মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২০

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী

এদিকে রিশা সেদিনের পর থেকে ইশানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ইশান হাজারটা প্রশ্ন করলে রিশা একটারও উত্তর দিচ্ছেনা। রিশা কিছু না বললেও ইশান ঠিকই বুঝেছে ঘটনা কি।
” রিশা বেইবি, জান্স আমার, ও মাই ডিয়ারিং ওয়াইফি, আমার সরিষা ফুল, আমার ধুতুরা ফুল। ” রিশার পিছুপিছু ঘুরতে ঘুরতে ঘ্যানঘ্যান করছে ইশান।
রিশা ইশানের মুখে এমন অদ্ভুদ ডাক শুনে রা*গী চোখে তাকায়।
” কি আমি ধুতুরা ফুল? এই যে অ*স*ভ্য লোক ডিয়ারিং কি কি জিনিস? ”
ইশান দাঁত দিয়ে জিভ কে*টে বলে, ” সরি, ডিয়ার বলতে যেয়ে দাঁত ফসকে ডিয়ারিং বলেছি। আর ঐটা ধুতুরা ফুল হবেনা, হবে পদ্ম ফুল। এবারের মত মাফ করে দাও জান্স। ভবিয্যতে এমন ভুল আর হবেনা। ”
” নিকুচি করেছি তোর মাফের। লু*চু ব্যাডা। ”
” ও বউ, তুই তোকারি করছ কেন! আমি না তোমার নিজের একমাত্র জামাই! নিজের জামাইকে কেউ তুইতোকারি করে! ”
” নিজের জামাই জন্যই তো তোকে তুই করে বলছি। মানুষের জামাইকে তুই করে বলব? ”
” অবশ্যই মানুষের জামাইকে তুইতোকারি করবে।
আমাদের বাসায় কাজ করে বিলকিস, ওর জামাইকে তুই বলবে, পাশের বাসার কাজের মেয়ের জামাইকে বলবে, প্রয়োজনে শহরের সব কাজের মেয়ের জামাইকে তুই বলবে। এছাড়াও অন্যের জামাইকেও তুই বলবে, শুধু নিজের একমাত্র জামাই ছাড়া। বুঝেছ আমার গুল্টুমুল্টু ওয়াইফি। ”
” তাহলে তোর ভাবির একমাত্র জামাইকেও আজ থেকে তুই বলব। ”
” নাউজুবিল্লাহ, সে তোমার ভাসুর হয়! ভাসুর হলো বড় ভাইয়ের সমতুল্য। ”
” কেন, সেও তো অন্যের জামাই? আর সবার জামাইকে তুই বললে তোর কিছু যায় আসেনা, কিন্তু নিজের ভাইয়ের বেলায় ষোলআনা। ”
” বাদ দাওনা বেইবি। এই নিষ্পাপ জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটুও মায়া হয়না তোমার? ”
” নিষ্পাপ আর তুমি! তুমি যদি নিষ্পাপ হতে, তাহলে অন্যের বউ তোমাকে টিটকারি করত? ”
ইশানের বুক ধক্ করে উঠে। যে ভয় সে পাচ্ছিল এখন সেই পয়েন্টেই তরী ভিড়েছে!
” ক…কে আমাকে টিটকারি মারল! ক.. ক…. কার এত বড় সাহস! ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে।
” তানিশা আমার ফ্রেন্ড। সে টিটকারি মেরেছে। ও তোমার সাথে কেন এমনটা করল? ” সোজাসাপটা প্রশ্ন রিশার।
” এ…এমনি হয়তো করে থ….থাকবে। ” কলিজা গলার কাছে চলে এসেছে। এখন শুধু লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার অপেক্ষা।
” এভাবে তোতলাচ্ছো কেন? চোরের মনে পুলিশের ভয়, ব্যাপারটা এইরকম তাইনা? ”
” ছিহ্ জান্স এসব কি বলছ! আমি চোর হতে যাব কোন সুখে! ”
” কাহিনী কি আমাকে খুলে বলো। ” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে রিশা।
” ও এই কথা! আচ্ছা আমি আগে খুলছি পড়ে বলছি। ” বলেই নিজের শরীরে থাকা শার্ট খুলতে শুরু করে।
” এই তুমি শার্ট খুলছ কেন? দেখ আমার সাথে চালাকি করলে খবর আছে কিন্তু। ”
” তুমিইতো বললে, খুলে বলতে। ” মুখটা পাংশুটে করে জবাব দেয়।
” ইয়ার্কি করবেনা বলছি। ” রিশার অ*গ্নি*মূ*র্তি দেখে ইশান সিদ্ধান্ত নেয় সব খুলে বলবে।
” রিশা, ঘটনা তেমন কিছুই নয়। তুমি জানতো তানিশার সাথে আমার কিভাবে পরিচয় হয়েছিল। ঘটনা ঠিক এ পর্যন্তই। ঐ পরিচয়েই সীমাবদ্ধ। তবে আমার দিক থেকে একটুআধটু দুষ্টুমি ছিল এই যা। ”
” তুমি তানিশাকে ভালোবাসতে?” রিশার চোখে পানি। ইশানের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। রিশার চোখের পানি ও সহ্য করতে পারেনা। এক পা দু পা করে রিশার কাছে এসে দু’হাতের আঁজলায় মুখটা নিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ আঁকে দীর্ঘসময় ধরে।
” সেটা একতরফা ছিল। সেই মেয়ে কখনোই আমার দিকে তাকিয়ে দেখেনি। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত। এরপর একসময় নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর তুমি আমার জীবনে এলে। এখন মনে হয় তুমিই আমার সব। আমার অস্তিত্বেই তুমি মিশে আছো । ”
ইশানের সরল স্বীকারোক্তি রিশার মনের দুকূল ছাপিয়ে কান্নার হু হু করে ঝরতে থাকে। ওর শুধু মনে হচ্ছে, কেন ইশান অন্য কাউকে ভালোবাসবে? ইশান শুধুই ওর। কেন সে ইশানের জীবনে প্রথম নারী হলনা?
রিশাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেই ইশান বলে, ” আমার সোনা বউ, তুমি কাঁদলে যে আমার বড় কষ্ট হয়। বিশ্বাস কর আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করলে, এ আমার মৃ*ত্যু*র সমান। ”
” তবে তানিশা কেন তোমাকে ঐ কথা বলল? ” নাকের পানি ইশানের শার্টে মুছতে মুছতে বলে রিশা। ইশান তা দেখেও না দেখার ভান করে।
” কোন কথা বউ? ” ইশানের বুক ভয়ে দুরুদুরু করছে।
” ঐ যে, না হওয়া এসপি। ” কাঁদোকাঁদো গলায় রিশার উত্তর।
ইশান হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
” ঐযে তোমাকে বলেছিলাম, তানিশাকে কিছু বখাটেদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। তাদের কাছে পরিচয় দিয়েছিলাম আমি এসপি। সেই কথা নিয়েই বলেছে বোধহয়। ” ইশানের মুখ গোমড়া।
” শোন আমি আমার বন্ধুকে খুব ভালোভাবেই চিনি। ওকে বিশ্বাসও করি। কিন্তু বিশ্বাস করিনা তোমাকে। তুমি যেখানে এসপির পরিচয়ে ব*খা*টে*প*না করতে পারো, সেখানে আর কি কি করতে পারো বা করেছ সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। ” রিশা বিষয়টিকে আর গভীরে নিতে চায়না। ও ভালো করেই জানে ইশান ওকে কতটা ভালোবাসে। কারো জীবনে অতীত থাকতেই পারে। তাই বলে সেই অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকার কোন মানেই হয়না। রিশার চাওয়া ইশান শুধু ওকেই ভালোবাসুক, যা ও পেয়েছে।
” আমাকে অপমান্স করলে জান্স! তোমার একমাত্র নিজের জামাই পিউর নিষ্পাপ। তার সাদা মনে কোন কাদা নেই। এরকম নিষ্পাপ, ভার্জিন জামাই কয়জন মেয়ের কপালে জুটে বল? ”
” আসছে আমার নিষ্পাপ জামাই। আর কি বললে, তুমি ভার্জিন ছিলে! প্রমান দাও। ”
রিশা কথা শেষ করতে পারেনা তার আগেই ইশান ওকে কাছে টেনে নিয়েছে। রিশার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় ও কিছু বুঝে উঠার আগেই। রিশাও বাধ্য মেয়ের ন্যায় ইশানের কাজে সাড়া দেয়।
দীর্ঘক্ষণ পর রিশাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, ” বউ, প্রমান পেয়েছ? এসবে তুমি যেমন নতুন, তেমন আমিও নতুন। বিছানায় এসো আরেকটু প্রমান করি আমি ভার্জিন ছিলাম কি না। ” ইশানের এমন লাগামছাড়া কথায় লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় রিশা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। ইশান বুঝে যায় রিশার মনোভাব পজিটিভ। ওকে আর পায় কে।

রাত এগারোটা বাজে অথচ সাদিফ এখনো ফিরেনি। তানিশা তানিমকে ফোন করে কিন্তু কোন রেসপন্স পায়না। অগত্যা সাদিফের কাছে ফোন দেয়। সাদিফ ফোন কেটে নিজে ফোন দিয়ে জানায় ওদের আসতে আরও দেরি হবে।
সবাই যে যার মত শুয়ে গেছে।
সাইরাকে একা একটা ঘর দিয়েছেন আয়েশা খাতুন কিন্তু সাইরা একা থাকতে ভয় পাচ্ছে। তাই ওর সাথে তৃষ্ণা শুয়েছে। তূর্ণাকে নিয়ে তানিশা নিজের ঘরে আছে যেখানে সে বিয়ের আগে থাকত। সাদিফদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আয়েশা খাতুন তার মেয়ের সাথে বসে গল্প করছিল। কিন্তু যখন সাদিফ জানায় ওদের আসতে দেরি হবে তখন তানিশা ওর মাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দেয়। ও-ই গেইট খুলে দিবে।
