মম চিত্তে পর্ব -০৪+৫

#মম_চিত্তে
#পর্ব_৪
#সাহেদা_আক্তার

মম বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বাজল। এসে দেখল রায়হান সাহেব টেবিলে বসে আছে। ঐদিকে টিভি চলছে। জাবেদ খালু বসে আছেন সোফায়। টিভি দেখছেন। মাধুরী খালা দরজা খুলে দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। মম এসে টেবিল থেকে জগ নিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, খেয়েছো? রায়হান সাহেব ফোন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, না। ও পানিটুকু খেয়ে গ্লাসটা রেখে বলল, কেন খাওনি? এসেছো কখন অফিস থেকে?

– তা এসেছি অনেকক্ষণ। নয়টার দিকে। তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

– এবার থেকে খেয়ে নেবে। আমার আসতে এমনই সময় লাগবে।

– কত বললাম আমার চাকরিটা তোকে দিয়ে দিই। আমার স্যারকে বললেই দিয়ে দিতেন। শুনলিই না।

– আব্বু তুমি তো জানো আমি নিজের যোগ্যতায় চাকরি নিতে চেয়েছি। আত্মসম্মান জিনিসটা যদি আমার কাছে তুচ্ছ হতো তাহলে রনকের সাথে আজকেও সংসার করতে দেখতে আমায়।

– তা না হয় বুঝলাম। তোর জামায় কিসের দাগ?

– একজনের সাথে ধাক্কা লেগে কফি পড়ে গেছে। মধুখালা, খাবার বেড়ে দাও। আমি জামা বদলে আসি।

মম রুমে এসে জামা পাল্টে নিল। পেটের দিকটা এখনো লাল হয়ে আছে। ও বার্ণার ক্রিম লাগিয়ে নিয়ে জামাটা সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখল। যদি দাগটা ওঠে এই আশায়। ডাইনিং ঘরে এসে দেখল মাধুরী খালা খাবার বেড়েছেন। মিম জিজ্ঞেস করল, তোমরা খেয়েছো গো খালা? মাধুরী খালা হেসে বললেন, খামু পরে। তোমরা খাইয়া লও।

– এসব কি খালা? বলেছি না একসাথে খাবো। এসো বসো।

মম জোর করে মাধুরী খালা আর জাবেদ খালুকে বসিয়ে দিল। সবাই খেয়ে উঠল একসাথে। মাধুরী খালাকে বাসনপত্র ধুতে সাহায্য করে বলল, নিনির খাওয়া হয়েছে? খালা গোছগাছ করছিল। বললেন, হ, একেবারে কোলে বইসা খাইসে। মম হাসল। নিনিটা বন্ধুর মতো সবার সাথে মিশে যায়।

ও এসে শুয়ে পড়ল। খুব ক্লান্ত লাগছে। ফারিজার কথাগুলো ওর মাথায় এল। সাথে সাথে চোখ খুলে গেল ওর। মনে মনে শপথ করে নিল নিজের দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকবে কারোর দয়ায় নয়। নিনি ওর কাছে এসে গা ঘষতে লাগল। মম নিনিকে পরম আদরে ওর কাছে টেনে নিয়ে চোখ বুজলো।

সিঙ্গাপুর থেকে ইমোতে ফেরদৌসীকে কল দিতেই সবাই ভিডিও কলে হাজির। বোন সবগুলো একসাথে কথা বলছে। এটা ওটা আনতে বলছে। রিয়ানের ইচ্ছে হলো কল কেটে দিতে। কিন্তু তাও দিল না। বলল, সবাই বানরের মতো একসাথে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করলে কে কি বলছিস কিচ্ছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো ঘুরতে আসিনি। কাজে এসেছি। রিতু মুখ ভার করে বলল, তো কি হয়েছে? নিক্কণ ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ঠিকই তো ভাই। বিদেশে গেলি তোর বোনদের জন্য কিছু আনবি না? অনিমা নিলীমা দুইজনে একসাথে বলল, ভাবির জন্য আনবে। রিয়ান বিরক্ত হয়ে বলল, ভাবি কোথায় পেলি? রিতু চোখ টিপে বলল, ঐ যে মেয়েটা।

