছেন রুমে এবং এই মুহূর্তে পান তৈরীর পাশাপাশি কানটা পেতে রেখেছেন ওর দিকে। রিয়ানের মা ফেরদৌসীকে আপাতত দেখা যাচ্ছে না। নিচে রান্নাঘরে হয়ত গোছগাছ করছেন ফুলির সাথে। আর বাকি আন্ডাবাচ্চাগুলো? রিতু ওর নিজ বোন। অনিমা আর নীলিমা কনক চাচির জমজ মেয়ে। নাহার চাচির তিন ছেলেমেয়ে। মিনহাজ, নিক্বণ আর আদ্রিতা। মিনহাজ তো ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। আদ্রিতা এখন বাড়ি নেই। দেশের বাইরে জামাইকে নিয়ে থাকে। আর নিক্কণ একজন কার্ডিওলজিস্ট যে এ মুহূর্তে তার হাই পাওয়ারি চশমা ঠেলে চোখের আরো কাছে এনে রিয়ানের দিকে সামান্য ঝুঁকে বলল, তোমার হার্টবিট মনে হচ্ছে বেড়ে গেছে ভাই। মেয়েটাকে তো তাহলে খুঁজে বের করতে হচ্ছে।
রিয়ানের মেজাজটা খারাপ হচ্ছে। মিনহাজের পাঁচ বছরের ছেলে নাবিল ওর কাছে এসে বলল, চাচু, ভাউ। নীলিমা নাবিলকে শুধরে দিয়ে বলল, ভাউ কি রে হাদা? বউ বল বউ। নাবিল কি বুঝে বলল, আপিপি, চাচু, ভাউ। রিয়ান ওকে কোলে নিয়ে বলল, ছোট ছেলেটাকেও ছাড়ো না। কি যে শুরু করেছো তোমরা! শান্তি মতো কাজ করতে পারি না। আমি তুলি ভাবির কাছে ওকে দিয়ে আসছি। দরজার কাছে আসতেই দুই বোন এসে পথ রোধ করে বলল, আগে বলো কে অনি কে নীলি। রিয়ান অনিমাকে নীলি আর নীলিমাকে অনি বলে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আসার সময় শুনলো দুই বোন খ্যাক খ্যাক করে হাসছে আর বলছে, পারেনি, পারেনি। রিয়ান মিনহাজের রুমের দিকে এগোলো। নাবিলকে দিয়ে করিডোর ধরে সোজা খোলা বারান্দায় গিয়ে বসবে। এখন আর রুমে গিয়ে লাভ নেই। সবাই ওখানে নির্ঘাত গল্প জুড়ে বসবে। গেলে চেপে ধরবে মেয়েটার কথা জানতে।
তুলি ভাবি বিছানা ঠিক করছিল। রিয়ানকে দেখে বলল, ওকে এনেছো ভাই!? অনি নীলি বেচারাকে কি বলে যেন নিয়ে গেল। ঘুমে ভেঙে পড়ছে ছেলেটা। রিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেলেছে এর মধ্যে। তুলি ভাবি ওর কোল থেকে নিয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়। চাদরটা ওর গায়ে টেনে দিতে দিতে বলল, মেয়েটাকে চিনতে?