সাদিফদের আসতে আসতে বারোটা বেজে যায়। ওরা গেইটের সামনে এসে তানিশাকে ফোন দিলে সে দরজা খুলে দেয়। তানিশার রা*গা*ন্বি*ত চেহারা দেখে কেউ কোন কথা না বলে সুরসুর করে নিজ নিজ ঘরে ঢুকে পরে।
সাদিফ ফ্রেশ হয়ে এসে তানিশাকে খাবার আনতে বলে। কারন ও জানে তানিশা এখনো খায়নি। তানিশা খাবার আনলে সাদিফ নিজ হাতে প্লেটে বেরে নেয়। তানিশা চুপচাপ বসে সাদিফের কাজ দেখছে। ভাতের সাথে তরকারি মেখে তানিশার মুখের সামনে ধরলে ও অবাক হয়ে তাকায়।
” কি হল বউ? আমি জানি তুমি এখনো খাওনি। নাও তারাতারি খাও দেখি। দুজনের খেতে সময় লাগবে। ”
তানিশা মৃদু হেসে খাবার মুখে নেয়।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে নিজেকে সাদিফের বুকে আবিষ্কার করে। তূর্ণাতো ওদের মাঝখানে শুয়েছিল! তবে ও সাদিফের বুকে কেন! সাদিফের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসেই লক্ষ্য করল সাদিফই ওর পাশে এসেছে।
তানিশা হেসে ঘুমন্ত সাদিফের দিকে তাকাতেই ওর কোমড়ে টান পরে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে সাদিফ ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
” আহ্ বউ, সবসময় এমন যাই যাই কর কেন! একটু আরাম করে ঘুমাতে দাও দেখি। ”
” আপনাকে ঘুমাতে কে মানা করেছে! আপনি ঘুমান, এর মধ্যে আমাকে টানছেন কেন! ”
” তুমি কাছে না থাকলে আমার ঘুম আসেনা। এবার চুপটি থেকে আমাকে ঘুমাতে দাও। ” সাদিফ ঘুম জড়ানো গলায় কথা বলতে বলতে তানিশার ঘাড়ের ভাঁজে মুখ ঢোবায়। সাদিফের এহেন কান্ডে তানিশার শরীর শিরশির করছে। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। সাদিফকে নিষেধ করতে চাইলেও গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছেনা। আবেশে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এদিকে সাদিফের ছোট ছোট চুমুতে ওর প্রান ওষ্ঠাগত।
” এ কি বউ! কিছুই তো করিনি , এতেই এমন কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে! এবার কিছু করে ফেললে মন্দ হয়না কিন্তু। ”
” ছিহ্, নির্লজ্জ পুরুষ! আপনি এখন শ্বশুর বাড়িতে আছেন ভুলে যাবেননা। ”
” কেন, শ্বশুর বাড়ি থাকলে বুঝি বউকে আদর করা যায়না! এমন থিওরী তোমার জামাই বিশ্বাস করেনা। ” সাদিফের স্পর্শের গভীরতা বাড়ছে।
” এমন করছেন কেন। প্লিজ ছাড়ুন না। সকাল হয়ে আসছে। তূর্ণা জেগে যাবে। ”
সাদিফ ঝটপট তানিশাকে ছেড়ে সোজা হয়ে শোয়।
” আজ বেঁচে গেলে। ইভেন, যতদিন বাবার বাড়িতে আছো ততদিন নিজের মত থাকো। ঢাকা যাওয়ার পর সব আমার মত চলবে। তুমি চোখের পলকও ফেলবে আমার ইচ্ছেতে, বুঝেছ বউ? আর রইল বাকি ব্যাপারগুল, সেখানেও আমার রাজত্ব। ” সাদিফের ইঙ্গিত বুঝতে তানিশার সময় লাগেনা। লজ্জা পেয়ে সাদিফের বুকেই মুখ গুঁজে।
” এই বুকের মধ্যেই যখন আসতে হবে, তখন দূরে দূরে থাক কেন। আর কেনইবা পালিয়ে বেড়াও। ” শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে তানিশার মাথায় কয়েকটা চুমু দেয় সাদিফ। তানিশা তার কথার কোন প্রত্তুত্বর না করে চুপচাপ শুধু আদরগুলো অনুভব করতে থাকে।
এরইমাঝে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত হয় কদম তলীর আকাশ-বাতাস।
সাদিফ তানিশাকে ছেড়ে দিলে সে উঠে অজু করতে যায়। আর সাদিফও কিছুক্ষণ পর উঠে অজু করে তালিব শেখের সাথে বেরিয়ে যায় মসজিদের দিকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here