– আবার ঐ প্রসঙ্গ আনলে কানটা ছিঁড়ে দিবো আসলে। বেশি পাকছিস।

– ছিঁড়, পরে বর না পেলে সব তোর দোষ।

– তোকে এমনিতেও কেউ বিয়ে করবে না। বানরকে কেউ বিয়ে করে? আম্মুকে ফোন দে।

রিতু ভেংচি কেটে ফেরদৌসীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। রুম থেকে যাওয়ার আগে বলল, আমরা লিস্ট দেবো। যদি জিনিসগুলো না এনেছিস তো বাড়িতে ঢুকতে পারবা না। হুহ্। ফেরদৌসী হেসে বললেন, কেমন আছিস বাবা? রিয়ান বলল, ভালো আছি। তুমি কার রুমে? দিদুনের রুমে মনে হচ্ছে। পেছনে বিছানা থেকে রওশন আরা আওয়াজ করে বললেন, হ্যাঁ দাদুভাই। রিয়ান বলল, সব শাঁকচুন্নি গুলো এই রুমে চিল্লাচ্ছিল। একেকটাকে কান ধরে বের করে দিতে পারোনি? এখন তো ওখানে সাড়ে এগারটা বাজে। এত রাতে এসে দিদুনকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। ওর কথা শুনে ফেরদৌসী হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, খেয়েছিস?

– হুম। তোমাদেরও তো সব শেষ।

– হ্যাঁ। কাজ না থাকলে ঘুমিয়ে যা।

– হুম।

ফোনটা রাখতেই ফারিজা দরজায় নক করল। এখন দেড়টা বাজে। এত রাতে কেন!? রিয়ান দরজার অপরপাশ থেকে বলল, কি হয়েছে? ফারিজা ভয় পাওয়া কন্ঠে বলল, স্যার দরজাটা একবার খুলুন। প্লিজ স্যার। রিয়ান না পারতে দরজা খুলল। ফারিজা সাথে সাথে ঢুকে পড়ল। ভয়ে কাঁপছে। রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? ফারিজা ভয়ার্ত গলায় বলল, মাকড়শা স্যার। আমার রুমে। আমি খুব ভয় পাই। আমাকে এ রুমে থাকতে দেবেন? ঐ সোফাটায় ঘুমাবো। আমার খুব ভয় করছে। ওর গায়ে নাইটড্রেস পরা। তাতে শরীরের আকার আকৃতি স্পষ্ট। কোটিটার দড়ি খোলা। যে কোনো মুহূর্তে কোটিটা খুলে যেতে পারে। বেশ এলোমেলো হয়ে আছে সে। ওর দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল রিয়ান। ফোন আর মানি ব্যাগ নিয়ে বলল, বেশ তুমি এই রুমে থাকো আমি তোমার রুমে আছি। বলে বের হয়ে যাচ্ছিল। ফারিজা ওর হাত ধরে বলল, স্যার যদি এখানেও মাকড়শা থাকে! থেকে যান না স্যার। প্লিজ। রিয়ানের মেজাজ খারাপ হলো। বেশ রেগে বলল, যদি থাকে তো আলো নিভিয়ে অন্ধকারে ঘুমাবে। মাকড়শা তো বুঝে শুনে তোমার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। এটুকু বুদ্ধি নিয়ে কাজ করতে এসেছো কি করে কোম্পানিতে? রিয়ান বেরিয়ে অন্য রুমে চলে গেল। ফারিজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
.
.
.
.
নিনির ডাকে ঘুম ভাঙল। বেচারির খিদে পেয়েছে। আজকে শুক্রবার। অফিস নেই। জয়েনের একদিনের মাথায় ছুটি কাটানোটা মজার ব্যাপার। ভেবেছিল একটু আরাম করে ঘুমাবে কিন্তু নিনি হতে দিল না। হামি তুলতে তুলতে বিছানা ছাড়ল। বিড়ালটা পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করছে৷ খাবার না দিলে এখন ওয়াশরুম অবধি চলে যাবে। ওর খাবার বাটিতে খাবার দিয়ে ওয়াশরুমে রওনা দিল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানাতে গেল। কি বানাবে চিন্তা করছে। অনেক দিন বাসায় ও রান্না করে না। আজকে রান্না করবে ভাবছে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মাধুরী খালা এসে হাজির। ওকে দেখে বললেন, কিছু লাগবো? মম মাথার চুলে খোঁপা করতে করতে বলল, না খালা। নাস্তা বানাতে এসেছি। কি বানালে ভালো হয় বলতো।