– ভাবি তুমি অন্তত ওদের মতো শুরু কোরো না।
ভাবি মুচকি হেসে বলল, আচ্ছা করবো না। যেভাবে সবাই তোমার রুমে জড়ো হয়েছে। এই ভূত সহজে নামছে না কারো মাথা থেকে। দেখো। রিয়ানও ভালো করে জানে এটা। তাই সোজা রুম থেকে বেরিয়ে খোলা বারান্দার টি-টেবিলটায় বসলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। বারান্দার উপরে ছাদ থাকায় বৃষ্টি বেশি ভেতরে ঢুকতে পারছে না। বারান্দার কিনারায় থাকা গাছগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেটা দেখে দুলটার কথা মনে পড়ল। সেটা থেকে টুপ টুপ করে পড়া পানির কথা মাথা থেকে সরছে না৷ ব্যাপারটা বেশ সুন্দর। গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার মতো। রিয়ান আপন মনে হেসে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
ভোর ছয়টায় এলার্মে ঘুমটা ভাঙল। রিয়ান এলার্মটা অফ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘুম আসছে হালকা এখনো। ঘাড়টাও ব্যাথা করছে। কালকে বারান্দার টেবিলটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটার সময় রিতু ডেকে বলেছে রুমে গিয়ে শুতে। এসেই পোশাক বদলে সোজা বিছানায় ঘুম। এক ভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে শরীর কেমন যেন আটকে আছে। নাইট ড্রেস বদলে জগিং স্যুট পরে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। কাছেই একটা বড়ো দীঘি আছে যার পাশে জগিং করার মতো রাস্তা আছে। দুই কানে ইয়ার ফোন গুজে দিয়ে এক ঘন্টা জগিং করে এল।
বাড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে এসে দেখল অনিমা আর নীলিমা নাস্তার টেবিলে বসে। চাচারা সোফায় বসে কাগজ দেখছে। নাস্তা টেবিলে আসলেই চলে আসবে। নিক্কণ নাবিলকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে আর সে তখন থেকে তুলি ভাবির কোলে যাওয়ার জন্য কেঁদে চলেছে। এদিকে চাচিরা আর তুলি ভাবি নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। ফুলিটা পাশে হাত লাগিয়ে কাজ করছে। রিতু কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই রিয়ান চাটি মেরে বলল, ওদের দুইজনকে দেখে শেখ। সাড়ে সাতটার আগেই স্কুল ড্রেস পরে তৈরী হয়ে নাস্তার টেবিলে। আর তুই এতক্ষণে এলি। রিতু মাথা ঢলতে ঢলতে বলল, তাই বলে এই সকালে মাথায় মারবে? জানো মাথায় কি থাকে?
– কি থাকবে? মগজই তো। যেটা তোর নেই। গোবর ভরা। বায়োলজিগিরি ফলাতে আসিস না। অন্তত কমনসেন্স আছে আমার। যা আমাকে এক গ্লাস পানি দে। ঘেমে গেছি একেবারে।
রিতু ভেংচি কেটে নীলিমার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। রিয়ানের কথায় পাত্তাও দিলো না। কি করে যে এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা ওর বোন বুঝে পায় না। বড় হয়ে নাকি নিক্কণের মতো ডাক্তার হবে। তাই সায়েন্স গ্রুপ নিয়ে পড়ছে। ডাক্তার হয়ে যে কষাই হবে না এটার গ্যারান্টি সে দিতে পারছে না। রিয়ান কথা না বাড়িয়ে পোশাক বদলাতে চলে গেল।
আটটার সময় সবাই নাস্তার টেবিলে বসে পড়ল। রাকিব হাসান গম্ভীরমুখে বসে আছেন৷ পাশেই দুই ভাই। দাদি বসেছেন অপরপাশে। দাদির পাশে নাতি নাতনীরা বসে। ভাবি আর চাচিরা নাস্তা বেড়ে দিচ্ছেন। রিয়ান এসে বসল মিনহাজের পাশে৷
.
.
.
.
আজ আর এলার্ম দেয়নি ঘড়িতে। অনেকদিন তো নিয়ম করে ওঠা হলো সংসারের দায়িত্ব পালনের জন্য। আজ মুক্ত পাখি হয়ে নিয়মটা মানতে মন চাইলো না। রায়হান সাহেবের ডাকে মম বিছানায় উঠে বসল। কিন্তু পুরোনো নিয়মেই ঘুমটা আরো আগে ভেঙে গেছে৷ চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। বৃষ্টিটা থেমেছে। রাতে ঘুমানোর আগেও বৃষ্টির শব্দ কানে আসছিল।
মমর বিড়াল নিনিটাও বেলা অবধি ঘুমায়। অলসের হাঁড়ি একটা। মমর মতোই নিনির ঠোঁটের কাছে একটা তিল আছে। সেটা দেখেই এক বছর আগে এই আলসেটাকে পছন্দ করে এনেছিল মম। শ্বশুর বাড়ির কেউ বিড়াল পছন্দ করতো না দেখে রায়হান সাহেবের কাছে রেখে গিয়েছিল। এতদিন পর আসায় এখন ওর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাল রাতেও যখন জানালার পাশে ছিল তখন পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এখনো ওর গা ঘেষে চিৎ হয়ে শুয়ে মিঁও মিঁও করছে। মম মাথাটায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেই আরামে গরগর শব্দ করতে লাগল।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল মাধুরী খালা নাস্তা তৈরী করে ফেলেছেন৷ তার স্বামী জাবেদ খালু দারোয়ানের কাজ করেন। তারা মমর অনেক ছোটবেলা থেকেই আছেন। তাদের মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। এখন রায়হান সাহেবের সাথে থাকেন আর দেখাশোনা করেন।
নাস্তা দিতে দিতে মাধুরী খালা বললেন, আফামনি, সাহেবরে একটু বোঝাও। আমগো কতা তো হুনতে চায় না। মম রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, কি হয়েছে?
– আহ্, মেয়েটা আসতে না আসতেই শুরু করলে?
– কি বল তো মধু খালা। বাবা কি ঠিকমতো ওষুধ খায়?
– নাগো খালা। সেই কতাই তো কইতে লাগসিলাম। তুমি আইবার দিনও পেশার উইঠা শুয়ে আছিল কতক্ষণ। তোমার খালু মাইপা দেখে ১৬০।
– সে কি! আব্বু, তুমি ওষুধ খাওনি?
– ঐ একটু ভুলে গিয়েছিলাম ঐদিন। মধু সব কথা বলতে হয়?
– বলেছে বেশ করেছে। কেন খাওনি?
– ওষুধটা শেষ হয়ে গিয়েছিলাম তাই আর কি।
– তো জাবেদ খালুকে বল নি কেন? ওকে, আমি আনবো।
মম খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে উঠে গেল। রায়হান সাহেব ওকে বাঁধা দিয়ে বললেন, এখন ওষুধের জন্য বের হবি? ও নাস্তার প্লেট গোছাতে গোছাতে বলল, আমি এমনিই বের হতাম। ফোনটটা কালকে পড়ে ভেঙে গেছে। পানিও ঢুকেছে। ওপেন হয়নি৷ একটা কিনতে হবে৷ আসার সময় ওষুধ নিয়ে আসবো। রায়হান সাহেব বললেন, আমার স্কুটিটা নিয়ে যা। ও আপত্তি জানিয়ে বলল, তাহলে তুমি অফিস যাবে কি দিয়ে? আমি তো চলেই আসব। মম চট করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
চলবে…
#মম_চিত্তে
#পর্ব_৩
#সাহেদা_আক্তার