– আমারে কও মা। আমি বানিয়ে দিতেসি।

– না খালা, আজকে আমিই রান্না করব। কতদিন বাসায় রান্না করে তোমাদের খাওয়াতে পারিনি। চাকরি যখন ধরেছি কবে আর রান্না করার সময় পাই তার ঠিক নেই।

– আইচ্ছা। তো কি রাঁনবা? আমারে কও। সাহায্য করুম।

– লুচি আলুরদম কেমন হবে গো খালা?

– ভালোই হইবো। তোমার লুচির স্বাদই আলাদা মা। সেই তোমার বিয়ার আগে খাইসিলাম। এখনো মনে পড়লে খাইতে ইচ্ছা হয়।

মম মুচকি হেসে বলল, তাহলে আজ লুচি আলুর দমই করি। কি বল? মাধুরী খালা রাজি হয়ে গেলেন। মম ময়দা খুঁজতে গিয়ে বলল, খালা, চা পাতা নেই? খালা আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, না গো মা। কালকেই শেষ হয়ে গেসে। তোমার খালুরে বলতে ভুইলা গেসিলাম। মম ময়দার বয়াম নামিয়ে নিয়ে বলল, আচ্ছা আজকে বলে দেবো আমি। মাধুরী খালা সম্মতি জানিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন।

নাস্তার টেবিলে ধোঁয়া ওঠা লুচি আর গরম গরম আলুর দম দেখে রায়হান সাহেব একেবারে খুশি হয়ে গেলেন। মম একটা প্লেটে তিনটে লুচি আর এক বাটি আলুর দম দিয়ে সবাইকে পরিবেশন করে নিজে খেতে বসল। রায়হান সাহেব খেতে খেতে বললেন, কতদিন পর যেন মনের মতো খেতে পারছিরে মা। তোকে ছাড়া একেবারে ফাঁকা লাগে ঘরটা। মম মুখে হাসি এনে বলল, আছি তো। এবার থেকে তোমার কাছেই তো থাকব। রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েদের একটা সময়ের পর বাপের বাড়িতে থাকতে নেই রে মা। মম তাঁর কথা শুনে লুচি মুখে তুলতে গিয়েও তুলল না। আলুরদমের ঝোলে লুচির অংশটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, গিয়েছিলাম তো। কিন্তু রাখেনি। তোমার হিরেকে যত্ন করার লোক এখনো আসেনি আব্বু। রায়হান সাহেব কিছু না বলে চুপ করে খেতে লাগলেন। চোখে পানি আসতে চাইছে কিন্তু তিনি জোর করে আটকে রেখেছেন৷ পুরুষদের যে কাঁদতে নেই৷ আর বাবাদের তো চোখের জল ফেললে চলে না। নরম হলে ঘরের ভীত মজবুত করবে কে?