কালকে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে চারপাশ। কি ভেবে আজকেই সাদা সেলোয়ারটা পড়তে গেল! হয়ত ডিভোর্সের পর নিজেকে বিধবা বিধবা লাগছে। তাই মন চাইলো এটা পরতে। হাতের ঘড়িটার রঙ উঠে গেছে। কিনেছে অনেক দিন হলো। চট করে কখন বন্ধ হয়ে যায় দরকারের সময়। এখনকার দিনে তো ফোনেই সময় দেখার কাজ চলে। কিন্তু মমর ঘড়ি না হলে ভালো লাগে না। তাতেই সময় দেখতে ভালো লাগে।অনেকটা যার যে কাজ তাকে সে কাজেই মানায় এমন।একটা কেনা লাগবে। আগে ফোন কেনাটা স্থির করলো। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ডিভোর্সের আগে ভাইভা দিয়ে এসেছিল অনেক লুকোচুরি করে। টের পেলে যাওয়ার সুযোগ দিতো না। যদি কপালে থাকে তবে সেখান থেকে ম্যাসেজ আসতেও পারে। অবশ্য চারদিন হয়ে গেছে। এখনো ডাক আসেনি। তাও আশা। বলে না আশায় বাঁচে চাষা। স্যামসাংয়ের একটা দোকানে গিয়ে পছন্দমতো ফোন, প্রটেক্টর গ্লাস, কভার সব কিনে সিম ঢুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ফোনটা ওপেন হতে কিছু সময় নিল। নেট কিনে ডাটা খুলতেই হাজারটা ম্যাসেজ জমা হল। স্বাভাবিক; কাল যে মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে। সমবেদনার ঢল বইছে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইনস্টাগ্রাম সব জায়গায়। যাদের বিয়ের পর একদিনের জন্যও খবর নিতে দেখেনি তারাও কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে৷ খারাপ খবর কেন বাতাসের আগে ছড়ায় সেটা এখনো বুঝতে পারে না মম। ও ডাটা অফ করে দিল। ম্যাসেজের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। রিকশায় বসে বাসার দিকে রওনা দিতে দিতে ফোন ম্যাসেজে ঢুকল। একগাদা ফোন কোম্পানির ম্যাসেজ। অল্প দিনের জন্য গাদা গাদা টাকা দিয়ে অফার কেনার ইচ্ছে নেই আপাতত৷ মমর ইচ্ছে করছে সব একসাথে ডিলেট দেয়। নিচে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটা ম্যাসেজে নজর পড়ল। সাথে সাথে রিকশাওয়ালাকে বলল, চাচা, রিকশা ঘুরান। মম উল্টা পথ ধরল। এখন সাড়ে আটটা বাজে। নয়টায় পৌঁছাতে হবে অফিসে। আজ ওর চাকরির প্রথম দিন।
মম সোয়া নয়টায় এসে পৌঁছালো। ও আসতে আসতে ছোটখাটো সমবর্ধনা শেষে সবাই নিজের কাজে জয়েন হয়ে গেছে। গেটে ঢুকতে গিয়ে দারোয়ানের বাঁধার মুখে পড়ল। অপরিচিত কাউকে সে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। মম বলল, দেখুন আজ আমি নতুন জয়েন হয়েছি।
– কাগজ দেখান।
মম তো কোনো কাগজ আনেনি। ম্যাসেজে উল্লেখ ছিল কিন্তু ওর কাছে সময় ছিল না। ও অনেক অনুরোধ করে বলল, চাচা, বিশ্বাস করেন কালকে আমার ফোনটা ভেঙে গিয়েছিলো তাই ম্যাসেজ দেখতে পারিনি। ফোন কেনার পর যখন ম্যাসেজ দেখলাম সাথে সাথে রওনা দিয়েছি। তাই কাগজ আনার সময় পাইনি। দারোয়ান কোনোভাবেই মানতে চাইলো না। সময় পার হয়ে গেছে। এখন আর ঢুকতে দেওয়া যাবে না। মম তাও অনুরোধ করতে লাগল। দারোয়ান তার অবস্থানে অনড়। ও কি করবে বুঝতে পারছে না। এমনিতেও পনের মিনিট পর এসেছে। এখন আধাঘন্টা হতে চলছে।
মিনহাজ একটা দরকারে বেরিয়েছিল। ঢুকার সময় দারোয়ান সালাম দিল। দারোয়ানকে সালাম দিতে দেখে মম তাকে ডেকে বসল। মিনহাজ দাঁড়িয়ে বলল, বলুন। মম তার পরিস্থিতির কথা বোঝানোর চেষ্টা করল।নিজেকে লজ্জিত লাগছে। সব ফোনের দোষ৷ হাত থেকে ছাড়লেই নিচে পড়ে ভাঙতে হবে!? ভাগ্য ভালো সকাল সকাল ফোন কিনতে বেরিয়ে ছিল। ম্যাসেজটাও চোখে পড়ল৷ মিনহাজ জিজ্ঞেস করল, আপনি নতুন?