সবার খাওয়া শেষ। মম হাতের লুচিটা খেয়ে উঠে গেছে অনেকক্ষণ। রায়হান সাহেবও এরপর একটাও লুচি মুখে দেননি। কোনোমতে প্লেটের তিনটা খেয়েই উঠেছেন। জাবেদ খালু বরাবরই কম খান। মাধুরী খালা সবার খাওয়া শেষে টেবিল পরিষ্কার করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মম নিজের রুমের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মাথাটা ঝুলছে বিছানার কিনারায়। চুলগুলো মেঝে স্পর্শ করার পরেও অনেকটা ছড়িয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই লম্বা চুল ওর৷ অন্য সময় হলে নিনি খোলা চুলগুলো নিয়ে খেলতো। কিন্তু সে কি বুঝে ওর কাছে এসে শুয়ে আছে। বোবা প্রাণীগুলো কিভাবে যেন মন খারাপের ভাষাটা বুঝে যায় যা বাচাল মানুষগুলো বুঝতেই পারে না।

মম রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল দুপুরের মেনু কি হবে তখনই কলিংবেল বাজল। মাধুরী খালা দরজা খুললেন। ও উঁকি দিয়ে দেখল জয়ীতা চাচি এসেছেন যাকে ছোটবেলায় সিসিক্যামেরা বলে জানে মম। কার বাড়িতে কি হয়েছে, কার ঘরে আগুন লেগেছে, কার ঘর ভেঙে গেছে এসব খোঁজ খবর রাখা তাঁর নৈতিক দায়িত্বে পড়ে। তাঁর বাচনভঙ্গিতে সবাই তাঁকে বিশ্বাস করতে বাধ্য। এমন অনেকের সংসারের আগুনে ঘি ঢেলে এসেছেন তিনি যার ফলে আজ সুখের সংসারগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। মম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি লুচি আর আলুর দম গুলো গরম করতে দিল চুলায়। মাধুরী খালা ফল কাটছেন। জয়ীতা চাচির সাথে কে যেন এসেছে। সে জয়ীতা খালার কি কথা শুনে কিছুক্ষণ পর পর রাক্ষসী হাসি দিচ্ছে। রায়হান সাহেব প্রেশারের রুগী। এর হাসিতে আবার হাই প্রেশার উঠে যায় নাকি ভয়ে আছে মম। ও নাস্তা নিয়ে যেতেই মহিলাকে দেখতে পেল। ভয়ঙ্কর রকম সাদা স্বাস্থ্যবহুল মহিলা। দেখতে কুষ্ঠ রোগী ভেবে বসবে যে কেউ। ভাবতেই মম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল কথাটা। কাউকে চেনার আগেই বাজে ধারণা নিতে নেই। নাস্তাটা রেখে সোফায় বসল। জয়ীতা চাচি বড় করে হেসে বললেন, কিরে মম, এসব কি শুনছি বলতো! তোর মতো সংসারী মেয়ের নাকি বিয়ে ভেঙেছে। সংসার ভাঙাটা কত বড় দাগ তুই জানিস না বুঝি? মম মিষ্টি করে হেসে বলল, চাঁদেরও তো দাগ আছে চাচি। তাকে তো কেউ কটাক্ষ করে না। তাহলে আমাকে কেন করবে বলো?

– সে যাই বলিস, স্বামীর যখন বাইরের মেয়ের প্রতি ঝোঁক তবে আরেকটা বিয়ে করিয়ে নিতি। দেখতি সব ঠিক হয়ে গেছে।

– সতীন নিয়ে ঘর করতে বলছ?

– তো কি হয়েছে? দুই বোন মিলে মিশে থাকতি। শুধু শুধু বিয়েটা ভাঙলি। তোরা আজকালকার মেয়েরা যে কি কে জানে। জানেন ভাবি, এখনকার মেয়েরা একেবারে সামান্য আতিথেয়তাও জানে না। কদিন আগে এক মেয়ের বাড়ি গেলাম। কি অভদ্র! এক কাপ চাও দিল না! কি সব আপেল আর কমলা কেটে দিল!

– হায় হায় চাচি! তাহলে তো আমার বাসায়ও আপনার আসা উচিত হয়নি।

জয়ীতা খালা আর মহিলাটি স্বপ্রশ্নে তাকাতেই ও হেসে বলল, আমার বাসায়ও যে চা নেই।
#মম_চিত্তে
#পর্ব_৫
#সাহেদা_আক্তার

জয়ীতা চাচি মহিলাকে নিয়ে চলে গেছেন। মমর সাথে মাধুরী খালাকে নিয়ে একপ্রকার তর্ক হয়ে গেছে তাঁর। চা দেওয়ার কথাটা জয়ীতা চাচি মেকি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পর মাধুরী খালা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলেন আজকে কি রান্না হবে। মম তাকে সোফায় ওর সাথে বসতে বলেছিল। তাতেই জয়ীতা চাচির ঘোর আপত্তি। কাজের লোক কেন তাদের সাথে বসবে। মম জিজ্ঞেস করল, কাজের লোকেরা আমাদের থেকে কোন দিক দিয়ে ভিন্ন? জয়ীতা চাচি বললেন, সবার জায়গা সমান নয়। কাজের লোকদের মাথায় উঠাতে নেই। মম মাধুরী খালাকে টেনে এনে কাছে দাঁড় করিয়ে বলল, এসব পুরান কথা চাচি। তুমি তো মাধুরী খালাকে চেনোই। ছোটবেলা থেকে আমাদের সাথে আছেন। খালাখালু দুজনেই ভালো মানুষ। জয়ীতা চাচি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, তাই বলে সবাইকে মাথায় তুলতে হবে? কোনদিন তোদের উপর ছড়ি ঘোরাবে দেখিস। খালি তোর বুড়ো বাপটা পটল তুলুক। এবার মমর বেশ গায়ে লাগল। এতক্ষণ সম্মান দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছিল। যে মানুষ অন্যকে সম্মান দিতে জানে না তাকে সম্মান করাটাও অযৌক্তিক।

– এজন্যই আপনার কাজের লোকগুলো একমাসের বেশি টেকে না চাচি। মাধুরী খালাকে তো আমি খালা ডাকি। খালা মানে তো মায়ের বোন। তাহলে কি দাঁড়ালো? মাধুরী খালা আমার আম্মুর বোন। তাই না চাচি?

মম হাসি মুখে মাধুরী খালার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে জোর করে বসালো। তিনি অসহায়ের মতো ওর দিকে তাকালেন। জয়ীতা চাচি এতে অপমানিতবোধ করলেন। “মেয়েটা পুরোই মার মতো হয়েছে। এজন্যই বিয়েটা ভেঙে গেছে৷ চলেন ভাবি, এমন মেয়েকে আপনার ঘরের বউ করার দরকার নেই।” জয়ীতা চাচি এই বলে মহিলাকে নিয়ে উঠে চলে গেলেন। তাঁর কথার ভাঁজে মম বুঝতে পারল জয়ীতা চাচি ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। মাধুরী খালা করুণ দৃষ্টিতে মমর দিকে তাকালে সে একটা সুন্দর হাসি দিল।

দুপুরের দিকে একটা ফোন এল। মম ফোন নাম্বাটা চিনতে পারল না। অচেনা নাম্বার। ফোন ধরে হ্যালো বলতে একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে এল অপরপাশ থেকে। বলল, কেমন আছিস মম? কন্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল, এতদিন পর! কোত্থেকে এলি? আমার কথা তো একটুও মনে পড়ে না। তা আতাবানুর কি খবর? মেয়েটা রাগ করার ভাণ করে বলল, এতদিন পর ফোন করলাম ফের আতা বলে মজা করছিস? মম হেসে বলল, সরি সরি, আদ্রিতা। হয়েছে? এখন বল কি খবর? শুনেছিলাম বিয়ে করে সেটেল হয়ে গেছিস অথচ বিয়ের দাওয়াত দিসনি।

– তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হয়েছিল। ওর বিদেশে যাওয়ার ডেট কাছে ছিল তাই। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল কিন্তু তোর নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

– তা এখন কি করে পেলি?

– স্বপ্নার কাছে।

– ওর সাথে তোর যোগাযোগ আছে?