– জ্বি।
– আচ্ছা আপনি আমার সাথে আসুন।
মিনহাজ তার আইডি কার্ড দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মমও ওর সাথে অফিসে ঢুকল। ঢুকতেই দেখল সবাই ব্যস্ত। মিনহাজ বলল, এখানে আসার পরই সবাইকে একটা করে আইডি কার্ড দিয়ে দেওয়া হয়। তবে পজিশন ভেদে আইডি কার্ড ভিন্ন হয়। সবার সব জায়গায় যাওয়ার পারমিশন নেই। ফারিজা এসে বলল, আপনাকে রিয়ান স্যার ডাকছেন।
– ওকে, তুমি ওকে… কি নাম তোমার?
– মম, ফারিহা বিন মম।
– মিস মমর আইডি কার্ড সংগ্রহ করে সিটটা দেখিয়ে দাও। আর মিস মম।
– জ্বি।
– কালকে কাগজ জমা দিয়ে দেবেন। নাহলে আপনার পজিশন বাতিল হয়ে যাবে। ওকে?
– ওকে স্যার।
– এখানে সবাই আমাকে মিনু ভাই ডাকে। তুমিও ডাকবে।
– আচ্ছা।
মিনহাজ চলে গেল। ফারিজা ওকে একটা খালি ডেস্ক দেখিয়ে বলল ওখানে বসতে। ও ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের খালি চেয়ারে বসে পড়ল। চারপাশে সবাই ব্যস্ততার সাথে কাজ করছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও ফারিজা ওর আইডি কার্ড নিয়ে এল না। ও বসে আছে কোনো কাজ ছাড়াই। রায়হান সাহেবকে খবরটা জানানো হয়নি। ও একটা ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিল চাকরির কথা। ফোন স্ক্রিন অফ করতেই ফারিজাকে দেখা গেল। সে কফি খেতে খেতে ফোনে হেসে কথা বলছে। ও ভাবল হয়ত ভুলে গেছে। মম ওর দিকে হেঁটে গেল সেটি ফারিজা খেয়াল করেনি। সে কথা বলায় মগ্ন। তাই ফারিজা পেছন ফিরতে ধাক্কা খেল মমর সাথে। কফি পড়ে মমর পেটের দিকের সাদা সেলোয়ারটা কফির রং ধারণ করল। কফি গরম থাকায় তার তাপটা ঠিকই ও অনুভব করল। ফারিজা চেঁচিয়ে উঠল, হাও ডেয়ার ইউ? চোখ কি ব্যাগে রেখে হাঁটো? দিলে তো আমার কফিটা অপচয় করে।
– মিনু ভাই আপনাকে আমার আইডি কার্ড দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিতে বলেছিল।
– তো? সামান্য আইডি কার্ড নিজে সংগ্রহ করে নিতে পারো না আবার এই কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছো?
মম প্রতিউত্তরে কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু আজকে নতুন বলে কিছু বলল না। সোজা হাঁটা দিল। ফারিজা পেছন থেকে ডাকছিল কিন্তু ও পাত্তা দিল না। ওয়াশরুম যাওয়া লাগবে। সেলোয়ারটা নষ্ট করে দিল।
.
.
.
.
ফারিজা রুমে ঢুকতেই রিয়ান বলল, জানো না একটু পর আমার ফ্লাইট? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? সে ধানাই পানাই করে বলল, সরি স্যার। আসলে নতুন ইমপ্লয়ইগুলো এতোটা ইরেস্পন্সিবল! রিয়ান ফাইল টেবিলে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ভুলে যেও না তুমিও একজন ইমপ্লয়ই। আমার পিএ। সো ঠিকমতো নিজের কাজের দিকে কনসেন্ট্রেট করো।
– ইয়েস স্যার।
– চেক করে দেখো যে যে ফাইলগুলো নিতে হবে তা নেওয়া হয়েছে কি না।
– ওকে স্যার।
ফারিজা বের হতেই মিনহাজ রুমে ঢুকল। রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর কোট ঠিক করছিল৷ সে এসে কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল, কোটটার খবর পেলি? ও সরে গিয়ে চেয়ারে বসে বলল, দিলে তো কাল সবাইকে বলে? ঘুমটাও ঠিকমতো যেতে পারিনি। মিনহাজ পাশে দাঁড়িয়ে চেয়ার ওর দিকে ফিরিয়ে ঝুঁকে বলল, মিস করছিস নাকি? রিয়ান ওকে সরিয়ে চেয়ার আবার টেবিলের দিকে ফিরিয়ে বলল, ফালতু কথা বলিস না তো। ভুল করে কোটটা দিয়ে ফেলেছি এটা নিয়ে বাড়িতে প্যারা। এখন আবার এক সপ্তাহের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে।
– ভাই, এই ডিলটা যাতে কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয়। চাচা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে। একবার ফসকে গেলে অন্য কোম্পানি নিয়ে যাবে।
– তাই বলে হুট করে বলবে? নাস্তার টেবিলে বসতে না বসতেই এক সপ্তাহের ট্যুর। তুমি সব দেখে দিয়েছো কি কি নিতে হবে?
– হুম, সব রেডি। ফারিজাও তো যাচ্ছে তোর সাথে। ওকে বলে দিয়েছি, কোথাও না বুঝলে ও সব বুঝিয়ে দেবে। দেড়টায় ফ্লাইট। এখনই বেরিয়ে পড়।
– ওকে। ড্যাডকে বোলো বেরিয়ে গেছি।
– বলব।
রিয়ান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিনহাজ ওকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
মম ওয়াশরুমটা খুঁজে পাচ্ছে না। একজনকে বলে কোনোরকম খুঁজে নিল। বেসিনের কাছে এসে পানি দিয়ে কফি পড়া অংশ ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলো কিন্তু দাগ বসে গেছে। পেটের কাছটা কেমন জ্বালা করছে। গায়েও লেগেছে কফি। লাল হয়ে গেছে পেটের সাইডটা। এখানে বার্ণ ক্রিম পাওয়া যাবে কি না কে জানে। ভাবতে ভাবতেই ফারিজাকে ওয়াশরুম ঢুকতে দেখলো। ওকে দেখে মুখ বাঁকা করে হেসে ফ্রেশ হতে গেল। মমর ভীষণ রাগ উঠছে। কিছু বলতে পারছে না প্রথম দিন বলে। ও নিজের কাজে মনযোগ দিল। কিছুতেই যাচ্ছে না দাগটা। শেষে হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দিল। ফারিজা বের হয়ে বেসিনে হাত ধুচ্ছে। মম বের হওয়ার সময় ফারিজা বলে উঠল, নিজের কাজ এবার থেকে নিজে করবে। আমাকে কাজে লাগাতে চাইলে চাকরি জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ও মম কাছে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, তুমি জানো আমি কে? এই কোম্পানীর হবু বস। রিয়ান স্যারের হবু বউ। আমার সাথে তেরামি করলে বা কথা না শুনলে চাকরি নট করে দেবো। ফারিজা ওর সেলোয়ারে হাত মুছে চলে গেল। ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। ও পানি দিয়ে জায়গাটা মুছে আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, তোমার কপালে যদি শনি না নাচিয়েছি তবে আমার নাম ফারিহা বিন মম নয়।
ফারিজা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, সরি স্যার লেট হয়ে গেছে। রিয়ান ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, তুমি কবে ফাস্ট কাজ করেছো? গাড়ি ছাড়ো সিরাজ। সিরাজ গাড়ি স্টার্ট দিল।ফারিজা অভিযোগ দেওয়ার সুরে বলল, একটা নিউ ইমপ্লয়ই খুব বিরক্ত করছে স্যার। নিজের কাজ নিজে না করে আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। রিয়ান বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বলল, এক সপ্তাহ পরে এসে দেখছি। এখন চুপচাপ বসো। ফরিজা কথাটা শুনে বেশ খুশি হলো। রিয়ান নিজের ভাবনায় হারিয়ে গেল। ওর চোখে কেবল কানের দুলটা থেকে পড়া পানির ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে।
চলবে…