– হুম। বেচারিও জামাই বাচ্চা কাচ্চা পালতে পালতে হিমসিম খাচ্ছে।

– বিয়ে করেছে তাহলে! কলেজে থাকতে তো বলছিল বিয়ে করব না বিয়ে করব না। শেষমেশ করেই নিল।

– হুম, তোর কি অবস্থা? বিয়ে করিসনি?

– হয়েছিল কিন্তু এখন সিঙ্গেল।

– মানে!? বিয়ে হলে সিঙ্গেল কেন?

– ডিভোর্স ইস্যু। তা কই তুই?

– আজকে দেশে এসেছি। কাছেই একটা হোটেলে উঠেছি আপাতত। আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না৷ ভাবলাম বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে বাড়ি যাবো।

– তাহলে তো তোর সাথে দেখা করা লাগছে।

– তাহলে সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়ি চলে আয়। আজকে থাকবি। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।

– নারে। কালকে অফিস আছে।

– চাকরি করছিস?

– হ্যাঁ, নতুন জয়েন করেছি। তাহলে আমাকে হোটেলের ঠিকানাটা দিয়ে দে। আমি দুপুরে খেয়ে বের হবো।

– ওকে। আচ্ছা শোন তোর ফেসবুক আইডিটা দে তো। এড হয়ে নিই। পরে তাহলে ফোন নাম্বার না থাকলেও যোগাযোগ করতে পারব।

– ফারিহা আফরিন মম। সার্চ দিলেই পেয়ে যাবি।

– একমিনিট,…… পেয়েছি। রিকুয়েষ্ট দিয়েছি একসেপ্ট করিস।

– আচ্ছা, তাহলে রাখ। আমি রান্না বান্না করে খেয়ে বের হই।

– ওকে, ভালো থাকিস।

– তুইও। ফি আমানিল্লাহ।

আদ্রিতা ফোন রেখে দিল। মম ফেসবুক রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নিল নাম দেখে। তাড়াহুড়োয় ছবিটার দিকে তাকালও না। তাহলে হয়ত মত পরিবর্তন করত!

মম রান্নাঘরে গেল। অনেক ভেবে মোরগপোলাও রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। মাধুরী খালা ওকে সাহায্য করলেন। একটার মাঝেই রান্না শেষ করে ফেলল দুজনে মিলে। গোসল সেরে সবাইকে টেবিলে ডাকল মম। নিনিটারও খিদে পেয়েছে। কাছে ঘুর ঘুর করছে আর করুণ স্বরে ডাকছে। ও গিয়ে খাবর দিতেই দৌঁড়ে গিয়ে খেতে লাগল। মাধুরী খালা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসলেন। মমর খাওয়া দেখে রায়হান সাহেব বললেন, কি রে এত তাড়াতাড়ি খাচ্ছিস যে?

– বের হবো। দেরি হয়ে যাবে।

– কোথায় যাবি? আজ তো অফিস ছুটি।

– কে বলল অফিস যাচ্ছি? আদ্রিতার কথা মনে আছে? আমার কলেজ ফ্রেন্ড ছিল?

– হ্যাঁ, একবার এসেছিল বাসায় বোধহয়।

– হুম। ওর সাথেই দেখা করতে যাবো। আজকেই বিদেশ থেকে ফিরেছে হাসবেন্ডসহ।

– ও, আচ্ছা। সাবধানে যাস তাহলে।

– হুম।

রায়হান সাহেব আর কথা এগোলেন না। কখন ক্ষতে গিয়ে আঘাত হেনে ফেলেন সেই ভয়ে।
.
.
.
.
আজকে স্কুটিটা নিয়েই বের হলো। সোজা চলে গেল স্বপ্নকানন হোটেলের সামনে। আদ্রিতা তখনই ম্যাসেজ করে দিয়েছে ঠিকানা। ভেতরে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করল আদ্রিতার রুম কোনটা।

– আপনি ওনার কে হন?

– ফ্রেন্ড।

– প্লিজ এখানে একটা সাইন করুন।

মম খাতায় স্বাক্ষর দিলে রিসেপশনিস্ট বলল, ৩০৬ নাম্বার রুম। এখান থেকে সোজা তিনতলায় চলে গেলে পেয়ে যাবেন। মম ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিল। ৩০৬ নাম্বার রুমে এসে নক দিল। ভেতরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে। মম মনে মনে হেসে বলল, বাচ্চা সামলাতে সামলাতে তো নিজেই হিমসিম খাচ্ছে মনে হচ্ছে। ও যখন নিজে নিজে হাসছে তখন একজন লোক দরজা খুলল। সাথে সাথে মমর হাসি উধাও হয়ে গেল। লোকটার পিছন থেকে আদ্রিতা উঁকি দিয়ে বলল, এসেছিস!? তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ভেতরে আয়। মম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে দেখে ও টেনে ভেতরে নিয়ে এসে বলল, আমরা বের হয়ে যেতাম। তুই আসবি বলে এখনো আছি। মমকে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিতা বলল, ও, তোর সাথে তো পরিচয় হয়নি। ও আমার হাজবেন্ড, আলিফ। বিয়েতে তো নিমন্ত্রণ করতেই পারলাম না ওর তাড়াহুড়োয়। কিরে? কি হল? মম ধ্যান থেকে বাস্তবে ফিরে আলিফের দিকে একটা শুকনো হাসি দিল। শেষ পর্যন্ত ওর প্রাক্তন ওর কলেজ ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে!

বাচ্চাটা আবার কান্না করা শুরু করল। আদ্রিতা চলে গেল বিছানার কাছে। সেখানে বালিশ দিয়ে প্রাচীর করে রেখেছে বাচ্চাটার পাশে। মায়ের কোলেও শান্ত হচ্ছে না বাচ্চাটা। মম কি করবে বুঝতে পারল না। রাগে অভিমানে ঘৃণায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো আলিফের দিকে নিবদ্ধ। এদিকে আলিফের কপাল ঘামছে। পাছে মম সব বলে দেয় আদ্রিতাকে। তাহলে ওর সুখের সংসার একেবারে ভেসে যাবে। মম কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আলিফ বলল, চলো, বেরিয়ে পড়ি। লেট হয়ে যাচ্ছে।

– ওমা সেকি! কি বলছ! আমার বান্ধবী এতদিন পরে এল আর কথাই তো হল না।

– আমিও সেটাই বলছিলাম। তোরা বেরিয়ে পড়। আজ এলি মাত্র। বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে। পরে আরেক সময় কথা হবে।

– মম…, চল সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে যাই। তুই তো আমার বিয়ে খেতে পারিসনি। আজ খেতে খেতে কথা বলব।

– তোদের দেখেই খুশিতে পেট ভরে গেছে। তাছাড়া খেয়েই তো এলাম বাসা থেকে।

– তাহলে আমাদের বাড়ি চল। সেখানে মন ভরে কথা বলা যাবে।

– আমার একটু তাড়া আছে। আজ না।

– আজ তো শুক্রবার, অফিস নেই। তাহলে কি তাড়া শুনি।

মম গোপন ভাব করে বলল, সিক্রেট। আদ্রিতাও ফিসফিস করে বলল, আই লাভ সিক্রেট। তারপর দুজনেই হাসল। আলিফের চোখে মমর শুকনো হাসিটা চোখে পড়ল। আদ্রিতা বলল, তাহলে এককাজ করি, তোকে বাসায় দিয়ে আসি। মম আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি স্কুটি এনেছি। চিন্তা করিস না। চলে যেতে পারব। তোরাও বেরিয়ে পড়। আদ্রিতা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। মম জোর করে এটা ওটা বুঝিয়ে বেরিয়ে এল। এমন বিশ্বাসঘাতকের সাথে একমুহূর্ত থাকার রুচি নেই ওর।

বি.দ্র.: নামে সমস্যা থাকায় ফারিহা আফরিন মম করা হয়েছে।

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here